চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পন্চম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসল একটি সুদর্শন লম্বাটে ছেলে । যথারীতি পরীক্ষা দিয়ে চলে গেল ।
পরীক্ষক মহোদয় খাতা দেখে অবাক ! এ ছেলের খাতা তো সাধারন নয় ! জানানো হল অধক্ষকে , কি করা যায় !
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাবল প্রমোশন দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দিল ।
ক্লাসে ছেলেটির মেধাবী উত্তরে স্যার রা মুগ্ধ হয়ে থাকেন ।
গণিতের প্রতি যেন ছেলেটির একটু বেশিই নেশা । বিশেষ করে জ্যামিতি যেন আরো ভাল লাগে ।
নবম শ্রেণী পর্যন্ত এখানে পড়ে ছেলেটি যায় লরেন্স কলেজে । প্রথমে কমপ্লিট করল সিনিয়র কেমব্রিজ ডিগ্রী ।
এবার সাবজেক্ট চয়েজের পালা , সে বেছে নিল গণিত পুরো কলেজে সে একাই ! পাশ করল হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ ডিগ্রী ।
বিএসসি অনার্সে ভর্তি হল কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । সেখানকার ভিনদেশি এক শিক্ষক ফাদার গোরে লক্ষ করল , যেখানে কঠিন সাবজেক্ট বলে সবাই গনিত এড়িয়ে চলে , সেখানে বাঙালি এই ছাত্রটি গভীর মায়ার সাথে গণিত বুঝতে আসে । খুব অল্প সময়েই ছাত্রটি ফাদারের অতি প্রিয় হয়ে উঠল ।
ফাদারের গণিতের অগাধ জলে সে অনায়সেই সাতার কাটে ।
পরবর্তী জীবনেও ফাদারের সাথে যোগাগোগ রেখেছিল সে ।
সাল 1957 ছেলেটি বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হল কেমব্রিজে , সেখানে তার পরিচয় হল আরেক প্রতিভাবানের সাথে । সেই প্রতিভাবীনের নাম ছিল স্টিফেন হকিং , আর ছেলেটি হল ঝিনাইদহের জামাল নজরুল ইসলাম ।
1939 , 23 শে ফেবর্রুয়ারি ঝিনাইদহের মুন্সেফের (এখনকার জজ) জন্ম নিল রাজপুত্রের মত ছেলে । পিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন , মানুষ ও এমন সুন্দর হয় ?
ছেলে জন্মের কয়েক বছর পরই উনি বদলী হলেন কলকাতায় সঙ্গে পরিবারও । সুতরাং ছেলেটির বাল্যকাল এখানেই কাটল ।
ফিরে চলি কেমব্রিজে । কি ভাগ্য এক বই পড়ুয়া ম্যাথ পাগল জামালের রুমমেট পড়ল আরেক পদার্থ পাগল হকিং !!
অবাক হকিং লক্ষ করল , এই বাঙালি গণিত করে ঠিকই তবে ক্যালকুলেটর ছাড়া !!
এবার তরুণ বন্ধু পেল মনের মত , ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা , নোবেল জয়ী ব্রায়ান জোফেফসন , পরমানু বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম , রিচার্ড ফাইন ম্যানের মত প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের । (তারা তখনো নোবেল পান নি ।)
১৯৫৯ , এখানে প্রায়োগিক গণিত এবং তাত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স করলেন । পরের বছর মাস্টার্স ।এবার জামাল নজরুল পুরোপুরি কর্মজীবন প্রবেশ করলেন ।
বিশ্ব তখনো জানে না বাঙালী এই যুবক কি করতে চলেছে ।
যুক্তরাস্টের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো পদে যোগদান করলেন
১৯৬৪ তে একই বিষয়ে পিএইচডি করলেন ।।
1965তে ছেড়ে দিলেন এই চাকরি । পড়াশোনার পাশাপাশি এত খাটা খাটি সম্ভব না ।
১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আবার কেমব্রিজের ইস্টিটিউট অফ এস্ট্রোনোমিতে কাজ করেন । কসমোলজিতে আগ্রহের শুরুটা বোধহয় এখানেই ।
এর পর ১৯৮৪ পর্যন্ত আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ন পদে চাকরি করলেন ।
এবার জামাল নজরুল শুরু করল স্বগবেষনা , পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে লেখালেখি ।
১৯৭১এ দেশে লাগল মুক্তি যুদ্ধ , বিদেশবাসী বাঙালি তরুন দেশের জন্য কিছু করার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন ।
ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলেন বাংলাদেশকে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে । এমনকি ব্রিটিশ এমপি লর্ড বাটলারের মাধ্যমে গণচীনে খবর পাঠালেন , তারা যেন পাকিস্তানের পক্ষ না নেয় ।
১৯৭৭ তার প্রকাশ করা একটি গবেষনার ড্রাফট (possible ultimate fate of universe) থেকে বড় বড় বিজ্ঞানীরা বিশ্বের অন্তিম পরিনিতি নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত হলেন ।
পদার্থবিদ এবং গণিতবিদ ফ্রীম্যান ডাইসন , অবাক ! যেখানে তার নিজের দেশের বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণায় অনাগ্রহী সেখনে এই বাঙালিটা করছে কি !!
তিনি বিবৃতি দিলেন , জামাল ইসলাম আমাকে পৃথিবীর শেষ পরিণতি নিয়ে ভাবতে উদ্ভুদ্ব করেছে । সে ,সেই কাজটাই করেছে যে অনেকে করতে চায় না কারন কাজটা কঠিন ।
বিশ্ববাসী বুঝল খুব দ্রুতই তারা আরেকজন মেধাবী বিজ্ঞানী পেতে চলেছে ।
১৯৮২ তে তার কাজের ফলস্বরুপ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দূর্লভ এবং সম্মানজনক ডক্টর অফ সাইন্স ডিগ্রী দেয় ।
সাল ১৯৮৩ বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন , আইন্সটাইনের জেনারেল থিউরি দিয়ে পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ব ও শেষ পরিনতির ব্যাখা দিতে ।
এমন সময় একটি বই বের হল " দি আলটিমেট ফেট অফ দি ইউনিভার্স" , পুরো বিজ্ঞানীমহলে সাড়া পরে গেল , আইনস্টাইন পরবর্তি মহাকাশ গবেষণা শুরু হল এই জামাল নজরুলের হাত ধরে ।
পরের বছর যৌথ সম্পাদনায় বের করলেন ক্ল্যাসিকাল জেনারেল রিয়েলিটিভিটি ।
গবেষনা অব্যাহত রইল ।
সবে খ্যাতির চূড়ায় উঠতে শুরু করেছেন
এরই মধ্যে অকস্মাৎ জামাল ইসলামের মনের কি হল , দেশে আসার জন্য পাগল হয়ে উঠলেন ।
বন্ধুদের সিদ্ধান্ত জানালেন , হকিং বললেন তুমি তো এখান থেকেই দেশের জন্য কাজ করতে পার ।
তাও ঠিক । কিন্তু এক দিকে দেশের জন্য আকুপাকু মন , অন্যদিকে ক্যারিয়ারের মাঝে এমন সিদ্ধান্ত !
বিশ্বে যদি বাংলাদেশকে মাথা তুলে দাড়াতে হয় , বাংলাদেশের তরুণদের বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখায় অবাধে সন্তরন শিখতে হবে । নিজে কেমব্রিজে গবেষণা করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের কখনোই সেরকম চ্যালেন্জিং জগতে সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় ।
সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল , এসে চট্টগ্রামবিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন । অতি নিম্ন বেতনে ।।
আসার সময় বন্ধুদের বলে এলেন , বাংলাদেশের একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়েকেও যদি আমি বিজ্ঞানের পথে নিয়ে আসতে পারি , যদি তার সামনে মহাবিশ্ব অনুসন্ধানের একটি দরজাও খুলে দিতে পারি তবেই আমার দেশে ফেরা স্বার্থক ।।
এসেই খাটাখাটনি , ভার্সিটিতে গণিতের কোন ভাল রিসার্চ সেন্টার নেই , নেই কোন গবেয়ণাগার । নিজেই কোমর বেধে নেমে পড়লেন সকল দূর্দশা দূর করতে । গড়ে তুললেন রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথম্যাথিকাল এন্ড ফিজিকাল সাইন্স ।
নিজের সকল বিদেশী বন্ধুদের সাথে ছাত্রদের পরিচয় করিয়ে দিতে কদিন পর পর তাদের বিভিন্ন সেমিনার , সভায় আনেন । ১৯৮৪ তে এমনি এক সেমিনারে পাকিস্তানের পরমানু বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম , বলে গেলেন এশিয়াতে আমার পর কেউ যদি নোবেল পায় , সে হল জামাল ইসলাম ।
বিহারের কয়েকজন গরীবলোক , টাকার জন্য এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করছে , মাথায় টাকার টেনশানে মাথা ভো ভো করছে , বাংলাদেশীরা তাদের খুব একটা ভাল চোখে দেখে না , হঠাৎ দলপতি দেখলে সামনে এক ফরসামত ভদ্রলোক হেটে যাচ্ছে , প্রতিদিনকার মত উনার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইল সে । অবাক লোকটি যে টাকা দিল তাই নয় , বলল এখন থেকে প্রতি মাসে যেন এরা এসে টাকা নিয়ে যায় ।
এভাবে নিত্যই বেতনের একটা অংশ গরীব দুখীদের দিতেন , বিজ্ঞানী জামাল ইসলাম ।
১৯৮৫ তে বাংলা একাডেমি তাকে তার কর্মের পুরষ্কার স্বরূপ স্বর্ণপদকে ভূষিত করে ।
চট্টগ্রামে এসেও গবেষণা থেমে থাকে নি মহান এই বিজ্ঞানীর , ১৯৯২ এ লিখলেন এন ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথম্যাথিকাল কসমোলজি ।
এবার স্যারের মনে হল মাতৃভাষায় কিছু লেখা উচিত নিজের দেশের ছেলেপিলেদের জন্য ।
লিখলেন কৃষ্ণবিবর ।
বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লিখেই চললেন , আরো লিখলেন মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ ।
বিজ্ঞান ছাড়াও সাহিত্যে বেশ আগ্রহ ছিল জামাল ইসলামের । নিজে খুব চমৎকার পিয়ানো ও সেতার বাজাতে পারতেন ।
এবার লিখলেন , শিল্প সাহিত্য ও সমাজ ।
একবার এক সেমিনারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে , আপনি বাইরে এত দামী চাকরি ছেড়ে
ফিরে এলেন কেন । গর্বিত বিজ্ঞানী জবাব দিলেন , আমার বাড়ি চিটাগং । আমি আমার দেশকে ভালবাসি । এখান থেকে আমি নিতে আসিনি । দিতে এসেছি ।
১৯৯৪ এ পান , ন্যাশনাল সাইন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল ।
আবারো বই লিখলেন দেশের প্রেস নয় , সরাসরি কেমব্রিজের প্রেস , স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ ।
লিখলেন দি ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স , এভেন্ডার থেকে প্রকাশিত । আবারো সাড়া পড়লো । স্প্যানিশে অনুদিতও হল ।
অনেকবারই ভিসি হওয়ার জন্য , স্যারের নিকট চিঠি এসেছে , প্রত্যেকবারই ফিরিয়ে দিতেন আর বলতেন , আমার চায়ের কাপ
রিসার্চ সেন্টারে । প্রশাসনিক অফিসে নয়
১৯৯৮ সালে ইতালির আব্দুস সালাম সেন্টার ফর থিউরিকিক্যাল ফিজিক্স , উনাকে মেডাল লেকচার পদক দেয় ।
২০০০ সালে , কাজী মাহবুবুল্লা এন্ড জেবুন্নেছা পদক পান ।
সাল ২০০১ , পুরো পৃথিবীতে এক গুজব ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবী নাকি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ।
তখন বিজ্ঞানী জামাল নজরুল গাণিতীক হিসাব কষে দেখান সেরকম কোন সম্ভাবনা নেই , এমন কি সৌরজগতের সকল গ্রহ এক সরল রেখায় চলে আসলেও পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না ।।
এর কয়েক দিন পরই একুশে পদক লাভ করেন ।
পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১১ তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উনাকে রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক দেয় ।
দেশের বিজ্ঞানের দুদর্শা দেখে প্রায়ই বলতেন , আমরা দেশে একজন গায়ককে নিয়ে কত ভাবি , একজন ক্রিকেটার ভাল খেলে অনেক আর্থিক সুবিধা দেই অথচ বিজ্ঞানীদের জন্য তেমন কিছুই করা হয় না ।
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে বিজ্ঞানী খুব কম জন্মেছে , যে কয়জন আছে তন্মধ্যে স্যার জামাল নজরুল একজন ।
রাজনৈতিক বিতর্কের উর্ধে থেকে , সরল মানবতাবাদী এই অধ্যাপক সবসময় দেশ ও উচ্চ শিক্ষার কথা ভাবতেন ।
অত্যন্ত্য পরিতাপের বিষয় , তৎকালীন লেজুড়ে রাজনীতির মতাদর্শী না হওয়ায় উনাকে কখনো সরকার যথাযথ মূল্যায়ন করে নি ।
ফুসফুসে সংক্রমণ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে . হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ই মার্চ ২০১৩ তে মারা যান মহান এই বিজ্ঞানী ।
বিশ্বে যেকয়জন বিজ্ঞানী মহাকাশ নিয়ে গবেষনা করেছেন তার মধ্যে স্যার জামাল নজরুল তার মৌলিক গবেষনার জন্য বিখ্যাত , অথচ তার মৃত্যুর পর আমাদের তথাকথিত বোদ্ধারা পত্রপত্রিকায় ছোট ছোট বিবৃতির মধ্যেই সীমিত রাখছেন শোকবার্তা । যেখানে
উনার বিভিন্ন জার্নাল-বই বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান পাঠ্য সেখানে আমাদের প্রজন্ম তা থেকে বন্চিত ।
আরো পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশের বিজ্ঞান ছাত্র ছাত্রীদের শতকরা ১০ ভাগও উনার নাম জানে না ।।
যদিও ক্ষুদ্র এই লেখাতে কিছুই তুলে ধরতে পারি নি তবুও উনার মহান এই জীবনি পড়ে তারা যেন বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত হন সে কামনায় ।
(বি;দ্র ; কারো জীবনি বানিয়ে লেখা সম্ভব না , আর বিভিন্ন ব্লগে যা দেখলাম কোনটাতেই উনার জীবনি সম্পূর্ন না , আমি তাই শুধু ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত তথ্যগুলু আমার মত সাজিয়ে লিখেছি ) ( ছবিও সংগ্রিহীত)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৫