somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-৯ | রোমান শ্রেণিসংগ্রাম: ঝড়ের কবলে স্বর্গ

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইতালিতে রোমান রিপাবলিকের অভ্যুদয়ের গোড়া থেকেই এ সভ্যতার একচেটিয়া সুবিধাভোগী শ্রেণি ছিল অভিজাতরা। ল্যাটিন ভাষায় এদেরকে বলা হতো প্যাট্রিসিয়ান। প্যাট্রিসিয়ানদের মতো কিছুটা সুবিধা ভোগ করত বণিকরা; বাদ বাকী সকল মানুষ ছিল চরমভাবে সুবিধাবঞ্চিত অথবা শোষিত। স্বাধীন কৃষক অর্থাৎ প্লেবিয়ানরা একটি সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি হলেও তারা অন্তত স্বাধীন মানুষের স্বীকৃতির অধিকারী ছিল যা ক্রীতদাসদের ক্ষেত্রে ছিল অকল্পনীয়। রোমান সভ্যতার সবচেয়ে শোষিত শ্রেণি ছিল ক্রীতদাসরা।


চিত্র: জননন্দিত ট্রিবিউন গেইয়াস গ্রেকাস জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন

রোমান সমাজব্যবস্থায় ক্রীতদাসরা ছাড়াও আরেকটি শ্রেণি অভিজাতদের স্বার্থের বলী হয়েছিলো। এরা হলো প্রলেতারিয়ান শ্রেণি। সারা দেশের জমিগুলো অভিজাতদের ল্যাটিফান্ডিয়ার ভেতরে চলে গেলে প্লেবিয়ানদের একটি বিশাল অংশ পরিণত হয় ভূমিহীন প্রলেতারিয়েতে। কৃষি উৎপাদনে শ্রমের চাহিদা ল্যাটিফান্ডিয়ার দাসদের দিয়ে পূরণ হয়ে যাওয়ায় এরা চুড়ান্তভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। তবে ট্রিবিউন নির্বাচনে তাদের সমর্থনের প্রয়োজন হতো। রোমান নাগরিকদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য শ্রেণি হলো ব্যবসায়ী-বণিক-সুদখোর শ্রেণি। সিনেটের ক্ষমতায় অভিজাতদের নিরংকুশ প্রাধান্য থাকায় এরা ছিলো ক্ষমতাবঞ্চিত। তাই ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে তারা প্রলেতারিয়ানদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়।

এজন্য টিবেরিয়াস গ্রেকাস নামে একজন অভিজাতকে তারা হাত করে। ১৩৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি ট্রিবিউন নির্বাচিত হয়ে ভূমিহীনদের ভূমি প্রদানের জন্য সিনেটে আইন পাশের প্রস্তাব করেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তিনি অভিজাতদের হাতে নিহত হন। ১২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাঁর ভাই গেইয়াস গ্রেকাস ট্রিবিউন নির্বাচিত হয়ে ভূমিহীনদের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হন। বণিকরা তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলো। তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় হওয়ার পরে টিবেরিয়াসের ভূমি আইন রদ হয়ে যায় এবং সিনেট পুরনো ক্ষমতা ফিরে পায়। তবে এ সময় রোম সাম্রাজ্য নতুন সঙ্কটে পতিত হয়।


চিত্র: রোমান প্লেবিয়ানদের বিদ্রোহ

টিবেরিয়াস ও গেইয়াসের মতো প্রলেতারিয়ান প্রতিনিধিদের আবির্ভাব অভিজাতদের নিরংকুশ প্রভাবে ফাটলই ইঙ্গিত করে। গেইয়াস গ্রেকাসের পতনের পর রোমান শাসনের বিরুদ্ধে আফ্রিকায় বিদ্রোহ দেখা দেয়, স্পেনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, ইতালিজুড়েও দাস বিদ্রোহের প্রকোপ দেখা দেয়। এর ওপর আবার যাযাবর জার্মান, ডাচ ও স্কেন্ডিনেভিয়ান টিউটন জাতির লোক ইতালিতে এসে ঢুকে যায়। এই গভীর সঙ্কটের মুখে পড়ে রাষ্ট্র রক্ষার জন্য অভিজাতরা প্রলেতারিয়ানদের সাথে আপষে বাধ্য হয় এবং নিরংকুশ অভিজাততন্ত্রে একটি স্থায়ী ফাটল দেখা দেয়।

সিপিয়োর প্রাক্তন সেনাপতি মেরিয়াস প্রলেতারিয়ানদের নিয়ে রাষ্ট্র রক্ষার জন্য একটি নতুন সেনাবাহিনী গঠনের অনুমতি পেলেন। প্রলেতারিয়ান সেনাবাহিনী গঠনে বণিকরাও সমর্থন দিয়ে গেলো। মেরিয়াস এবার আর ট্রিবিউন নয়, বণিকদের সহায়তায় একেবারে কনসাল পদে নির্বাচিত হলেন। তিনি পাঁচ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রের সুরক্ষা ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু অভিজাতদের সাথে বণিক ও প্রলেতারিয়ানদের শ্রেণি-সংঘর্ষ চাপা থাকলো না। ট্রিবিউনদের পরিষদ ও সিনেটের মধ্যে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন সবসময় লেগে ছিলো তা এবার প্রাকাশ্য রূপ ধারন করলো।


চিত্র: রোমান সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ

রোম সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শ্রেণি-বিরোধ অনেক সময়েই মিটমাট হয়ে যেতো লুটের ধন ভাগাভাগি করে। অন্যদেশ দখল ও লুণ্ঠন করে যে জমি ও সম্পত্তি পাওয়া যেতো তা দিয়ে বঞ্চিতদের তুষ্ট করা যেতো অনেক ক্ষেত্রে। দেশ লুন্ঠনে অভিজাতরা নেতৃত্বে দিলেও প্রলেতারিয়ানরা বা প্লেবিয়ানরা সেনাবাহিনীতে অংশ নিয়ে লুটপাটের অংশীদার হতে পারতো। এভাবে পরের ঘরের ধন লুট করে নিজের ঘরের বিরোধ মেটানো যেতো। লুণ্ঠন ছিলো রোমান সমৃদ্ধির মূল চাবিকাটি।

জমি, দাস ও সম্পদ - সবই আসত অন্যদেশ দখল ও লুণ্ঠন থেকে। রোমানদের সমৃদ্ধি ও উত্থানের মূল ছিলো লাগাতার দেশ দখল ও লাগামহীন লুণ্ঠন। এ লুণ্ঠনে যেসব প্লেবিয়ান- প্রলেতারিয়ান সৈন্যরা অংশ নিতো তারা লুণ্ঠনলদ্ধ অর্থ পেয়েই সুখী থাকতো। উপ্রি লাভ হতো অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের। জমি ও দাস দুটোই তাদের হাতে আসতো অগনিতভাবে। তাই সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে রাখলেও অন্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়াটা অভিজাতদের জন্য ক্ষতিকর ছিলো না বরং অত্যন্ত লাভজনকই ছিলো।


চিত্র: গেইয়াস মেরিয়াস (১৫৭-৮৬ খ্রি.পূ.)

মেরিয়াস তার অনুগত প্রলেতারিয়ান সৈন্যদেরকে বিজিত দেশ স্পেন, আফ্রিকা ও তুরস্ক হতে ২৫ হেক্টর করে জমি দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদের নিয়ে গলদেশ অর্থাৎ ফ্রান্স দখলেরও প্রস্তাব করলেন। আর দখল মানেই তো অভিজাতদের হাতে আরও দাসের চালান, আরও ল্যাটিফান্ডিয়া স্থাপনের সুযোগ; বণিকদেরও অবাধ লুন্ঠনের সুযোগ; সেনাবাহিনীরও পোয়াবারো। বিজিত দেশের জমি প্রলেতারিয়ানদের মাঝে বিতরণে অভিজাতদের আপত্তি নেই, কারণ এতে তাদের ল্যাটিফান্ডিয়ায় হাত পড়ে না। অতএব দুটি সিদ্ধান্তেই কেউ আপত্তি তুললো না। সবাই সানন্দে রাজী ছিলো। কিন্তু বাঁধ সাধল সেনাবাহিনী বহির্ভূত প্রলেতারিয়ানরা। তারা দেখলো ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

প্রলেতারিয়ানরা গ্রেকাস ভাইদের ভূমি আইন বাস্তবায়নের দাবি তুললো। এ আইন বাস্তবায়ন হলে অভিজাতদের ল্যাটিফান্ডিয়ার জমিতে হাত পড়বে। তাই তারা গ্রেকাস ভাইদের আইন বাস্তবায়ন যেকোন মূল্যে ঠেকিয়ে রাখতে প্রস্তুত হলো। ফলে মেরিয়াস বঞ্চিত প্রলেতারিয়ানদের কথায় কান দিলেন না। কিন্তু তারা সংখ্যায় ছিলো বিপুল। তারা অচিরেই সংগঠিত শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করলো। ট্রিবিউন সেটারনিনাস তাদের নেতা হিসেবে অবির্ভূত হলেন। সমস্ত ইতালির প্রলেতারিয়ানদেরকে তিনি রোমে আসতে আহ্বান জানালেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেরিয়াসকে হটিয়ে দিয়ে প্রলেতারিয়ানরা রোম দখল করলো। কারাগার ভেঙে তারা দাসদের মুক্ত করলো। তাদের হাতেও তুলে দিলো অস্ত্র এবং সিনেট ভবন দখল করে নিলো।


চিত্র: রোমান কৃষক

প্রলেতারিয়ানদের এই আকম্মিক উত্থানে ভঁড়কে গেলো বণিকরা। তারা এই বিপ্লবে তাদের কোন স্বার্থ খুঁজে পেল না। কিন্তু তারা এতদিন প্রলেতারিয়ানদেরকে ভূমি প্রদানের পক্ষে ছিলো এই কারণেই যে, এতে তাদের কোন ক্ষতি হতো না; হতো ল্যাটিফান্ডিয়ার মালিকদের এবং এতে প্রলেতারিয়ানদের সমর্থন নিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসার পথও প্রশস্ত হতো। কিন্তু এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেলো যে শুধু অভিজাত নয়, তাদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিলো। তাই বিরোধ ভূলে অভিজাতদের সাথে তারা হাত মেলালো এবং উভয়ে মিলে মেরিয়াসের অধীনে পূণর্গঠিত করলো সেনাবাহিনীকে।

১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেরিয়াস ও সেটারনিনাসের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে সেটারনিনাস নিহত হন ও তাঁর বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। কিন্তু এ বিজয়ে শ্রেণি বিরোধের অবসান হলো না। রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এ বিরোধ চলেছিলো আরও ৭০ বছর ধরে। এক সময়ের একমাত্র অভিজাতদের স্থলে তখন বণিক ও প্রলেতারিয়ানরা সংগঠিত শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সমাজের রাজনৈতিক ভিত্তিও তিনটি শক্তিকেন্দ্রে ভাগ হয়ে গিয়েছিল।


চিত্র: রোমের গৃহযুদ্ধ

বণিক ও প্রলেতারিয়ানরা ততদিনে সমাজে স্বতন্ত্রভাবে সংগঠিত রাজনৈতিক সত্ত্বা অর্জন করে ফেলেছে। প্রলেতারিয়ানদের পরাজিত করে বণিক ও অভিজাতরা মিলে উভয় পক্ষ হতে দুজন করে কনসাল নিযুক্ত করতে থাকে রোমে। নতুন কনসালরা প্রলেতারিয়ানদের বিদ্রোহ প্রশমিত করার জন্য তাদেরকে ব্যাপক হারে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে বিদেশে নিয়ে যায় দখল-লুণ্ঠন অভিযানে।

প্রলেতারিয়ানদের বিরোধ আপাতত নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বণিক ও অভিজাতদের বিরোধ আর চাপা থাকলো না। নতুন কনসাল সুল্লা ও বণিক ভজা প্রোকনসাল সেনানায়ক মেরিয়াস উভয়েই যখন রোমের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ দমন ও লুণ্ঠনে বেরিয়েছেন তখন হঠাৎ করে মেরিয়াস ফিরে এসে অপর কনসাল সিন্নাকে নিয়ে রোম দখল করে ফেললেন। অভিজাত ও বণিকদের পক্ষ থেকে তখন সুল্লা ও সিন্নাকে কনসাল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো।


চিত্র: স্পার্টাকাস

মেরিয়াস পাঁচদিন ধরে অভিজাতদের হত্যা করতে থাকেন এবং তাদের সম্পত্তি বণিকদের মাঝে বিতরণ করে দেন। ভালো ভালো ল্যাটিফান্ডিয়াগুলো নাম মাত্র মূল্যে বণিকরা কিনে নিলো। সুল্লা দেশে ফিরে এসে পুনরায় রোম দখল করে নেন। মেরিয়াসের সৈন্য ও সমর্থকদের হত্যার জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করলেন। জমিও আবার হাত বদল হলো। এটাই অভিজাতদের শেষ বিজয়। রোম তখন নামে মাত্র বিপাবলিক। সিনেটের কার্যকারিতা লোপ পেয়ে গেছে ততদিনে। সুযোগসন্ধানী সেনানায়করা চাইলেই অভিজাত ও বণিকদের সমর্থন নিয়ে একনায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছে।

এতদিন সেনানায়করা এক বছরের জন্য কনসাল নির্বাচিত হতে পারতেন। এক বছর পরে প্রোকনসাল হয়ে তারা বিজিত কোন প্রদেশের ক্ষমতায় বসে অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ পেতেন। রিপাবলিক ব্যবস্থায় স্থায়ীভাবে কনসাল বা একনায়ক হওয়ার সুযোগ আগে ছিলো না। কিন্তু এই অবস্থায় এসে অভিজাত ও বণিকদের মধ্যে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কোন এক পক্ষকে স্থায়ীভাবে স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একনায়ক হিসেবে ক্ষমতায় বসার সুযোগ সেনানায়কদের হাতে ধরা দিচ্ছিলো। কিন্তু এমন সময় স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহে তাদের সে উৎসাহে ভাটার টান ধরে যায়।


চিত্র: রোমান সেনা

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দাসবিদ্রোহের ঘটনা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৭০ দশকে। এ বিদ্রোহের সূচনা হয় কাপুয়া শহরের একটি এরেনা থেকে। এর নেতা একজন গ্লাডিয়েটর। তাঁর নাম স্পার্টাকাস। রোমানরা তাকে বন্দী হিসেবে এনেছিলো তুরস্ক থেকে। ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে দাস বিদ্রোহের সুচনা ঘটে। এটা অন্যান্য বিদ্রোহ থেকে একেবারেই আলাদা। স্পার্টাকাস তার অনুসারিদেরকে নিয়ে পালিয়ে ভিসুভিয়াস পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে রোমান সেনাদের অবরোধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে তাদের ধ্বংশ করে দেন। স্পার্টাকাসের বিজয়ের সংবাদ চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের শহরের হাজার হাজার বিদ্রোহী ক্রীতদাস তাঁর বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে।

তিন মাসের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার ক্রীতদাস এই বিদ্রোহে শামিল হয়। রোমান সিনেট বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পরাজিত হয়। স্পার্টাকাস তাঁর বিশাল বাহিনী নিয়ে সিসিলির দিকে অগ্রসর হন। দক্ষিণ ইতালিতে তিনি রীতিমত একটি স্বাধীন রিপাবলিক স্থাপন করে ফেলেন। স্পার্টাকাস একবার তিনশ রোমান সৈন্যকে ধরে এনে গ্লাডিয়েটরের মতো তাদের একজনকে আরেকজনের বিরুদ্ধে মৃত্যু পর্যন্ত লড়তে বাধ্য করেন। এতে রোমে আংতকের ঢেউ বয়ে যায়। এই সংকটের সময় কনসাল পদে প্রার্থী হতে কেউ রাজি হচ্ছিল না। রোমান বাহিনী র্স্পাটাকাসের বাহিনীর কাছে বারবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত হচ্ছিল।

অবশেষে ক্রাসাস নামে এক ধনী লোককে রোমের কনসাল পদে বসানো হয়। তাঁর আহ্বানে রোমকে রক্ষা করার জন্য আশপাশের রাষ্ট্র থেকে বিশাল সেনাবাহিনী এসে পৌঁছায়। এই সম্মিলিত বাহিনী বিদ্রোহী বাহিনীর পিছু ধাওয়া করে। খ্রিস্টপূর্ব ৭১ সালে এই সম্মিলিত বাহিনীর কাছে ঝড়ের প্রকোপে বিশৃঙ্খল হয়ে যাওয়া স্পার্টাকাসের বাহিনী পরাজিত হয়। বিদ্রোহীরা দুই বছর ধরে কনসালের সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছিলো। মোট পাঁচবার রোমান বাহিনী পরাজিত হয়েছিলো তাদের কাছে।


চিত্র: শত্রুর তীর ও বর্শার আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটি জনপ্রিয় রোমান সমর কৌশল ‘tortoise’

শেষ ও চূড়ান্ত যুদ্ধে দাসেরা পরাজিত হলে রোমান সিনেট নারকীয় উল্লাসে বিদ্রোহীদের শাস্তি প্রদান করে। কাপুয়া থেকে রোম শহর পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে হাজার হাজার ক্রীতদাসকে ক্রশবিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। রক্তের বন্যায় এই বিদ্রোহকে ডুবিয়ে দেয়া হলো বটে; কিন্তু এটা সভ্যতার আসল চেহারাই ফুটিয়ে তুললো এবং রেখে গেলো মহান সংগ্রামের উত্তরাধিকার। সভ্যতার ভেতরের কদর্য চেহারাটা বেরিয়ে এলো এই বিদ্রোহে। রোমানদের কদর্য দাস প্রথার বিরুদ্ধে কোন রোমান দার্শনিকই প্রতিবাদ জানাননি। গ্রিকদের মধ্যে থেকে একমাত্র সেনেকা দাসদের পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাস করতেন।

দীর্ঘ যুদ্ধে পরাজিত হলেও দাসেরা ছোট ছোট খন্ডযুদ্ধ পরিচালনা ও সমুদ্রে রোমান জাহাজ লুট করতে থাকে। ফলে রোমে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই খাদ্য সংকটের ফলে ভুক্তভোগী প্রলেতারিয়ানদের অসন্তোষ নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠার উপক্রম হলো। নিরূপায় অভিজাত ও বণিকরা বাধ্য হয়ে সেনানায়কদের হাতে স্থায়ীভাবে ক্ষমতা তুলে দিতে সম্মত হয়। রাষ্ট্রকে পতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় বণিক ও অভিজাতরা সম্মত হলো।

এতে ভূস্বামী অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানদের একক আধিপত্য হ্রাস পায়। সিনেট-অভিজাততন্ত্র ধ্বসে পড়ে। সমর নায়করাই তখন উভয়পক্ষের নেতায় পরিণত হয়েছেন। রাজনীতিবিদরা আর নাগরিক নেতা থাকলেন না। সেনানায়কগন দুই পক্ষের যে কোন এক পক্ষে ভিড়ে গিয়ে স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় বসার পথ প্রশস্ত করছেন। অন্যদিকে বণিক ও অভিজাতরা রাজনীতি বাদ দিয়ে সেনানায়কদের হাত করে স্বার্থ রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠছেন। এভাবে তারা ক্রমে আরও বেশি করে সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন।


চিত্র: রোমান ফোরামের বর্তমান দৃশ্য। এটি ছিল রোম নগরীর কেন্দ্র

ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক পদ্ধতিটি এভাবে সামরিক একনায়কত্বের জালে বন্দী হয়ে যেতে শুরু করে। এ সময়ে রোমান অভিজাতদের আর্থ-সামাজিক কর্তৃত্ব তলানীতে গিয়ে ঠেকে। দাসবিদ্রোহ এবং মেরিয়াসের মতো বণিকপন্থী সেনানায়কের উত্থানের কারণে অনেক ভূস্বামীরই সর্বনাশ হয়। যেসব অভিজাতদের হাতে তখনও যথেষ্ট পরিমাণে ভূসম্পত্তি ছিলো তারা বণিকদের সাথে সন্ধি স্থাপন করে দাস ব্যবস্থা কায়েম রাখার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে সামরিক এনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। কারণ ল্যাটিফান্ডিয়ার উৎপাদন বাঁচাতে দাস শোষণ ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিলো না।

সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্বে বণিক ও অভিজাতদের মধ্যে একটা চুক্তি হলো। চুক্তিতে বণিকদের প্রতিনিধিত্ব করলেন ক্রাসাস আর অভিজাতদের প্রতিনিধিত্ব করলেন জুলিয়াস সিজার ও পম্পেই। পম্পেই ও সিজার দুজনেই বিখ্যাত রোমান সেনানায়ক ও বিশাল সৈন্যবাহিনীর অধিকারী ছিলেন। এরা আলেকজান্ডারের সাবেক সাম্রাজ্যভুক্ত এলাকা ও ইউরোপের বিশাল অঞ্চলকে রোমান শাসনের পদানত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরকারী তিনজনই একনায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ক্রাসাসের পরে পম্পেই ও জুলিয়াস সিজার যৌথভাবে কনসাল নিযুক্ত হন। পম্পেই কনসাল হয়েছিলেন অভিজাতদের পক্ষ হতে আর জুলিয়াস সিজার কনসাল হয়েছিলেন দল বদল করে বণিক প্রতিনিধি হিসেবে।

কনসাল হয়েই তারা প্রোকনসাল ক্রাসাসকে এশিয়া মাইনরে লুণ্ঠনের জন্য পাঠিয়ে দেন। যথারীতি নিজেরাও দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন দখল-লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে। এ সময়ে সিজার ইউরোপের বিশাল ভূখন্ড দখলে আনতে সমর্থ হন। খ্রিস্টপূর্ব ৬০ সালের মধ্যে ক্রাসাস, সিজার ও পম্পেই রোমান সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তায় পরিণত হন। এদের সময়ে রোমান সাম্রাজ্য সর্বাধিক ব্যপ্তি লাভ করে। ইউরোপের মূল ভূখন্ড প্রথমবারের মতো বিভিন্ন প্রাচীন অর্ধসভ্য জাতির হাত থেকে কেঁড়ে নিয়ে রোমান শাসন ও শোষণের আওতায় আনতে সমর্থ হন জুলিয়াস সিজার। মধ্য ও উত্তর ইউরোপ এই প্রথম রোমান সভ্যতার আওতায় আসে।


চিত্র: জুলিয়াস সিজারকে নিয়ে একটি চিত্রকর্ম

আলেকজান্ডারের সাবেক সাম্রাজ্যের একটি বিশাল অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছিলেন পম্পেই ও সিজার। রোমান সাম্রাজ্যের সীমানাকে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত করেন এরাই। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপজুড়ে বিশাল ভূখন্ডকে এরা রোমান শাসনের অধীনে নিয়ে আসেন। আলেকজান্ডারের পরে বিশ্বব্যাপী একক আধিপত্য বিস্তারে তাঁর সমকক্ষ হওয়ার যোগ্যতা সর্বপ্রথম অর্জন করেন জুলিয়াস সিজার। আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের অন্যতম দুটি অংশ মিসর ও সিরিয়াকে প্রথমবারের মতো রোমান শাসনের পদানত করেন পম্পেই ও সিজার। রোম ইউরোপের সবচেয়ে বড় শক্তি হলেও এতদিন পর্যন্ত টলেমিদের মিসর ও সেলুসিড রাজ্য সিরিয়া আংশিক বা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে। পম্পেই ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেলুসিডদের সিরিয়া দখল করতে সফল হন এবং জুলিয়াস সিজার ৪৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমের অনুগত ক্লিওপেট্রাকে মিসরের ক্ষমতায় বসান। অবশ্য এর আগেও মিসর কয়েকবার রোমের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:১১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×