somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবন সায়াহ্নের হালখাতা

০৮ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘বদ্দা এন্ডে সফিক সাবর কবর হন্যান, হইত্তারিবেন্না?’
প্রশ্নটি শুনে গ্রামের অল্প ব্যস্ত চায়ের দোকানী বয়স্ক লোকটা মাথা তুলে চেনার চেষ্টা করে মাঝ বয়সী আগন্তুককে। চিনতে ব্যর্থ হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে ‘হন সফিক সাব?’
‘বছর পঁচিশ আগে এক্সিডেন্টত মারা গেইলদে?’
‘অ, চৌধুরী বাড়ির সফিক সাব! সাম্মর চৌধুরী বাড়ির কবরাস্থানত জারুল গাছ জিবা আছে ইবার উত্তর ঢাহদ্দি বাধাইন্যা ইবা’।

দোকানীর নির্দেশনামত সামনে এগিয়ে যান নাজিম সাহেব,সাথে তার ২৮ বছর বয়সী পুত্র শাফিন। অনেক আগে একবার এখানে আসা হয়েছিল কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কবরের অবস্থান সঠিক মনে নেই। শাফিন বাবার মুখে হঠাত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা শুনে একটু ঘোরের মধ্যে আছে তাই এখানে কি নিয়ে কথা হয়েছে তা খেয়াল করেনি। বাবাকে অনুসরণ করে হেঁটে চলছে আর ভাবছে কিছু একটা রহস্য ঘনিয়ে আসছে মনে হচ্ছে।

শাফিনের মা চট্টগ্রামের স্থানীয় মেয়ে হলেও শুধু বাবারবাড়ির আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কারো সাথে আঞ্চলিক ভাষার বিন্দুমাত্রও ব্যবহার করতনা। আর দাদাদাদি বহু আগে অন্য জেলা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এখানে সেটেল্ড, তাই বাবার মুখ থেকে কখনো কোন আঞ্চলিক কথা শোনা যায়নি। শাফিন গত রাত থেকেই কিছু একটা রহস্যের আঁচ পাচ্ছিল যখন শুক্রবারের ছুটির দিনে বাবার নির্দেশে সদ্যবিবাহিত স্ত্রী স্নিগ্ধাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। বাবা শাফিনকে নিয়ে কোথাও বের হবেন বললেও নির্দিষ্ট করে কোথায় যাবেন তা বলেন নি, শাফিনও জানার চেষ্টা করেনি।

জারুল গাছের পাশে বাঁধানো একটা কবর, পুরোনো হলেও দেখে বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে এর যথেষ্ট পরিচর্যা হয়। কবরের মাথার দিকে শ্বেত পাথরে কালো অক্ষরে খোদাই করে লেখা,
মরহুম সফিকুর রহমান চৌধুরী
পিতাঃ আলহাজ মজিবুর রহমান চৌধুরী
জন্মঃ ১৩ই জুন, ১৯৭৭
মৃত্যুঃ ৫ই এপ্রিল, ২০০৮


তথ্য দেখে বুঝা যায় মৃত ব্যক্তি অল্প বয়সে গত হয়েছেন এবং মৃত্যুকালে তাঁর পিতা জীবিত ছিলেন। নাজিম সাহেব কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন কবরের পাশে, শাফিনও পাশে দাঁড়িয়ে বাবার কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করছে। কবরস্থানের মাঝারি আকারের গাছগুলিতে বিভিন্ন ধরণের পাখির কলকাকলি ভেসে আসছে।
‘শাফিন’
‘জি, বাবা’ শাফিন বাবার মুখের দিকে তাকায়। বাবা তার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে মুখের দিকে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর কবরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘তুই এখন পর্যাপ্ত বড় হয়েছিস, পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিস, সংসার শুরু করেছিস, এখন জীবনের মূলধারায় আছিস, আজ তোকে আমি বেশ কিছু কথা বলব যা জানানো অনেক জরুরী, আমি আশা করছি আর অতীতের কিছু দুঃখের কথা জেনে ভেঙ্গে পড়বিনা’।
‘বাবা, তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছিনা, তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার’ শাফিনের কন্ঠে কাঁপা একটা ভাব চলে আসে অজানা কিছু শঙ্কায়।
‘এই যে সফিকুর রহমান চৌধুরী, ইনিই তোর জন্মদাতা পিতা’ কথাটা বলে নাজিম সাহেব একটু থামেন, শাফিন এই অদ্ভুত উক্তির কোন মর্ম উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাজিম সাহেব আবার ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন ‘বাবা, তুই এখন যথেষ্ট বড় হয়েছিস, আমি এখন তোকে সব কিছু খুলে বলব। চল পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে গিয়ে বসি’ এই বলে তিনি পুকুর পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করেন, শাফিনও বাবার পিছু নেয়।
সকাল প্রায় দশটা বেজে গেছে, পুকুর পাড়ের জায়গাটা সম্পূর্ণ নির্জন আর শান্ত, মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সিঁড়ির এক পাশে একটা কাঠবাদাম গাছ বিশাল ছায়া ফেলেছে, শাফিন তার বাবার সাথে ছায়ার দিকটাতেই বসেছে কিছুটা দূরত্বে। সে মনে করতে পারছেনা এর আগে কখনও এরকম নিরিবিলি বাবার পাশে বসেছে কিনা। পুকুরের চারপাশে অনেক বড় বড় গাছ আছে, পুকুরের পানির প্রায় অনেকটাতেই ছায়া পড়ে আছে। বর্ষার শুরুতে পুকুরের পানি প্রায় ভর্তি, পানিতে দলবেঁধে নাইলোটিকার ঝাঁক খাবি খাচ্ছে মহানন্দে। একটু দূর গিয়েই সবগুলা একসাথে পানির উপর লেজের নাচুনি দিয়ে ডুবে যাচ্ছে।

‘শাফিন’
‘বাবা’
‘কাছে এসে বস’ শাফিন পাশে গিয়ে বসে বাবার মুখের দিকে তাকায়। বাবা বলেন ‘স্মরণকালে কি তোর কখনও মনে হয়েছে এমন কিছু, যা আমি একটু আগে বললাম?
‘না বাবা, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা, সানি আর শম্পাও তো আমার ভাইবোন!’
‘তবে তোর মায়ের কাছে এতটুকুই আমার সাফল্য যে আমি তোকে নিজের ছেলের মত আদর শাসন দিয়ে লালনপালন করতে পেরেছি, আমি তোর জন্মদাতা পিতা নই, কিন্তু আমার জীবনের জন্য এটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে তুই কখনও যেন ভাবতে না পারিস আমাদের পরিবারে তুই আলাদা কিছু।’

শাফিন আর কিছু ভাবছেনা, অপেক্ষা করছে যা বলার বাবাই বলুক, সে শুধু শুনে যাবে। এই সময়ে কথাগুলো সত্য হোক আর গল্প হোক নিজের কাছে মেনে নেয়া আর না নেয়া একই কথা। সে জানে তার বাবা মা দুজনে পৃথিবীর সেরা মা-বাবা, স্মৃতি হাতড়ে যতদূর মনে পড়ে কখনও পরিবারে এমন কিছু ঘটতে দেখেনি যার জন্য সে আজকের এসব কথার অপেক্ষা করতে পারে। বড় ছেলে হিসেবে ঐ বাবা-মার বেশি কাছাকাছি ছিল, অন্যদের তুলনায় সবসময় কিছুটা বেশিই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। সুতরাং জন্মদাতা বা পালক এখন স্রেফ আলমারিতে তুলে রাখা শোপিসের মত তথ্য। বাবা তাকে তাঁর জীবনের অতীত অধ্যায়গুলি বলতে লাগলেন।
‘আমি পড়াশোনা শেষ করে সবে কর্মজিবনে প্রবেশ করেছি, বাবা মা আত্মীয়রা সবাই আমার বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি শুরু করেন, এ ব্যাপারে আমার বোন মানে তোর ফুফুর আগ্রহটাই ছিল বেশি। ও আমার জন্য অনেক পাত্রী দেখেছে কিন্তু আমাকে শত অনুরোধ করেও কোথাও নিতে পারেনি। আসলেই তখন আমি বিভিন্ন বিবেচনায় নিজেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত ভাবতে পারছিলামনা। তখন আমার লক্ষ্য ছিল একটাই, বেশ কিছু টাকা পয়সা উপার্জন করে বাবা-মার সীমাবদ্ধতাগুলির সমাধান করা। বাবা যদিও কখনও এভাবে কিছু বলেন নি আমাকে, তবু আমি জানতাম বাড়িতে টানাটানি লেগে আছে। আর আমিই পরিবারের বড় ছেলে, তাই খুব দ্রুত নিজেকে অর্থনৈতিক হাল ধরতে হবে। বিভিন্নভাবে আমাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে একসময় সবাই মোটামুটি ক্ষান্ত দিলেন এই কাজ থেকে, আমিও নিস্তার পেয়ে নিজের কাজে একাগ্রচিত্তে মনোযোগ দিলাম।
তুই তো তোর রাসেদ মামাকে চিনিস! আগে থেকেই ও আমার বন্ধু, আমার বাড়িতেও ওর যাতায়াত ছিল উন্মুক্ত, আমিও ওদের বাড়িতে যেতাম মাঝেমধ্যে। আমাদের দুই পরিবারই রক্ষণশীল মনমানসিকতার ছিল যা এখনও আগের অবস্থানেই আছে। ওই একদিন হঠাত আমাকে প্রস্তাব দিয়ে বসল যাতে আমি একটা মানুষের, একটা পরিবারের উপকারার্থে নিজের কিছু ত্যাগ স্বীকার করে নেই। আমি সেটা ভালো বুঝতে পারিনি, জানতে চাইছিলাম আসলে সে কি বলতে চাইছে। তখন সে আমাকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্য বলল ‘কিছুদিন আগে তোকে বলেছিলাম আমার এক ভগ্নীপতি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে’। ব্যাপারটা আমার মনে পড়ল, ঘটনাটা তখন থেকে প্রায় ৬-৭ মাস আগের, আমি তার কথায় সায় দিয়ে বিস্তারিত বলতে বললাম। তখন সে বলল ওর দেড় বছর বয়সী একটা বাচ্চা আছে, এখন চাচা-চাচি চাচ্ছেন ওকে আবার বিয়ে দিতে। ওর শ্বশুর শাশুড়িও এটাই করতে বলছেন কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা। ওর একটাই কথা, বিধবা হয়ে এখন আরেকজনের অনুগ্রহের পাত্রী হওয়ার চেয়ে ছেলেটাকে মানুষ করার জন্য বাকি জীবন একা কাটিয়ে দেয়াই ভালো। বাবা মা যেন তাকে এতটুকুই আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় এটাই তার একমাত্র কামনা। কিন্তু বাস্তবতা তো অত সরল সমীকরণ না যে একটা সুত্র দিলেই সমাধান হয়ে যাবে।

রাসেদ কি বলতে চাইছে তা আমার কাছে আর অস্পষ্ট রইলনা, হঠাত নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে একটা মেয়ের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে নিজে মেয়ে না হলেও কিছুটা অনুভব করার ক্ষমতা আমার ছিল। জীবনের ঐ পর্যায়ে স্বাধীনভাবে নিজের জীবন নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়ার মত অবস্থা আমার ছিলনা, পরিবার পরিজনের কথা মাথায় না রাখলে সেটা কিছুতেই সামনে এগুবেনা, আবার কতটা নির্ভরতা থাকলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমার কাছে এটা আশা করতে পারে। তাকে বললাম বাবা-মার কথা, তার মুখে হঠাত একটা ঝলকানির মত কিছু একটা দেখলাম। সে বলল ‘তোর বাড়িতে আমি কথা বলে এসেছি, উনাদেরকে আমি বুঝিয়ে বলায় উনারা অনাপত্তি জানিয়ে সব কিছু তোর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তোর বোনের সাথেও আঙ্কেল আন্টি কথা বলেছেন, সেও সব শুনে অনাপত্তির জানিয়েছে। এখন তোর কিছু বলার থাকলে বলে ফেল আর আমি জানি তুই যাকে বিয়ে করবি তার সাথে আগেই বোঝাপড়ায় যাবি, যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি ওকে রাজি করিয়ে তোর সাথে আলাপের ব্যবস্থা করি’।

জীবনে এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়ার চিন্তাও কখনও ছিলনা, আর এই মুহুর্তে আমি দ্বিমত করার ও কোন সুযোগ পেলামনা। ও যেহেতু বলছে বাবা-মার সাথে কথা বলেছে তার মানে তাঁরা এতেও হয়তো কিছু ভালো দেখেছেন। এরপরেও আমি বাড়িতে বাবা-মার সাথে কথা বললাম, জানতে চাইলাম তারা কি বুঝে এতে সম্মতি জানিয়েছেন। বুঝতে পারলাম মুখ্যভাবে একমাত্র মানবিক দিক আর গৌণভাবে আমাকে সংসারী করার যেকোনো একটা উপায় হিসেবেই তাঁরা ভাবছেন। তোর মাকে বুঝাতে তাদের একটু বেগ পেতে হয়েছে তা আমি স্পষ্ট বুঝলাম, কয়েকদিন পরে রাসেদ আমাকে সন্ধার পর একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলল, সেখানে রাসেদের সাথে তোর আম্মু আর তোর মামি মানে তার স্ত্রীও ছিল। তোর মায়ের সাথে তখন বেশি কিছু বলার মত ছিলনা এখানে, যেহেতু সবকিছুই জানা আর তাকে চাপে ফেলার মত ইচ্ছা ছিলনা আমার। জানতে চাইলাম সে আমাকে কিছু বলতে চায় কিনা, সে আমাকে শুধু বলল তোকে নিজের সন্তান ভেবে দায়িত্ব নিতে পারলে আর কিছুই তার চাওয়ার নেই, সে যেকোনো প্রকার ত্যাগ করতে ইচ্ছুক। তার কথায় বুঝতে পারলাম সে পরিবারের চাপাচাপিতেই নিরুপায় হয়ে রাজী হয়েছে। এটা আমার কাছে খুব অস্বস্তিকর ছিল। তাকে বললাম ‘যদি আপনার অতীতকে ভুলে সবকিছুই বর্তমান ভেবে নিতে পারেন তাহলে আমি আপনার সমস্ত দায়িত্ব নেব। আর আপনার পরিবার সম্বন্ধে যতটুকু জানি, কম্প্রোমাইজ প্রসঙ্গে আমার কিছুই বলার দরকার নেই’।

তখন আর বিশেষ কিছুই আমার বলার ছিলনা, পরে রাসেদ তোর দাদাদাদি আর নানানানি সবার সাথে কথা বলে সবকিছু পারিবারিকভাবে সমাধা করল। চট্টগ্রামের কিছু ট্রাডিশন আছে জামাইর বাড়িতে উপহার পাঠানোর বেশ আড়ম্বর করার, আমি সরাসরি জানিয়ে দিলাম এসব কিছু আমার সাথে যেন না হয়। আমার যতটুকু আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তোর মাকে তো এখনও আমার কাছে সেদিনের মতই মনে হয়, তাকে পেয়ে আমার ভাগ্যই হেসে লুটোপুটি খেল পায়ের উপর। আমার ঘর সংসার, অর্থনৈতিক অবস্থা সবকিছুই নিজের অনুকুলে চলে আসল। সে আমার জন্য অসম্ভব কিছু পাওয়া। সেই দেড় বছর বয়স থেকে আমার বাড়িতে তুই আজ পর্যন্ত বড় নাতি হিসেবেই ছিলি, বাবা মাকেও কখনও ভিন্ন কোন আচরন করতে দেখিনি আমি। আর তোর মাকেও আমি যতটুকু সাধ্য চেষ্টা করেছি অতীত ভুলে সবকিছু বর্তমান করে নিতে। আমার কাছে আমার তিন সন্তান সমধিক প্রিয়। প্রথম দিকে মাঝেমাঝে তোর কাকা আর দাদাদাদি আমাদের বাড়িতে আসত তোকে দেখতে, পরে তোর আর তোর মায়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এটা বন্ধ করে দেয় পাছে তোর বুঝার বয়স হলে প্রশ্ন করে বসিস!’

শাফিন বাবার দীর্ঘ বর্ণনা শুনে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। সূর্য মাথার উপর এসে গেছে অনেকটা, যদিও গাছের ছায়ায় বসায় গরম লাগছেনা তাদের। নিজের অতীত স্মৃতিকে ঘেঁটে দেখার চেষ্টা করে ও, এমন কিছু নিজের জীবনে জড়িয়ে আছে ভাবতেও পারেনি কখনও। সেই ছোটবেলা বেলা থেকেই দেখে আসছে বাবামার সুখী সংসার, সবসময় সবাই হাসিখুশি। বাবার কর্মজীবনের ব্যস্ততা আর মায়ের সংসার, দাদাদাদির কোলে থেকে তার খেলাধুলা, কোনভাবেই ভাবতে পারছেনা উনারা তার প্রকৃত দাদাদাদি নয়। ফুফুও তাকে অনেক আদর করে, এখনও বাড়িতে আসলেই বুকে জড়িয়ে ধরেন। আর এমন হলেত নানুর বাড়ির দিকে আম্মুর বাড়তি ঝোঁক থাকত অথচ আম্মু সেদিকে খুব কমই আগ্রহী ছিলেন। ছোটবেলায় স্কুল ছুটির কিছু দিনে নানুর বাড়িতে বেড়াত তাও বেশির ভাগ সময়ে বাবাকে ছাড়া, তাই সেটা খুব কম সময়ের জন্য ছিল। নানুর বাড়িতে অনেক প্রাচুর্য দেখেছে শাফিন, সেই তুলনায় বাবার বাড়িতে অনেক অনাড়ম্বরতা ছিল। এসবে আম্মুর স্বতঃপ্রণোদিত সাবলীলতা দেখে মাঝেমাঝে সে ভাবত বাবা-মা হয়তো ভালোবেসে সংসার শুরু করেছে। কিন্তু কখনও মাকে বা অন্য কাউকে এটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি।

‘শাফিন’
‘বাবা’
নাজিম সাহেব তার পুত্রের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন, ‘কি ভাবছ এত?’
বাবার প্রশ্নে একটু লজ্জিত হয় শাফিন, একটু নড়েচড়ে বসে বাবার কথার অপেক্ষা করে। বাবা আবার শুরু করেন, ‘আমার আপত্তি সত্ত্বেও তোমার নানুর বাড়ি থেকে তোর আম্মুর নামে অনেক কিছুই দেয়া হয়েছে। আমি আপত্তি করলে মনে হত সে খুব কষ্ট পাচ্ছে, চোখেমুখে একটা বিষণ্ণতা ফুটিয়ে রাখত তাই তার প্রশান্তির জন্য আমি একসময় এসব নিয়ে মাথা ঘামানো ছেড়ে দিয়েছি। পাছে আমি তাকে আমার সামর্থ্যে অখুশি ভাবি তাই সে এসব ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল। বাবা মা যাই দিতে চায় তা নিতনা, আমার আপত্তির কথা বলে হাসিমুখেই এড়িয়ে যেত অধিকাংশ সময়ে। তোদের পড়াশোনা আর সংসার খরচ আমিই সামলেছি। বাড়িভাড়ার দরকার ছিলনা, নিজের পৈত্রিক সেমিপাকা বাড়িতেই আছি সেই আগে থেকেই। তোর আম্মুর নামে ২টা ফ্ল্যাট আছে, তোর নানা উইল করে গিয়েছিলেন। তোর মা তোদের দুই ভাইকে দুইটা ফ্ল্যাট লিখে দেবেন আর আমার বর্তমান বাড়িটা শম্পাকে দেব। আর আমার সঞ্চয় যা আছে, তোর মায়ের নামে কিছু ফিক্সড ডিপোজিট ও আছে এসব যতটুকু খরচ হয় হল বাকিটা তোরা ভাগ করে নিস। তোর বিয়ে দিলাম, আরও খরচ করার ইচ্ছা ছিল আমার, কিন্তু তোর আম্মুর কারনে হয়নি, সে তার তিন সন্তানের কথা মাথায় রেখেছে। আশা করি যতটুকু করেছি, আল্লাহর রহমতে সবাই সন্তুষ্ট হয়েছে।

তোর মার অনেক ইচ্ছা ছিল তোকে আরও আগে এসব জানানোর, কারন তোকে এসব না জানানো মানে তো মিথ্যের মধ্যে রাখা, কিন্তু আমি নিষেধ করেছি। আমি চাইনি তোর জীবনের কোন বিশেষ সময়ে তুই আমাকে পর কেউ ভাবিস। এখন তোর জীবনে মোটামুটি একটা স্থায়ী অবস্থা এসেছে। তোর কাছে এখন আমার একটা চাওয়া আছে। তোকে আমি এসব জানানোর পর যাতে কোন প্রতিক্রিয়া না আসে। তোর মা জানবে যে তুই সব জেনেও স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিস। আর এতে হয়তো তার মধ্যে আর কোন অস্থিরতা কাজ করবেনা। এখন আমাদের বয়স হয়েছে, কতদিন আর বেঁচে থাকব, বড় ছেলে হিসেবে তোর সবকিছুই জানা থাকা দরকার। আমাদের প্রজন্ম আর তোদের প্রজন্মের মাঝখানে তো তুই মেলবন্ধন। কি, পারবিনা?'
'ঠিক আছে বাবা, তাই হবে। সবকিছুই তো জানলাম। আমার মধ্যে তো আর কিছু অপ্রাপ্তি নেই যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাব, আমিতো বাবার অভাব বোধ করিনাই। ভাগ্য এমন ছিল বলেই মাকে এত অস্থিরতার মধ্যে জীবন কাটাতে হয়েছে।'
'এখন চল তোর বাবার কবরে ফাতেহা পাঠ করে বাড়িতে ফিরব’ বলে নাজিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, শাফিন ও বাবার পিছু নিল। ঘুরে দাঁড়াতেই পিছনে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তারা। নাজিম সাহেব চিনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন কিন্তু ভদ্রলোক চিনতে পারলেন উনাকে। ‘আপনি নাজিম ভাই না?’
‘জি হ্যাঁ, আপনি মনে হয় শাফিনের কাকা!’ নাজিম সাহেবের কিছুটা মনে পড়ে।
‘জি, ওই কি শাফিন?’ বলে শাফিনের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। শাফিন বাবার দিকে তাকাতে বাবা সায় দিয়ে বললেন, ‘উনি তোর কাকা, ছোটবেলায় দেখেছিস এখন মনে নেই হয়তো’ বলে তিনি ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন। শাফিন কাকাকে সালাম দিল, নাজিম সাহেব উনাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তা, এদিকে হঠাত! গ্রামেই থাকছেন নাকি!’
‘না, আমিতো মাঝেমাঝে ভাইয়ের কবরে দোয়া পড়তে আসি, জুম্মার নামাজটা এখানেই পড়ি’।
‘ভালোই হয়েছে, আজ আমরা একসাথেই পড়লাম’ একটু আনন্দের সাথেই নাজিম সাহেব বললেন। তারপর তিনজনে একসাথে কবরস্থানের দিকে এগিয়ে গেল।

পাদটীকাঃ গল্পের প্লট ভবিষ্যতে, ২০৩৭ সালের দিকে অনুমিত। ভিন্নতা আনার স্বার্থে এভাবেই আমার গল্পের প্লট।
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×