somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যারা ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল

১২ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৮:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কবি আল মাহমুদ লিখেছেন-

আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরুহ, ( সোনালি কাবিন)

বাংলাদেশ সত্যিই জ্ঞানীর আতুড়। এখানে অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নিয়েছেন শত মহীরুহ।
তাদেরই একজন আচার্য শান্তিরক্ষিত।
আচার্য শান্তিরক্ষিতের জন্ম বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামে। হ্যাঁ। অতীশ দীপংকরও ওই বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামেই জন্মেছিলেন । অবশ্য, আচার্য শান্তিরক্ষিতের আরও তিনশ বছর পর।
আচার্য শান্তিরক্ষিত-এর জন্ম তাহলে সপ্তম শতকে, যেহেতু অতীশের জন্ম দশম শতাব্দীতে। হ্যাঁ। তাইই।
তো, কেমন ছিল সপ্তম শতক, বাংলায়, উত্তর ভারতে?
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলার পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের অংশবিশেষে গৌড় রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল। শশাঙ্কের নাম শুনে থাকবেন। ইনি গৌড়ে ক্ষমতা দখল করেন। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রাঙ্গামাটিতে তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে।
বর্তমান বিহারের মগধ রাজ্যটিও শশাঙ্কের গৌড় রাজ্যের অংশ ছিল! এবং শশাঙ্কই বাংলার প্রথম রাজা যিনি বাংলার ভৌগলিক সীমানা অতিক্রম করে বাংলার বাইরে বহূদূর অবধি আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন।
সেই সপ্তম শতকে উত্তর ভারত শাসন করতেন সম্রাট হর্ষবর্ধন।
শশাঙ্ক একটি উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে শশাঙ্ক এমন কী হর্ষবর্ধনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এদিক থেকে তিনি পরবর্তীকালের পাল বংশীয় রাজা ধর্মপাল ও দেবপাল এর আক্রমণাত্মক উত্তর ভারতীয় নীতির অগ্রদূত।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলায় বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। একেই বলে মাৎস্যন্যায়। যে কারণে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ অবধি গৌড়ের ইতিহাস অস্পস্ট। ওদিকে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর (৬৪৬/৬৪৭ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সাম্রাজ্যে নৈরাজ্য ও সংশয় দেখা দেয়।
ঠিক ওই সময়ে তিব্বতের যুদ্ধবাজ রাজা শ্রং-ছান-গেমপো বাংলায় ও উত্তর ভারতে পর পর বেশ কটি সামরিক কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন।
এমনই এক ঘোর অরাজক অবস্থায় তিব্বতে গিয়েছিলেন বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনি গ্রামের আচার্য শান্তরক্ষিত।
কেন?
বলছি। আচার্য শান্তরক্ষিত ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। সেই সময়টায়, অর্থাৎ, সপ্তম অস্টম শতকে শিবপন্থি ও বিষ্ণুপন্থিদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ থেকে অপসারিতে হয়ে যেতে থাকলেও বাংলা বৌদ্ধধর্মকে প্রায় একাদশ শতক অবধি আগলে রেখেছিল তার বুকে। বাংলার এই আশ্রয়ী ভূমিকা বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়।
আগেই বলেছি, তিব্বতের ক্ষমতাধর রাজা বাংলায় শ্রং-ছান-গেমপো পর পর কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে শান্তিবাদী ধর্মের প্রচার জরুরি ছিল। বৌদ্ধধর্ম তিব্বতের ভিতর দিয়েই চিনে গিয়েছিল তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে। কাজেই বৌদ্ধধর্মটা চিনে তখন ছিল। হয়তো কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল।
সপ্তম শতকের আচার্য শান্তরক্ষিত তিব্বতে শান্তিবাদী বৌদ্ধধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন।
সে যুগে তিব্বত যাওয়া কি অত সহজ ছিল? অবশ্যই না। তবু আচার্য শান্তরক্ষিত গিয়েছিলেন। বিপদসঙ্কুল পথ। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই গিয়েছিলেন শান্তরক্ষিত। যুদ্ধবিধস্ত অস্থির সময়টাকে শান্ত করতেই গিয়েছিলে। তিব্বতবাসীকে এই কথাই বলতে গিয়েছিলেন -যুদ্ধ নয়, আজ শান্তি চাই। আর শোনো- শান্তি এক জরুরি বিষয়। যুদ্ধ করে কি লাভ বল-আর আমি শান্তিময় একটি দেশ থেকেই এসেছি। আমার গ্রামের দক্ষিণে যে নদীটি প্রবাহিত- তার নাম পদ্মা, ওই নদীতে যে সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়, তার নাম ইলিশ।
ইলিশ?
হ্যাঁ। ইলিশ।
আর পুবের নদীটির নাম মেঘনা, ওই মেঘনা নদীর পাড়ে চন্দ্রপুর নামে এক নৌ-ঘাট আছে, অর উত্তরের নদীর নাম ধলেশ্বরী ...ওখানেই তো শীতলক্ষ্যা নদী আর স্বর্ণগ্রাম।
স্বর্ণগ্রাম? তিব্বতী কিশোরীটির চোখে প্রগাঢ় বিস্ময়।
হ্যাঁ, স্বর্ণগ্রাম। আমার দেশের নাম যে স্বর্নবঙ্গ। ভিজা মাটির দেশ, জলের দেশ আর মাছের দেশ। তারপর বৃদ্ধ শান্তরক্ষিত ফিসফিস করে বলেন-

আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরুহ,

অজানা ভাষা শুনে তিব্বতী কিশোরীটির চোখে প্রগাঢ় বিস্ময়। শান্তদাদু মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে বোঝা যায় না। তখন বেলা পড়ে এসেছে। ওরা দুজন সেই দুপুর থেকে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে ছিল। ওদের ওপর ঝরে ঝরে পড়ছিল সপ্তম শতকের রোদ। প্রাঙ্গনে একটা দীর্ঘ কৃষ্ণচূড়া গাছ, তলায় তার অজস্র শুকনো পাতা। সময়টা শেষ অগ্রহায়ন। শীত আসছে। বাতাসে শীতের মৃদু কামড়। দূরের পবর্তশীর্ষে শেষবেলার রক্তিম রৌদ্রালোক প্রতিফলিত। শান্তরক্ষিত সেদিকে তাকিয়ে ভারি অন্যমনস্ক হয়ে যান।
কিশোরীটি আদুরে গলায় বলল, শান্তদাদু?
কি রে নরবু।
তুমি আমাকে তোমার ভিজে মাটির জলের মাছের দেশে নিয়ে যাবে? কিশোরী নরবু গাঢ় স্বরে বলল।
এই কথায় শান্তরক্ষিতএর চোখে জল জমে। তিনি দূরের পবর্তশীর্ষে প্রতিফলিত শেষবেলার রক্তিম রৌদ্রের দিকে তাকালেন। তারপর ফিসফিস করে যা বললেন তা আজ আর এত বছর পর জানা যায় না।
সেই সপ্তম শতকে আচার্য শান্তরক্ষিত শান্তিবাদী বুদ্ধবাণী নিয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন । আমাদের মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগীনি গ্রামের একজন জ্ঞানী মানুষ। ভাবলে কেমন যেন লাগে। বারবার আল মাহমুদের কবিতা মনে পড়ে। বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড় ...
একজন প্রখ্যাত বাঙালী গীতিকার/সুরকার গেয়েছেন-

কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল
সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল।

যারা ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল- সপ্তম শতকের আচার্য শান্তরক্ষিত তাদেরই একজন।

তথ্যসূত্র:

(ক) একরাম আলি: অতীশ দীপংকর।
(খ) বাংলাপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৩০
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×