বাঙালী জীবনে যদি গর্ব করার মত কিছু ঘটে থাকে তা হচ্ছে ১৯৭১। এরপর আমাদের জাতীয় জীবনে আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি যা দিয়ে এ জাতি গর্ব করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এখানে আমি কিছু বলব না। শুধুমাত্র বলব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমি বুঝি একটি আধুনিক (অসাসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক) এবং বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ ব্যবস্থা। যে বিশাল আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এ দেশের জন্ম, সে দেশ কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে কতটুকু পাড়ি দিয়েছে এবং আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম আছি তাদের ১৯৭১ এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভূমিকা কি হওয়া উচিত সেদিকে আলোপাত করব।
পেশা হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার কারনে ক্লাসে আমি প্রায় ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে আমি ১৯৭১ নিয়ে জানতে চাই। দুঃখের বিষয় শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী মনে করে ব্যাপারটি রাজনৈতিক এবং তারা যেহেতু রাজনীতি করে না সেহেতু তারা সে বিষয়ে তেমন কিছু জানে না। অনেক শিক্ষার্থী আবার ইতিমধ্যে মনে করা শুরু করে দিয়েছে যে, (এটা অবশ্য আমার অনুমান মাত্র) স্যার বোধহয় বিশেষ একটি দলের পক্ষে হয়ে ক্লাসে এসব কথা বলছে। তাদের মধ্যে এমন কিছু তরুণ শিক্ষার্থী রয়েছে যারা মনে করে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভারতের একটি চক্রান্ত এবং মুক্তিযুদ্ধ না হলে তারা একটি শক্তিশালী ইসলামিক দেশের গর্বিত নাগরিক হতে পারত!!! এদের কাছে ইতিহাস কেবল-ই মিথ্যা বিষয় এবং একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নির্বাচন জয়ের একটি হাতিয়ার মাত্র। এরা অনেক সময় ক্লাসে বলেই ফেলে, ইতিহাস নিয়ে ডুবে থাকা এখন বোকামী এবং ইহুদী নাসারাদের সাথে লড়তে হলে এখন আমাদের পূর্বের ইতিহাস ভুলে গিয়ে সামনের দিকে তাকাতে হবে। ইসলামিক ভাইদের সাথে এক হয়ে লড়তে হবে। ক্লাসে হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। ভীষণ একটি ধাক্বার মতো খায়। এইতো মাত্র ৪০ বছর আগে এদেশের অনেক মেধাবী তরুণ তাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছিল ভবিষ্যৎ প্র্রজন্মের জন্য। সেই মূহুর্তে আমার কল্পনায় শফি ইমাম রুমি (আজ থেকে ঠিক ৪০ (১৯৭১ সালে) বছর আগে একটি তরুণ আমেরিকার ইলিউনিস ইউনিভার্সিটিতে, পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি, পড়ার জন্য আমন্ত্রণ পাই, কিন্তু সে যুবকটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য তাঁর মায়ের কাছে আবদার করে। অনেকক্ষন বাকযুদ্ধের পর যুবকটির মা ছেলের যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে ছেলেকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়। যুদ্ধ থেকে ছেলেটি আর ফিরে আসেনি। প্রথম ঢাকা আক্রমন করার মত দুঃসাহস দেখায় (তাঁর বাহিনীর নাম ছিল ক্র্যাক প্লাটুন)। ছেলেটির নাম শফি ইমাম রুমি এবং তাঁর মায়ের নাম জাহানারা ইমাম। এখন আমরা সব ভুলে গেছি। রাজাকাররা এই দেশে বড়, ইসলাম এজেন্সীশীপ নিয়ে তারা এখন ব্যবসা করে। যুদ্ধাপরাধের বিচার আমি চাই কারণ রুমির মত আরও অনেক তরুণের কাছে জাতি ঋনী, আজ এদের ঋন শোধ করার সময় এসেছে।), বদিউল আলম (বদি) (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র (১৯৭১ এ মাস্টার্স এ অধ্যয়নরত), জীবনে যে কোন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি। ২৫শে মার্চ এ পাকিস্তানীদের বর্বরতা দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেন নি। যোগ দেয় ক্র্যাক প্লাটুনে। দুঃসাহসী হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন এর অন্যতম নায়ক। ২৭শে আগষ্ট,১৯৭১, রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এরপর বদিকে আর কেউ খুঁজে পাইনি।), জুয়েল (ক্রিকেটার, ১৯৭১ এ পাকিস্তান ক্রিকেট এর জাতীয় দলে অন্তর্ভূক হওয়ার পরও যিনি দলে যোগ দেননি, তাঁর সপ্ন ছিল স্বাধীন বাঙলাদেশ এর জাতীয় ক্রিকেট দলের পক্ষ হয়ে খেলবেন, না হয় খেলবেন না) এর মুখগুলো ভেসে আসে। আমি জানি আমার ছাত্ররা আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তারা ভাবছে আমি একটি বিশেষ দলের পক্ষ হয়ে কথা বলছি। এখন মুক্তিযুদ্ধ মানে নির্দিষ্ট একটি দলের। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের আমি রুমি, বদি, জুয়েলকে চিনে কিনা জিজ্ঞ্যেস করি কিন্তু এরা কিছুই জানে না। বেশীর ভাগ ছাত্র-ছাত্রী এমনি বলতে পারে না কেন আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। এই মূহুর্তে আমার মনে পরছে শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার ”রাইফেল, রোটি, আওরাত” উপন্যাসের শুরুতে একটি বিখ্যাত উক্তি ”মানুষ এবং পশুর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে পশু শুধু বর্তমান নিয়ে থাকে আর মানুষ অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে….যখন কোন ব্যক্তি বা সমাজ একমাত্র বর্তমানের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে তখন সর্বনাশের ইশারা প্রকট হতে থাকে….” জাক লাঁকার ভাষায় বলতে হয়- ”ইতিহাস শুধু অতীত নয়।”
তরুণ প্রজন্মের এই ইতিহাস বিমুখতার জন্য আমি ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট এর পর দুইটি সামরিক সরকার মূলত এর জন্য দায়ী। তারা চেয়েছিল ১৯৭১ এর সম্পূর্ণ চিন্হ মুচে দিতে। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে সত্যকে বেশীদিন ধামা চাপা রাখা যায় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে সেইসব শহীদ তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ক্ষমা করবেন না। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ইতিহাস আমাদের আস্তাকুড়েতে নিক্ষেপ করবে। এখন বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে ঠিক করতে হবে দেশ কোন দিকে যাবে, আমরা কি আফগানিস্তান এর দিকে যাব নাকি একটি আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নের দিকে যাব। যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম আজ থেকে ৪০ বছর আগে।
আমার অনেক সহকর্মী আমাকে বলেন, শিক্ষক হিসেবে আমার নিরপেক্ষ থাকতে হবে। আমি যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই।হ্যা, আমি এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নই। শিক্ষক হিসেবে আমি নিরপেক্ষ থাকতে পারি না। যুদ্ধাপরাধের বিচার কোন রাজনৈতিক চাওয়া নয়। এটি সমগ্র জাতির অস্থিত্বের প্রশ্ন। এটি একটি মিথ্যার বিরূদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা মেরুদন্ডহীনতার পরিচয়। একজন মেরুদন্ডহীন শিক্ষক একটি মেরুদন্ডহীন জাতি-ই উপহার দিতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১২ রাত ১০:৫৯