আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন আমাদের ভাইবোনদের মাঝে খুব মিল ছিল। আমরা যারা ছোটবেলা থেকে গ্রামের বাতাসে ঘুড়ি উড়িয়ে বড় হয়েছি, তারা বলতে গেলে সবাই মোটামোটি ৫ ভাইবোন থাকতাম। ৩ ভাইবোন খুব কমই থাকতো কিভাবে যেন।
আমাদের সে ছেলেবেলায় ফেসবুকের মত কোন নীল সাদার জগত ছিল না।তার বদলে স্কুল থেকে দেয়া নীল রঙ এর একটি ডায়রী, আর সাদা রঙ এর একটি ৩ টাকা দামের ইকোনো বলপেন ছিল। বছর শেষে ডায়রীটির বেশীরভাগ পাতাই খালি থেকে যেতো। আঁকিঝুকি করতে করতে কিভাবে কিভাবে যেন ডায়রীটি পুরনো হয়ে একসময় হারিয়েও যেত। সাদা রঙ এর বলপেনটির কালি যখন ফুরিয়ে যেতো, আমরা সেটি পুড়িয়ে এক বিশেষ কায়দায় কলমের এক প্রান্তে ফুঁ দিয়ে দিয়ে লম্বা বেলুন তৈরী করতাম। আগের দিনের বিয়ের বাতিগুলো দেখতে যেরকম হতো। সে বেলুনগুলোও সেরকম হতো।
আমাদের বোনেরা সেসময় একটি পুতুল কিনতো। ১০ টাকা দামের পুতুল হলে সেগুলোর নিচে সবুজ রঙ এর একটি বাঁশি লাগানো থাকতো। পুতুলের পেটে চাপ দিলে প্যা পু করে শব্দ করে উঠতো। যেসব পুতুলের দাম ৫০ টাকার উপড়ে, সেগুলোয় চেপে ধরলে শাহরুখ খানের "ছাইয়া ছাইয়া" গানটি বাজতো।
আমাদের বোনেরা ছোটবেলা থেকেই পুতুলের বিয়ে দিতো। বিয়ের রান্না হত ৮ টাকা দামের কাপ আইস্ক্রিমের কাপে। সেখানে সত্যিকারের খাবার থাকতোনা। কিছু ভেজা বালি থাকতো।সেগুলোই মিছেমিছি খেতে হতো। পুতুলের বিয়ের ঘর সাজানো হতো বাতিল ইকোনো বলপেন থেকে ভাইদের বানানো বেলুন দিয়ে। সেজন্যে সে বিয়েতে ভাইদেরও দাওয়াত করা হতো। পুতুলের বাসর ঘর বানানো হতো জুতার বাক্সে... । সে বাক্সটি তারা খাটের নিচের এক কোনায় খুব যত্ন করে রেখে দিতো । মাঝে মাঝে সে বাক্সটি বের করে সে পুতুলকে আবারো বিয়ে দিতো.. এক পুতুলকে কতবার যে কাগজের শাড়ী পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।
এই ভাইবোনদের মধ্যে ভাইদের কাছে ফেভারিট হিরো সবসময় ছিল সিনবাদ। বড় একটি বাশের কঞ্চির সাথে ছোটো আরেকটি কঞ্চি আড়াআড়ি করে বেধে T আকৃতির মত করে আমরা সিনবাদের তলোয়ার বানাতাম। ভাইয়েরা মিলে ওই তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। এক ভাইয়ের তলোয়ার ভেঙ্গে গেলে ভাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে আবার মায়ের কাছে বিচার দিতাম। মা দুজনকেই আচ্ছামত বকে চুল ধরে পড়ার টেবিলে অংক বই নিয়ে বসিয়ে দিতেন। টেবিলে বসে বসে আমরা নিরুপায় হয়ে পেন্সিল কামড়াতে কামড়াতে "পিতা-পুত্র" এর অংক করতাম।
আমাদের ভাইবোনদের মাঝে একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল চোরপুলিশ। কাগজ দিয়ে আমরা বিশেষ এক জিনিস বানাতাম। সেটি দিয়ে কে চোর-পুলিশ-বাবু অথবা ডাকাত সেটি নির্ধারন করতাম। ভাই চোর হলে বোন তাকে চোর বলে ক্ষেপাতো। ভাই তখন প্রতিশোধপয়ায়ন হয়ে বোনের সে পুতুলের বাক্সটি ওলট পালট করে আসতো।
আমাদের ছোটবেলায় রমজান মাস শীতকালে আসতো। আমাদের পাড়ায় তখন মহল্লার কিছু ছেলেপেলেরা সেহেরীর সময় হলে সে সময়কার ডানো অথবা রেড কাউ দুধের বড় টিনের ডিব্বাগুলো দিয়ে শব্দ করতে করতে গলি দিয়ে হাটতো। পাড়ার সবার ঘরেই সে শব্দে ধীরে ধীরে বাতি জ্বলে উঠতো। তবে আমাদের মায়েদের কেন যেন সে শব্দ শোনার কোন প্রয়োজন হতো না। কিভাবে কিভাবে যেন তার আগেভাগেই উঠে গিয়ে সবার প্রথমে তারা রান্নাঘরের বাতি জ্বালাতেন।
আমাদের সেহেরীর মূল আইটেম ছিল দুধ কলার সাথে ভাত। অন্যসময় ঢিলেমি দিয়ে ভাত খেলেও এ সময়টায় দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার সাথে আমরা তাল মেলাতে চেষ্টা করতাম। আযান দেয়ার আগে আগে পানি বেশী করে খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলতো। সে সময়ে আমরা পুরো রোজা রাখতে পারতাম না। তখন দুটো মিলিয়ে আমাদের একটি রোজা হতো।
আমরা ভাইবোনেরা যখন অনেকটা বড় হই, তখন ভাইদের মাথায় রমজান এলেই ঈদ কার্ডের দোকান দেয়ার বুদ্ধি মাথায় আসতো।কাঠ বাঁশ দিয়ে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে তার সাথে সাদা রঙ এর প্যান্ডেলের কাপড় দিয়ে কোনরকমে একটি দোকান দাঁড় করাতাম রাস্তার পাশে।আমাদের দোকানে ৫ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা দামেরও ঈদ কার্ড থাকতো । ২০০ টাকার কার্ডে মিউজিক বাজতো। সেসময় এক টাকা দামের কিছু পকেট কার্ড পাওয়া যেতো। আমাদের সে এক মাস মেয়াদী দোকানে সেগুলোও থাকতো। সে কার্ডের এক পাশে থাকতো ক্যালেন্ডার। আর অন্য পাশটায় থাকতো সালমান খান আর শাহরুখদের ছবি।
কোন কোন কার্ডে আবার হাতে আঁকা একটি অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও থাকতো। বেশীরভাগ সময়েই সেরকম ছবিতে একটি নদী থাকতো। নদীর পাশে আবার আরেকটি মেয়েও দাঁড় করিয়ে দেয়া হতো। আমাদের সে উঠতি বয়সে আমাদের তখনো পর্যন্ত কোন পছন্দের কেউ না থাকলেও সে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আমরা কিছু একটা অনুভব করতাম। দোকানে কাস্টমার কমলে সে কার্ডটি আমরা বারবার বের করে দেখতাম। কেউ নেই মনে.. তবু কে যেন আছে.. যে আছে , তারও আবার অস্তিত্ব নেই.. কি অদ্ভূত!
আমাদের বোনেদের সমসময় এবাড়ি ওবাড়ি ঘোরা অভ্যেস ছিল। সেসময়টি ছিল ভাঙ্গা কাঁচের বোতল ফেরিওয়ালাকে দিয়ে তিলের খাজা খাওয়ার বয়স। দাড়িয়াবান্ধা আর বরফ পানি খেলতে খেলতে হঠাৎ করে তাদের ভেতর কি যেন একটা পরিবর্তন চলে আসে। তখন আর দাড়িয়াবান্ধা খেলতে ভাল লাগেনা। ড্রয়িং খাতার ভেতরে বা দিকে সিথি করে চুল আচরানো একটি সাদামাটা ছেলের ছবি আঁকতে ভাল লাগে। ডায়রীর মাঝখানের পাতায় নীল কালি দিয়ে একটি কবিতা লিখে সে পাতায় ময়ূরের পালক রাখতে ভাল লাগে। এ সময়ে আর চঞ্চলতা থাকেনা। স্থিরতা এসে ভর করে। অনেকটা গ্রামগঞ্জে জ্বীন-ভূতে ধরার মত করে হুট করে এসে ভর করে।
ভাইগুলোরও যে পছন্দের কেউ থাকতো না তা নয়। বিকেলে ক্রিকেট খেলার সময় মাঠের মাঝখান দিয়ে সে মানুষটি গেলে আমাদের বুকে তখন তীব্রভাবে ধুকধুক করতো। কপাল দিয়ে ঘাম ঝড়তো। হাতের ব্যাটটি প্রথমে টাইট করে ধরা থাকলেও তখন আঙ্গুলে জোর কমে আসতো। আমাদের কখনোই সে মানুষটির সামনে নিজেকে রাজপুত্র মনে হয়নি। রাস্তার এক গলি দিয়ে হেটে গেলেও আমরা তখন অন্য গলিতে যেয়ে ঢুকতাম। প্রত্যাখানের ভয়ে আমরা তাকে কিছুই জানাতাম না, বড়জোর একটি ছোট্ট কাগজে কিছু একটা লিখতাম। কখনো সেটি দেয়া হতো, কখনো আবার হতো না.. হারিয়ে যেতো..
বোনগুলোর সেই ময়ূরের পালক রাখা ডায়রীটা এক সময় আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় যেন সেগুলো হারিয়ে যায়। ডায়রীর সাথে সাথে সে বাম দিকে সিথি করে চুল আচরানো সাদামাটা ছেলেটিও হারিয়ে যায়। ভাইগুলোরও এক সময়ে আর আগের মত মাঠে ক্রিকেট খেলতে যায় না। রাস্তায় হাটলেও আর অন্য কোন গলিতে হুট করে ঢুকে পড়তে হয়না।গলির মোড়ের চায়ের দোকানে তখন নির্বিঘ্নে গোল্ডলিফ টানা যায়। কারন তাদের সে মানুষটিও কোথায় যেন হারিয়ে যায়...
একটি সময়ে বয়স বেড়ে যাচ্ছে বলে পরিবার থেকে বোনদের উপড় বিয়ের চাপ আসে । আর বাবা বুড়ো হচ্ছে বলে ভাইদের উপড় চাপ আসে কামাই রোজগারের।কিভাবে কিভাবে যেন বোনদের একটি সময়ে বিয়ে হয় মোটামোটি তাদের চাইতে উচ্চ বংশের কোন পরিবারে। আর ভাইগুলো যতদিনে পরিবারকে টেনে নিয়ে আর নিজের পায়ের নিচের মাটি কিছুটা শক্ত করে, ততদিনে ওইদিকে আড়াই বছর ধরে "বাসায় বিয়ের চাপ দিচ্ছে, ভাল একটা জব ধরো" বলা মেয়েটিও পারিবারিকভাবে নির্ধারন করা কোন এক আমেরিকা প্রবাসীর হাত ধরে হারিয়ে যায়...
সৃষ্টিকর্তা ছেলেদেরকে যেমন শারীরিক শক্তি বেশী দিয়েছেন, তেমনি মানসিকভাবেও ততটিই শক্ত করেছেন।বোনগুলো বা দিকে সিথি দেয়া ছেলেটির কথা বিয়ের পরে মনে হলেও ভাইগুলো আড়াই বছরের কষ্ট তাই আড়াই মাসেই ভুলে যায়। তবুও মাঝেমধ্যে ক্ষতটায় বৃষ্টির দিনগুলো মরিচা পড়া পেরেকের মত গেথে যাওয়ায় যন্ত্রনা হয় খুব। সেটি ভুলতেও আবার তাদের আড়াই মিনিটের বেশী লাগেনা। হাজার হলেও পুরুষের মন। এটুকু শক্ত তো হতেই হবে... কষ্ট যতই হোক, বাড়তে দেয়া যাবেনা..
একটি সময়ে পিতার সম্পত্তি নিয়ে ভাগাভাগি শুরু হয়। কে কত ভাগ পাবে এ নিয়ে ভাইদের ভেতর শুরু হয় দন্দ্ব। বোনেরাও তখন তাদের ভাগের অংশটুকু নিতে বাবার বাড়ি ঘনঘন আসাযাওয়া শুরু করে। বোনেরা যখন নিজেরা নিজেরা গল্প করে, তখন জমি সংক্রান্ত সলাপরামর্শের পাশাপাশি কার জামাই এর ইনকাম কিরকম সেটি একটু কথাবার্তায় তুলে আনার চেষ্টা করে।
সম্পত্তি সংক্রান্ত এ ঝামেলার নিষ্পত্তি হয় বড়সড় এক ঝামেলার মধ্য দিয়ে, যে ঝামেলার পর ভাইবোনের মধ্যকার সে আগের বন্ধনগুলো থাকেনা। পিতার জমি খন্ড খন্ড হবার সাথে সাথে ভাইবোনগুলোর বন্ধনটিও তত টুকরোতেই খন্ডিত হয়ে যায়...
এসময় তখন আর কোন বোন ভাবেনা, একটি সময়ে তারা সবাই মিলে একই পুতুলকে কাগজের সাদা শাড়ী পড়িয়ে অসংখ্যবার বিয়ে দিতো। সে বিয়েতে ভাইদের সেই ইকোনো বলপেন থেকে বানানো বেলুনগুলো সাজানো থাকতো। কাপ আইস্ক্রিমের কাপে ভেজা বালু হাতে নিয়ে বোনদের রান্না করা সে খাবারও তারা মিছেমিছি খেতো....
ভাইরাও কখনো ভাবেনা , একসময় তারা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সিনবাদের তলোয়ার বানিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো। কখনোই মনে হয়নি ভাইদের সাথে শুধু এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটি একটি সময় সত্যিকারের যুদ্ধে রুপ নেবে..
এখন আর কেউ মিছেমিছি খাবার খায়না। খাবার হয়েছে সত্যিকারের, কিন্তু সম্পর্ক হয়েছে মিছেমিছি... ইংরেজীতে নাকি সেটিকে ফর্মাল বলা হয়..
কেউ মিছেমিছি যুদ্ধও করেনা, যুদ্ধও সত্যিকারের হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যে যুদ্ধটি সবচেয়ে বেশী হয়, সেটি হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধ..
দিনশেষে সবার সম্পর্কই হারিয়ে যায়... যে মানুষটিকে এক টাকা দামের কোন পকেট কার্ডের দিকে তাকালে ভেতরটায় ধক করে উঠতো , সেও হারিয়ে যায়। বিয়ের পরে বাচ্চাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গেলে সেখানের ময়ূরের পালকের দিকে তাকালে নীল কালিতে লিখা যে কবিতা আর সাদামাটা যে ছেলেটার কথা মনে হয়, সেও হারিয়ে যায়...
কোথাও আর থাকেনা কেউ....
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১১:৫৫