চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি। উঁচু নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকেই সবুজ। মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়ের কিনার ঘেষে ছুটে গেছে আকাবাঁকা মেঠোপথ। বিশেষ করে এখানে কোন যান্ত্রিক দূষণ নেই।যান্ত্রিক দূষণ মুক্ত পরিবেশ । কোথাও কোথাও আবার ধাবমান পথে ছুটে চলছে রূপালী ঝর্ণাধারা। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের সম্মিলন যেন এখানে। এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান মালনীছড়া।চা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পানীয়। সকালে এক কাপ গরম চা না পেলে বাঙালী সমাজের যেন একদম চলে না। বাংলাদেশের যে কয়টি অঞ্চলে চা বাগান পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে সিলেট অন্যতম। সিলেটের চা বাগানের খ্যাতি রয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে। দেশের মোট চায়ের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। এজন্য সিলেটকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ ও বলা হয়।
সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম এবং সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান। যার নাম মালনীছড়া চা বাগান।’ ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে ১৮৪৯ সালে ১৫০০ একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়া। বাগানটি বর্তমানে পরিচলিত হচ্ছে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে। ভ্রমনবিলাসী মানুষের কাছে আনন্দ ভ্রমণ কিংবা উচ্ছল সময় কাটানোর প্রথম পছন্দের স্থান হলো মালনীছড়া চা বাগান। সিলেট শহরের একেবারেই অদূরে হওয়ায় চা বাগান দেখতে পর্যটকরা প্রথমেই ছুটে যান মালনীছড়ায়। মালনীছড়া চা বাগানের প্রবেশদ্বার বেশ কয়েকটি। আপনি চাইলে যে কোন একটি পথ দিয়েই চা বাগান দর্শনের কাজ শুরু করতে পারেন। তবে ঝামেলা এড়াতে বাগানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়াই বাঞ্চনীয়। তারপর ঘুরে দেখেন বাগানের এপাশ থেকে ওপাশ। দেখে আসতে পারেন বাগানের বাংলো। মালনীছড়ার পাশেই রয়েছে আলী বাহার চা বাগান। সিলেটের চায়ের রঙ, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান সিলেট শহরে অবস্থিত। নাম মালনীছড়া। ১৮৪৯ সালে এই চা বাগান প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বেসরকারী তত্ত্ত্বাবধানে চা বাগান পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৫০০ একর জায়গার উপর এই চা বাগান অবস্থিত। চা বাগানের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারের চাষ করা হয়। মালনীছড়া চা বাগান ছাড়াও সিলেটে লাক্ষাতুড়া চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, খাদিম, আহমদ টি স্টেট, লালাখাল টি স্টেট উল্লেখযোগ্য।মালনীছড়া এবং লাক্ষাতুড়া চা বাগান দুইটিই সিলেট শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত। শহরের কেন্দ্রস্থল জিন্দাবাজার পয়েন্ট হতে গাড়ীতে মাত্র ১৫ মিনিটের পথ।
পাহাড়ের গায়ে চা বাগানের দৃশ্য, ছায়া বৃক্ষ, চা শ্রমিকদের আবাসস্থল, কমলার বাগান, রাবার বাগান, চা তৈরীর প্রক্রিয়া। বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালোলাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান। তাই ছুটির অবসরে কিংবা বৈকালিক বিনোদনের তৃষ্ণা মেটাতে তারা ছুটে যান চা বাগানের সবুজ অরণ্যে। সারাটা বিকাল চলে সবুজের ভেতর লুকোচুরি, হৈ হুল্লোড় আর আনন্দে অবগাহন। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে। আর বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চা বাগান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চা বাগান হলোঃ মালনীছড়া চা বাগান, লাক্কাতুরা চা বাগান, তারাপুর চা বাগান, দলদলি চা বাগান, খাদিম চা বাগান, বড়জান চা বাগান, গুল্নি চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, হাবিব নগর চা বাগান, আহমদ টি এস্টেট, খান চা বাগান, লালাখাল টি এস্টেট, শ্রীপুর চা বাগান, মুলাগুল চা বাগান ইত্যাদি।
লাক্কাতুরা চা বাগান
মালনীছড়া আর লাক্কাতুরা চা বাগান পাওয়া যাবে একই যাত্রা পথে। ব্যবধান শুধু রাস্তার এপাশ ওপাশ। শ্রেষ্টত্বের দিক থেকে লাক্কাতুরা চা বাগানটি কখনো কখনো মালনীছড়া চা বাগানকে ছাড়িয়ে গেছে। নগরীর চৌকিদেখি আবাসিক এলাকা পেরুনোর পর গলফ ক্লাবের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই একবারেই চলে যাবেন বাগানের মধ্যিখানে। বাগানের এপাশ ওপাশ ঘুরে গল্ফ ক্লাবের সুন্দরম টিলার উপরও হতে পারে আপনার আনন্দ আয়োজন। গল্ফ ক্লাব মাঠ পেরিয়ে আরো একটু সামনে এগুলেই পেয়ে যাবেন সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম। চারপাশে চা বাগান আর মাঝখানে স্টেডিয়াম সত্যিই অসাধারণ! এমন সবুজ প্রকৃতির ভেতর স্টেডিয়াম পৃথিবীতে সম্ভবত একটাই।
তারাপুর চা বাগান
তারাপুর চা বাগানও সিলেট শহরের একেবারেই কাছে। নগরীর আম্বরখানা থেকে মদিনা মার্কেট যাওয়ার পথে পাঠানটুলা এলাকায় প্রকৃতির ছায়াঘেরা পরিবেশে তারাপুর চা বাগান। একবারেই লাগোয়াভাবে জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় মদন মোহন কলেজের ব্যবসায় শাখার ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তারাপুর চা বাগান পর্যটকদের মাঝে আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় সবসময়ই পর্যটকদের পদচারনায় মূখর থাকে এ বাগানটি।
দলদলি চা বাগান
নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকা থেকে এমসি কলেজের দিকে একটু অগ্রসর হলেই হাতের বাম পাশে উপজেলা খেলার মাঠ। এর পাশ দিয়েই ভেতরে যাওয়া রাস্তায় সামান্য গেলেই পেয়ে যাচ্ছেন দলদলি চা বাগান। মূল বাগানে যেতে হলে পার হতে হবে বেশ কিছু লোকালয়। লোকালয় থেকে ভেতরে যেতে হয় বিশাল বিশাল টিলা বেষ্টিত মেঠো পথ ধরে। তারপর মূল চা বাগান। ভেতরে যাওয়ার রাস্তাটি গাড়ীর জন্য বেশ সুবিধাজনক নয়, সে জন্য মোটর বাইক কিংবা নিজে পা হতে পারে আপনার সুবিধাজনক বাহন।
একের ভেতর তিন
শহরতলীর শাহপরাণ মাজার গেট থেকে তামাবিল রোডে সামান্য গেলেই হাতের বাম পাশ দিয়ে ভেতরে গেছে খাদিম জাতীয় উদ্যানের রাস্তা। প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে ভেতরে উদ্যান । কিন্তু চা বাগানের জন্য এতোদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তামাবিল রোড থেকে একটু ভেতরে গেলেই একে একে পাওয়া যাবে বড়জান চা বাগান, গুলনি চা বাগান এবং খাদিম চা বাগান। বাগানের লাগোয়া পথে যেতে যেতে দেখা সবুজ দৃশ্যপট, শিল্পিত লোকালয় পর্যটকদের নজর কাড়ে সহজেই। রাস্তার পাশেই চা প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি হওয়ায় নাকে লাগে সতেজ চায়ের মধুমাখা ঘ্রাণ। এছাড়া হাবিব নগর চা বাগান, আহমদ টি এস্টেট এবং খান চা বাগানের অবস্থান সিলেট তামাবিল সড়কের হরিপুর এলাকায়।
লালাখাল টি এস্টেট
সিলেট তামাবিল সড়কের সারিঘাট এলাকায় গিয়ে নৌকা করে যেতে হয় লালাখাল টি স্টেট। ঘন্টা খানেকের পথ। চা বাগানের সকল সৌন্দর্য ছাড়িয়ে গেছে সবুজ জলের আস্তরনে ছেয়ে যাওয়া নদীপথ। আসলেই অসাধারণ দুই পাশের সবুজ প্রকৃতির ছায়া যেন আছড়ে পড়েছে স্রোতস্বীনির বুকে।
শ্রীপুর চা বাগান
জাফলং সবুজের সাথে সবুজের কি অপরূপ মেলবন্ধন । পর্যটন স্পট জাফলংয়ের কথা কে না জানে, প্রকৃতিপ্রেমীদের পদচারনায় প্রতিনিয়ত মূখর থাকে পর্যটন স্পট জাফলং। জাফলংয়ের সৌন্দর্যের মাঝে অন্য এক ভালোলাগার আবেশ সৃষ্টি করেছে শ্রীপুর চা বাগান। আপনার আগামীর জন্য এখানেও ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারেন কিছুটা সময়। সিলেট, যেন সবুজ প্রকৃতির অভয়াশ্রম! আর সবসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষের জন্য সেরা সময় এখনই। যখন প্রকৃতির সব বিচিত্র সৌন্দর্য মিশে আছে চা গাছের সবুজ পাতায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১০:৫৯