somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সের্গেই আইজেনস্টাইন, ব্যাটলশিপ পটেমকিন ও ১৯০৫ সাল

১১ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ সকাল ৭:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আমার লেখালেখির ফোল্ডারে সের্গেই আইজেনস্টাইনের উপর একট অসম্পুর্ণ লেখা পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছি । আইজেনস্টাইন সম্বন্ধে লিখতে গেলেই 'ব্যাটলশিপ পটেমকিন' চলে আসবে আর পটেমকিন আসলেই ১৯০৫ এর প্রথম রুশ বিপ্লবের প্রসঙ্গ টানতে হবে । আমি ১৯০৫ এই থমকে গেছি দেখতে পাচ্ছি । লেখাটা শেষ করার বিশেষ কোন তাগিদ পাচ্ছি না )

২২ জানুয়ারি, রবিবার, ১৯০৫ সাল , সেইন্ট পিটার্সবুর্গ, রাশিয়া । বরফ, কাদা আর সুঁই ফোটানো হিমেল বাতাসকে উপেক্ষা করে শীত প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মিছিলগুলো । প্রায় ছয়টা মিছিল, ছয় রাস্তা ধরে চলছে, পুর্ব পরিকল্পিতভাবে জমায়েত হবে প্রাসাদের সামনে, সম্পুর্ণ শান্তিপুর্ণ মিছিলগুলোর পরিবেশ, প্রধান মিছিলের নেতৃত্বে ফাদার গেওর্গি গাপন । জার দ্বিতীয় নিকোলাসের প্রতিকৃতি আর নানান সাধু সন্তের আইকন বয়ে নিয়ে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতে গাইতে, চলেছে তারা, মহামান্য সম্রাটের সকাশে হাজির হয়ে সবিনয় আর্জি জানাবে জনতার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিশেষত ফাদার গাপন, দেশের পরিস্থিতি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে, দয়া করে একটা কিছু করুন মহামান্য সম্রাট, তাই এই দেড় লাখ মানুষের মহা গন জমায়েত । ভয় পাবার কোন কারন ঘটেনি মিছিল উদ্যোক্তাদের, কারন ফাদার গাপন ক্ষমতাশীল গোষ্ঠির বিশেষ আস্থাভাজন লোক । কমিউনিস্ট আর অন্যান্য সমাজবিপ্লবীদের কাজে ঘাবড়ে গিয়ে রুশ সরকার গাপনকে লাগিয়েছিলো একটা "পোষা" শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে, যেটার ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে কর্তৃপক্ষের। তাই থেকে এই বুমেরাং মিছিল ।

কিন্তু এ বিশাল জমায়েত দেখে ঘাবড়ে গেলো প্রাসাদরক্ষী সশস্ত্র কসাক অশ্বারোহীর দল, বন্দুক তুলে গুলি চালালো নির্বিচারে, পরবর্তী কয়েক মিনিটের তান্ডবে মারা পড়লো কয়েকশো মানুষ, আত্বগোপন করলেন ফাদার গাপন । কলংকিত দিনটাকে ঘোষনা করা হলো , "ব্ল্যাক সানডে" কালো রোববার । গুপ্তস্থান থেকেই গাপন ঘোষনা করলেন জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে রাশিয়ার "আত্মা-হত্যাকারী" (সোল মার্ডারার) বলে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সংঘর্ষ রুপ নিলো গৃহযুদ্ধে, সু্ত্রপাত কৃষ্ণসাগরের ওডেসা বন্দরে নোঙ্গর করা যুদ্ধজাহাজ পটেমকিন বিদ্রোহ । শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে এই গণঅভ্যুত্থান, তবে এ হবে , একযুগ পরের ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের মহড়া, স্টেজ রিহার্সাল ।

সময়টা ভালো যাচ্ছিলোনা রুশ সাম্রাজ্যের জন্য । ১৯০৪ সালের ডিসেম্বরে, সুশিমা অন্তরীপের যুদ্ধে ভয়াবহ শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করেছে দুরপ্রাচ্যের রুশ নৌবহর । এবং এই পরাজয় জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ওপর জেঁকে বসে থাকা জারের নিরংকুশ অভিকজাত একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে জমা হওয়া সমস্ত ক্ষোভ প্রকাশের পথ খুলে দিলো । বাইশে জানুয়ারীর গণহত্যা, অঙ্গারে ঘি ঢাললো, দরকার ছিলো কেবল একটা স্ফুলিঙ্গের, সেটা যোগান দিলো কৃষ্ণসাগরে পটেমকিন যুদ্ধ জাহাজের নাবিকদের বিদ্রোহ

জারিনা ক্যাথারিন দ্য গ্রেটের বিশেষ আস্থাভাজন ও প্রিয়পাত্র প্রিন্স গ্রিগোরি আলেক্সান্দ্রোভিচ পটেমকিন (১৭৩৯-১৭৯১) ছিলেন অষ্টাদশ শতক রাশিয়ার জাঁদরেল রাজপুরুষ ও কুটনীতিক । । অতএব, রুশ জারের নৌ কর্তৃপক্ষ তাদের অন্যতম আধুয়নিক যুদ্ধ জাহাজের নাম রাখেন ব্রনোনোসেৎস পটেমকিন বা যুদ্ধজাহাজ পটেমকিন ।

আসলে ঠিক কী ঘটেছিলো আজ থেকে একশো বছর আগে এই রুশ যুদ্ধজাহাজে তা আন্দাজ করা কঠিন । তবে এটুকু জানা যায় পোকাধরা মাংস নাবিকদের খাওয়ানো হচ্ছে এই অভিযোগে পটেমকিনের নাবিকরা খেতে অস্বীকার করে, এয়ার্ডরুমে বন্দী করে রাখা হয় তাদের কয়েকজনকে । বিদ্রোহী নাবিকরা দ্রত পটেমকিন জাহাজের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ফেলে, এবং বেশ কয়েকজন অফিসারকে পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় । তাদের উদ্দেশ্য ছিলো পুরো কৃষ্ণসাগর নৌবহরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেয়া, যদিও সেটা করতে ব্যর্থ হয় তারা । তবে গোটা ব্যাপারটা যে অনেকটাই পুর্ব পরিকল্পিত তাতে বিশেষ কোন সন্দেহ নেই, এব্যাপারেও আমারা নিঃসন্দেহ থাকতে পারি যে বিদ্রোহীদের প্রায় সবাই নিষিদ্ধ সোশ্যাল ডেমোক্রাটি পার্টির বিপ্লবী শাখার সদস্য ছিলো ।

রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো জারের রাশিয়ায় ১৯০৫ সাল পর্যন্ত । সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির অস্তিত্ব তাই ছিলো আন্ডারগ্রাউন্ডে । পার্টির প্রধান প্রধান মোড়লরা ছিলেন ইউরোপ আর আমেরিকার নানান শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে । লেনিন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে, কামেনেভ ভিয়েনায়, ট্রটস্কি আমেরিকার নিউ ইয়র্কে । ম্যাক্সিম গোর্কি যদিও কোন নেতা ছিলেননা, পুরোপুরি সহানুভুতিশীল ছিলেন এই দলের প্রতি, লেকচার দিতে ঘটনা চক্রে তিনিও ছিলেন নিউ ইয়র্কে । নানান ফন্দি ফিকির করে, গোপন রাস্তায় অনেকেই দেশে এসে আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন ।

সের্গেই আইজেনস্টাইনের বয়স তখন সাত বছর । লাতভিয়ার রিগা শহরে জন্ম তার ১৮৯৮ সালে, বাবা মিখাইল আইজেনস্টাইন প্রকৌশলী ও সরকারী ঠিকাদার, পুর্বপুরুষেরা এসেছিলেন জার্মানি থেকে । দেখতেন বালক সের্গেই, রাস্তা দিয়ে মিছিল যাচ্ছে, কখনো কানে আসতো দুরে কোথাও বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দ । শৈশবে দাগ কেটে যাওয়া এইসব অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগাবেন সর্বকালের সেরা ছবি "ব্যাটলশিপ পটেমকিন" তৈরৌ করতে ।

খাঁটি বুর্জোয়া পরিবারের সন্তান সের্গেই আর্কিটেকচার পড়ার জন্য ভর্তি হন সেইন্ট পিটার্সবুর্গ পলিটেকনিকে । কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে লেখাপড়া শিকেয় ওঠে তখন । ১৯১৭ সালের এপ্রিল আর অক্টোবর, দুটো বিপ্লবই ঘটে যায় সের্গেইয়ের চোখের সামনে দিয়ে । শীত প্রাসাদে জনতার হামলায় অংশ নেন সের্গেই, বলশেভিক পার্টির সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন । বছর দুয়েক পরে বিপ্লবী নাট্যদলে নাম লেখান, ফ্রন্টে যেসব ট্রেন যেতো সেগুলোর বাইরের দেয়ালে উদ্দীপক স্লোগান আর ছবি আঁকার দায়িত্ব পান । তারপর ১৯২০ সালে সেনা বাহিনী থেকে ছাড়া পেয়ে পরীক্ষামুলক থিয়েটার জড়িয়ে পড়েন ।

পরীক্ষামুলক থিয়েটারের পরিচালক ছিলেন তখন ভি. মেয়ারহোল্ড । মেয়ারহোল্ড বিশ্বাস করতেন, সংলাপ আর অংগসঞ্চালন কোন বার্তা বহন করবে দর্শকের প্রতি, আবেগ নিরভর স্বাভাবিক অভিনয় থেকে সরে আসবে এসব প্রচারনির্ভর ছবি । অন্যের হাতে পড়লে হয়তো নিরেট নির্বোধ প্রোপাগান্ডায় পরিনত এসব ছবি, কিন্তু মেয়ারহোলড আর আইজেনস্টাইনের হাতে পড়ে প্রোপাগান্ডাও হয়ে ওঠে নিখুঁত এপিক । মেয়ারহোল্ডের নির্দেশনায়, আইজেনস্টাইন গড়ে তোলেন তাঁর "মন্টাজ অভ অ্যাট্রাকশন্স", কতিপয় ধারাবাহিক দৃশ্যপ্রবাহ, যা দর্শকদের কাছ থেকে কাম্য প্রতিক্রিয়া আদায় করে ছাড়বে । ব্যাটেলশিপ পটেমকিন ঠিক তেমনই একটি ছবি ।

কতগুলো ব্যাপার শুরুতেই বোঝা দরকার, বিশ শতাব্দীর বিশের দশক ছিলো রুশ কমিউনিস্টদের বিজয়ের প্রথম দশক । নিজেদের মতবাদ প্রচারে অপরিসীম উৎসাহ আর উদ্দীপনা ছিলো সদ্য ক্ষমতায় আসীন বলশেভিকদের । কিন্তু তখনও ততোটা স্থিতবস্থা লাভ করেনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতার দুর্গ । সেন্সরশিপ ততোটা কঠিন হয়ে ওঠেনি, বাইরের দুনিয়া থেকে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি তখনও, পরবর্তীকালের গোঁড়ামির (বা গোঁয়ার্তুমির) চিহ্ন ততোটা পাইনা আমরা বিশের দশকের রুশ শিল্পে । আইজেনস্টাইন, মেয়ারহোল্ড, গোর্কি এঁরা নিজেদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবেই মনে করতেন নিজেদের এবং তা মনে করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারনও ছিলো । তাঁদের অনেকেই লেখাপড়া করেছেন দেশের বাইরে, প্রচুর যাতায়াত ছিলো বিদেশে, ফরাসী, ইংরেজি আর জার্মান ভাষা আর সাহিত্যে ঈর্ষণীয় দখল ছিলো, সুতরাং প্রথমযুগের কমিউনিস্টরা সেভাবে কুপমন্ডুকতায় আক্রান্ত হননি, যদিও নিষ্ঠাবান পার্টি কর্মী ছিলেন তাঁদের অনেকেই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×