somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পানির সমস্যা

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পানির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে নিবিড়৷ আর এ পানি কলুষিত হলে জীবন ধারণের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক৷ সভ্যতার শুরুতে মানুষের সমাজবদ্ধ হওয়ার দিনগুলোতে নদী বা হ্রদ ছিল পানির উত্‍স আর সেই পানির উত্‍সকে ঘিরেই দূর অতীতে গড়ে উঠেছিল গ্রাম ও নগর৷ বেগমান নদী, ঘূর্ণমান পানি অপো হ্রদ বা সরোবরের স্থির পানি স্বচ্ছ পরিষ্কার ও সুস্বাদু৷ মানুষ সে-কারণেই পুকুর, কৃত্রিম সরোবর তৈরি করে পানীয়জল হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে৷ পরবতর্ীতে আবিষ্কৃত হয় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা অর্থাত্‍ নলকূপ৷ পুকুর বা কূয়োর পানি আপাতদৃষ্টিতে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার মনে হলেও সে পানি কিন্তু পানের উপযোগী নয়৷ এতে রোগজীবাণু ছাড়াও এমন কিছু রাসায়নিক ও খনিজ পদার্থ থাকে যা মানব দেহের প েতিকর৷ তাই বিশুদ্ধ পানির এক নাম যেমন জীবন, তেমনি দূষিত পানির অপর নাম মরণ৷
পানীয় জলে মিশ্রিত অতিরিক্ত খনিজ উপাদান শরীরের জন্যে তিকর৷ আমাদের দেশে পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের ল্যে বিশেষ করে গ্রাম বাংলায় নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার জন্যে ৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে নলকূপ বসানোর কাজ শুরু হয়৷ ক্রমশঃ মানুষ নলকূপের পানি পান করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং পুকুর, দীঘি, কুয়া ইত্যাদির পানি পান করা পরিত্যাগ করে৷ এর ফলে যুগযুগ ধরে গ্রাম বাংলায় ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশুদ্ধ করার যে দেশজ প্রযুক্তি প্রচলিত ছিল তাও মানুষ তিন-চার দশকের ভেতর ভুলে যায়৷
বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, বিশেষ করে গ্রামের মানুষ খাবার পানির বিষয়ে একান্তভাবে নলকূপনির্ভর হয়ে পড়েছে অথচ এই নলকূপ হতে বের হচ্ছে পানি মিশ্রিত বিষাক্ত পদার্থ৷ আর্সেনিক-এর রাসায়নিক সংকেত AS,রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এটি ধাতু ও অধাতু উভয়ের ধর্মই প্রদর্শন করে বলে একে অপধাতু বা মেটালয়েড বলে৷ প্রকৃতির প্রায় সর্বত্র এই আর্সেনিকের উপস্থিতি ল্য করা যায়৷ প্রকৃতিতে আর্সেনিকের যৌগগুলোকে অজৈব ও জৈব এই দুইভাবে ভাগ করা যায়৷ অজৈব আর্সেনিক জৈব অপো অনেক বেশি তিকর৷
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জেনে আসছে, নলকূপের পানি বিশুদ্ধ৷ কিন্তু ইদানীং যখন তারা জানতে পারছে যে, নলকূপের পানি ব্যবহারের কারণে তাদের মাঝে একটি মারাত্মক রোগ সৃষ্টি হচ্ছে তারপরও তা ব্যবহার বন্ধ করছে না৷ আবার অনেকে বিশ্বাসই করছে না নলকূপের পানি দূষণের কারণে রোগ হচ্ছে৷ আমাদের বাংলাদেশ ষড় ঋতুর দেশ হলেও শীত ও গ্রীষ্মেই পানির অভাব অনুভব হয় বেশী৷ দেশের অধিকাংশ জেলায় এ সময় পানি দুর্লভ হয়ে পড়ে৷ নলকূপের পানির স্তর নীচে নেমে যায় দ্রুত৷ শুকিয়ে যায় নদ-নদী, খাল-বিল৷
জনসংখ্যানুপাতে বাংলাদেশে খাবার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল৷ নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজনে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন এক বিতর্ক৷ গত তিন দশকে ভূগর্ভস্থ পানির জন্যে কমপ ে৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে, অথচ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়নি দেশের সর্বসাধারণের জন্যে৷
জীবাণু ও দূষিত গ্যাস থাকার ফলে পানি দুর্গন্ধ ও বিস্বাদ হয়৷ যেমন পানিতে ঝাঁঝালো গন্ধ থাকলে বুঝতে হবে এতে জৈব অ্যামোনিয়া আছে৷ বিশেষ করে শিল্পকারখানা এলাকায় ভূপৃষ্ঠস্থ পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি থাকে৷ নাইট্রোজেনের যৌগগুলো অঙ্েিজনের সংস্পর্শে এসে তিকারক নাইট্রাইড তৈরি করে৷ আর এ নাইট্রাইডের উপস্থিতি পানিতে কোনভাবেই কাম্য নয়৷ তাই মানুষ বাধ্য হয়েই লেগে যায় ভূগর্ভস্থ পানি সংগ্রহে৷ শুরু হয় গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপন৷ এভাবে পানি উত্তোলন অব্যাহত থাকলে ভূগর্ভস্থ পানি স্তর শুকিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়৷ উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু জায়গায় এরই মধ্যে খাবার পানির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে৷ ছোট বড় শহরে পানি সংগ্রহের করুণ সচিত্র খবর পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে প্রতিনিয়ত৷ শুধু পানি স্বল্পতাই নয়, উদ্বেগ দেখা দিয়েছে পানির মানগত দিক নিয়েও৷
পানি দূষণ আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকি অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়নের ফলে আবাসিক এলাকা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা, পয়ঃনিষ্কাশন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে৷ তেলের ট্যাংকারের মতো উত্‍স থেকেও প্রচুর ধাতু, যৌগ, ার, তৈলাক্ত পদার্থ, সীসা, পারদ, দস্তা ও ক্রোমিয়ামের মতো বিষাক্ত দ্রব্য সাগরে ছড়িয়ে পড়ে৷ আমাদের দেশে বস্ত্র শিল্প, চামড়া শিল্প, শোধনাগার, ছাপাখানা ও বড় শিল্পের তরল বর্জ্য পানি দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ৷ অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠের পানি দূষণ সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়ে যখন গ্রামের মানুষ নলকূপ ব্যবহার শুরু করেছে তখনই তারা শিকার হয়েছে আর্সেনিকের৷ আজ বাংলাদেশের বৃহত্‍ জনগোষ্ঠী আর্সেনিকজনিত সংকটে পতিত৷ বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্যে বড় সমস্যা যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে৷ সমপ্রতি ইউএনএফপি-এর এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামাঞ্চলে শতকরা ৮৭ ভাগ লোকের পানীয় এবং সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই৷ এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রতি-পাঁচটি রোগের মাঝে চারটিই সৃষ্টি হয় বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব থেকে৷ আর এজন্যে তৃতীয় বিশ্বে পানিবাহিত রোগে প্রতিদিন গড়ে ২৫ হাজার লোক মৃতু্যবরণ করে৷
ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি দূষিত হয় কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে৷ এই কীটনাশকে থাকে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস৷ অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হলে তা মাটির ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে ভূ-অভ্যন্তরের পানিকে বিষাক্ত করে তোলে৷ শহরাঞ্চলে ভূঅভ্যন্তরে পানি দূষিত হবার স্তরটি মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে৷ ময়লা আবর্জনা ফেলার স্থান ভূগর্ভস্থ পানি দূষণের একটি বড় উত্‍স৷ বাংলাদেশ সরকার পানি সরবরাহের জন্যে স্থাপন করেছে বিভিন্ন প্রযুক্তির নলকূপ৷
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সর্বপ্রথম ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯০ এর সময়কালে আন্তর্জাতিক পানীয়জল সরবরাহ ও স্বাস্থ্যরার েেত্র উল্লেখযোগ্য সার্ভিসের মাত্রা বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল৷ কিন্তু বর্তমানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এর জরিপে উল্লেখ করা হয়, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোয় প্রতি ৫ জনে ৩ জন নিরাপদ খাবার পানি পায় না এবং প্রতি ৪ জনের মাঝে ৩ জনের স্বাস্থ্যরার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই৷ গ্রামাঞ্চলে এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ৷ মাত্র ১ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যরা সার্ভিস পেয়ে থাকে৷ স্বল্প মাত্রায় পানি সরবরাহ ও অপ্রতুল স্বাস্থ্যরার জন্যে এসব দেশে শতকরা ৮০টি রোগব্যাধি হয়ে থাকে৷
বাংলাদেশের সরকারের ২০১০ সালের মাঝে সবার জন্যে স্বাস্থ্যের পাশাপাশি নিরাপদ পানির ব্যবস্থার অঙ্গীকার ঘোষণার পরও, ব্যবস্থাপনার অভাবে দূষিত পানি পান করে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এসব পানিবাহিত রোগে অধিক আক্রান্ত হচ্ছে অপুষ্টির শিকার শিশুরা৷ বাস্তবতা হচ্ছে ২০০ জন মানুষের জন্যে রয়েছে একটি মাত্র নলকূপ; ৮ শতাংশ মানুষ নলকূপের পানি পান করে; মাত্র ২৬ শতাংশ মানুষ সবকাজে নলকূপের পানি ব্যবহার করে৷ এরপর রয়েছে পানি স্তরের ভিন্নতা ভেদে বৈষম্য৷ উপকূলীয় এলাকায় ২৫২ জনের জন্য রয়েছে ১টি নলকূপ; পানি স্তরের নিচে নেমে আসে এমন এলাকায় ১৮৫ জনের জন্য রয়েছে ১টি নলকূপ; পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৫০ জনের জন্য ১টি নলকূপ; অথচ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে ৪০ শতাংশ এলাকায়৷
ঢাকা মহানগরীতে পানির চাহিদা দৈনিক ১৪০ কোটি লিটার৷ ঢাকা ওয়াসার ৩১১টি গভীর নলকূপের মাঝে সচল রয়েছে ২০০টি৷ এগুলো থেকে দৈনিক পাওয়া যাচ্ছে ১১৯ কোটি লিটার পানি৷ এর শতকরা ২২ ভাগ সিস্টেম লস মিলে ৫০ কোটি লিটার পানি কম সরবরাহ হওয়ায় পানি সংকট শুরু হয়৷ কিছুসংখ্যক বাড়ির মালিক মূল সরবরাহ লাইন থেকে মোটরের মাধ্যমে পানি টেনে নেয়ার ফলে সাধারণ লাইনে প্রবাহ কমে যায়৷ অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের জন্য অনেক পাম্পহাউজই পানি উত্তোলন করতে পারে না৷ যদিও ওয়াসা দাবি করে, তারা পাম্প হাউজগুলোতে জেনারেটরের সংযোগ করায় পানি উত্তোলনের সমস্যা নেই, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, জেনারেটর সংযোগের বাইরে রয়েছে ১৯৯টি পাম্প, যা ডেসার বিদু্যতের সাহায্যে চলছে৷ ওয়াসা এক দশকেও সায়দাবাদ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কাজ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার নিয়োগ ইত্যাদি সমস্যার জন্যে শেষ করতে পারে নি৷ যদি এ শোধনাগারটি চালু করা যেত তাহলে আজ যে হাহাকার হচ্ছে পানির জন্য তা হতো না৷ অপ্রতুল পানি সরবরাহ ছাড়াও ওয়াসার পানির দামও বেশি৷ প্রতি হাজার গ্যালনের মূল্য ৫ টাকা, যা ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশি৷ এরপরও ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ নয়৷ এ পানিতে বিপুল পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া থাকে৷ চান্দনীঘাটের ট্যাঙ্ক বুড়িগঙ্গার যে স্থান থেকে পানি সংগ্রহ করে তাতে অঙ্েিজনের পরিমাণ খুবই বেশি৷ সেখানে বিভিন্ন জৈব পদার্থ ও ভাসমান পদার্থ বিপজ্জনক অবস্থায় পাওয়া যায়৷ ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াও অসম্পূর্ণ৷ ওয়াসার পানি সরবরাহকারী লাইনে প্রচুর পরিমাণ জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে৷
এসব দিক বিবেচনা করে চিকিত্‍সকরা ওয়াসার পানি কমপ ে২০ মিনিট ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দেন৷ এটা মানতে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ১৮ কোটি টাকার গ্যাস৷ তিতাস গ্যাসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, একটি বার্নারে এক ঘণ্টার জন্য গ্যাস মাত্র ১৯৫ টাকা নিয়ে থাকে৷ একটি বার্নারে যে-গ্যাস পোড়ে তার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ১০০ টাকা৷ ঢাকার ১ কোটি অধিবাসীর মাঝে অর্ধেকের বেশি মানুষ ফোটানো পানি পান করে৷ প্রতিদিন গড়ে ৪ লিটার পানি ফোটাতে এক ঘণ্টা গ্যাস পোড়াতে হয়৷ এ হিসাবে পানি ফোটাতে প্রতিদিন ঢাকায় ব্যয় হচ্ছে ১৮ কোটি টাকা৷
ঢাকায় ৭০ শতাংশ দূষণ ঘটে গ্রাহকের অব্যবস্থাপনা এবং অসচেতনতার জন্যে৷ গ্রাহক ওয়াসার মূল লাইনে অতিরিক্ত পাম্প বসিয়ে পানি টেনে নেয়৷ এভাবে পাম্প বসানোর কাজটি অবৈধ৷ কিন্তু ঢাকা শহরে আশি শতাংশ গ্রাহক সেই অবৈধ কাজটিই করছে৷ সমস্যা হচ্ছে পাম্প মেশিন বসিয়ে যখন পানি টানা হয় তখন ফাঁকা লাইনের ভ্যাকুয়াম অংশে প্রচণ্ড টানের সৃষ্টি হয়৷ এ টানে পানি আসার আগেই লাইনের ফুটো দিয়ে বাইরের নানা ধরনের রোগ জীবাণু প্রবেশ করে৷ এভাবে পানি ব্যাপকভাবে দূষিত হয়৷ পাইপ লাইনে লিকেজ হবার জন্য ওয়াসার এবং ঠিকাদারদের গাফিলতিকেই দায়ী করা হয়৷ গ্রাহকের অসাবধানতায় পানি দূষিত হয় রিজার্ভ ট্যাংক এবং ওভারহেড ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করার জন্যে৷ ৬ মাস অন্তর রিজার্ভ ট্যাংক ১০ গ্রাম বি্লচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়৷ অথচ বছরের পর বছর চলে গেলেও গ্রাহকরা তাদের ট্যাংক পরিষ্কার করেন না৷
বন্যা, বৃষ্টি, কিংবা ভূগর্ভস্থ স্রোতের মাধ্যমে পানির একটি যোগান রয়েছে৷ তবে এ প্রাকৃতিক সরবরাহের তুলনায় উত্তোলনের ব্যাপারটি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷ এজন্যে আস্তে আস্তে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে৷ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় একদিকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, যা নতুন দুর্যোগ বিশেষ করে ঢাকা শহরে আর্সেনিক দূষণের মতো ঘটনা ঘটছে বলে আশংকা করা হচ্ছে৷
এদিকে ঢাকা ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ওয়াসা বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতুর কাছে পানি শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করে তা পাগলায় নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ বুড়িগঙ্গার নদীর পানি শোধনের অনুপযুক্ত হওয়ায় পদ্মা নদীকে বেছে নেয়া হয়েছে৷ এজন্যে পদ্মার মাওয়া পয়েন্ট থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি পাগলায় এনে শোধন করার পর ঢাকা নগরে সরবরাহ করা হবে৷ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪শ' কোটি টাকা৷ প্রকল্পটি নগরবাসীর জন্যে আশার সঞ্চার করলেও বিবিসি একটি দুঃসংবাদ দিয়েছে৷ দিলি্লর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আইসিএসআই এর প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ ইসমাইল হাসনাইনের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়ায় আগামী ৩৫ বছরে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মতো অনেক বড় নদ-নদী শুকিয়ে যাবে, কেননা পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্রের উচ্চতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি দুইমেরুর পরেই হিমবাহ ধারণে যার অবস্থান সেই হিমালয়ের বরফ গলে যাবে৷ ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে বলে তিনি জানান৷ প্রক্রিয়াটি বর্তমান হারে চলতে থাকলে আগামী ২০৩৫ সাল নাগাদ হিমালয়ের পুরো হিমবাহ গলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এতে শুধু ঢাকা শহর নয়, সামগ্রিক অঞ্চলে কি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে তা মাত্র অনুমান করা যায়৷
পরীামূলকভাবে ওয়াসা বৃষ্টির পানি ধারণ করে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের বিষয়ে জনসাধারণকে উত্‍সাহী করার ল্যে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে৷ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ভবনের ছাদে বৃষ্টির পানি ধারণ ও ব্যবহারের একটি বাস্তবসম্মত মডেল চূড়ান্ত করা এবং এ বিষয়ে গণমাধ্যম সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের দ্বারা জনসাধারণ তথা নগরীর বাড়ির মালিকদেরকে উত্‍সাহিত করা৷ পরীামূলক এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে কারওয়ান বাজারস্থ ওয়াসা ভবনের ছাদে বৃষ্টির পানি ধারণ করে ভবনের সপ্তম তলার ট্যাংকে পানি নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷ ভবনের ছাদের আয়তন প্রায় ১৩,০০০ বর্গফুট এবং প্রকল্পের আওতায় গত বর্ষা মৌসুমে এর অর্ধেক অংশে পানি ধারণ করে ওয়াসা ভবনে সরবরাহ করা হয়েছে৷
ভারত, মালদ্বীপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৃষ্টির পানি বাড়ির ছাদে ধারণ করে ব্যবহার করা হয়৷ বৃষ্টির পানির বহুল ব্যবহার প্রচলিত হলে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমবে অন্যদিকে জলাবদ্ধতাও হ্রাস পাবে৷ ফলে পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হবে৷ ছাদে পানি ধারণ করার দুটো সুবিধা আছে৷ প্রথমতঃ খাওয়া ব্যতীত ব্যবহার্য চাহিদা মিটবে, দ্বিতীয়তঃ সঙ্গে সঙ্গে উদ্বৃত্ত পানি পাইপের মাধ্যমে ভূঅভ্যন্তরে ফিরিয়ে দেয়াও সম্ভব হবে৷ ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে ওয়াসার ভূগর্ভভিত্তিক পানি উত্তোলন ও সরবরাহ ব্যবস্থা নগরবাসীর জন্যে ক্রমশঃ অপ্রতুল হয়ে পড়ছে৷
পরিসংখ্যান বু্যরোর হিসাব অনুযায়ী এদেশে অভ্যন্তরীণ জলাধারের পরিমাণ তিন হাজার ছয়শত তেইশ বর্গমাইল৷ এছাড়া নদী দখল করে আছে তেরো হাজার সাতশত সত্তর বর্গমাইল৷ দেশে ছোটবড় পুকুরের সংখ্যা বাইশ লাখ আটাশি হাজার দু'শ বাইশ৷ ভূপৃষ্ঠের এ পানি ঋতু ভেদে যথেষ্ট না-হওয়ার দরুন নির্ভর করতে হচ্ছে ভূগর্ভের পানির ওপর৷ মাস্টার প্ল্যান অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে শীতকালে পানির সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে তিন হাজার কোটি কিউবিক লিটার৷ এ পরিমাণ প্রয়োজন শুধু কৃষি কাজের জন্যেই৷ অন্যদিকে খাল-বিল হাওড় থেকে এক হাজার আটশত কোটি কিউবিক লিটার পানি পাওয়া যায়৷ বাকি একহাজার সাতশত কোটি কিউবিক লিটার পানির জন্য নির্ভর করতে হয় ভূগর্ভের পানির ওপর৷ কৃষি সেচের জন্য ঊনসত্তর শতাংশ পানি ভূগর্ভ থেকে ওঠানো হয়৷
মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী দেশে দৈনিক দশ কোটি লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে৷ এখন প্রায় তিন কোটি বিশ লাখ মানুষ প্রতিবছর পানির সংকটে ভোগেন৷ ওয়াটসন প্রকল্পের গবেষণায় বলা হয়েছে দেশের নলকূপগুলোর শতকরা ছেচলি্লশ ভাগের পানিই আর্সেনিকযুক্ত৷ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে প্রকাশ, টিউবওয়েলের নিরাপদ পানি ব্যবহারের আওতায় সাতানব্বই শতাংশ মানুষকে আনা হয়েছিল৷ কিন্তু চৌষট্টিটি জেলার একষট্টিটিতেই ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক দূষণের ফলে এ সংখ্যা এখন পঁচাত্তর শতাংশে নেমে এসেছে৷ জাতিসংঘ জনসংখ্যা সংক্রান্ত এক হিসেবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, বর্তমান দশক নাগাদ বিশ্বের ২০০ কোটি মানুষ খাবার পানির তীব্র সংকটে পড়বে৷ ২০৫০ সালে এ ধরনের দেশের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৮ এবং পানির অভাবে ভুগবে এমন মানুষের সংখ্যা হবে চারশত কোটি৷ এর মাঝে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা হবে সবচেয়ে ভয়াবহ৷ ২০২০ সালে বাংলাদেশে পানির প্রয়োজন হবে ২৪,৩৭০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার৷ মাটির ওপর এবং নীচে থেকে আমরা যে পানি পাব তার পরিমাণ ২৩,৪৯০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার৷ অর্থাত্‍ প্রয়োজনের চেয়ে ৮৮০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার কম৷ এর মধ্যে সিংহভাগ পানি খরচ হবে কৃষি সেচের জন্য৷
কুমিল্লা পৌর এলাকার প্রায় দশ লাধিক অধিবাসীর জন্য ৬টি ওভারহেড ট্যাংক, ২৫টি পাম্প স্টেশন, ১৮টি গভীর নলকূপ রয়েছে৷ ৩৬৫টি রাস্তার ট্যাপ ও ৩০০টি অগভীর নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক ৫৬ লাখ গ্যালন পানি পৌর এলাকার ৮৯.৪২ কি. মি. পানির পাইপ লাইন দিয়ে সরবরাহের কথা থাকলেও, মাত্র ১৯ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ হচ্ছে৷ যদিও কুমিল্লা পৌরবাসীর চাহিদা দৈনিক ৪৫ লাখ গ্যালন পানি৷ গত দু'বছর হলো কুমিল্লা পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের আওতায় ১২ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়৷ গোবিন্দপুর, দণি বিষ্ণুপুর ও সুজানগর-এ চারটি স্থানে ২ লাখ গ্যালন ধারণ মতাসম্পন্ন ওভারহেড ট্যাংক স্থাপনসহ ১০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে৷ অথচ দু'বছরের ব্যবধানে বিষ্ণুপুর এলাকায় ওভারহেড ট্যাংকের ৫টি অকেজো হয়ে গেছে এবং অন্যান্য ট্যাংকগুলো নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে সঠিকভাবে পানি সরবরাহ করতে পারছে না৷
বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে বলা হয়ে থাকে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী৷ ৩৩ ল অধিবাসীর জন্যে চট্টগ্রাম নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ১০ কোটি গ্যালন৷ বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ করছে মাত্র সাড়ে তিন কোটি গ্যালন৷ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে সাড়ে ৬ কোটি গ্যালন৷ ওয়াসার সরবরাহ নেটওয়ার্কের পাশাপাশি প্রায় অর্ধেক পানি হালদা নদী থেকে উত্তোলন করে বহদ্দারহাটে মোহরায় শোধন এবং বাকি অর্ধেক গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলনের পর পরিশোধন করা হয়৷
ওয়াসার পাশাপাশি নলকূপভিত্তিক পানি ব্যবহারকারীদের অবস্থাও ভাল নয়৷ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বহু নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ছে৷ এ ঘাটতি পূরণে ওয়াসা চারটি প্রকল্প গ্রহণ করে ২৪ কোটি টাকা ব্যয় 'সেকেন্ড ইন্টাররিম ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট' নামে প্রকল্পের আওতায় নগরীর পানি সরবরাহ উন্নয়ন, পানি উত্তোলন অন্তভর্ুক্তির কাজ শেষ হয়েও হচ্ছে না৷ এদিকে ফতেয়াবাদ এলাকায় 'সার্ড ইন্টাররিম ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট' নামে প্রকল্পটি বহু আগে গ্রহণ করা হলেও নানা টানাপোড়েনে প্রকল্পটির খসড়া চাপা পড়ে থাকে, কিছুদিন পূর্বে প্রকল্পটি প্রি-একনেকের অনুমোদন পেয়েছে৷
রাজশাহীর প্রায় ৭ লাখ জনসংখ্যা অধু্যষিত নগরীতে প্রায় ২ কোটি গ্যালন পানির চাহিদার অনুকূলে সিটি কর্পোরেশন সরবরাহ করতে পারে মাত্র ৬০ হাজার গ্যালন৷ ৩৬টি ওয়ার্ডের মাত্র ১৫টিতে কর্পোরেশন পানি সার্ভিস লাইন স্থাপন করেছে৷ বর্তমানে ৩৩টি পানির পাম্প দ্বারা ১৯০ কি. মি. পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে৷ এছাড়া ৩ হাজার ৫শত হস্তচালিত নলকূপ স্থাপনের কথা কতর্ৃপ জানালেও বাস্তবে রয়েছে অনেক কম৷
খুলনা পৌরসভার ১৫ লাখ অধিবাসীর জন্য নূ্যনতম প্রয়োজন ৩ কোটি গ্যালন৷ সরবরাহ করা হয় ৬০ লাখ গ্যালন৷ খুলনা মহানগরীর পানি সংকটের স্থায়ী সমাধানে ইতিপূর্বে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা ফাইলবন্দী হয়ে আছে৷ খুলনা মহানগরী পানি সরবরাহ ব্যবস্থা টিকে রয়েছে মূলতঃ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে৷ ৪৮টি প্রোডাকশন ওয়েল (পাম্প) থেকে বিভিন্ন এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয়৷ এছাড়া নগরীতে ১৬শ' গভীর ও ৩ হাজার অগভীর নলকূপ রয়েছে৷ ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনের ফলে বিভিন্ন এলাকার অগভীর নলকূপে পানি উঠছে না৷ নগরীর বিপুলসংখ্যক মানুষ ধোয়া-মোছা ও গোসলের জন্যে পুকুর, খাল, নদীর পানি ব্যবহার করে৷ শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে যায়৷ বর্তমানে নদীর পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ফলে নলকূপের ওপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ছে৷ খুলনায় ওয়াসা স্থাপনের সিদ্ধান্তটি এখনও হিমাগারে৷ প্রায় চার বছর আগে ডুয়েল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়েছে৷ এই প্রকল্পে দুটো ব্যবস্থা রাখা হয়৷ এর একটি হচ্ছে নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ ব্যবস্থা এবং অন্যটি অপরিশোধিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা৷

দুই

পৃথিবীর পানির বেশির ভাগই থাকে সাগর-মহাসাগরে৷ যার পরিমাণ ১৩৭ কোটি ঘন কিলোমিটার৷ কিন্তু তা লবণাক্ত৷ মিষ্টি পানির বৃহত্তম উত্‍স হচ্ছে হিমশৈল এবং বরফের পাহাড়৷ এই বরফের পাহাড়ের বৃহত্তম অংশ রয়েছে অ্যান্টার্কটিকা বা কুমেরু মহাদেশ৷ যেখানে প্রায় ৩ কোটি ঘন কিলোমিটারের মতো পানি রয়েছে বরফ আকারে৷ অবশিষ্ট উত্‍সগুলোর মাঝে পড়ে নদী হ্রদ মাটি এবং আবহাওয়া৷ এগুলোর মাঝে পানির মোট পরিমাণ ২ লাখ ঘন কিলোমিটার৷ এসব ছাড়াও মিষ্টি পানির আরো একটি উত্‍স রয়েছে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে৷ এর মাঝে রয়েছে সংখ্যক গভীর খাদ৷ বাকী সব অত্যন্ত সরু রন্ধ্র বিশেষ বালুকণার অন্তর্বতর্ী সূক্ষ্ম ফাঁক এবং শিলাস্তরের সূক্ষ্ম ফাটল৷ এসব রন্ধ্রে প্রচুর পরিমাণ পানি থাকে৷
শিলাস্তরের রন্ধ্রের মাঝে প্রায় ৫ কোটি ঘন কিলোমিটার পরিমাণ পানি রয়েছে যার ভেতর ৪০ লাখ ঘন কিলোমিটার মিষ্টি পানি৷ কোনও কোনও শিলাস্তর অন্যান্য শিলাস্তর থেকে বেশি রন্ধ্রবহুল হয়ে থাকে৷ আবার ত্রেবিশেষে রন্ধ্রগুলো আয়তনে বড় হয়৷ আর তাদের মাঝে থাকে পারস্পরিক সংযোগ৷ এ ধরনের শিলাস্তরের ভেতর পানি অনায়াসে প্রবাহিত হতে পারে৷ এদের বলা হয় 'প্রবেশ্য শিলা'৷ যেমন বেলে পাথর এবং নুড়ি৷ কোনও কোনও শিলা আছে পানি যাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় না৷ তাই এ ধরনের শিলাকে বলা হয় 'অপ্রবেশ্য শিলা'৷ যেসব শিলাস্তর যথেষ্ট সচ্ছিদ্র এবং তার ফলে প্রচুর পরিমাণ পানি ধারণে সম, সেই পানি শিলার মধ্য দিয়ে অবাধে প্রবাহিত হয়৷ তাই তাদের বলা হয়ে থাকে পানিশিরা৷ এ জন্য ভূস্তরের মধ্যস্থিত এই পানিশিরা মিষ্টি পানির একটি বড় উত্‍স৷
অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের উপরে থাকে পানিশিরা৷ বর্ষার পানি সম্পৃক্ত হলে পানিশিরার পানি ক্রমে ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়৷ যেসব অঞ্চলে ভূমি নিচের দিকে ঢালু সেই সব অঞ্চলেই চলে এ ধরনের প্রবাহ৷ এর ফলে কোনও কোনও েেত্র চুঁইয়ে পড়ে পানি৷ কোনও কোনও জায়গায় এমনও দেখা যায়, বৃষ্টির পানি মাটিতে এসে পড়ছে, মাটি সেই পানি শুষে নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে পানিশিরায়৷ পানিশিরার মাধ্যমে সেই পানি প্রবাহিত হচ্ছে দূরবতর্ী অঞ্চলের উপত্যকার মতো নিচু এলাকায়, যেখানে সৃষ্টি করছে প্রস্রবণ৷ আর এ প্রস্রবণের পানিতেই সৃষ্টি হয় মরুদ্যান৷ উল্লেখ করা যেতে পারে লিবিয়ার মরুভূমি অধু্যষিত কুফরার কথা৷ যেখানে দূর থেকে বেলে পাথরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে পানি, তাকে বলা হয় নুবিয়ান বেলে পাথরের পানিশিরা৷ এই পানিশিরার পানিতে কুফরায় গড়ে উঠেছে একটি শীতল পানির হ্রদ৷
পানি সম্পৃক্ত শিলাস্তরের উপরের অঞ্চলটিকে বলা হয় 'ওয়াটার টেবিল' বা পানি সীমা৷ এই পানি সীমার নিচে যে শিলাস্তর থাকে সেই শিলাস্তরের মধ্যস্থিত সম্পৃক্ত পানিস্তরকে বলা হয় 'গ্রাউন্ড ওয়াটার'৷ এই স্তরের উপরে থাকে অসম্পৃক্তস্তর৷ কোনও কোনও অঞ্চলে পানিশিরার বৈচিত্র্যের দরুন কূপ খননেরও ব্যবস্থা করা যায়৷ শিলায় ফাটল বা সূক্ষ্ম রন্ধ্র না থাকলে মাটির পানি ভূস্তরের গভীরে প্রবেশ করতে প্রচুর সময় নেয়৷ কিন্তু একবার গভীরতম অঞ্চলে প্রবেশ করলে সেই পানি ভূস্তরের গভীর অঞ্চলে থেকে যায় বছরের পর বছর৷ কূপ অথবা প্রস্রবণের মাধ্যমে সেই পানি পুনরায় বেরিয়ে আসতে সময় নেয় দশ থেকে হাজার বছর৷ কোনও কোনও অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠে থাকে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর বা মৃত্তিকাপাথর, গ্র্যাফাইট পাথর অথবা পরিবর্তিত শিলা অর্থাত্‍ স্লেট৷ এ ধরনের ভূপৃষ্ঠে খুব কম পরিমাণ বৃষ্টিই শোষিত হয়৷
অস্ট্রেলিয়ার জলবিজ্ঞানীরা গ্রেট আরটেজিয়ান বেসিন এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেন ঐ অঞ্চলের কোনও কোনও জায়গায় গভীর ভূস্তরের মাঝে জমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ পানি, প্রাকৃতিক সঞ্চয় হিসেবে৷ এ পানির বয়স প্রায় দশ ল বছর৷ এ ধরনের পানিকে বলা হয় 'প্রাচীন পানি' বা ওল্ড ওয়াটার৷ আর প্রতিবছর বর্ষায় ভূস্তরের উপরের দিকে যে পানি জমে তাকে বলা হয় 'নতুন পানি' বা নিউ ওয়াটার৷ কোনও কোনও অঞ্চলে গভীর ভূস্তরে এমন পানিরও সন্ধান পাওয়া গেছে যা সঞ্চিত হয়েছিল শেষ বরফ যুগের সময়৷ এ পানিকে বলা হয় 'ফসিল ওয়াটার' বা 'জীবাশ্মপানি'৷ আবার সব েেত্র বৃষ্টির পানিই যে শুধু গভীর ভূস্তরে সঞ্চিত হয় তাও নয়, কোনও কোনও অঞ্চলে দেখা গেছে সমুদ্রের নিচে গভীর শিলাস্তর৷ সেই শিলাস্তরের ফাটলের মধ্য দিয়ে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করে স্থানে স্থানে শিলাস্তরের মাঝে আটকে রয়েছে৷ লবণাক্ত হওয়ায় এ পানি পানের অনুপযোগী৷
পৃথিবীর বহু দেশে এখন বিদু্যত্‍ শক্তি উত্‍পাদনের জন্য বসানো হয়েছে পারমাণবিক চুলি্ল৷ এসব চুলি্ল থেকে ছড়ায় তেজস্ক্রিয় বস্তু৷ এছাড়াও পারমাণবিক চুলি্লতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলেও যথেষ্ট পরিমাণ তেজস্ক্রিয় দূরবতর্ী অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ সেসব আবার পানিতেও মিশে যায়৷ তাই তেজস্ক্রিয় কণা মিশ্রিত পানি বেশ কিছুটা সময় ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকলে তেজস্ক্রিয় কণায় পরিণত হয়৷ এজন্যে ভূগর্ভস্থ পানিই স্বাস্থ্যের প েনিরাপদ৷ এসব কথা বিবেচনা করে জলবিজ্ঞানীরা এখন ভূগর্ভস্থ পানির কথাই ভাবছেন বেশি৷ অজ্ঞাত ভূগর্ভস্থ উত্‍সগুলো আবিষ্কার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে বহু অঞ্চলে পানি সরবরাহ করা সম্ভব, চেষ্টাও চলছে অনেক উন্নত দেশে৷
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন চলতি শতকে মানবতার অন্যতম প্রধান বিপর্যয় হতে পারে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংস্থানকে কেন্দ্র করে, এমনকি বিশ্বযুদ্ধ বাধলে তার কেন্দ্রীয় ইসু্য হবে পানি৷ এ শতাব্দীতেই পানির জন্য মানব সভ্যতার বিপর্যয়ের আশংকা ক্রমশই বাড়ছে৷ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী পানিবাহিত রোগে জনস্বাস্থ্য হানির ওপর গবেষণা চালিয়েছে৷ সংস্থাটির মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে আড়াই কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগে অকালমৃতু্য বরণ করছে৷
বিশ্ব পানি সাংবাদিক ফোরাম পানির সঠিক ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে৷ পানি নিয়ে আশংকাজনক পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে বিশ্ব পানি সম্মেলনগুলোতে৷ খাদ্যের বাজার, অস্ত্রের বাজার, পেট্রোলের বাজার, ইলেকট্রনিঙ্-এর বাজার ইত্যাদির পর মার্কেট ইকোনমিতে আরো একটি বাণিজ্য দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, সেটা পানির বাজার৷ পানি আজ অর্থনৈতিকভাবে একটি সম্পদ৷
বিংশ শতাব্দীতে দু'দুটো মহাযুদ্ধ হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে পানি নিয়ে দেশে দেশে বিবাদের সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছে৷ বিশ্বে যখন পানি সংকট দেখা দিচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ ভূঅভ্যন্তরের পানি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে নিয়ে আসছে আর্সেনিক নামের মরণদূত৷ বাংলাদেশের পানির সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যাপক পর্যায়ে গবেষণার সময় এসেছে৷ সময় এসেছে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরীর৷ যে-নীতিমালায় শুধু বর্তমান সমস্যার তাত্‍ণিক সমাধানই নয়, থাকবে ভবিষ্যত্‍ প্রজন্মের হিস্যাও৷
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমার ড্রোন ছবি।

লিখেছেন হাশেম, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩

বৃহত্তর প্যারিস তুষারপাত।

ফ্রান্সের তুলুজ শহরে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।

হ্যাসল্ট, বেলজিয়াম।

ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফ্রান্সের ফ্রিওল আইল্যান্ড।


রোডেসিয়াম এম রেইন, জার্মানি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×