somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রিয় নাজমুল এবং সাঁঝবাতির রুপকথা, কিছু অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর!

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুভেচ্ছাতে কোচিং করতাম তখন। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ব্যাপারে শুভেচ্ছার নাম ডাক ছিল ঈর্ষনিয়। থাকি নাখালপাড়ায়, ফার্মগেট থেকে ক্লাস শেষ করে একটু শাহবাগের আজিজ মার্কেট ঢু মেরে সোজা বাসায়। আমার গণ্ডি তখন খুবই সীমিত।
কদিন ধরে বাবার অফিসে ঝামেলা চলছে। প্রায় মাস পাঁচেকের বেতন বকেয়া। ৬ জনের গাদাগাদি সংসার টানতে গিয়ে মা'র মুখ ক্রমশ ম্লান হচ্ছে। বাবার গায়ে জ্বর লেগেই থাকে। চোখ মুখ গর্তে ঢুকে যাবার অবস্থা, ঠিক চেনাই যায়না। যে মানুষটা দাঁড়ালে আকাশ ঢেকে যেত তার অস্তিত্বের পরতে পরতে তখন হেরে যাওয়ার গ্লানি।

কদিন ধরেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অনুরোধ নিয়ে মা'র কাতর আকুতি। বাবা'র কোন গ্রাহ্যই নেই। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়, সারা রাত কাটে নির্ঘুম। হঠাৎ একদিন মা খেয়াল করল বাবার গলার কাছে কেমন যেন ফুলে আছে। আর কোন অনুনয় নয়, সোজা জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আমাদের পরিচিত, উনি কিছু ভিটামিন প্রেসকাইব করে তিনটে টেস্ট করতে দিলেন। যথা সময়ে টেস্টের রেজাল্ট আসলো, ডাক্তার কাকা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বললেন "আমার খানিকটা ভুল হচ্ছে, আমি একটা নাম দিয়ে দিচ্ছি, আপনারা বরং সময় নষ্ট না করে ওনার সাথে খুব দ্রুত যোগাযোগ করুন"।

কাকার দেয়া সেই ঠিকানায় পৌঁছে গেলাম পরের সকালেই। খুব নামি প্রফেসর, কথা বলার আগেই কয়েকটি টেস্ট করতে দিলেন। দু-দিন পর আসবে রেজাল্ট।

২৯ জানুয়ারির সেই সকালটা হয়তো খানিক অন্যরকম ছিল। খুব ভোরেই চলে গেলাম ল্যাবরেটরিতে। উদ্ভট সব লেখা, কিছুই বুঝিনা। ওখানকার এক এ্যাটেনডেন্টকে মা খুব রিকোয়েস্ট করায় দয়াপরবশ হয়ে উনি বললেন, রিপোর্ট খুব খারাপ, ক্যান্সার হয়েছে।

মাথার ওপর আকাশ ভেঙ্গে পরার কথা বইতে অনেক পরেছি। সত্যি সত্যি আকাশ ভেঙ্গে পরার সেই মুহুর্তটা আজো ভুলতে পারিনা। চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন অবাস্তব লাগতে শুরু করল। সেই ছোট বেলায় যার কাঁধে চরে ঘুরে বেরানোর সময় ভাবতাম আমার বাবা কখনই বুড়ো হবেনা, সেই মানুষটিই কিনা আর থাকছেন না? আসলে সেই মুহুর্তটা কখনই ভুলতে পারবোনা জীবনে।

বাবাদের ৫ ভাই এর মধ্যে আমার সেঝ কাকার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার ক্ষমতা বেশি থাকায় মা সাথে সাথে তাকে ফোন করল। কিছুক্ষনের ভেতরেই উনি চলে এলেন বাসায়। একে একে সবাই আসতে শুরু করল। আমি বা মা কেউই বাবার সামনে যাচ্ছিনা। বাবাও কিছু জিজ্ঞেস করছেন না।

চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ধানমন্ডিতে তখন খুব নামি একটা নার্সিংহোম ছিল ক্যান্সারের জন্য। ডাক্তারের কথা মত ওখানেই নেয়া হলো বাবাকে। দুপুরের ভেতরেই আরো বেশ কিছু টেস্ট এবং রাতে রেজাল্ট নিয়ে আমি আর আমার সেই সেঝ কাকা গেলাম কথা বলতে। প্রফেসর সাহেব কেন যেন কাকা কে একটু বাইরে যেতে বললেন। একটু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে তার প্রশ্ন, "সহ্য ক্ষমতা কেমন?" উত্তরে ঠোটে হাসি ফুটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। সোজাসুজি বলে বসলেন, ফুসফুসের পুরোটাই শেষ। বড়জোর ৬ মাস চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে এধরনের কেসে ৩ মাস বেঁচে থাকাটাই অনেক বেশি।

বজ্রাহত। কাকা শুনে বললেন আর কাউকে না জানাতে। প্রাণান্ত চেস্টায় একটা হাসি মুখ করে সবাইকে জানালাম এখনো চেষ্টা করা যায়। সময় শেষ হয়ে যায়নি। তারপর এক ছুটে বাইরে এসেই কাপাকাপা হাতে সিগারেট ধরালাম।

আমি তখন সবার নজর বন্দী। সারাখন হাসি হাসি মুখে সবাইকে শোনাচ্ছি আশার কথা। কেউ মুহুর্তের জন্যেও আমাকে ছেড়ে থাকতে চাচ্ছেনা, যেন বা সমস্ত ব্যাপারটাকেই নিছক দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার হাতে। অভিনয় করাটা যে মাঝে মাঝে কি ভয়ংকর হয়ে ওঠে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি সে সময়গুলোতে।

জানুয়ারির ৩১ আমার জন্মদিন। পোলাউ রান্না হলো। ডাক্তার হাসি মুখে অনুমতি দেয়ায় বাবাও মজা করেই খেলো, জানিনা হয়তোবা উনিও অভিনয় করছিলেন তখন। কিমো থেরাপী শুরু হয় সন্ধ্যা বেলা। রাত ১০টার দিকে টলতে টলতে বাসায় ফিরি।

পরদিন দুপুরে গেলাম হাসপাতালে। দেখি উনি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমি পাশে বসতেই মুঠো করে আমার হাত ধরলেন, তারপর হাসতে হাসতেই বললনে, "আই টু ডাই, ইউটু লীভ, হোয়াট ইজ বেটার অনলি গড নোজ (মনে নেই পুরো লাইন গুলো)"। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে একবার তাকিয়ে শুয়ে পরলেন।

২ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে বাবাকে আপাতত রিলিজ করা হলো। সেঝ কাকা গাড়ি নিয়ে আসায় বাসায় ফিরতে সমস্যা হয়নি। টানা তিন দিন নির্ঘুম থাকার পর মা ঘুমাতে গেলেন। সন্ধায় সবাই মিলে আগের মতোই আড্ডা দিতে বসলাম। কিছু পরে মা আলাদা করে আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, হাতে তো আর টাকা নেই, রাতে খাওয়াবো কি? পকেটে কিছু খুচরো টাকা ছিল, তা দিয়েই চাল আর আলু কিনে আনলাম। বাসার সবচে ছোট সদস্য আমি কথাটা সবাই কেমন যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। তখনো কেউ জানেনা সবই নিষ্ফল চেষ্টা। সপ্তা তিনেক পরে কিমো থেরাপীর টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে সে চিন্তাও যেন শুধুই আমার!

৩ ফেব্রুয়ারি সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাইরে গেলাম সিগারেট খেতে। একটু বেশি সময়ই বাইরে ছিলাম। ঘরে ঢুকেই দেখি বাবার চোখ লাল, নিশ্বাস নিতে পারছেন না। ডাক্টারকে ফোন এবং টার কথা মত খুব কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হলো। দুপুরের দিকে আবার ছটফট করতে শুরু করলেন, আমি এদিক ওদিক ছুটলাম কোথায় অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যায় খুঁজতে। শেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে কাকা কে ফোন করায় উনি আবার গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। সামনে সিটে কাকা আর ড্রাইভার, পেছনের সিটে মা আর আমি। আমার কোলের ওপর মাথা রেখে বাবাকে শোয়ানো হলো। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, নিশ্চল হয়ে শুয়ে শুয়ে নিশ্বাস নেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় উনি প্রায় হার মেনে চলছেন, আমি অন্য দিকে তাকিয়ে। খালি একটু পর পর কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। এক পর্যায়ে মনে হলো সব শান্ত, কোলের ওপর শুয়ে থাকা মানুষটি হার মেনে নিয়েছেন।

নার্সিংহোমে পৌঁছতেই দুজন ইন্টার্ন ছুটে এলেন। বাবার চোখে আলো ফেলে আর গলা হাতরে পাল্‌স খোঁজার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তাকে মৃত ঘোষণা করে চলে গেলেন। মা বাইরে, কাকা রা এদিক ওদিক পায়চারি করছেন, আর আমার কোলের ওপর পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির মৃতদেহ। এক পর্যায়ে আর না পেরে একটু গলা উচিয়েই কাকাকে ডেকে বললাম, আর পারছিনা, আমাকে একটু বের হতে দিন।

পরের চারটে ঘণ্টা কোথা থেকে উড়ে গেল মনে নেই আর আজ। অনেক রাতে বাসায় গেলাম। ততক্ষণে বাবাকে কবরস্থানে রেখে সবাই বাসায় ফিরেছে। সবাইকে সান্ত্বনা দেয়ার দায়িত্বও যেন শুধুই আমার! ডাক্তার কাকা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে কি একটা ইন্জেকশন বের করে পুশ করলেন। কিছু পর ঘুমিয়ে পরলাম।

সকালে ঘুম ভাঙলো "মনে কি দ্বিধা নিয়ে গেলে চলে" শুনতে শুনতে। আমার বড় আপু বাজাচ্ছিলো। নাস্তা করে পেপার নিয়ে বসতেই নাঈম ভাই এলেন। তার সাথে মিরপুরে তার এক বন্ধুর বাসায় যাওয়া হলো। জীবনের প্রথম হিন্দী সিনেমা দেখলাম, হুতুতু! রাতে ফেরা এবং আবার ইন্জেকশন নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া।

৭ দিন পর প্রথমবারের মত ফোন করলাম ওকে। হাসতে হাসতেই বললাম আমার বাপ মৈরা গেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্যরি বলে ফোন কেটে দিল। দুপুরের দিকে আবার ফোন করলাম, কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, দেখ, বাসার অমতে আমি কিছুই করতে পারবোনা। আমাকে মাফ করে দিও।

আসলে প্রেম ভালবাসা নিয়ে ভাবার মত মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। ১০ দিন পর কোথা থেকে বাসা ভাড়া জোগাড় করবো এই চিন্তাতেই মাথা আউলা, আমি শুধু খানিকটা মনের আশ্রয় পাবার লোভে যোগাযোগ করেছিলাম।

জানিনা কেন, সেই থেকে আজ অবধি জানুয়ারির মাঝ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম কদিন খুব এলোমেলো হয়ে থাকি। অনেক চড়াইউৎরাই পেরিয়ে বলতে গেলে আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ১০ বছর আগে যেই একাকিত্ব আমাকে ঘিরে ধরেছিল আজো সেটা থেকে মুক্তি পাইনি।

প্রিয় নাজমুল এবং অমিত, যদি এতখানি পরার ধৈর্য দেখিয়ে থাক তবে হয়তো বুঝতে পেরেছো আমি খুব একটা স্বাভাবিক নেই কদিন ধরে.....
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ৯:২৪
১১৬টি মন্তব্য ১১২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×