আবছা আলোর রাত।
—মুহাম্মদ সালাহ উদ্দিন।
১।
মিথিলার সাথে প্রবালের যোগাযোগ নেই অনেক দিন। মেয়েটা ইচ্ছা করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রবাল চাইলে অবশ্য যোগাযোগ করতে পারতো, তার কাছে মেয়েটার সবগুলো ফোন নাম্বারই ছিলো। কিন্তু সে-ও আর যোগাযোগ করেনি।
প্রবাল অভিমানী ছেলে। মিথিলাও সেটা জানে। জেনেও সে এমন একটা কাজ করেছে।
প্রবাল মাঝেমধ্যে ভাবে— নিজের দূর্বলতা আসলে অন্যের কাছে প্রকাশ করতে হয় না। করলেই বিপদ। আজ যে মানুষটা সবচেয়ে কাছের, হয়তো কালকেই সে হয়ে যাবে সবচেয়ে দূরের! ব্যবধান শুধু একটি রাত, কিংবা তারচেয়েও কম। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করেই সবচেয়ে বেশি ঠকে, অথচ মানুষকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতে হয়।
২।
একটা কথা ভেবে প্রবালের খুব অবাক লাগে, মিথিলা তাকে কিভাবে ভুলে যেতে পারলো! এই মেয়েটাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিলো। ভেবেছিলো, সমস্ত পৃথিবী তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও অন্তত এই মেয়েটি তার পাশে থাকবে। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, সে-ই সবার আগে দূরে সরে গেলো! ইদানীং তার মনে প্রশ্ন জাগে— সে কী মেয়েটার সাথে কখনো এমন কোন আচরণ করেছে, যার কারণে বাধ্য হয়েই মেয়েটা তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে?
প্রশ্নটা তার মাথায় ঝড় তোলে। সে স্মৃতির পাতা হাতড়ায়। তেমন কোন অন্যায় আচরণ চোখে পড়েনা। বরং সবসময় সে মেয়েটার টেক-কেয়ার করেছে, ভালোমন্দ খোঁজ খবর নিয়েছে। দেখা করার সময় কোনদিন দেরি করেনি, আগেভাগে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মেয়েটার কোন আচরণে কষ্ট পেলে সেটাও মেয়েটাকে জানায়নি কখনো। বরং নিজেকে তার মতো করে বদলে নিতে চেষ্টা করেছে। গত তিন বছরের রিলেশনশিপে সেক্রিফাইস যা করার সে একাই করেছে। এতো কিছুর পরেও মেয়েটাকে ধরে রাখতে পারেনি সে। ঠিকই উড়াল মেরেছে।
প্রবাল গতকাল একটা গান শুনছিলো—
“ দড়ি দিয়া কষা কইরা বান্ধা পঙ্খীর পাঁয়
পঙ্খী যায় উইড়া যায়!"
আসলেই তো! যে যাবার তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলেও কি আঁটকে রাখা যায়? সে তো যাবেই!
৩।
গত কয়েকদিনে মিথিলার নাম্বারে অন্তত কয়েক হাজার বার কল দিতে চেয়েছে সে। কিন্তু একবারও পারেনি! ভেতর থেকে কে যেনো আঁটকে দিচ্ছে বারবার।
সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিল অনেক দিন— আবার ধরেছে। মাঝেমধ্যে মেয়েটাকে দেখার জন্য যখন মনটা খুব উতলা হয়, তখন সে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের কোন একটা তারাকে মিথিলা ধরে নিয়ে তার সাথে কথা বলেতে চায়। কিন্তু আকাশের মিথিলাও বাস্তবের মিথিলার মতো আচরণ করে। কোন কথার উত্তর দেয় না। তবুও সে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে সিগারেট জ্বালায়। চাঁদের আলোয় তার গালের দুপাশে কী যেনো চিকচিক করে উঠে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপও নেই। সিগারেটের ধোঁয়ায় এক সময় সেই চিকচিকে ভাবটা আবছা হয়ে যায়।
৪।
ছেলেটার দিনগুলো এভাবেই কাটছিলো। হয়তো বাঁকি দিনগুলোও এভাবেই কাটতো, যদি মিথিলা নামের মেয়েটা তার জীবনে আরেকবার ফিরে না আসতো।
মিথিলার সাথে প্রবালের যোগাযোগ বন্ধ হবার মাস ছ'য়েক পরের কথা। প্রবালের ফোনে একদিন অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন আসে। প্রবাল ফোনটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে কোন কথা শুনা যাচ্ছিল না। যে ফোন করেছে সে কথা বলছিল না। প্রবাল-ও ফোনটা রাখছিল না। এভাবেই কাটলো বেশ কিছুটা সময়। একটা সময় প্রবাল যখন নিশ্চিত হলো— ফোন যে করেছে সে কথা বলবেই না, তখন নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘কথা বলো মিথিলা! আমি তোমার প্রতিটা নিশ্বাস প্রশ্বাস চিনি। চুপ করে থেকেও নিজেকে লুকাতে পারবেনা তুমি।'
প্রবালের কথা শুনে অপরপ্রান্ত থেকে হু-হু করে কেঁদে ফেললো মেয়েটা!
সেবার দুজনে অনেক কথা হলো। যার সারর সংক্ষেপ হলো এই যে— প্রবালের কাছে ক্ষমা চায় মিথিলা। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত ও অনুতপ্ত। প্রবাল যেন তাকে আরেকটা সুযোগ দেয়। নিজেকে শুধরে নিয়ে আরেকবার প্রবালকে ভালোবাসতে চায় সে।
প্রবাল তাকে সুযোগ দিয়েছিলো এবং এই ঘটনার প্রায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মিথিলার জোরাজুরিতে পড়ে তাকে বিয়েও করে ফেলল।
৫।
বিয়ের পর মাস খানেক ভালোই চলল। এরপর একরাতের কথা।
প্রবাল মিথিলার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। মিথিলা প্রবালের চুলে আলতো করে বিলি কাটতে কাটতে বললো, ‘ তোমাকে একটা কথা বলার ছিল...।'
প্রবাল চোখ না খুলেই বলল, ‘বলো।'
মিথিলা আমতা-আমতা করে বলল, ‘ না মানে... আগে তুমি কথা দাও, কথাটা শুনার পর রাগ করবেনা!'
প্রবাল এবারো চোখ না খুলেই বললো, ‘ আমি তোমার উপর কখনোই রাগ করতে পারিনা— কথাটা তুমি ভালো করেই জানো। সুতরাং এতো ভনিতা না করে কী বলবে সোজাসুজি বলে ফেলো তো।'
মিথিলা তখনো আমতা-আমতা করছে, ‘ না মানে... এবারের ব্যাপারটা আসলে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি জানি, কথাটা শুনলেই তুমি ক্ষেপে যাবে। আচ্ছা আগে আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও— কথাটা শুনার পর তুমি রাগ করবে না, প্লিজ!'
প্রবাল উঠে বসল। তারপর একমুখ হাসি নিয়ে দু'হাতে আঁজলা ভরে মিথিলার আনত মুখটা তুলে ধরে বলল, ‘ কসম করতে হবে না, তুমি বল। বললাম তো রাগ করবো না। তুমি কি, আবার আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছো, হুঁ?'
মিথিলা তড়িঘড়ি করে প্রবালের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘ না না— তা না। আমি কি সেটা বলেছি নাকি?'
‘ তাহলে কি সেটা? বলো আমাকে?'
অধৈর্য শুনালো প্রবালের গলা।
মিথিলা মাথা নিচু করে প্রায় শুনা যায় না এমন- আস্তে করে বলল, ‘ আমি প্রেগন্যান্ট...।'
এটুকু বলেই থেমে গেলো সে। আর বলতে পারল না। প্রবাল বেশ কিছুক্ষণ মিথিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ এটাতো খুশির খবর। এতে এতোটা নার্ভাস হওয়ার কি আছে?'
মিথিলা এবার খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল, ‘ আহ্! তুমি বুঝতে পারছো না! আমি প্রেগন্যান্ট তাও প্রায় তিন মাস হয়ে গেছে, আর তুমি...?'
প্রবাল মিথিলার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘ হুম, তো? তাতে সমস্যা কি? '
মিথিলা এবার কেঁদে ফেলল। ‘ আমি তিনমাস ধরে প্রেগন্যান্ট, আর তুমি সমস্যা খুঁজে পাচ্ছ না? তুমি বুঝতে পারছ না আমি তোমাকে ঠকিয়েছি? আমি অপরাধ করেছি, আমাকে শাস্তি দাও প্লিজ! প্রতিটা দিন এই অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে! নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি— আর পারছি না। তোমার মত একজন মানুষকে আমি ঠকিয়েছি, আমার তো নরকেও যায়গা হবে না! আমাকে তুমি শাস্তি দাও প্লিজ, আমাকে তুমি শাস্তি দাও!' শেষের দিকে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটা!
৬।
মিথিলাকে এভাবে কাঁদতে দেখে প্রবালের মনটাও খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা বারবার খাটের রেলিঙের সাথে মাথা ঠুকছে! প্রবাল কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছে না। শেষমেষ সে জোর করে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কাকুতির সুরে বলল, ‘ দেখ আমি তো বললাম ব্যাপারটা নিয়ে আমার সমস্যা নেই, তাহলে তুমি খামাখা এমন করছ কেন? তোমার সন্তান কি আমার সন্তান নয়? তোমার সন্তান মানে তো আমারো সন্তান।'
প্রবালের কথা শুনে ফুঁসে উঠলো মিথিলা! 'এই জন্যেই তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। তুমি আসলেই একটা অপদার্থ! একটা পাগল! শুধু অপদার্থ-ই না, অন্ধ-ও! এইটুকু জানো না যে কাউকে অন্ধের মতো ভালোবাসতে হয় না। আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতে কে বলেছে তোমাকে? তোমার এই অন্ধ ভালোবাসার কারণে বিরক্ত হয়ে একদিন তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্য গিয়ে কি লাভ হলো? সেইতো একটা আপদ পেটে নিয়ে তোমার কাছেই ফিরে আসলাম।'
প্রবাল মিথিলাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ তাতে তো আমারই লাভ হলো। আমি আবার তোমাকে ফিরে পেলাম, হা হা হা!'
প্রবালকে হাসতে দেখে মুখ ঝামটা দিল মিথিলা। ‘ খবরদার! একদম হাসবে না! হেঁ হেঁ হেঁ! যেনো উনি খুব জিতেছেন! খুশিতে একেবারে হেঁ হেঁ হেঁ শুরু করেছেন!'
তারপর গলার স্বর খুব তরল করে বলল, ‘ নিজের ভালো কি কোনদিনই বুঝবে না? অন্যের সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিচ্ছ! এতো বোকা কেনো তুমি? এতো বোকা কেনো?'
বলতে বলতে আবারো কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটা।
প্রবাল মিথিলার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘ দেখো, সবাইকে চালাক হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই, তাই না? আমাদের মত লোক না থাকলে তোমরা বোকা বলতে কাদের কে বলো? বোকা বলার লোকই তো খুঁজে পেতে না। তাছাড়া চালাক মাত্রই তো একজন আরেকজনকে ঠকানোর চিন্তা করে। এদিক দিয়ে তোমার কোন চিন্তা নেই, আমি তোমাকে কখনো ঠকানোর চিন্তা করবো না। আর অন্যের সন্তান কেন বলছ? এটাতো তোমারো সন্তান। তোমার সন্তান মানেতো আমারো সন্তান। আমি কি তোমার পর, বলো? এখন এক কাজ করো, এসব আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দাও। তারচেয়ে বরং আসো আমরা আমাদের বেবির জন্য খুব সুন্দর একটা নাম ঠিক করে ফেলি। আচ্ছা ভালো কথা, বল তো, আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে? আমার তো মেয়ে পছন্দ, তোমার?'
মিথিলা চোখমুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ চুপকরো! বোকার হদ্দ কোথাকার! ঘুমাও। এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।' বলেই বেড-লাইট নিভিয়ে দিয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। প্রবাল-ও আর ওকে ঘাঁটালো না। সে নিজেও অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজতেই নিজের অজান্তে চোখ থেকে টুপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ঘর ভর্তি অন্ধকার। ভাগ্যিস ব্যাপারটা মিথিলার চোখে পড়েনি। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো— আরে! আজ এতো অন্ধকার কেন! আজ কি অমাবস্যা?
অন্ধকার তার একদম ভালো লাগে না।
৭।
মিথিলার নিশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে। ঘুমের ঘোরে সে প্রবালের দিকে ফিরলো। প্রবাল সেটা খেয়ালও করলো না। তাইতো মিথিলার একটা হাত প্রবালের পিঠে লাগতেই চমকে উঠলো সে।
নেবে না নেবে না করেও মিথিলাকে বুকের ভেতর টেনে নিলো সে। ঘুমের মধ্যেই মৃদু শব্দ করে প্রবালের বুকে মুখ গুঁজে দিলো মেয়েটা।
প্রবালের বুক চিরে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো। দীর্ঘশ্বাসটা সুখের না দুঃখের প্রবাল জানে না। শুধু জানে মানুষের মস্তিষ্কে অক্সিজের অভাব হলেই কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায়, পারে না। গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে আঁটকে আছে! সে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। আজ কি আসলেই অমাবস্যা? মিথিলার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায় সে। ধবধবে ফর্সা মুখটা আবছা আলো হয়ে আছে। হঠাৎ তার মনে হয়— সে বুঝি একটুকরো জোছনা বুকে নিয়ে শুয়ে আছে! জোছনার আড়ালে অমাবস্যা থাকে। তারও আছে। সুতরাং অন্ধকার নিয়ে এতো চিন্তা করার আসলেই কিছু নেই।
ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে তার মনে হতে থাকে— প্রতিটা মানুষই তো জোছনার মতো, একপিঠ আলো, আরেকপিঠ অন্ধকার।
=====
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ৩:৫১