"স্কুলের এক স্যার ছিলেন মোটামুটি পাষন্ড প্রকৃতির। কিন্তু স্যারের আর্থিক অবস্হা ভাল ছিল না। একদিন স্যারের কিছু টাকার দরকার হল । আমাকে বললেন মাকে বলে তাকে সেই টাকা এনে দিতে পারব কিনা কিনা। বাসায় এসে আমার মাকে বললাম, মা টাকা দিলেন। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। কিন্তু সেই বয়সেই ঝানু মহাজনের মতো স্যারকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলাম।
যেদিনই পড়া শেখা হতো না এবং স্যারের হাতে মার খাবার সম্ভবনা থাকত- ক্লাসের শুরুতে স্যারের কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলতাম, স্যার আমার মা আজকে বিশেষ করে বলেছেন টাকাটা ফেরত দিতে। স্যার আমতা আমতা করে টাকাটা ফেরত না দেবার কৈফিয়ত দিতেন এবং অবধারিতভাবে সেই ক্লাসে পড়া ধরার পরিবর্তে মধুর ব্যবহার করতেন।"
গল্পটা আমার জীবনের নয় । মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি বইতে পেলাম ঘটনাটি তবে আমার জীবনেও প্রায় এমনই একটা গল্প আছে।
ক্লাস ফোর এর ই ঘটনা। অরণখোলা স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছি। ভর্তির তিনদিনের মাথায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে ফার্স্টবয় মনোয়ারের সাথে আমার তুমুল ঝগড়া লেগে গেলো। ঝগড়া একসময় হাতাহাতিতে রুপ নিল এবং আমি সাইজে ছোট হওয়াই মনোয়ারের হাতে মার খেলাম বেশি।
টিফিনের পরের পিরিয়ড ছিল মতিয়ার স্যারের । মতিয়ার স্যার ছিলেন ঐ সময়ের সবচেয়ে জাঁদরেল শিক্ষক। যেমন স্যারের বিশাল দেহ ছিল তেমনি তার কন্ঠ। ক্লাসে ঢুকেই বিশাল চিত্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
"মারামারি করিছিস কিডা কিডা দাঁড়া।"
আমি আর মনোয়ার উঠে দাঁড়ালাম। এবার স্যার অন্যান্য ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
"দোষ বেশি ছিল কার?"
একমিনিট কেউ কোন কথা বলল না। স্যার আবার চিত্কার দিলেন, "কথা কচ্ছিস না ক্যা ? দোষ বেশি কার?"
সরাসরি স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ঘুসা খাওয়া মুখে বললাম,
"স্যার দুজনেরই সমান দোষ ছিল।"
স্যার হঠাত্ ক্ষেপে হুংকার দিয়ে আমাকে সামনে ডাকলেন,
"কত বড় সাহস ! আমার মুখে মুখে কথা ! এদিক আয়।"
সামনে এগিয়ে যেতেই বললেন হাত পাত। তারপর দডাম দড়াম করে দুইটা বেতের বাড়ি দিলেন ।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাতে পাশাপাশি দুইটা লাল দাগের রেখা তৈরি হয়ে গেল হাতে আর জীবনে প্রথম বারের মত অনুভব করলাম ব্যাথার তীব্রতা । স্যারের প্রতি প্রচন্ড অভিমানে আমার চোখে জল চলে এল। পরেরদিনই ক্লাসের সবচেয়ে সাহসী ছেলে সুজন স্যারকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। স্যার হয়তো তার ইনজাস্টিস বুঝতে পেরেছিলেন। এই একটি ইনজাস্টিসের জন্যই স্যার পরবর্তী দুই বছর কখনো আমার গায়ে হাত তুলেন নি। আর আমাকে সবসময় আদর করে বলতেন 'বিক্যাশ বাবু'।