somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাংবাদিক যখন ৫০৬ ধারা মতে অভিযুক্ত! আসুন, চতুর্থ স্তম্ভের প্রতি সহনশীল হই

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাংবাদিকতা একটা মহৎ পেশা। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্তিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ যদি হয় স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তবে একেকজন সাংবাদিক ঐ স্তম্ভের একেকটা খুটি যারা স্তম্ভকে আগলে রাখে। অন্য তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে-জাতীয় সংসদ, নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ। বাকী তিনটি বিভাগের পাহাড়ায় সাংবাদিকগণ অতন্ত্র প্রহরী হিসাবে কাজ করে। এতেই অনুধাবন করা যায় গণমাধ্যমের ও গণমাধ্যমকর্মীদের গুরুত্ব কত অসীম।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন বিশ্বের বড় বড় গুণিজনরা। যেমন থমাস জেফারসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটিও তিনি করেছিলেন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে, তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ জেফারসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথাই বলেছিলেন। ঠিক তাঁর প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর।’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।’ যুগে যুগে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, আবার এটিও উপলব্ধি করেছে যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হয় অথবা সংবাদমাধ্যম যদি কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে অসত্য বা অর্ধসত্য সংবাদ প্রচার করে, তা দেশ, জাতি ও সমাজের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনটা যে হয় না তা কিন্তু নয়। নাম সর্বস্ব সংবাদমাধ্যম ও তাদের কর্মীরা যেমন ক্ষতিকর তেমনি নামজাদা সংবাদমাধ্যম ও তাদের কর্মীরা সমাজের জন্য এইচআইভির মতই ক্ষতিকর। যে আশংকাটা করেছিলেন এবং বুঝেছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

এত কথা যে কারনে এবার সেটা বলি। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্টজন নির্ভীক সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলাম। একদিন হঠাৎ রাতের বেলায় ফোনে জানালো তার কাছে একটি সমন গেছে। তার বিরুদ্ধে একটি ননজিআর মামলা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। তাকে দন্ডবিধির ৫০৬ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগঃ এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। পুকুর চুরিতে সিদ্ধহস্ত সেই পদস্থ কর্মকর্তা তাকে সাক্ষাতকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি নাকি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন এবং তার রাজ কাজে বাধা দিয়েছেন এবং জীবন নাশের হুমকি দিয়েছেন! আর সেই সাক্ষাৎ চাওয়ার অপরাধে এবং হুমকির-খারাপ ব্যবহারের অভিযোগে কর্মকর্তা থানায় জিডি করেন। জিডি তদন্ত করে কর্মকর্তার অধিনস্ত কর্মচারী ও কতিপয় ঠিকাদারের জবানবন্দী গ্রহণ করে কাজী নজরুল ইসলাম ভাইর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে যা একজন সাংবাদিককে হয়রানি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

যেহেতু দন্ডবিধির ৫০৬ ধারার প্রসঙ্গ উঠেছে তাই আইনটি সম্পর্কে কিছু তথ্য দেই যাদের এই ধারাটার গুনাগুন জানা আছে কিন্তু ভুলে গেছেন। দন্ডবিধি (১৮৬০ সালের ৬ অক্টোবর এর ৪৫ নং আইন) আইনটির নাম ছিল ভারতীয় দন্ডবিধি। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তদানিন্তন পাকিস্তান এর জন্য নাম হয় পাকিস্তান দন্ডবিধি। ভারত ও পাকিস্তানে ওভাবেই নামটি রাখা আছে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিরোনামটি ৩০ জুন ১৯৭৩ তারিখের ৮ নং আইন দ্বারা সংশোধন করে পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিয়ে পেনাল কোড নামে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে। দন্ডবিধির ৫০৬ ধারায় কি বলা আছে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। ধারাঃ ৫০৬-অপরাধজনক ভীতি প্রদর্শনের শাস্তিঃ যদি কোন ব্যক্তি অপরাধজনক ভীতি প্রদর্শনের অপরাধ করে, তাহা হইলে-সেই ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদান্ডে, কিংবা অর্থদন্ডে, কিংবা এতদুভয় দন্ডেই দন্ডিত হইবে; এবং যদি হুমকিটি মৃত্যু বা গুরুতর আঘাত ঘটাইবার, কিংবা অগ্নি সংযোগে কোন সম্পত্তি ধ্বংস করিবার কিংবা মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় কোন অপরাধ সংঘটনের কিংবা সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের কারাদন্ডে দন্ডনীয় অপরাধ সংঘটনের কিংবা কোন স্ত্রীলোকের সতিত্ব নষ্ট হইয়াছে বলিয়া দুর্নাম আরোপের হুমকি হয়, সেই ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অর্থদন্ডে কিংবা এতদুভয় দন্ডেই দন্ডিত হইবে। উক্ত ধারার বিচার প্রকৃয়াঃ আমল অযোগ্য-জামিনযোগ্য-মিমাংসারযোগ্য-যে কোন ম্যাজিস্ট্রেট, গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচার্য। মৃত্যু বা মারাত্মক জখমের ভীতি প্রদর্শন হইলে মিমাংসার অযোগ্য এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য।

একজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যখন কোন কর্মকর্তার কাছে যান তখন ঐ কর্মকর্তার যদি সৎসাহস থাকে তবে সাংবাদিককে স্বাগত জানিয়ে এক কাপ লাল চা খাইয়ে তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে বিদায় করেন। কিন্তু যদি তার সে সৎসাহস না থাকে তবে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন এবং তার সাথে মন্দ আচরণ করেন, এটা আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বে সাংবাদিকরা (প্রকৃত সাংবাদিক) জীবন বাজী রেখে অন্যায় অবিচারের স্বীকার হয়ে কাজ করেন। কখনো কখনো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়। আর চাঁদাবাজী, মানহানি, হুমকি-ধামকির মামলাতো হরহামেশাই খেয়ে থাকে সাংবাদিকরা। আমাদের এই সোনার দেশে জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়নের নামে বরাদ্দকৃত টাকা পোষা চাটুকার নেতা-কর্মীদের ভাগবাটোয়ারা করে দেয়া, অধিগ্রহণের নামে কিছু মৃত-অর্ধমৃত পাটকাঠির মত গাছের মূল্য কোটি টাকা দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত পুকুর নেতার বাড়িতে কাটা, স্কুলের জমি নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ, ভূমি অধিগ্রহণের সময় দোচালা ছনের ঘর দোতালা বানিয়ে টাকা তসরুপ, গৃহহীন মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর নির্মানের নামে টাকা পকেটস্থ করার খবর কাজী নজরুল ইসলামদের মত সাংবাদিকরা হাটে-মাঠে ঘুরে তুলে আনেন বলেই আমরা তা জানতে পারি এবং কোন কোন সময় সেই আত্মসাৎকারী লোভীদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয় সরকারের। এই তালিকা লিখে আসলে শেষ করা যাবে না। চতুর্থ স্তম্ভের খুটিগুলো অপর তিনটি স্তম্ভকে সর্বদা সোজা পথে চলতে বাধ্য করে এই সাংবাদিকরাই। তবে এই দুর্নীতির তালিকা যেমন কাজী নজরুল ইসলামদের মত সাংবাদিকরা তুলে এনে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেয় আবার অনেক কাজী নজরুল ইসলাম আছে যারা সেই সুযোগে দুর্নীতিবাজদের রুটি হালুয়ায় ভাগ বসিয়ে, উচ্ছিষ্ট খেয়ে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের চিন্তার কারন হয়।

সর্বপরি যা বলতে এই লেখাটা লিখার তাগিদ অনুভব করলাম তা হলো-পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারনে সাংবাদিকদের প্রতি বিরাগভাজন হওয়া, মামলা-হামলা করে হয়রানি, হুমকি ধামকি দিয়ে তাদের কলম বন্ধ করার চেষ্টা থেকে আমাদের বিরত হতে হবে। নয়তো একদিন এই সোনার দেশ স্মশানে পরিনত হবে। আপনার আমার কারোরই বাসযোগ্য থাকবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:৪২
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×