সালমান খানের আরেকজন ভক্ত বলছি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
হিন্দী সিনেমার নায়কদের নামগুলো অনেক সময় জনমানুষের সাথে মিলেমিশে যায়। এই যেমন ধরেন আপনি বিলেতের উত্তরের কোন শহরে গিয়ে বললেন যে, আমি আমির খানেরে ‘সাপোট করি’, তাহলে ভাল সম্ভাবনা হল, যে আপনার কথার অর্থ ধরে নেয়া হবে অলিম্পিকে মেডেল পাওয়া কিশোর বক্সার আমির খানের কথাই বলছেন। এই অল্প কদিন আগ পর্যন্তও শাহরুখ নাম বললে তার সাথে ভারতীয় কারো সম্পর্ক ধরা হোত না, বরং শাহরুখ নামে ইনিই বেশী পরিচিত ছিলেন। তেমনি আরেক নায়োকচিত কিংবাদন্তী পুরুষ হলেন সালমান খান। হ্যাঁ আমি এইবারও স্বল্পবসনা পেশীবহুল কারো নাম নিচ্ছিনা, আরেকজন সালমান খান যিনি তার নায়োকোচিত নাম নিয়েই বসে ছিলেন না বরং একাই পৃথিবীর মানচিত্র পালটে দেবার মত এক দুঃসাহসী কাজ ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন।
শুরুটা হয়েছিল মোটামুটি সহজ ভাবেই, খানবাবা আম্রিকা থাকেন, এম,আই,টির ট্রিপল গ্র্যাজুয়েট (একলগে ম্যাথ, ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিরি আর কম্পু), লগে হার্ভার্ডের এম্বিএ আর লাগে কি। হেজ ফান্ড, ক্যাপিটাল মার্কেট এইসব নিয়া কাজকাম। একদিন তার এক খালা এসে ধরল, আমার মাইয়াটারে একটু অংক দেখাইয়া দাওগো। খান থাকে এক শহরে বইন থাকে আরেক শহরে, হাইফাই ব্রডব্যান্ডের জমানায়, নো পেরবলেম, ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারের ডুডল নোটপ্যাডে ভয়েস চ্যাট আর আঁকিবুঁকি নিয়ে ভার্চুয়াল ক্লাস নেয়া শুরু হল। পরীক্ষায় রেজাল্টে ফেল্টুশ বোন দিব্যি ছক্কা মারল। এইরকম আরো দুচারটা কেসের পরে সালমান চিন্তা করছিলেন এই অনলাইন মাস্টারিগিরিকে কিভাবে আরো ছড়িয়ে দেয়া যায়। পরবর্তীতে এইগুলোকে পুরোদস্তুর ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করা হল। তার কিছুদিন পরে এক আশ্চর্য জিনিষ দেখা গেল, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গা থেকে বিশেষ করে আমেরিকারই বিভিন্ন যায়গা থেকে অসম্ভব হিট আসা শুরু করল এবং এর প্রায় সব দর্শকই দেখা যাচ্ছে স্কুল ও কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা। এই পাবলিসিটি এতই বাড়া বাড়ল যে, এক পর্যায়ে তিনি এক দুঃসাহসীক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। নটা-পাঁচটার নিয়মিত চাকরী ছেড়ে দিয়ে অনলাইন ফ্রি টিউটোরিয়াল বানানোকেই ফুলটাইম কাজ হিসেবে নিয়ে নিলেন। নিয়মিত কিছুকিছু করে তৈরি করতে করতে আজ পর্যন্ত ১৮০০+ টিউটোরিয়াল একদম একাএকাই তৈরি করে ফেললেন।
এইবারে আসি ভিডিওগুলির ব্যাপারে। প্রথমত কোন ঝকমকা এনিমেশন নাই, গ্রাফিক্সের বলিহারি নাই, দিব্যি কালো একটা স্ক্রীন তার মাঝে কিছুক্ষণ পরে পরে কাঁচা হাতে আঁকিবুকি হচ্ছে আর কেউ একজন ঘ্যানঘ্যান করে অডিওতে কথা বলছে। প্রশ্ন হল এইখানে ম্যাজিকটা কোথায়? একটু ফিরে যান আপনার ছোটবেলায় স্কুলের দিনগুলিতে। আমার বিশ্বাস প্রত্যেকেরি অভিজ্ঞতা আছে নিজের বড়ভাই, পাড়ার বড়ভাই বা পাশের বিল্ডিং এর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া যিনি আপনার পড়াশোনার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো ও সমস্যা সমাধানের মৌলিক আগ্রহ জাগানোর জন্য অসাধারণ অবদান রেখেছেন। ভিডিওর ধরণটাও অনেকটা তেমনই। শুনলে মনেই হবেনা যে ক্লাস করছেন, মনে হবে এই সাধারণ একটা জিনিষ কেউ একজন আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। যিনি বোঝাচ্ছেন, তিনি নিজেও আপনার চেয়ে মহা আঁতেল কেউ না, বরং ভাবখানা যেন আমিও গত সপ্তাহেই শিখেছি ব্যাপারটা, ভূলে যাবার আগেই তোমারে একটু শিখায়ে দেই। খুব সীমিত দৈর্ঘের (৩-৭ মিনিট) এই ভিডিওগুলোতে যেকোন বয়সের শিক্ষার্থীর জন্য একদম ডুবে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই টের পাবার আগেই দেখা যাচ্ছে উল্লেখিত ক্লাসের বিষয়টি শিক্ষার্থী শিখে ফেলছে। আর এই অদ্ভূত অভিজ্ঞতা একজন, দুইজন না বরং আমেরিকা ও সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর এখন। উঁচু বেতনের অফিস ফেলে গোঁয়ারের মত লেগে থাকার ফলে সালমান খান বর্তমানে আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে একজন প্লাস রীতিমত সেলিব্রিটি।
সালমান খানের করা ইউটিউবের ভিডিও নিয়ে ওয়েবসাইট খান একাডেমী। এই আকর্ষণীয় প্রকল্পটির ওয়েবসাইটে আমি প্রথম দেখি ২০১০ সালের প্রথম দিকে। তখুনি প্রচন্ড কাজের একটা জিনিষ মনে হয়েছিল আর এই নিয়ে ব্লগেও লিখব মনে করেছিলাম। আজকে খান একাডেমী নিয়ে একটু অতিরিক্ত বাকবাকুম হয়ে আছি আমি কয়েকটা কারণে। এই মহা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফ্যান হিসেবে বিল গেটস নিজেকে পরিচয় দিতে সম্মানিত বোধ করেন। মাইক্রোসফটের এডুকেশন এওয়ার্ড পেয়েছিল এই সাইটটি আগেই। আজকে যেটা আবিষ্কার করলাম যে, গুগল ২০০৮ সালে প্রোজেক্ট ১০ টুদিপাওয়ার ১০০ নামে প্রোজেক্টটি চালু করে। তাতে পৃথিবী বদলে যেতে পারে এমন আইডিয়া চাওয়া হয় সারা পৃথিবীর কাছে। প্রায় ১৫,০০০ আইডিয়া জমা পড়ে সারা পৃথিবী থেকে। সেখান থেকে প্রায় দেড় বছর যাচাই বাছাই করে ১৬ টি পরিকল্পনা ঠিক করা হয়, সেখান থেকেও ভোটাভুটির মাধ্যমে ৫ টি আইডিয়াকে গুগলের পক্ষ থেকে ২ মিলিয়ন ডলার করে দেয়া হয়। শিক্ষা খাতে পৃথিবীর সেরা প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয় এই খান একাডেমী। আমার দৃষ্টিতে এক হিসেবে নোবেল পুরস্কারের চেয়েও বড়ো অর্জন পৃথিবীর সেরা চ্যালেঞ্জ জিতে নেয়া এই সম্মান। এই অর্থ দেয়া হয় আরো অনেক বেশী ভিডিও আরো বেশী ভাষায় অনুবাদ যেন করা যায় সেই জন্য।
এই তো গেলো পুরস্কার পাবার পরের কথা, কিন্তু সালমান খানের এই ভিডিওগুলির কল্যাণে তিনি যখন ছোট বা মাঝারি আকারে পরিচিত, তখনই বিভিন্ন যায়গা থেকে অফার এসেছিল এইগুলোকে বাণিজ্যিকিকরণ করার। তাতে তিনি দিব্যি সেলিব্রিটি থেকে ধনী সেলিব্রিটিতে পরিণত হতেন একই সাথে বানিজ্যিক বিপনন মাধ্যমগুলোতে তার শিক্ষা ছড়ানো যেত। কিন্তু ধীরস্থী বিনয়ী এই শিক্ষাতাপস সযত্নে এইসব প্রোলভন এড়িয়ে গেছেন আর তার ভিডিওগুলি বিতরণ করেছেন ওপেন সোর্স লাইসেন্সের মাধ্যমে। অর্থাৎ, যে কেউ ডাউনলোড করে যতখুশি বিতরণ করতে পারবে, দিব্যি ইংরেজীর যায়গায় চীনে ভাষায় অনুবাদ করতে পারবে কোন আইনী বাধা ছাড়াই। এই বিষয়ে ব্লগার ডেভিড তাকে উৎসাহিত করেন তার প্রকল্প মুক্ত রাখার জন্য।
আরেকটা যেই কারণে অমানুষিক আনন্দ হচ্ছে সেটা বলছি। গতবার খান একাডেমী দেখার পরে ইচ্ছে হয়েছিল এই চমৎকার উদ্যোগ নিয়ে ব্লগে লিখব। কিন্তু আলসেমী সহ আরো অন্যান্য কারনগুলোর মধ্যে একটা ছিল যে সালমান খানের বাড়ী পাকিস্তান অথবা উত্তর পশ্চিম ভারত বলে মনে হচ্ছিল। তাই আরেকদিন লিখুমনে বলে মনে মনে ড্রাফট করে ফেলেছিলাম। আজকে চেক করে দেখলাম যে কয় কি! মনুর বাড়ী বরিশাল! বাংলার জন্য, বাংলাদেশের জন্য এটা বিপুল এক গৌরব!
স্প্যানিশ সহ আরো বেশ কিছু ভাষায় ইতমধ্যে সালমান খানের করা ভিডিওগুলি অনুবাদ করা শুরু হয়ে গেছে। স্রেফ আলসেমীর কারণে খুব সম্ভবত বাংলার মুখ দেখবে না। তবুও আমন্ত্রণ রইল খান একাডেমীতে।
পূর্বে প্রকাশিত
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?
যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।
নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন
আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!
কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে
আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?
এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন