somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১ | মানবসভ্যতার ইতিহাস: আদি হতে অন্ত

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইতিহাসের গল্পের শুরুতেই যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে চলে আসে সেটি হলো মানুষের ইতিহাসের শুরু কোথা থেকে? এর উত্তর পেতে হলে যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হলো, মানুষ যতদিন ধরে এই পৃথিবীতে বিচরণ করছে তার বড় অংশেরই কোন ইতিহাস নেই। ইতিহাসের পূর্বের এই সময়কালকে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের জীবনের গল্প কোন লিখিত দলিলে পাওয়া যায় না। কারণ সে যুগের মানুষ লিখন পদ্ধতির কথা জানত না।

তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে যা জানা যায় তা মূলত সে যুগের হাতিয়ার, তৈজসপত্র, অলংকার ও গুহাচিত্র থেকে পাওয়া। লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবনের মধ্য দিয়েই মূলত ইতিহাসের পথে মানুষের যাত্রা শুরু হয়। লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবনের ফলে মানুষ তার জীবনের গল্প লিখে রেখে যেতে শিখল। হাজার হাজার বছরের পুরনো সেসব লেখা পড়ে আজ আমরা সে যুগের মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি।

তবে এসব লেখার পাঠোদ্ধারের কাজটি খুব সহজ হয়নি। দীর্ঘ দিনের গবেষণা ও পরিশ্রমের পর প্রাচীন লিপির অর্থ উদ্ধারে সক্ষম হন অধুনিক যুগের গবেষকরা। এর ফলে আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় পুরনো দিনের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের অনেক রহস্য। তবে যেসব সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত লিপির অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি সেসব সভ্যতাকে ঐতিহাসিক যুগের আওতায় ধরা হয় না; আবার প্রাগৈতিহাসিক যুগের আওতায়ও ধরা হয় না।

এসব সভ্যতাকে প্রায়-ঐতিহাসিক সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায়-ঐতিহাসিক সভ্যতাগুলোর অস্তিত্ব ছিল ঐতিহাসিক সভ্যতাগুলোর সমসাময়িক যুগপর্বেই। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সভ্যতার ইতিহাসের সূচনার পরবর্তী সময়েই এসব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সাধারণভাবে বলা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা সবগুলো প্রায়-ঐতিহাসিক সভ্যতার উত্থান-পতন সংঘটিত হয়েছে ৫০০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে।

অন্যদিকে ঐতিহাসিক যুগের সূচনাও আনুমানিক ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। তখন থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত চলমান মানুষের ইতিহাসকে মোট তিনটি পর্বে ভাগ করা হয়। এ তিনটি পর্ব হল- বিশ্বসভ্যতার প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। প্রথম পর্বটি শেষ হয় ৪৭৬ সালে; দ্বিতীয় পর্বটি শেষ হয় ১৪৫৩ সালে। তৃতীয় পর্বটি বর্তমানে চলমান এবং আগামীতেও চলমান থাকবে।

দুটি সুনির্দিষ্ট বছরকে বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের যুগ বিভাজনের বছর হিসেবে ধরে নেওয়ার বেশ তাৎপর্য রয়েছে। ইতিহাসের প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ- এ তিনটি যুগ বিভাজনেরও তাৎপর্য রয়েছে। বস্তুত মানুষের ইতিহাসে দুটি উল্লেখযোগ্য বাঁক বদলের সময় এসেছিল বলেই বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা সম্ভব হয়েছে।


পূর্বেই বলা হয়েছে, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের প্রথম ভাগে রয়েছে প্রাচীন যুগ যার ব্যাপ্তিকাল হল ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে মধ্যযুগ যার ব্যাপ্তিকাল হল ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তৃতীয় ভাগে রয়েছে আধুনিক যুগ যা ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখনও পর্যন্ত চলমান। ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পূর্বে মানব সভ্যতার ইতিহাস প্রায় নেই বললেই চলে।

এ সময়কে বলা হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ ছিল যাযাবর কিংবা অনুন্নত পশুপালনভিত্তিক বা কৃষিভিত্তিক সমাজের সদস্য। সে সময় কোন নগর সভ্যতা ছিল না। কোন লিখন পদ্ধতিও ছিল না। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন লিখিত ইতিহাস নেই। এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, মানুষ যখন লিখতে শুরু করেছিল তখন থেকেই মূলত মানুষের ইতিহাসের সূচনা হয়।

মূলত লিখন পদ্ধতি আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই মানুষ ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করে। তবে বেশ কিছু প্রাচীন লেখার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হওয়ায় এসব লেখার সমসাময়িক কালকে প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের নির্দিষ্ট কোন ব্যাপ্তিকাল নেই। পৃথিবীর একেক অঞ্চলে একেক সময় পর্যন্ত এ যুগ চলমান ছিল। ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে এ যুগ চলমান ছিল।

পৃথিবীতে নগর সভ্যতার সূচনা প্রায় ৫০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এর পূর্বে মানুষ কৃষি অথবা পশুপালনভিত্তিক সমাজে বসবাস করত। তবে ৫০০০ সালের পরেও বহুদিন পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলে যাযাবর সমাজ কিংবা কৃষি ও পশুপালনভিত্তিক সমাজের অস্তিত্ব ছিল। এমনকি এখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে কৃষি-সমাজের চেয়েও আদিম শিকারী সমাজের অস্তিত্ব রয়ে গিয়েছে। আমাজান জঙ্গল কিংবা আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেন্টিনেল আইল্যান্ডের মানুষ এখনও কৃষি-সমাজেই প্রবেশ করেনি! তারা এখনও সবচেয়ে আদিম শিকারী জীবনে রয়ে গিয়েছে।

৫০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে মিশর ও মেসপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাকে)। এ দুই অঞ্চলে মূলত কৃষিজীবী সমাজের গর্ভেই জন্ম নিয়েছিল নগর সভ্যতা। প্রাকৃতিক উর্বরতা এ দুই অঞ্চলে মানুষের স্থায়ী সমাবেশ ঘটিয়েছিল যা সমৃদ্ধির এক পর্যায়ে নগর সভ্যতার সূচনা ঘটিয়েছিল। মিশর ও মেসপটেমিয়ায় গড়ে উঠা নগর-সমাজগুলো ছিল মূলত কৃষিজীবী।


মিশরে প্রায় ৪০টি নগর-সমাজ গড়ে উঠেছিল। এগুলোকে ‘নোম’ বলা হত। এসব নগর-সমাজে যেসব ক্ষুদ্র রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয় তা একসময় বৃহৎ রাজনৈতিক সমাজের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছিল। ইরাকে সর্বপ্রথম আল-উবাইদ অঞ্চলে সমৃদ্ধ কৃষি-সমাজ গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়। একই সময়কার ওয়ারকা অঞ্চলেও সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। সুমেরীয় ভাষায় ওয়ারকা অঞ্চলের নাম ছিল ইউরুক।

উবাইদ ও ইউরুকের নবোপলীয় গ্রামীণ সমাজের পরে মেসোপটেমিয়ায় উল্লেখযোগ্য নগরসভ্যতা গড়ে তোলেছিল সুমেরীয়রা। সময়ের বিচারে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন নগরসভ্যতা হল সুমেরীয় সভ্যতা। সুমেরীয় সভ্যতা হল পৃথিবীর প্রথম রাষ্ট্রবাদী সভ্যতা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকে সুমেরীয় সভ্যতার সূচনা। এরপর সুমেরে অনেকগুলো নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল।

সুমেরীয় মহাকাব্যে রাজতন্ত্রের ধারণা থাকায় অনুমান করা হয় যে, সুমেরীয় নগররাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হতো রাজতন্ত্রী শাসনের অধীনে। এসব নগররাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সম্ভবত আদি রাজতান্ত্রিক ধারায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকে ৩০০০ সালের মধ্যে বিশ্বসভ্যতায় রাষ্ট্রবাদী সমাজের ধারণা বিকশিত হয়। সর্বপ্রথম বৃহৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় মিশরীয় সভ্যতায়।

৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিনেস নামে একজন রাজা পুরো মিশরকে একত্রিত করে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত করেন এবং রাজবংশীয় শাসনের সূচনা ঘটান। একসময় মেসোপটেমিয়াতেও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে সারগন নামে একজন রাজা মেসোপটেমিয়ার নগররাষ্ট্রগুলো দখল করে ঐক্যবদ্ধ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে বিশ্বসভ্যতা পূর্ণাঙ্গভাবে রাষ্ট্রবাদী ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে থাকে।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রথমে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে । কিন্তু একপর্যায়ে বৃহত্তর সাম্রাজ্যের যুগ শুরু হলে নগররাষ্ট্রভিত্তিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সভ্যতাগুলো হারিয়ে যায়। ভারতবর্ষের প্রথম সভ্যতা- সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগররাষ্ট্রভিত্তিক সভ্যতা। ইউরোপের মূল ভূখণ্ডেও সর্বপ্রথম নগররাষ্ট্রভিত্তিক গ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

বৃহত্তর সাম্রাজ্যের সূচনা হয় মিশর ও মেসোপটেমিয়া থেকেই। সুমেরীয় ও ব্যবিলনীয় সভ্যতার পতনের পরে মেসোপটেমিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল পর পর অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য ও ক্যালদীয় সাম্রাজ্য। মিশরীয় সাম্রাজ্যের সাথে প্রতিযোগিতা হতো এদের। একসময় পারস্য থেকে এক বিশাল সাম্রাজ‍্যের উত্থান হলে মিশর পর্যন্ত এর দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। পারস্য বীর সাইরাস দ্য গ্রেট এই বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


এই বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য দখল করেন মেসিডোনীয় বীর আলেকজান্ডার। ইউরোপীয় গ্রিক সভ্যতার পতনের পর মেসিডোনিয়া থেকে এক বিশাল সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটান রাজা ফিলিপের পুত্র আলেকজান্ডার। তাঁর সাম্রাজ্য ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর পর এ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে কয়েকটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মিশরভিত্তিক টলেমি সাম্রাজ্য এবং সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সেলুসিড সাম্রাজ্য।

এর পরবর্তীতে ঐতিহাসিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় ইতালির রোমান রিপাবলিক। রিপাবলিকের সামরিক শক্তির সামনে একের পর এক অঞ্চলকে মাথা নোয়াতে হয়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে মিশরীয় টলেমি সাম্রাজ্য এবং সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়ার সেলুসিড সাম্রাজ্য রোমান রিপাবলিকের অধীনস্ত হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল এসব বিজয়ের পরবর্তীতে রোমান রিপাবলিক আনুষ্ঠানিকভাবে রোমান সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

প্রায় পাঁচ শতকের রিপাবলিকান শাসন এবং আরও পাঁচ শতকের সাম্রাজ্যিক শাসন মিলিয়ে এ সভ্যতা হয়ে উঠেছিল এক সহস্রবর্ষী পুরনো সভ্যতা। প্রাচীন যুগের শেষ পাঁচ শতক ছিল রোমান সভ্যতার যুগ। তিন মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত রোমান-বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বসভ্যতার মূল অংশ। প্রাচীন সুমেরে নগররাষ্ট্রের উত্থানের মধ্য দিয়ে যে সমরবাদ ও রাষ্ট্রবাদ জন্ম নিয়েছিল তা রোমান সাম্রাজ্যের মহাবিজয় উৎসবের মধ্য দিয়ে সফলতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছেছিল।

স্থায়ীত্ব, আয়তন, জনসংখ্যা, সম্পদ ও সমৃদ্ধি- সবকিছু মিলিয়ে রোমান সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রবাদী সভ্যতা। এ সাম্রাজ্য রাষ্ট্রবাদকে এমন এক চূড়ান্ত সফল পরিণতিতে নিয়ে গিয়েছিল যার পরে সফলতার আর কোন সোপান বাকী ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হল, সফলতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছার পর রাষ্ট্রবাদ সেই অবস্থানে স্থির থাকতে পারে?

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সফলতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছার পর রাষ্ট্রবাদ সবসময়ই সংকটে নিপতিত হয়েছে। যখনই দখল করার মতো আর কোন দেশ পাওয়া যায়নি তখনই রাষ্ট্রবাদী সভ্যতা অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখী হয়েছে এবং অনিবার্যভাবে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু সমরবাদ হল রাষ্ট্রবাদী সভ্যতার মূল ভিত্তি সেহেতু যুদ্ধ ও জবরদখলের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রবাদী সভ্যতা বেঁচে থাকতে চাইবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।


এ কারণে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে সফলতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে উপনীত হওয়ার পর রোমান সভ্যতা অর্থনৈতিক মন্দায় নিপতিত হয়েছে এবং ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ সালের মধ্যে অগাস্টাস সিজার রোমান সভ্যতাকে ঐক্যবদ্ধ করলেও পরবর্তীতে বার বার গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছে। ৩১২ সালে কনস্টানটাইন আরেকবার রোমান সভ্যতাকে ঐক্যবদ্ধ করে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রবাদের অনিবার্য সংকট থেকে এ সভ্যতা কখনোই রেহাই পায়নি।

পঞ্চম শতকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। পশ্চিম ইউরোপীয় রোমান সাম্রাজ্য ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে কেবল ইতালিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি ৪১০ সালে একবার এবং ৪৫৫ সালে আরেকবার রোম নগরী বর্বরদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৪৭৬ সালে রোমান জাতির বালক সম্রাট রেমুলাস অগাস্টুলাসকে সরিয়ে বর্বর গোত্রীয় নেতা ওডোয়েসার রোমান সিংহাসন দখল করলে পশ্চিম ইউরোপে রোমান জাতির শাসনের অবসান ঘটে। রাষ্ট্রবাদী সভ্যতার সবচেয়ে বড় অধঃপতনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল রোমান সভ্যতা।

প্রাচীন ইরাক ও মিশর থেকে যে রাষ্ট্রবাদী সমাজ ও সভ্যতার উত্থান হয়েছিল তার অবক্ষয় ও পতনের সর্ববৃহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় রোমান সভ্যতার পতনের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রায় একটি বড় ধরণের উত্থান-পতনের পর্ব সমাপ্ত হয়েছে রোমের পতনের মধ্য দিয়ে। তাই রোমের পতনের মুহূর্তকে ইতিহাসের একটি বড় ধরণের বাঁক বদলের মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৪৭৬ সালকে যুগ বিভাজনের একটি সুনির্দিষ্ট বছর হিসেবে ধরে নেওয়ার তাৎপর্য মূলত এখানেই।

পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরবর্তী সময়ে বিশ্বসভ্যতায় নানা উত্থান-পতন সংঘটিত হলেও তা মূলত চিরায়ত রাষ্ট্রবাদী সভ্যতার নিয়মেই সংঘটিত হয়েছে। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই আবর্তিত হয়েছে মধ্যযুগের ইতিহাস। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল, প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগকে আলাদা করে দেখার মৌলিক ভিত্তি কী?

এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে গেলে বিশদভাবে আলোচনার প্রয়োজন। ইতিহাসের গভীরে পৌঁছাতে পারলে পাঠক নিজেই এর উত্তর খুঁজে পাবেন। তবে মূল আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায় যে, নগরসভ্যতার উদ্ভবের পর হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা মানব সভ্যতার বিকাশের প্রক্রিয়া যখন এক পর্যায়ে গিয়ে থেমে গিয়েছে এবং সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী সাম্রাজ্য অবক্ষয়ের মধ্যে ভেঙ্গে পড়েছে তখন থেকে মধ্যযুগের সূচনা ধরা হয়।

চিরায়ত রাষ্ট্রবাদী সভ্যতার অবক্ষয়ের মধ্য দিয়েই কেটেছে মধ্যযুগ। মধ্যযুগের সূচনালগ্নে পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রবাদের ভিত্তি দূর্বল হয়ে পড়ে এবং একটি নতুনত্ব যুক্ত হয়। এ নতুনত্ব হল খ্রিষ্টধর্মীয় যাজক সংগঠন চার্চের কর্তৃত্ব। প্রাচীন রোমান শাসনের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপে রাষ্ট্র-সংগঠনের শূণ্যতা পূরণ করে চার্চ সংগঠন। বর্বর অধ্যুষিত পশ্চিম ইউরোপে সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব চলে যায় ক্যাথলিক চার্চের হাতে।


চার্চের গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে পোপতন্ত্রের উত্থান ঘটে। পোপ সম্রাটের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হন। এক্ষেত্রে যে বিষয়টি লক্ষ্য করা প্রয়োজন তা হল, সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে কেবল রাষ্ট্র-সংগঠনই যে একমাত্র কার্যকর সংগঠন নয় তার একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল এই চার্চ ও পোপতন্ত্র। পশ্চিম ইউরোপে কয়েক শতকজুড়ে চার্চ ও পোপতন্ত্রের হাতে সমাজ পরিচালিত হয়েছে।

একসময় বর্বরদের রাষ্ট্র-সংগঠন বিকশিত হলে চার্চ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়। ৮০০ সালে পোপীয় স্বীকৃতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’। সাবেক পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলে এ নতুন সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। এ সাম্রাজ্যের সম্রাটকে অভিষিক্ত করতেন রোমের পোপ। ক্ষমতা ভাগাভাগির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এমন দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা হল প্রাচীন যুগের সাথে মধ্যযুগের অন্যতম মৌলিক পার্থক্যের দিক।

পশ্চিম ইউরোপের কথা তো বলা হয়েছে। এবার দেখা যাক অন্যান্য অঞ্চলের অবস্থা কেমন ছিল। রোমের পতনের পর যে দুটি উল্লেখযোগ্য সভ্যতা প্রাচীন যুগের ঐতিহ্য নিয়ে কোনমতে টিকে থেকেছিল সেগুলো হল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং পারস্যের সাসানিদ সাম্রাজ্য। ৬০২ সালে এ দুটি সাম্রাজ্য এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

এ যুদ্ধে প্রথমদিকে পারসিকরা বিজয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের গতিরোধ করতে সক্ষম হন। ৬২৭ সালের মধ্যে পারসিকরা অধিকৃত অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভয়াবহ যুদ্ধ এ দুই সাম্রাজ্যের ভিত্তিই নড়েবড়ে করে দিয়েছিল। ফলে আরব মুসলমানদের আক্রমণের মুখে এ দুই সাম্রাজ্যের সমরশক্তি কোন কাজে আসেনি।

আরব মুসলমানরা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। অন্যদিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের আরব প্রদেশগুলোও মুসলমানদের পদানত হয়। বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের হাত থেকে যে অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করেছিলেন সেগুলো আবার হাতছাড়া হয়ে যায়। আনাতোলিয়া অর্থাৎ তুরস্ক ছাড়া সকল প্রাচ্যদেশীয় প্রদেশ বাইজেন্টাইনদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

আরবের ইসলামি খিলাফতের উত্থানের পর কেবল ইউরোপীয় অংশেই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আরব উপদ্বীপে ইসলামি খিলাফতের জন্ম হয় ৬৩২ সালে। ইসলামি খিলাফতের পূর্বে আরব উপদ্বীপে কোন রাষ্ট্র ছিল না। সেখানকার সমাজ ছিল অনুন্নত গোত্রবাদী সমাজ। গোত্রীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে সবসময়ই যুদ্ধ-কলহ লেগে থাকত। ইসলাম ধর্ম সেখানকার অসংখ্য আরব গোত্রকে পারস্পরিক যুদ্ধ থেকে সরিয়ে এনে এক ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের পথ দেখায়।


একসময় পশ্চিম ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে জার্মান জাতিগোষ্ঠীগুলো যেভাবে তাদের পুরনো দেব-দেবীর ধর্ম ছেড়ে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল এবং গোত্রবাদী সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রবাদী সমাজে প্রবেশ করেছিল সেভাবে আরবরাও তাদের পুরনো দেব-দেবীর ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং গোত্রবাদী সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে এক ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রবাদী সমাজে প্রবেশ করে।

এতদিন পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের বেদুইন যোদ্ধাদের বিপুল সামরিক শক্তি হারিয়ে যেত কেবল লাগাতার গোত্রীয় যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্যেই । ইসলাম ধর্ম এক ঐক্যবদ্ধ আন্তঃগোত্রীয় সমাজকাঠামোর মধ্যে বিপুল সামরিক শক্তির সমাবেশ ঘটায়। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে মরুচারী আরবরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, তাদের হাতে যে সামরিক শক্তি রয়েছে তা দিয়ে কোন সাম্রাজ্য জয় করে ফেলা সম্ভব।

ইসলামের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর তারা এ অসম্ভবকে সম্ভব করে। ৬৩২ সালে ইসলামি খিলাফত গঠনের পরদিনই খলিফা আবু বকর বাইজেন্টাইন প্রদেশ সিরিয়ায় সৈন্য পাঠিয়ে এক বিজয়ের ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করন। এরপর একের পর এক বিজয় আসতে থাকে মুসলমানদের হাতে। ৬৩৪ সালে খলিফা আবু বকরের মৃত্যুর পর নতুন খলিফা হন হযরত উমার।

খলিফা উমারের সময়ে ইসলামি খিলাফতের সবচেয়ে বড় বড় বিজয় অভিযানগুলো সম্পন্ন হয়। পারস্য সাম্রাজ্যের সাথে কাদেসিয়ার যুদ্ধে এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে ইয়ারমুকের যুদ্ধে আরব মুসলমানদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। মুসলমানরা পারস্যের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয়। বাইজেন্টাইন প্রদেশ সিরিয়া-ফিলিস্তিন ও মিশরে তাদের স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মুসলমানরা তুরস্ক এবং বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টানটিনোপল বিজয় করতে ব্যর্থ হন।

৬৪৪ সালে খলিফা উমারের মৃত্যুর পর নতুন খলিফা হন হযরত উসমান। উসমানের শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে মুসলমানদের বিজয় অভিযান স্তিমিত হয়ে আসে। কারণ সম্ভাব্য সকল সমৃদ্ধ এলাকাই মুসলমানদের দখলে চলে এসেছিল। সহজে জয় করার মতো আর কোন উল্লেখযোগ্য দেশ ছিল না। ইউরোপ ও ভারতে প্রবেশ করা তখন মুসলমানদের জন্য সম্ভব ছিল না। কনস্টানটিনোপল ছিল প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত এমন এক শহর যা দখল করা ছিল খুবই কঠিন।

তাই খলিফা উসমানের শাসনকালের মাঝামাঝি সময়ে খিলাফতের অর্থনীতিতে বেশ মন্দাবস্থা দেখা দেয়। যুদ্ধ-অর্থনীতির সমৃদ্ধি থেকে হঠাৎ এই মন্দাবস্থা দেখা দেওয়ায় ইসলামি খিলাফত বড় ধরণের অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখোমুখী হয়। এই সংকট একপর্যায়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। ৬৫১ সাল থেকে খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

খিলাফতের দুই প্রভাবশালী শাসক পরিবার- উমাইয়া ও হাশেমীদের বিরোধ এবং বেদুইন যোদ্ধাদের বেকারত্বজনিত অসচ্ছলতা ছিল এ বিদ্রোহের মূল কারণ। ইতিহাসের একটি অমোঘ নিয়ম হল, যখনই কোন সাম্রাজ্য সফলতার তুঙ্গে ওঠেছে তখন থেকেই এর অবক্ষয়েরও সূচনা হয়েছে। ইসলামি খিলাফতও এর ব্যতিক্রম নয়। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে এ সাম্রাজ্য সফলতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ায় এর অভ্যন্তরীণ মন্দা ও সংকটের সূচনাও হয়েছে খুবই দ্রুত।

সম্ভাব্য সকল দেশ জয়ের পর মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে যে বিরোধে লিপ্ত হন তার মর্মান্তিক পরিণতি হল খলিফা উসমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। ৬৫৬ সালে বৃদ্ধ খলিফা উসমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বিদ্রোহী মুসলমানরা। এরপর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তাতে নব্বই হাজার মুসলমান সৈন্যের প্রাণ ঝরে যায়। পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে এর সিকিভাগ মুসলমান সৈন্যও নিহত হননি।

৬৫৬ সাল থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত হযরত আলীর খিলাফতের পুরো সময়টিই কেটেছে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধে হযরত আলী তাঁর প্রতিদ্বন্ধী খলিফা মুয়াবিয়ার হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত না হলেও কূটনীতিতে তিনি মুয়াবিয়ার কাছে হেরে যান। ফলে হযরত আলীর মৃত্যু পর্যন্ত খিলাফত দুই ভাগে বিভক্তই থেকে যায়। ৬৬১ সালে হযরত আলীর মৃত্যুর পর তাঁর অধীনস্ত এলাকায় খলিফা নির্বাচিত হন তাঁর পুত্র হযরত হাসান। হাসান মাত্র ছয় মাস খলিফা ছিলেন।

হযরত হাসান খলিফা হওয়ার পর নিশ্চিত পরাজয়ের আশংকায় মুয়াবিয়ার সাথে আপোষ করতে বাধ্য হন এবং মুয়াবিয়াকে একমাত্র খলিফা হিসেবে মেনে নেন। সেদিন থেকেই ঐক্যবদ্ধ উমাইয়া খিলাফতের সূচনা হয়। ৭৫০ সাল পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য স্থায়ী ছিল। ৭৫০ সালে শেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের পতনের পর আব্বাসীয় খিলাফতের অভ্যুদয় ঘটে।

১২৫৮ সালে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান বাগদাদ দখল করে আব্বাসীয় খিলাফত ধ্বংস করেন। তবে মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যে আব্বাসীয় খিলাফতের পুনর্জন্ম হয়। বাগদাদের পতনের পর মিশরের মামলুক সুলতান সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি মামলুক সাম্রাজ্যে আব্বাসীয় খিলাফতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। তবে এ খিলাফতের হাতে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে না। খলিফার হাতে কেবল ধর্মীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।

১২৬১ সালে কায়রোতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে আব্বাসীয় খিলাফতের নতুন যাত্রা শুরু হয়। রাষ্ট্র এবং খিলাফতের এ বিভক্তি ছিল অনেকটা ইউরোপের ‘পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য’ এবং ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতা ভাগাভাগির মতো। ইসলামের ইতিহাসে ধর্ম এবং রাজনীতির পৃথকীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এটি।

মিশরের মামলুক সাম্রাজ্য যতদিন টিকেছিল ততদিন সেখানকার আব্বাসীয় খিলাফতও টিকেছিল। ১৫১৭ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের হাতে পতনের পর মিশরভিত্তিক মামলুক সাম্রাজ্য এবং আব্বাসীয় খিলাফত- দুটোই হারিয়ে যায়। মামলুক সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে উসমানীয় সুলতান মক্কা-মদিনাসহ আরব উপদ্বীপের কর্তৃত্ব লাভ করেন। পবিত্র নগরীগুলো হাতে আসায় এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটায় উসমানীয় সুলতানের নিজেকে খলিফা ঘোষণার পথে আর কোন বাধা থাকল না।

তাই, ১৫১৭ সালে উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিম নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা ঘোষণা করেন। নতুন খিলাফতের রাজধানী হয় ইস্তাম্বুল। সুলতান প্রথম সেলিমের পুত্র সুলতান সোলায়মান ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের খুবই বিখ্যাত সম্রাট। তবে উসমানীয় সুলতানদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্রাট ছিলেন সুলতান মাহমুদ ফাতিহ। তিনি ১৪৫৩ সালে কনস্টানটিনোপল জয় করে ইউরোপে উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্থায়ী ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সুলতান মাহমুদ ফাতিহ কনস্টানটিনোপল বিজয়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কামান প্রস্তুত করেছিলেন। এ নগরীর প্রাকৃতিক সুরক্ষা অতিক্রম করার জন্য তাঁর সৈন্যরা পাহাড়ের ওপর দিয়ে জাহাজ ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের ঘটনা ছিল এটি। এ বিজয়ের ফলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। এমনকি এ ঘটনা সভ্যতার ইতিহাসকে আরেকটি বাঁক বদলের পথে ধাবিত করে।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি এবং কনস্টান্টিনোপলের পতন মধ্যযুগীয় বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরণের ভাঙ্গন সূচিত করে। ইউরোপ ও দূর প্রাচ্যের মাঝখানে উসমানীয় সাম্রাজ্য যেভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাতে বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে পড়ে। ইউরোপের বণিকরা ভারত ও চীন-জাপানের সাথে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য নতুন জলপথ আবিষ্কারে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এভাবে পৃথিবীর অজানা মহাদেশসমূহ আবিষ্কারের পথ খুলে যায়।

আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীর জল ও স্থলভাগের খুবই ক্ষুদ্র অংশে সভ্য মানুষের বিচরণ ছিল। এমনকি কয়েকটি মহাদেশের অস্তিত্বের কথাও মানুষ জানত না। পৃথিবীর জল ও স্থলভাগের যে মানচিত্র মানুষ বানিয়েছিল তাতে অর্ধেক পৃথিবীও ভালভাবে স্থান পায়নি। কনস্টানটিনোপলের পতন সারা পৃথিবীকে খোঁজে বের করার ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর অজানা অংশগুলো আবিষ্কার এবং জলপথে সারা পৃথিবীকে জুড়ে দেওয়ার ফলে আরেকবার বিশ্বসভ্যতার মোড় ঘুরে যায়।

পশ্চিম ইউরোপের শাসকরা পৃথিবীজুড়ে সমুদ্রপথে অনুসন্ধান চালানোর ক্ষেত্রে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় অনেকগুলো ব্যয়বহুল অভিযান সম্পন্ন হয়েছিল। ১৪৯২ সালে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড এবং স্পেনের রাণী ইসাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস তিনটি জাহাজ নিয়ে আটলান্টিকের পশ্চিম দিকে এক দুঃসাহসিক অভিযানে বের হন। অজানা সমুদ্রের দিকে অসীম পথ পাড়ি দিয়ে এক পর্যায়ে তিনি উত্তর আমেরিকা পৌঁছান।

যদিও ৯৮৫ সালে ভাইকিংরা উত্তর আমেরিকা আবিষ্কার করে সেখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করেছিল তবুও বলা যায় যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আবিষ্কারই মূলত এ মহাদেশকে ইতিহাসের আলোয় নিয়ে এসেছিল। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর পর্যায়ক্রমে সকল অজানা ভূখণ্ড আবিষ্কৃত হতে থাকে। ১৫০০ সালে পর্তুগীজ নাবিক পেদ্রো আলভারেজ ক্যাব্রাল ব্রাজিল আবিষ্কার করেন। ১৪৯৮ সালে পর্তুগীজ অনুসন্ধানকারি ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা ঘুরে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন।

পৃথিবীর অজানা দেশসমূহ আবিষ্কারের প্রক্রিয়াটি চলেছিল কয়েকশ’ বছর ধরে। ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯০৯ সালে আমেরিকান নেভি ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট পিয়েরি পৃথিবীর উত্তর মেরু আবিষ্কার করেন। ১৯১১ সালে নরওয়েজিয়ান অভিযাত্রী রোলান্ড অ্যামুন্ডসেন এন্টার্কটিকা মহাদেশের গভীরে দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছেন। তবে বিশ্বসভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছিল মূলত পনেরো শতকের আবিষ্কারগুলো।

পনেরো শতকে আবিষ্কৃত ভূখণ্ডসমূহে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। দূরপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য-যোগাযোগের জন্য জলপথ আবিষ্কৃত হওয়ায় বিশ্ব-অর্থনীতিতে গতিশীলতা দেখা দেয়। পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো অর্থনতিক সমৃদ্ধি ও প্রবল বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা শুরু করে দেয়। এ বিষয়টি ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

ভোগ্যপণ্যের চেয়ে বাণিজ্য-পণ্যের চাহিদা বেশি দেখা দেওয়ায় ইউরোপীয় দেশগুলোতে মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রী-সামন্ততন্ত্রী অর্থনীতির স্থলে বাজার অর্থনীতি প্রাধান্য লাভ করে। কৃষি উৎপাদনের চেয়ে শিল্প উৎপাদনের হার অনেক বেড়ে যায়। মধ্যযুগীয় হস্তচালিত কারখানার (গিল্ড) স্থলে জায়গা করে নেয় আধুনিক শিল্প-কারখানা। বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং যন্ত্রশিল্পের ব্যাপক উন্নতি হাজার হাজার বছরের পুরনো মানব সভ্যতাকে কল্পনাতীতভাবে বদলে দেয়। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের এককটি আবিষ্কার একেকটি বিপ্লব হয়ে দেখা দেয়।

এসব কারণে আধুনিক যুগ কেবল মধ্যযুগ থেকেই নয়, পূর্ববর্তী সমগ্র সভ্যতার ইতিহাস থেকে পুরোপুরিভাবে স্বতন্ত্র এক নতুন যুগ হিসেবে দেখা দেয়। আধুনিক যুগে ধর্ম, দর্শন, রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চিরায়ত ধ্যান-ধারণার স্থলে নতুন ধারণা জায়গা করে নেয়। মানব সভ্যতার প্রতিটি ক্ষেত্রে একের পর এক পরিবর্তন ও বিপ্লবের ঢেউ আঘাত করে। জাতিরাষ্ট্রের উত্থান, শিল্প-সাহিত্যের রেনেসাঁ, খ্রিষ্টধর্মের রিফর্মেশন, পুঁজিবাদের উন্বেষ ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ থেকে হাজার হাজার বছর পরেও অব্যাহত থাকবে।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২৫
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×