জেবতিক যেমন তার উপন্যাসখানা না লিখলেও পারতেন তেমনি আমিও এই লেখাটি না লিখলেও পারতাম। অনেক দোনমনা করে লিখেই ফেললাম। ন্যাংটো রাজার গায়ে চমৎকার রেশমী পোষাক আবিস্কার করে ও তার সৌকর্যে মুগ্ধ হয়ে যে বা যারা স্তুতি করেন তাদের কোন ক্ষতি না হলেও রাজার ন্যাংটোত্ব কিন্তু ঠিকই প্রলম্বিত হয়। এ কারণে দারুন কিছু লেখার স্রষ্টা জেবতিকের উপন্যাসের ব্যাপারে নিস্পৃহ থাকা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না।
’ধুলি মাখা চাঁদের’ ডাকে সাড়া দিয়ে অর্থাৎ খরিদ করে এবং পাঠ করতে আরম্ভ করে কোন বাঁধা পেতে হয় না। এক নিঃশ্বাসেই পড়ে ফেলা যায়, কারণ কোন কিছুই ভাবায় না, পোড়ায় না। উপন্যাসটি নায়ক প্রধান। আনিস এবং দীপুকে কেন্দ্র করে এর গল্প আবর্তিত হয়েছে। বদরুল, তওহীদ, মির্জা, জয়ীতা, সেঁজুতি সহ আরো কিছু চরিত্র এসেছে। পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সুস্থ্য জীবনে ফিরে আসে আনিস। কিন্তু অন্ধকার জীবনের পুরোনো ঘটনাপ্রবাহের জের তাকে ছাড়ে না। উচ্ছাস নামের একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মী দীপু। সাংস্কৃতিক জগতকে ঘিরেই তার যত স্বপ্ন, প্রেম আছে একটি অনুষঙ্গ হয়ে। উচ্ছাসের বিকশিত রূপ আতঙ্কিত করে তোলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও মৌলবাদীদের। নানা ঘটনার ঘনঘটা পেরিয়ে দীপু জীবন দেয়। পুরোনো অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েও আনিস ব্যর্থ হয় দীপুর জীবন বাঁচাতে।
এরকম ঘটনা নিয়ে আরো কয়েক গন্ডা উপন্যাস লেখা হয়েছে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। জেবতিক এটাকে কতখানি শিল্পিত করতে পেরেছেনে, বা জীবনবোধ ও সময়কে তা কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে সেটাই মূখ্য। এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই এবং জেবতিকের লেখা যারা পছন্দ করেন তাদের জন্য এ উপন্যাসে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোন কিছুর সুযোগ নেই। ছাত্র রাজনীতির মত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এ উপন্যাসের অন্যতম অনুঘটক। এ নিয়ে আলাপ পাড়তে গেলে অবশ্যই লেখকের কিছু ইতিহাস বোধের পরিচয় দিতে হয়। আমাদের তরুণরা তো আর এমনি এমনি বিপথগামী হয়নি। তার অনিশ্চয়তা, প্রতিদিনকার অস্থিরতা ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতার যে রূপ এখন বাস্তব; সে বাস্তবের পেছনে আর কোন বাস্তব নেই? লেখক চরিত্র গুলোর মুখ নি:সৃত সংলাপ দিয়ে লাইনের পর লাইনের মনোটোনাস ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাবেন কিন্তু সময় ও বাস্তবের কাঁটাছেড়ায় পাঠককে অংশগ্রহণ করাবেন না আদৌ, এরকম উপন্যাস অন্য কেউ লিখতে পারেন কিন্তু জেবতিক কেন?
যদি মেনে নেই, এটি একেবারেই বর্ণনাধর্মী উপন্যাস যেখানে গল্পটাই মুখ্য তাতেও সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। জেবতিকের উপন্যাসের শেষাংশে যখন দীপু মারা গেল, এ জায়গাটির বর্ননায় লেখকের দায়সারা ভাব রীতিমত পীড়া দিয়েছে। ’মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল বা কেউ একজন বলল, দীপুকে মেরে ফেলেছে শুয়োরের বাচ্চারা, আনিস টের পেলো তার পায়ের নীচে মাটি সরে যাচ্ছে’ এরকম দু’চার লাইন দিয়ে উপন্যাস শেষ করা হল। শেষ হল ’তাকে ডেকেছিল ধুলিমাখা চাঁদ’ এর ডাক। দূর্মুল্যের বাজারে নগদ আশি টাকা খরচ হয়েছে বলে নয়, ’ধুলিমাখা চাঁদের ডাক শেষ করে চাঁদ খুঁজে না পেয়ে শুধু ধুলি ঝাড়তে হয়েছে বলেও নয়; আমি চিন্তিত একজন সম্ভাবনায়, সৃষ্টিশীল লেখকের গাঁজোয়ারি মানসিকতায়।
এ কারণেই এ লেখার শেষ একটি পূনরোক্তি দিয়ে, ’ আরিফ জেবতিক এই উপন্যাসটি না লিখলেও পারতেন।’
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৩:০৬