জীবনটা এখন বড়ই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। ইট-পাথরের এই ঢাকায় এখন মানুষ থাকে অনেকটা বাধ্য হয়ে। জীবনটাকে বড় বেশী পানসে মনে হয়। তাইতো শহরের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে দল বেধে বেড়িয়ে পরি কিছুটা প্রশান্তির খোজে। বলতে পারেন আমার ভাগ্যটা ভাল, কারন আমি যেখানে পড়াশুনা করি, আমার ক্লাসমেটদের মধ্যে একটা গ্রুপ আছে। বছরে ২-৩ বার দল বেঁধে বেরাতে বের না হলে আর ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন না করলে কারো যান ঘুমই হয়না। এর আগে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, সেন্টমার্টিন, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, বিরিশিরি, রাজশাহী ঘুরে বেরিয়েছি। তবে সবশেষে গত মার্চে ঘুরে আসলাম কুয়াকাটা থেকে। আসলে কুয়াকাটা আরো আগে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ভাঙ্গা রাস্তার গল্প শুনে প্রতিবারই কেউ না কেউ আপত্তি তোলে। তবে শেষ পর্যন্ত এইবার কুয়াকাটা যাওয়া হলই। আমি পুরোটা ভ্রমন কাহিনী সংক্ষেপে বলব, তবে মাঝে মাঝে কিছু তথ্যও দিব, যাতে যারা কুয়াকাটা যেতে চান, তাদের সুবিধা হয়।
ঢাকা থেকে যাবার জন্য তিনটি পথ আছে।
১। ঢাকা থেকে বরিশাল লঞ্চে। তারপর বরিশাল থেকে বাসে কুয়াকাটা।
২। ঢাকা থেকে পটুয়াখালি লঞ্চে। তারপর পটূয়াখালি থেকে বাসে কুয়াকাটা।
৩। ঢাকা থেকে সরাসরি বাস কুয়াকাটা।
আমরা গিয়েছিলাম প্রথম পদ্ধতিতে। এর জন্য যাত্রা শুরুর ২ দিন আগে গিয়ে লঞ্চের টিকিট কাটি। ঢাকা- বরিশাল, সুন্দরবন লঞ্চে। সোফা প্রতিজন ৪৫০ টাকা। আপনারা চাইলে কেবিন ও নিতে পারেন। ভাড়া ৮০০-১৬০০ টাকা। এখানে বলে রাখি পটুয়াখালির লঞ্চের চাইতে বরিশালের লঞ্চ আনেক ভাল মানের।।
রাত ৮টা ৩০ এ লঞ্চ ছাড়ে। এটা আমার জন্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল, কারন আমি এত বড় লঞ্চে আগে উঠিনি। মনে হচ্ছিল টাইটানিকে আছি। লঞ্চের ছাদে অন্যরকম অনুভুতি। এইবারি বুঝতে পারলাম, ঈদে মানুষ কেন লঞ্চে যেতে পাগল হয়।
যাহোক, লঞ্চ হতে সকাল ৬ টার দিকে বরিশাল নামলাম। এরপর হোটেলে খেয়ে কুয়াকাটার বাস স্ট্যান্ড এ চলে গেলাম রিকশায় করে। প্রতি ঘণ্টায় বাস ছাড়ে। লোকাল বাস। ভাড়া ২০০-২২০ টাকা প্রতিজন। কোয়ালিটি অতটা ভালনা। তবে খুব যে খারাপ, তাও না। এছাড়া লঞ্চ ঘাট থেকে প্রতিদিন ১০.০০ টায় বিআরটিসির একটা বাস ছাড়ে। ভাড়া একই। লোকাল বাসেই করে আমরা রওনা হলাম। সে এক সিরাম জার্নি। ৮টা ৩০ এর বাস এ উঠলাম, বাস দেখি ২ মিনিট পর পর থামে, আর যাত্রি তোলে। মাঝখানে একবার চাকা ফাটল। ঐটা ঠিক করতে গেল একঘন্টা। পথিমধ্যে ৪ খানা ফেরি।
প্রত্যেক ফেরিঘাটেই বাইরের খাবার খাইছি। যাদের পেটে প্রবলেম এর চান্স আছে তারা খাইয়েন না। আমার খেয়েতো অবস্থা খারাপ, কখন আবার বিগ বস ডাক দিয়ে বসে। তবে আমার মনে হয় জার্নিটা সবারই ভাল লাগবে। যাবার আগে শুনছিলাম, ঐখানকার রাস্তা নাকি ভাঙ্গা। ভাঙ্গা রাস্তা আছে, তবে অতটা বেশী না। আপনি যখন ভাঙ্গা রাস্তায় পৌছাবেন। তখন বুঝবেন সমুদ্র আর ১৬ মিনিট দূরে। বাস আমাদের ১ টা ৩০ এর দিকে নামিয়ে দিল একেবারে বীচের কাছে।
নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে লিলাম। খরচ ঢাকার মতই। এরপর হোটেলের খোঁজে বের হলাম। এখানে কক্সবাজারের মত ভাল ভাল হোটেল আছে, একেবারে সমুদ্রের কাছেই। অনেক কয়েক মিনিটের মধ্যেই হোটেলে উঠলাম। ৪ জন থাকার মত রুম, ভাড়া ১২০০ টাকা। রুমে নষ্ট এসি, ক্যাবল সহ টিভি, বাথরুমে বাথটাব ছিল। যেহেতু কুয়াকাটায় এক দিনের বেশী থাকতে হয় না, তাই ভাল হোটেলেই উঠলাম।
এরপর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে চলে এলাম বীচে। কক্সবাজারের মত অতটা ভিড় নেই, আমার মতে পারফেক্ট জনসংখ্যা। সমুদ্রে নেমে গোসল করা, দৌর-ঝাপ, ছবি তোলা, ফুটবল খেলা, সবই হল। পরিশেষে সুর্যাস্ত।। একথায় অপরুপ।।
সন্ধার পর নাস্তা খেয়ে কুয়াকাটা এলাকাটা একটু হেটে দেখলাম। সাথে পরদিন ঢাকা ব্যাক করার জন্য বাসের টিকিট বুক করে নিলাম, খরচ প্রতিসিট ৬৫০ টাকা । ছোট একটা বার্মিজ মার্কেট আছে। ঘুরে দেখতে পারেন। রাতে বীচে হাটলাম। অন্যরকম অনুভুতি। মনে হচ্ছিল, কেনযে বিয়ে করে আসলাম না :’( ।
বলে রাখা ভাল, পরদিন সুর্যোদয় দেখতে হলে আপনাদের বাইক ভাড়া করতে হবে। বিকালের দিকে বাইকের লোকদের সাথে কথা বলে রাখবেন পরদিন সকালে সুর্যোদয় এবং অন্যান্য স্পট দেখার জন্য। হোটেলের আশেপাশেই এদের পাওয়া যায়। আর না পেলে সমস্যা নাই, হোটেলের বয়কে বলে দিলেই ওদের খবর দিয়ে দিবে। বাইকের প্যাকেজ ২ ধরনের। ফাতরার চর ছাড়া ৪০০-৪৫০ টাকা প্রতি বাইক, দু জন যাওয়া যাবে। এই প্যাকেজে সুর্যোদয়, কাঁকড়ার চর, মন্দির, রাখাইন পল্লি সহ পুরো কুয়াকাটা দেখাবে। আর যদি বাইকে ফাতরার চর যেতে চান তবে খরচ হবে ৬০০-৬৫০ টাকা। তবে দ্বিতীয় প্যাকেজটায় লস। কারন বাইকে করে আপনি মুল চরে যেতে পারবেন না, শুধু দুর থেকেই দেখতে পারবেন। তবে চিন্তা করবেন না, ফাতরার চরে কিভাবে যাবেন সেটা পরে বলছি। আমরা গিয়েছিলাম প্রথম প্যাকেজে (৪০০ টাকা)।
পরদিন ভোর ৫ টার দিকে সবাই উঠে পরলাম। ৫ টা ৩০ এর দিকে বাইক যাত্রা শুরু হল। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। একদিকে সমুদ্র, আরেক দিকে ঝাউবন রেখে বালুর উপর দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলল বাইকগুলো।
আলো আধারের খেলায় মত্য গোটা প্রকৃতি। এই সময় মনে হবে কষ্ট করে কুয়াকাটা আশা সার্থক হল।
১৫ মিনিট পরে বাইকগুলো থামল। দেখলাম আশেপাশে আরো অনেকে এসেছে। পাশেই একটা চায়ের দোকান। এখান থেকেই দেখা যাবে সুর্যোদয়। চা খেতে খেতে অপেক্ষা করছিলাম কখন উঠবে সুরুজ মামু। আশেপাশের ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। এরই মাধ্যে মামা উঠে গেলো চারদিক আলোকিত করে।
আরো আধাঘন্টার মত এখানে থেকে গেলাম কাঁকড়ার চর। সুর্যো উঠার পর ছোট ছোট লাল কাকরারদল গর্ত থেকে বেড়িয়ে আসে রোদ পোহানোর জন্য। তবে এগুলো খুবই চাল্লু। সামনে গেলেই গর্তে ঢুকে পরে। তাই একটু দূর থেকেই দেখতে হবে এদের। আর ডিএসএলআর থাকলে ছবিও তুলতে পারবেন।
কাঁকড়ার চর থেকে পরবর্তী গন্তব্য শুঁটকি পল্লি। তেমন কিছুই নাই। গেছেন, দুই- চারটা ছবি তুলতে পারেন।। এরপরে গেলাম বৈদ্ধ মন্দির। এখানে আছে উপমহাদেশের সবচাইতে বড় বৈদ্ধ মুর্তি। প্রথমে ঘর দেখে মনে হল ভুল যায়গাতে আসছি। এত ছোট ঘর, হয়তো ছোট খাট মুর্তি আছে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে টাসকি খাইয়া গেলাম। এত বড় মুর্তি!!!
মন্দিরের পাশে ছোট দোকানে সকালের নাস্তা খেলাম ডিম-পরোটা দিয়ে। এরপর রাখাইন পল্লি ঘুরতে গেলাম। দেখতে পারবেন কিভাবে তারা কাপড় বুনতেছে। চাইলে কিনাও যায়। আমি কিনি নাই, কারন দেয়ার মত কেউ নাই।
আবারো বাইকে চরলাম, কুয়াকাটা এলাকা ঘুরে ঘুরে চলে আসবেন সেই কুয়ার কাছে, যেখান থেকে এই এলাকার নাম। কিন্তু যায়গাটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারন কুয়াটা আমাদের হোটেলের পাশেই :/ । কুয়া দেখে হোটেলে ফিরে এলাম সাড়ে ১০ টার দিকে। এই পর্যন্ত ছিল ৪০০ টাকার বাইক ট্রিপ। লস হয় নাই।।
হোটেলে আধা ঘন্টার মত রেস্ট নিয়ে আবার বের হলাম। উদ্দেশ্য, ফাতরার চর। এটা হল সুন্দরবনের শেষ প্রান্ত। বীচ থেকেই ট্রলার ছাড়ে। ১ ঘন্টার পথ। যাওয়া-আসা ভাড়া প্রতিজন ১৫০ টাকা। তবে ট্রলারে উঠার সিস্টেম একটু আলাদা। প্রথমে ওরা সবাইকে ছোট একটা ডিঙ্গি নৌকায় উঠাবে। তারপর ওইটাতে করে নিয়ে যাবে সমুদ্রে দারানো ট্রলারের কছে। তারপর ঐ নৌকা থেকে ট্রলারে উঠতে হবে, এই সময় খুবই ভয় পাইছি। কারন ঢেউয়ের কারনে নৌকাও দোলে, ট্রলারও দোলে। দুলতে দুলতে এক লাফে ট্রলারে উঠে গেলাম।
ট্রলার চলতে শুরু করল। আধা ঘন্টা পর এলাম ডাকাতিয়া নদীর মোহনাতে। আতদিন ফেসবুকে দেখেছি নদী আর সাগরের পানির সংযোগস্থলে দুই রঙের পানি দেখা যায়। আজ বাস্তবে তা দেখলাম।
আরো ১৫ মিনিট চলার পর এলাম ফাতরার চর। একাবারে সুন্দরবনের মত। মনে মনে ভাবলাম, যাক, সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য যে টাকাটা খরচ হতো, ওটা বেচে গেল।
ট্রলার থেকে নেমে সামনেই ২টা দোকান আছে। কাঁকড়া ফ্রাই পাওয়া যায়। ৫০ টাকা করে। আমি ডাব খেলাম, ২০ টাকা দিয়ে। সামনে একটা বড় পুকুর। টার পাশ দিয়ে একটা পথ বনের ভিতর চলে গেছে। শুরু করলাম হাঁটা। অস্থির অনুভুতি।মনে হচ্ছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখানো কোন বনে আছি। একটা টারজান টারজান ভাব।
দেখতে পারবেন সুন্দরবনের শ্বাসমুল, আর ভাগ্য ভাল থাকলে সমুদ্রের পারে হরিন।
প্রায় একঘন্টা হাঁটা-হাটি করে চলে এলাম ট্রলারের কাছে। তারপর কুয়াকাটায় ফিরলাম ২ টার দিকে। দুপুরে খেয়েদেয়ে আবারো গেলাম সমুদ্রের তীরে।
২০ টাকা দিয়ে বেঞ্চ ভাড়া করে নিজেকে চার্জ করলাম, কারন সন্ধ্যা ৬টা সময় ঢাকায় ফেরার বাস। সাকুরা পরিবহনের এই একটা বাসই সরাসরি ঢাকায় আসে। কোয়ালিটি ভাল। আর আপনি যদি বরিশালে এসে লঞ্চে ফিরতে চান, তাহলে আপনাকে একটু দ্রুত করতে হবে। কারন কুয়াকাটা থেকে বরিশালের শেষ ট্রিপ ছাড়ে দুপুর দুইটায়।
সন্ধ্যা ৬ টার বাসে করে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকা ফিরেছিলাম পরদিন সকাল ১০ টায়...
আমি জানি আমার লেখার মান খুবি খারাপ। অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে। তাই সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
[ক্যামেরা ব্যবহার করেছি Canon DSLR 60D, Cybershot W520]