'১৯৭১' সংখ্যাটা শুনলে বাংলার
মুক্তিযুদ্ধের কথাই মনে পড়ে। সুতরাং
এই সংখ্যাটি যদি কোন উপন্যাসের
শিরোনাম হয় তাহলে অবশ্যই সে
উপন্যাসের কাহিনীর সাথে
মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি যোগাযোগ থাকা
বা উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের
প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়ারই কথা। এবং
বাস্তবে হুমায়ুন আহমেদের '১৯৭১'
উপন্যাসেও হয়েছে ঠিক তা-ই। হুমায়ুন
আহমেদের আরও একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক
উপন্যাস হল '১৯৭১'। হুমায়ুন আহমেদের
সাহিত্য জীবনের প্রথম দিককার
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস সমূহের
একেকটিতে মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ভিন্ন
ভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে।
সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক
চিত্র সেগুলোতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সম্ভবত '১৯৭১'ই হল হুমায়ুন আহমেদের
প্রথম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস
যেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংস্লিষ্ট
একাধিক দিকে আলোকপাত করতে
চেয়েছেন। তবে বলে রাখা জরুরি,
উপন্যাসের এক পর্যায়ে এসে লেখক
সেটি আর কন্টিনিউ করেন নাই। তাই
শেষ পর্যন্ত '১৯৭১' উপন্যাসটিতেও
কেবল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কিছু
খন্ডচিত্রই ফুটে উঠেছে।
এই উপন্যাসের পটভূমি হল নীলগঞ্জ
নামের একটি গ্রাম। পাঠকরা নিশ্চয়ই
খেয়াল করে থাকবেন, হুমায়ুন আহমেদের
একাধিক উপন্যাসে এই নীলগঞ্জ
গ্রামের উল্লেখ আছে। এই নীলগঞ্জ
গ্রামের নানা শ্রেণি পেশার মানুষই
হল এই উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র।
সেসব চরিত্রের মধ্যে আছে বৃদ্ধ মীর
আলী, তার ছেলে বদিউজ্জামান, জয়নাল
মিয়া, আজিজ মাস্টার, ইমাম সাহেব
প্রমুখ। তবে এই উপন্যাসে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা
যাবে পাক মিলিটারির মেজর ও তার
এক বাঙালি সহকর্মী রফিক।
মে মাসের ১ তারিখ নীলগঞ্জ গ্রামে
পাক মিলিটারি আসে। মিলিটারি এসে
বেশ কিছু হিন্দুকে হত্যা করে। আজিজ
মাস্টার, ইমাম সাহেব, জয়নাল
মিয়াদের ধরে নিয়ে যায় তাদের থেকে
জানার জন্য যে গ্রামের বনে
মুক্তিবাহিনী লুকিয়ে আছে কিনা আর
থাকলে তারা সংখ্যায় কত। ক্রমশ
মিলিটারির মেজরের বন্দিদের উপর
নিষ্ঠুরতার চিত্র প্রতীয়মান হতে
থাকে কাহিনীতে। যুদ্ধ, বাংলার মানুষ,
পাকিস্তান প্রভৃতি বিভিন্ন ইস্যুতে
মেজরের নিজস্ব থিওরি প্রকাশিত হতে
থাকে যা মূলত একাত্তরে প্রায় সকল
পাকিস্তানি হানাদারদেরই নিজস্ব
অভিমত ছিল। পাকিস্তানি
হানাদারদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা নিষ্ঠুর
ছিল তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মিলবে এই
মেজরের চরিত্রের মাধ্যমে। আর এই
উপন্যাসের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র
হল রফিক যে কখনো বা নির্বিকারে
গ্রামের মানুষদের অত্যাচারিত হওয়া
দেখে চলেছে আবার কখনো মেজরের
নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করতে দুঃসাহসী
হয়ে উঠছে। এই রফিক চরিত্রটিই
কাহিনীর শেষ পর্যায়ে যেভাবে
মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে মেজরের মুখোমুখি
হয়, সেই ঘটনার মাধ্যমে রূপকভাবে
হলেও পাকিস্তানি হানাদারদের
বিরুদ্ধে বাঙালীর বীরত্বপূর্ণ
অবস্থানের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
নির্দিষ্ট করে এই উপন্যাসের
কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া
দুঃসাধ্য। তবে এটুক বলা যায়, নীলগঞ্জ
গ্রামের পটভূমিতে একাত্তরের কিছু
খন্ডচিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। সেসব
খন্ডচিত্রকে একত্রিত করে পাঠকের
পক্ষে সম্ভব হবে একাত্তর সম্পর্কে
কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে
লেখা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসসমূহের
মধ্যে '১৯৭১' কখনোই অন্যতম সেরা
নয়। তারপরও লেখক এই উপন্যাসের
মাধ্যমে একাত্তরে সাধারণ বাঙালীর
অবস্থান এবং হানাদারদের
নিষ্ঠুরতাকে কিছুটা হলেও বইয়ের
পাতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন।
তবে উপন্যাসটি পড়ে মনে হবে, অনেক
তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আরেকটু বড়
পরিসরে যদি লেখক কাহিনীটাকে
সাজাতেন তাহলে হয়ত আরও ডিটেইলে
একাত্তরকে উপস্থাপন করা যেত।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ২:১১