প্রথমে একটু অস্বস্তি হবে। ঠিকভাবে দেখার জন্য দুই ডান্ডার দুপাশে লাগানো ছোট্ট নবগুলো একটু ঘুরিয়ে নেবেন। এভাবেই নবগুলো ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে ফোকাস অ্যাডজাস্ট করতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে আসবে।
কৌতুহলের কাছে সব সময়ই দ্বিধার পরাজয় হয়। এর ফলাফল হিসেবে একটা কিম্ভুত চশমা পড়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে সোহেল। শুধু তাই নয়, এই খ্যাপা লোকটির নির্দেশ মেনে চশমার ডান্ডার দুপাশের নবগুলোও নেড়েচেড়ে দেখছে। এখন নিজেকে কেমন একটু বোকা বোকা লাগছে।
বিকেলের আলো মরে গিয়ে অন্ধকার নেমেছে বেশ খানিকণ। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ; প্রতিদিন কমপে দুই কিলোমিটার হাঁটতে হবে। সকালে সময় হয় না, তাই বিকেলে অফিস শেষে হাঁটতে বের হয় সোহেল। আজও স্বাস্থ্যরার জন্যই বাধ্যতামূলক সান্ধ্য ভ্রমনে বের হয়েছিলো। এ সময় এই অদ্ভুত মুর্তির সঙ্গে সাক্ষাত। মফস্বল শহরের এদিকটা একটু নিরিবিলি।
আবছা অন্ধকারে লোকটির বিচিত্র কান্ডকারখানা দৃষ্টি আকর্ষন করে সোহেলের। চোখে কিম্ভুত একটা চশমা পড়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে একাএকাই বিড়বিড় করছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুণ লোকটিকে পর্যবেণের পর তার মানষিক সুস্থ্যতা নিয়ে সন্দেহ জাগে সোহেলের মনে। একটা ঝাকড়া কাঁঠাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে দিব্যি একা একা কথা বলে যাচ্ছে। কখনো হাসছে, কখনোবা ভয়ে শিউরে উঠছে। পরিষ্কার পাগলের লণ। এই অন্ধকারে একটা পাগলের মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায় সোহেল। এ সময় চশমাটি খুলে গুটি গুটি পায়ে সোহেলের দিকে এগিয়ে আসে লোকটি।
ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় সোহেল। যা বাব্বা! এর সঙ্গে আবার কখন পরিচয় হলো।
লোকটি নিজের ভুল শুধরে নেয়। ছি ছি, আমিতো নিজের পরিচয়ই দেইনি। আমার নাম প্রফেসব হিজবিজবিজ, নামটা শুনেছেন নিশ্চই।
অদ্ভুত এই নামটা কেমন চেনা চেনা লাগে। ভদ্রতা করে নিজের পরিচয় দেয় সোহেল, আমি সোহেল রহমান। ব্যাংকে চাকরি করি।
সোহেলের নামটি শুনেই দু হাতে নিজের পেট চেপে ধরে ঠা-ঠা-ঠা যাতীয় বিচিত্র শব্দ করে কিম্ভুত লোকটি হাসতে থাকে। কারো নাম শুনে যে মুখের উপর এভাবে হাসতে নেই, এটুকু ভদ্রতা জ্ঞানও লোকটির নেই। মনে মনে বেশ বিরক্ত হয় সোহেল। তার নামটি এমন কী খারাপ যে এভাবে শরীর কাঁপিয়ে হাসতে হবে। অথচ হওয়ার কথা ছিলো উল্টো। হিজবিজবিজ নামটা শুনেই বরং অনেক কষ্টে হাসি চেপেছে সোহেল। টানা দশ মিনিট একনাগারে হেসে থামলো প্রফেসর হিজবিজবিজ। হাসির চোটে দু চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখ মুছে একটু সুস্থির হন।
আপনার নাম সোহেল? তাহলেতো আপনাকে অবশ্যই আমার সদ্য আবিষ্কৃত যন্ত্রটি দেখাতে হয়।
প্রায় এক বছর হলো ছোট্ট এই মফস্বল শহরটিতে চাকরি নিয়ে এসেছে সোহেল। এর আগে কখনো এ লোকটিকে দেখেনি। এরকম গায়ে পড়া লোক এ শহরে আছে বলেও তার জানা ছিলো না।
মনে মনে বিরক্ত কলেও প্রফেসর হিজবিজবিজের কান্ডকারখানা বিচিত্র কৌতুহলের জন্ম দিচ্ছে। এ জন্যই জায়গাটি ছেড়ে চলে যেতে পারছে না সোহেল।
আমার নামটি কী এমন স্পেশাল যে নাম শুনেই আপনি আপনার এই অদ্ভুতুড়ে যন্ত্রটি আমাকে দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন?
আপনার নামের বিশেষত্বটা আপনার নিজেরই জানা নেই? নিজের নামের অর্থটাও জানেন না? কী আশ্চর্য। আপনার নাম হচ্ছে সোহেল। ভেঙ্গে বললে বলা যায় শো-হেল (show-hell), মানে হচ্ছে দোজখ দেখানো। এবার বুঝতে পারছেন? আমার এই যন্ত্রটি দিয়ে আপনি চোখের সামনেই দোজখ দেখতে পাবেন।
এতোক্ষণ লোকটির মানষিক সমস্যা নিয়ে যাওবা কিছু সন্দেহ ছিলো, এখন তা পুরোপুরি দূর হয়ে গেছে। এ লোকটির মাধার স্ক্রু-বল্টুগুলো রিসেট করতে হবে, কোনো সন্দেহ নেই।
সোহেল বলে, আমার নামের অর্থতো জানলাম। এবার আপনার হিজবিজবিজ নামটার শানেনুজুল ব্যখ্যা করবেন কী?
শৈশবে বাবা মা আমার নাম রেখেছিলো তোয়াব্বর মৃধা। কী অন্যায়। একটা শিশু এমন একটা নাম নিয়ে বেড়ে উঠেবে? কী ভয়ঙ্কর! একটু বড় হয়েই আমি বুঝতে পারি আমার সঙ্গে বিরাট অন্যায় করা হয়েছে। যে নামটাকে আমি সারা জীবন বয়ে বেড়াবো, সেটার উপরই আমার কোনো হাত থাকবে না? তোয়াব্বর মৃধা- এই নামে কোনো বিজ্ঞানী বড় হতে পারে? আপনিই বলুন। কৈশরেই আমি বুঝেছিলাম বিজ্ঞানী হওয়া ছাড়া আমার কোনো গত্যান্তর নেই। এটাই আমার নিয়তি। সে জন্যই সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত চরিত্র প্রফেসর হিববিজবিজের নামটি নিয়ে নিয়েছি।
এতোণে সোহেল বুঝতে পারে, কেন হিজবিজবিজ নামটা চেনা চেনা লাগছিলো। মনে মনে তোয়াব্বর মৃধা আর হিববিজবিজ নামদুটি নিয়ে নাড়াচারা করে এ দুটির মধ্যে কোনটি ভালো সেই সিদ্ধান্ত আসতে ব্যর্থ হয় সোহেল।
তোয়াব্বর মৃধা উরফে হিজবিজবিজ আরেকটু এগিয়ে আসেন। তার হাতে ধরা বিচিত্র যন্ত্রটি সোহেলের মনযোগ কেড়ে নেয়।
ভুতস্কোপ, বলে সোহেলের চোখের সামনে যন্ত্রটি তুলে ধরে প্রফেসর হিজবিজবিজ। এই যন্ত্রের সাহায্যে ভুতদের রাজ্যে অবাধ প্রবেশের সুযোগ মিলবে। এটি চোখে লাগিয়ে আমাদের চারপাশের অশরীরী সম্প্রদায়কে দেখতে পাবেন। তাদের সঙ্গে কথাও বলা যাবে। আমি এটার নাম দিয়েছি ভুতস্কোপ।
সোহেলের চোখে বোধ হয় কিছুটা অবিশ্বাসের দৃষ্টি ফুটে উঠেছিলো। সেটা লক্ষ করে কেমন যেন খেপে যান প্রফেসর। নানা খটমট শব্দ ব্যবহার করে যন্ত্রটার কার্যপ্রণালী এবং তৈরির কলাকৌশল ব্যখ্যা করা শুরু করেন। তার কথার তোড়ে হাঁপিয়ে উঠে সোহেল। এ যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি করে বলে উঠে, বুঝতে পারলাম, এটা একটা মহান আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের জোরেই একদিন নোবেল পুরষ্কার আপনার হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
সোহেলের কথার ব্যাঙ্গটুকু ধরতে পারে না প্রফেসর হিজবিজবিজ। বলেন, আরে রাখেন আপনার পুরষ্কারটুরষ্কার। আমি ওসবের ধার ধারিনা। নিজের মনে আবিষ্কার করে যাই। পুরষ্কারের আশা করলেতো এতোদিন আমার বাড়িতে নোবেল-টবেলের লাইন লেগে যেতো।
হিজবিজবিজের হাতে ধরা যন্ত্রটি থেকে কেমন একটা সুক্ষ্ণ শব্দ আসছিলো। ব্যপারটি সোহেলকে কৌতুহলী করে তোলে। একবার পরে দেখবো নাকি? পরণেই চিন্তাটা বাতিল করে দেয়। এই পাগলের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
সোহেলের মনের দ্বিধার ভাবটি ঠিক ধরতে পারে প্রফেসর হিজবিজবিজ। যন্ত্রটি এগিয়ে দিয়ে বলে, একবার ভুতস্কোপটা ট্রাই করেই দেখুন না। একদম নতুন অভিজ্ঞতা হবে। গ্যারান্টি দিচ্ছি।
অতপর বিকটাকৃতির চশমাটি সোহেলের চোখে শোভা পায়।
প্রথমে সব কিছু কেমন আবছা দেখায়। দুপাশের নব দুটি ঘোরাতেই আস্তে আস্তে চোখের সামনে অদ্ভুত লালচে আলো ফুটে উঠে। ছায়া ছায়া কিছু অবয়বের নড়াচরা টের পাওয়া যায়। আরে, কিম্ভুত চেহারার একটি মা ততোধিক অদ্ভুতাকৃতির তিনচি ছানা নিয়ে হুটোপুটি করছে। এটাকে তুলে আছাড় মারে তো ওটাকে কান ধরে ঝুলাতে থাকে। আরেকটিকে হয়তো চ্যাংদোলা করে বনবন করে ঘুরাতে থাকে। বাচ্চাগুলো এসব কর্মকান্ডে দারুন খুশি। খলবল করে হাসতে থাকে। কিছুক্ষণ খেয়াল করে সোহেল বুঝতে পারে, এভাবেই ভুতমা ছানাদের আদর করছে। ভুতুড়ে আদর বলে কথা।
চোখ ঘুরিয়ে চারপাশের অদেখা, অস্পৃহ্য বিচিত্র জগটা দেখতে থাকে সোহেল। কী আশ্চর্য! আমাদের চারপাশেই রয়েছে কতো বিচিত্র অদেখা ভূবন। কতোণ কেটেছে খেয়াল নেই। আচমকা চোখের সামনে দেখতে পায় প্রফেসর হিজবিজবিজকে। আতকে উঠে দ্রুত চশমাটি খুলে ফেলে। কই, সামনেতো কেউই নেই। প্রফেসর হিববিজবিজ কোথায় গেল!
আবার চশমা পড়ে আশপাশে তাকায়। ওইতো বিকট দর্শন একটা মুর্তিও সঙ্গে হাত-পা নেড়ে দিব্যি গল্প করছে প্রফেসর হিজবিজবিজ। সোহেলের দিকে এবার চোখ ফেরায়। বাতাসে ভেসে এগিয়ে আসে। অবাক হয় সোহেল। কী হয়েছে প্রফেসরের?
আমি জানতাম, এই মনভুলো স্বভাবটিই একদিন আমাকে খাবে। সোহেলের কাছে এসে বলতে শুরু করে প্রফেসর হিজবিজবিজ, গত কয়েক দিন ধরে ওই কোব্বালার জন্য ক্যান্ডি নিয়ে আসছি। দেখতে হিংস্র হলেও কোব্বালা আসলে খুব লাজুক ভুত। সে জন্যই বেশিরভাগ সময় খাবার জোটে না। ভুত সমাজে লজ্জা থাকা বিরাট অন্যায়। এর শাস্তি হিসেবে কোব্বালাকে বেশিরভাগ সময় অভুক্ত রাখা হয়। তগ কদিন ধরে এদের সঙ্গে কথা বলছি, কোব্বালার উপর কেমন মায়া পড়ে গেছে। তাই প্রতিদিনই পকেটে করে তার জন্য ক্যান্ডি নিয়ে আসতাম। বুক পকেট থেকে ক্যান্ডিটা বের করা মাত্রই ভয়ঙ্কর চেহারার কোব্বালার মুখে শিশুর মতো আনন্দের হারি ফুটে উঠতো। দেখে আমার কী যে ভালো লাগতো! আজও সার্টের পকেটে ছিলো ক্যান্ডির প্যাকেট। আপনার সঙ্গে আলাপে আলাপে ক্যান্ডিটা বের করে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থিও কোব্বালা সকল ভদ্রতা ভুলে নিজের হাতেই আমার পকেট থেকে ক্যান্ডি বের করে নিতে চেয়েছিলো। বেচারা কী আর জানতো মানুষের শরীর এতো নরম! ক্যান্ডি বের করতে গিয়ে এক খাবলায় সে আমার হ্রদপিন্ডটাই বের করে নিয়েছে। অগত্যা কী আর করা, আমিও এখন এদেরই একজন হয়ে গেলাম। ভালো কথা, যখনই আমার সঙ্গে কথা বলতে মন চাইবে, ভুতস্কোপটা নিয়ে এখানে চলে আসবেন। জানেনইতো ভুতেরা কখনো এলাকা ছেড়ে যায় না।
প্রফেসর হিজবিজবিজের কথা শেষ হওয়ার আগেই উল্টোদিকে ঘুরে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে সোহেল। ভুতস্কোপটা কোথায় পড়েছে দেখার সময় নেই। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। বুকের ভেতর ধ্বকধ্বক করছে। সোহেলের জামার পকেটেও রাখা আছে কতগুলো চকলেট। অফিস থেকে ফেরার পথে সেও প্রতিদিন চার বছরের ছেলেটার জন্য কিছু একটা নিয়ে যায়। কোব্বালার কোন ভাই-বেরাদার আবার সেই চকলেটগুলোর জন্য পকেটে থাবা মারে কে জানে! নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকে সোহেল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০০৯ বিকাল ৫:০৮