এ'কাহিনীটি আমদের প্রতিবেশী, এক দরিদ্র পরিবারের একটি ছোট মেয়ে, সিমোনের জীবনের একটি ছোট অংশকে নিয়ে। সিমোন আমার গ্রাম্য সম্পর্কের বড় ভাই, বদি মিয়ার ছোট মেয়ে: ৩ বোনের মাঝে সে তৃতীয়; বড় বোনের বিয়ে হয়েছে, মেঝো বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে, সিমোনের বয়স হয়তো ১০ বছরের মতো; সে বেশ ছোটকাল থেকে পরিবারের জ্বালানী যোগাড় করতো: পাতা কুড়াচ্ছে, গাছের শুকনো ডাল নিয়ে আসছে, শুকনো গোবর সংগ্রহ করছে, ধানের নারা কাটছে; আমি নবম শ্রেনীতে পড়ার সময় সিমোন ক্রমেই আমার সামনে আসতে লাগলো; সে সব কিছু করতো খুব ভোরে; আর, আমিও ছিলাম ভোরের মানুষ: আমি কাছারীতে থাকি; খুব ভোরে উঠে পড়ালেখা, তারপর দরকার মতো চাষবাস, গরু, ছাগলগুলোর খোঁজ খবর নেয়া, ভোরে পুকুর থেকে মাছ ধরা; ৯টার পর থেকে স্কুলের যাওয়ার প্রস্তুতি।
নবম শ্রেণীতে থাকাকালে আমার উপর একটি বাড়তি কাজের দাযিত্ব পড়েছিলো, আমাদের সাদা গাভীর দুধ দোহানো; নামে সাদা হলেও, গাভীটি ছিল আসলে ধুসর; উহকে আমি কিনেছিলাম; এটি গাভী হলেও উহার মনমেজাজ ছিলো ক্ষিপ্ত যাঁড়ের মতো, আকারে বেশ লম্বা, শিংগুলো যাঁড়ের মতো; মানুষজন আশপাশ দিয়ে হাঁটতে পারতো না, সে আক্রমণ করার চেষ্টা করতো; আমাদের বুড়োমিয়া উহার দুধ দোহন করা তো দুরের কথা, উহার আশপাশ দিয়েও যেতেন না। দুধ দোহনের সময় বাচ্চাটা ধরার জন্য কাউকে পাওয়া যেতো না, আমাকে কোনভাবে একাই ম্যানেজ করতে হতো। এক ভোরে, গাভী ও বাচ্চা মিলে আমাকে যখন নাকাল করছিলো, সিমোন নিজের থেকে ভলনটিয়ার হয়ে আমাকে সাহায্য করতে এলো, সে কাছে এসে বললো,
-কাকু, বাচ্চাটা আমি ধরি?
-গাভী তোকে গুতো দিবে, এই গরুটি ভয়ংকর।
সে বাচ্চাটাকে ধরে, গাভীর সামনে নাগালের মাঝেই দাঁড়ালো; গাভী ২/৩ বার ফোঁসফাঁস করে বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো, সিমোনকে মেনে নিলো। এরপর থেকে প্রতি ভোরে সিমোন নিজে এসেই উপস্হিত। আমি সিমোনকে দুধ দিতে চাইলাম; সে নয়নি, সে শুধুমাত্র ছাগলের দুধ খায়। এরপর, সিমোন আমার মাছ ধরায় যোগ দিলো: বর্ষায় ও শীতে, সকালে পুকুরে মাছ ভাসতো, আমি জাল নিয়ে ব্যস্ত থাকলে, সিমোন মাছগুলো কুড়িয়ে নিতো, মাছের ঢুলায় রাখতো। মাছ দিলে সে মাঝেমাঝে নিতো।
সেবার শীতের এক খুব ভোরে, আমি কাছারীতে বসে পড়ছিলাম ও চা খাচ্ছিলাম; জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়ে সিমোন প্রশ্ন করলো,
-কাকু, তুমি কি খাচ্ছ, দুধ নাকি চা?
-চা।
-চা খেতে কেমন?
-তুই কোনদিন চা খাসনি?
-না।
-ভেতরে আয়, খেয়ে দেখ।
আসলে, চা সামান্যই ছিলো তলানীতে; সে সেইটুকু খেয়ে তৃপ্তি প্রকাশ করলো। মা আমাকে প্রতিদিন চা দিতেন না, বেশীরভাগ সময়ে দুধ দিতেন। আমি সিমোনকে ২ আনা পয়সা দিয়ে বললাম,
-মাদল কাকার দোকানে গিয়ে, ১ কাপ চা ও ১টা কুকি খেয়ে নিস।
পরদিন দেখা হওয়ার পর, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-মাদল কাকার চা কেমন লাগলো?
-আমি চা দোকানে যাইনি!
-কেন?
-তোমার মাদল কাকা জানতে চাইতে পারে, আমি পয়সা কোথায় পেলাম?
-তুই বলতে পারতি যে, আমি দিয়েছি!
-সেই কারণেই যাইনি!
-সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা আছে, সেটা তুমি বুঝবে না! পয়সাগুলো আমি মেলায় যাবার জন্য রেখে দিয়েছি।
-ঠিক আছে, আমার সাথে খালের ওপারের গ্রামে চা-দোকানে যাবি? ওখানে তোকে কেহ চিনবে না!
-না, যাবো না!
-সেখানে যেতে সমস্যা কি?
-তুমি পাশের সব গ্রামে যাও, তোমাকে অনেকে চেনার কথা!
-হয়তো চিনতে পারে, তুই সাথে গেলে তাতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়!
-অসুবিধা আছে!
-কি অসুবিধা?
-আমার কাপড়ই একটা অসুবিধা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১৯ ভোর ৫:৪৪