somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিল-অমিল নেপোলিয়ন-হিটলার (অষ্টম পর্ব )

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি নেপোলিয়ন আর হিটলার এর মিল-অমিল খোঁজার চেষ্টা করছিলাম মাত্র, কোনো বীর গাঁথা নয়। তবু ইতিহাস নাড়িয়ে দেয়া মানুষদের নিয়ে লিখতে গেলে অনেকটা বীর গাঁথার মতো শোনাবে এ এমন কি! যারা এই সিরিজটাকে ভালোবেসে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস আর শক্তি যুগিয়েছেন তাদের জন্য আবার রাখতে হলো হাত কী-বোর্ডে। এই কিছুদিন আগে হলে বলতে হতো ধরতে হলো কলম। এখন লেখার জন্য আর কলম ধরতে হয় না। সেদিন একটা ধাঁ-ধাঁ মাথায় ঘুরছিলো- বলুনতো কোন বইতে লিখতে কোনো কলম লাগে না। এই প্রশ্ন আজ থেকে পাঁচ বছর আগে করলে মাথা চুলকাতে হতো, এখন এই একটা পুচকা-পুচকী পর্যন্ত বলে দিতে পারে- কেন? Facebook।

কি নিয়ে লেখাটাকে এগিয়ে নেয়া যায় সেটা এখনো অবধি ঠিক করিনি। তবে যেহেতু এর আগে নেপোলিয়ন আর হিটলারের উত্থান পর্ব লেখা হয়েছে এর পর সেই উত্থান তাদের নিজেদের ভূমিকা কতটুকু ছিলো বা কেনো লোকজন তাদের Leadership বা নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলো সেই সম্পর্কে কিছু বলা যাক।

নেপোলিয়নঃ



নেপোলিয়ন ইতালী জয়ের জন্য বের হলেন। এর আগে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। ফ্রান্সে বিপ্লবের পর যে সাধারনতন্ত্রী শাসন ভার তুলে নিলো, অর্থাৎ জনগনের হাতে ফিরে এলো শাসনের ভার। এই ব্যাধীতে ততদিনে আক্রান্ত হয়েছে অনেক দেশ। ইউরোপের রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা তখন কমতে শুরু করেছে। জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলন নেই যে শাসন ব্যবস্থায় সে শাসনব্যবস্থা অনেক দেশের নাগরিকরাই আস্থা রাখতে পারছিলেন না। কিন্তু ইউরোপের অধিকাংশ রাজ্য তখন রাজতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত। তাই তারা (সে সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা) নেপোলিয়ন কে বাধা দেয়ার জন্য এক জোট বাঁধল। পোপ পরিচালিত রোমও সাধারণতন্ত্রীদের বিরোধী।

ইতালি বিজয়ের জন্য নেপোলিয়ন যখন বের হন তখন তিনি মাত্র ২৬ বছরের টগবগে যুবক। কোনো যুদ্ধের সেনাপ্রধান হিসেবে এটাই তার প্রথম যুদ্ধ যাত্রা। জোসেফাইনকে বিয়ের মাত্র দুদিন পরেই যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হন। নেপোলিয়নের যুদ্ধের রণ-কৌশল নিয়ে কিছু বলা যাক। নেপোলিয়নের যুদ্ধ প্রস্তুতির একটা বড় দিক ছিল, যে অঞ্চলে যুদ্ধ করবেন তার ভূপ্রকৃতি, ঘর-বাড়ি, নদী-নালা সমস্ত কিছু সম্পর্কে নিখুঁত তথ্য সংগ্রহ। নেপোলিয়ন জানতেন খালি পেটে যুদ্ধ হয় না। তাই তিনি সব সময় খাবার পর্যাপ্ত সাথে রাখতেন। আর সমরাস্ত্র। শুধু সমরাস্ত্র রাখলেই চলবে না। যেখানে যে পরিস্থিতি সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য উপযুক্ত পোশাক, বরফের উপর হাটার জন্য বুট জুতো ইত্যাদি সাথে রাখতেন। অতর্কিতে হামলা চালিয়ে দিশেহারা করে যুদ্ধ জয় ও তার একটি কৌশল। যা কখনো কেউ চিন্তা করতে পারেনা তাই করে দেখানোই ছিলো তার প্যাশন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুসেনা যাতে একত্রিত হতে না পারে এ দিকে বিশেষ নজর রাখতেন। একে বলে Divide & Rule, অর্থাৎ শত্রুদের বিভাজিত কর এবং নিজের আধিপত্য বিস্তার কর। কামানের গোলা বর্ষনের জন্য তিনি কামানের মাঝে চাকার ব্যবহার শুরু করেন, যাতে কামানকে সুবিধাজনক স্থানে সড়িয়ে নিয়ে গোলা বর্ষণ করা যায়।

যা হোক সব চেয়ে বড় কথা রণ-কৌশল তিনি মুহুর্মুহূ পরিবর্তন করতে পারতেন। সব যুদ্ধেই একই রণ-কৌশল ব্যাবহার করতেন না। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারাই ছিলো সবচেয়ে বড় ব্যাপার। তবে সাহস দেখানোর যে নজির তিনি গড়েছেন, তা এক কথায় অনন্য। মন্ডেনায় তিনি প্রথম জয়ী হন। এর পর মাত্র পনেরো দিনে ছয়টি যুদ্ধ জয় করেন। এরপর সৈন্যদের লুঠ করার স্বাভাবিক প্রবণতার বিরুদ্ধে সৈন্যদের মাঝে এক আদর্শবাদী ভাষণ দেন। তিনি বলেন- 'সৈন্যগণ! তোমরা পনেরো দিনে ছটি যুদ্ধে জিতেছ। শত্রুদের একুশটি পতাকা, পঞ্চাশটা কামান, বহু দুর্গ তোমাদের করায়ত্ত। পনেরো হাজার শত্রুসেনা তোমাদের কারাগারে বন্দী, দশহাজার শত্রুসেনাকে হয় বধ করেছ নয়তো আহত করেছ। তোমরা পর্বতে-পর্বতে যুদ্ধ করেছ, তোমরা হল্যান্ড এবং রাইনের সৈন্যদলকে পরাজিত করবার শক্তি রাখ। তোমাদের খাবার ছিল না, ভালো পোশাক ছিল না। এখন সব পেয়েছ। কামানের অভাবেও তোমরা যুদ্ধ থেকে বিরত হও নি। সাতার কেটে নদী পার হয়েছ, খালি পায়ে হেটেছ, অনাহারে থেকেও যুদ্ধ করেছ। ভুলে যেও না, তোমরা ফরাসি সাধারণতন্ত্রের বিশ্বস্ত সৈনিক, তোমরা স্বাধীনতার দূত, তাই তোমরা এই অসাধ্যসাধনে সমর্থ হয়েছ। ... আবার যুদ্ধযাত্রা করবার আগে আমি তোমাদের কাছে একটা অনুরোধ করব। আমার এই অনুরোধ রক্ষা করার জন্য তোমরা প্রতিজ্ঞা কর। তোমরা যে সব রাজ্য জয় করবে সে সব রাজ্যের মানুষের উপর কোনো রকম অত্যাচার করতে পারবে না। তা না হলে তোমরা বিপন্ন জাতির উদ্ধারকর্তার সম্মান ও কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হবে, তোমাদের সবাই ধ্বংসকারী বলে চিহ্নিত করবে। আমি কখনো মনুষ্যত্ব ও সম্মান নষ্ট করব না। তোমাদের গৌরবমুকুট যেন দস্যুরা হরণ করতে না পারে। যে লুঠ করবে তাকে আমি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করব।'
নেপোলিয়ন জানতেন আদর্শের জন্য মানুষ অকাতরে প্রাণ দিতে পারে। তাই তিনি সাধারণ সৈন্যদের সামনে একজন আদর্শ দলনেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এইটা একটা খুবই বড় ব্যাপার যে যাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া হবে তিনি এবং তার আদর্শ যদি সর্বসাধারণের কথা না বলে তবে তাকে সেই পূজার স্থান থেকে সর্বসাধারণের স্থানে নামাতে মানুষ খুব বেশি সময় নেয় না। একজন দলনেতার যে যে গুণ থাকা দরকার বলে আমরা জানি, তার প্রায় সর্বাধিক গুণ তার মধ্যে দেখা দিয়েছিলো। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। একবার একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি নিয়ে এক তরুণ সৈনিক নেপোলিয়নের কাছে আসেন। নেপোলিয়ন ঘোড়ার উপর বসেই চিঠির উত্তর তৈরি করে তাকে যথাস্থানে পৌছে দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু পত্রবাহক একটু ইতস্তঃত করতে থাকে। জিজ্ঞাস করাতে সেই তরুণ সৈনিক জানায় তাকে পৌছে দিয়েই ঘোড়াটি মারা যায় তাই এক্ষুনি চিঠি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কথা শুনে নেপোলিয়ন নিজের ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন এবং নিজের ঘোড়াটা দিয়ে দেন। প্রধান সেনাপতির সামনে তার ঘোরায় চড়ার সাহস হচ্ছে না দেখে নেপোলিয়ন নিজে এগিয়ে এসে ঘোড়ার লাগাম তার হাতে তুলে দেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে নেপোলিয়ন কে ঘিরে। তাই তারা নিজের জীবনের চেয়েও নেপোলিয়নকে ভালোবাসতেন। সেই সব কথাও হবে।

নেপোলিয়নের বেশির ভাগ সময় কেটেছে (যুদ্ধক্ষেত্রে) ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ার পিঠে চড়েই তিনি একটু চোখ বুজে ঘুমিয়ে নিতেন। সাধারণ সৈনিকরা এমন দলনেতাকে কাছ থেকে দেখেছেন, যেখানে রাতেও একজন সেনাপ্রধান বিশ্রামে না যেয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রদক্ষিন করছেন রণক্ষেত্র, রচনা করছেন যুদ্ধ কৌশল। একবার এক সৈনিক দুঃখ করে বলল,- ‘জেনারেল, আমরা কত যুদ্ধ জয়ী হলাম কিন্তু দেখুন আমাদের গায়ে সেই ছেড়া পোশাক!’
নেপোলিয়ন সাথে সাথে উত্তর দিলেন- ‘তার জন্য দুঃখ করছ কেন? এতো ভালোই হয়েছে, যদি ছেড়া পোশাক না পরতে তবে তোমাদের দেহের এই গৌরবময় ক্ষতগুলো তো দেখা যেত না’।

এই মূহুর্তে আমার খালিদ বিন ওয়ালিদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
‘I've fought in so many battles seeking martyrdom that there is no spot in my body left without a scar or a wound made by a spear or sword. And yet here I am, dying on my bed like an old camel. May the eyes of the cowards never rest?’ —Khalid ibn Walid

নেপোলিয়ন সাফল্যের অন্যতম কয়েকটি দিক আছে। যেমন প্রথমতঃ তিনি একটি মহৎ লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ করছেন, লক্ষ্যটি হলো সাধারনতন্ত্র (সাধারনের মধ্যে ক্ষমতার হস্তান্তর), এই বার্তাটি খুব ভালো ভাবে তার সৈনিক এবং যুদ্ধকবলিত এলাকার লোকদের মধ্যে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন। দিত্বীয়তঃ তিনি তার দেশের লোকদের খুব ভালো ভাবে চিনতে পেরেছিলেন। তাদের কি সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, তারা কি চায়, এই ব্যাপার গুলো খুব ভালো বুঝতেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারতেন তৎক্ষনাৎ। এমন কি রাজনৈতিক মঞ্চেও তিনি খুব ভালোভাবে বুঝেছিলেন, ঠিক কাকে বা কাদের ঠিক কতটুকু খুশি রাখতে হবে, আর কতটুকু ছাড় দিতে হবে। তৃত্বীয়তঃ সিদ্ধান্ত গ্রহনের পর সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকা। তার উক্তির দিকেই তাকালে এই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে- ‘Take time to deliberate, but when the time for action has arrived, stop thinking and go in.’।

হিটলারঃ



যে দিন হিটলার জানতে পারেন জার্মান আত্মসমর্পণ করেছে, সেদিনই হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে হিটলার প্রতিজ্ঞা করেন তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবেন। একজন প্রায় অন্ধ সামান্য সৈনিক কি ভাবে এই প্রতিজ্ঞা করে এইটা একটা বিস্ময়ই বটে। তিনি চাকরি পেলেন যুদ্ধবন্দি শিবিরে। চেষ্টা করতে থাকলেন যতটা পারা যায় মিলিটারীর কাছাকাছি থাকতে। ১৯১৯ সালের জুলাইতে হিটলার ডাক পেলেন Reichswehr থেকে। Reichswehr হলো জার্মান আর্মি সংগঠন। তার কাজ হলো অন্যান্য সৈনিক দের অনুপ্রাণিত করা আর German Workers' Party (DAP) এর উপর নজর রাখা। German Workers’ Party তেমন গুরুত্বপূর্ণ দল নয়। নতুন একটি দল। তবুও সামরিক বাহিনী প্রতিটি দলকে নিবীড় পর্যবেক্ষনে রাখতে চায়। সাধারনত তেমন ভীর দেখা যেত না, এই পার্টির অনুষ্ঠানে। খুব বেশি হলে ২৫-৩০ জনের একটি দল যাদের প্রায় সকলেই সাধারন ঘর থেকে এসেছে। প্রতিদিন একই রকম চলছিল। এই লোকগুলো ক্লাব ঘরে এসে নিজেদের মতো করে কথা বলতো। আসলে এই দলের নেতা ফেদারের আসলে কোনো লক্ষ্য ছিলো না। তাই ফেদার এর কথা শেষ হলে লোকগুলো হৈ-হুল্লোড় করতো। ফেদারের বক্তব্য শেষ হলেই বরঞ্চ হিটলার খুশি হতো।

তবে একদিন এক প্রফেসার, পার্সিয়া থেকে বাভারিয়া বিচ্ছিন্ন হলে এই পার্টির কি করা উচিত এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ফেদার বেশ ভালো ভাবেই উত্তর দিচ্ছিলো তবে বিশেষ কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারছিলো না। প্রফেসর এই পরিস্থিতিতে জার্মান-অস্ট্রিয়ার, বাভারিয়ার পাশে থাকা উচিত বলে জোর দাবী করে। হিটলার আর চুপ থাকতে পারেনি। সে মঞ্চে উঠে এসে তার যুক্তিগুলো তুলে ধরে প্রফেসরের সামনে। এবং প্রফেসরের আর কিছু বলার ছিলো না। হিটলার লক্ষ্য করেছেন, তিনি যখন কথা বলছিলেন, শ্রোতারা তার কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিলো। সে যখন Good Night বলে চলে যাচ্ছিলো তখন কে একজন তাকে একটা রাজনৈতিক বুকলেট বা পুস্তিকা হাতে গুজে দিয়ে পড়তে অনুরোধ করেন। সে সপ্তাহেই হিটলার একটি পোস্টকার্ড পান, যাতে তাকে বলা হয়েছে, “German Workers' Party (DAP) তাকে গ্রহণ করেছে। তিনি তার মতবাদ প্রকাশ করতে পারেন, এই জন্য পরবর্তী বুধবার সভায় তাকে আমন্ত্রন জানানো হচ্ছে”।
এই হচ্ছে হিটলারের মেম্বারশীপ কার্ড।



অবশেষে ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯১৯ সালে তিনি সামরিক বাহিনী থেকে সরে এসে German Workers' Party (DAP) তে যোগ দেন। তিনি ছিলেন ৫৫ তম সদস্য। তিনি যখন German Workers' Party (DAP) এর সদস্য হন, তখন কোনো কার্ড এর প্রচলন ছিলো না। কার্ড দেয়া নয় ১৯২০ সাল থেকে। তার কার্ডে ৫৫৫ নম্বর দেখা যায়। মূল বিষয়টা হলো, সদস্য সংখ্যা বেশি দেখানো জন্য নম্বর শুরু হয় ৫০১ থেকে।

মূল যে বিষয়টা আসলে বলতে চাইছি তা হলো, তার বাগ্মিতা। তিনি যখন বক্তৃতা দিতেন, মানুষ তন্ময় হয়ে শুনতো। এই বক্তৃতার গুণেই দলে তার কদর বাড়তে থাকে। তার বক্তৃতা শুনতে ধীরে ধীরে মানুষ সমাগত হতে থাকে তাদের ঘরোয়া মিটিং গুলোতে।

সে সময় মূল দল ছিলো দুটি। একটি হলো Social Democratic Party of German (SPD) আর ছিল German Communist Party (KPD)। এদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী হলো SPD আর বামপন্থী হলো KPD। হিটলার এর বক্তব্য খুব স্পষ্ট। হিটলারের বক্তব্য হলো, জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে কোনো সামাজিক চেতনা নেই আর সমাজতান্ত্রিক বামপন্থীদের কোনো জাতীয় চেতনা নেই। সত্যিকারের বিপ্লবী দল হল তার জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী দল- National Socialist Party. তাই হিটলার ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে হিটলার তার দলের নাম পরিবর্তন আনেন। German Workers' Party (DAP) এর সাথে National Socialist যুক্ত করে রাখেন National Socialist German Workers' Party (NSDAP)। তিনি একসাথে শ্রমিকের শ্রম আর বুদ্ধিজীবীদের মেধা- এই দুইয়ের মিলন ঘটাতে চেয়েছেন। তাই এই দলের নাম হল Nazi, এর উৎপত্তি NSDAP বা National Socialist German Workers' Party (NSDAP) বা National Sozialistische Dentsche Arbeiter Partei। National এর Na আর Sozialistische থেকে zi নিয়ে সহজ এবং সংক্ষিপ্ত নাম Nazi দল। বলার অপেক্ষা রাখেনা, এই দলের পতাকা কি হবে, কেমন হবে এর রঙ এই সব খুঁটিনাটি বিষয় পর্যন্ত হিটলার নিজে করেছেন।



আমার এই পর্বের মূল কথা হলো, এমন কি ছিলো হিটলারে মধ্যে ভিন্ন যা তাকে সামান্য একজন থেকে ফুরার বনে গেলেন। সেটা ছিলো তার বক্তৃতার গুণ। তিন যখন বক্তৃতা দিতেন তখন শ্রোতারা চোখের পলক ফেলতে পারতেন না। গভীর আগ্রহ নিয়ে কথা শুনতেন। আবেগে হাত তালি দিতেন। যখন তিনি ভার্সাই চুক্তির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে জার্মানীকে কিভাবে অপমান আর গ্লানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে এর আবেগ মিশ্রিত বক্তৃতা দিতেন তখন শ্রোতারা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠতেন।

হিটলারের বক্তৃতার ধরনটা ছিলো অসাধারণ। প্রায় তিনি সময় দেরী করে আসতেন। আর এসেই বক্তৃতা শুরু করতেন না, চুপ করে থাকতেন বা এমন কিছু করতেন যাতে পিন-পতন নীরবতা নেমে আসে। এর পর শুরু করতেন বক্তৃতা আসতে আসতে। এরপর যত সময় গড়াতো, তার কন্ঠস্বর উচ্চমার্গে উঠতে থাকতো। কন্ঠস্বরের চরম তীক্ষ্ণতাকে তিনি কাজে লাগাতেন। তার হাত-পা-মুখ-মাথা নাড়াবার ভঙ্গিগুলোও ছিলো বিচিত্র। এই সব বিচিত্র অঙ্গ-ভঙ্গি করেও লক্ষ লক্ষ জার্মানীকে করে রাখতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। মেয়েরা তার কথা শুনে কেঁদে উঠতেন, আর যুবকদের রক্ত নেচে উঠতো।

আসুন একটা বক্তৃতা দেখে নিই- এখানে দেখুন, সাবটাইটেল ইংরেজিতে দেয়া আছে।

তার বক্তৃতার সবচেয়ে বড় গুণ হলো- বক্তৃতায় কোনো ধোঁয়াশা, অস্পষ্টতা বা দুর্বোধ্যতা থাকতো না। সাধারণ মানুষ তার সোজা-সাপটা বক্তৃতা সহজেই বুঝতে পারতেন। তার বক্তৃতা জুড়ে থাকতো ভার্সাই চুক্তির দিক গুলো, যেগুলো জার্মানিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তিনি এরপর জিজ্ঞাস করতেন- ‘এ কী সত্যি?’ সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করতো- হ্যাঁ, সত্যি। শ্রোতাদের সমর্থন আদায় করে হিটলার জিজ্ঞাস করতেন- এর জন্য দায়ী কে? কোনো উত্তর নেই। হিটলার এবার উত্তর দেন- ‘এর জন্য দায়ি তারা যারা জার্মানির ক্ষতি চায়, আর যারা জার্মানিকে লুটে পুটে খেতে চায়’। এরপর আবার প্রশ্ন- ‘এরা কারা?’ এর উত্তর হিটলার অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। এরা ইহুদি আর কমিউনিস্ট। হিটলারের বক্তব্য- ‘এদের কাছে জাতীয় স্বার্থ বলে কিছু নেই। ইহুদি আর কমিউনিস্ট উভয়ের স্বার্থ এক। এদের কোনো জাতি বা দেশের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। এরা সারা পৃথিবী জুড়ে গোষ্ঠী স্বার্থ কায়েম করতে চায়। আর সেই গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য এরা নির্দিধায় নিজের দেশ, দেশের মানুষের ক্ষতি সাধন করতে পারে। কমিউনিস্টদের দোসর হলো ইহুদীগুলো। ইহুদী-কমিউনিস্ট দিয়ে জার্মান ভরে গেছে। এরা জার্মানিকে ধ্বংস করতে চায়। জার্মানির বুকের উপর বসে এরা জার্মানির রক্ত চুষে খাচ্ছে। (ভার্সাই চুক্তির টাকা সরকার দিতে ব্যর্থ হলে ইহুদীরা সুদের ভিত্তিতে সরকারকে অর্থের সংস্থান করে।) ইহুদীদের কে শেষ করতে না পারলে জার্মান শেষ হয়ে যাবে। তাই জার্মানিকে বাচাতে হলে ইহুদী নিধন শুরু কর। শুধু জার্মানিতে নয়, পৃথিবীর কোথায়ও ওদের বাঁচার অধিকার নেই। কারণ যে দেশে ওরা যাবে সে দেশেরই ওরা ক্ষতি করবে। ওদের তো নিজেদের দেশ বলে কিছু নেই, কমিউনিস্টদেরও কোনো দেশ হয় না। তারা নিজের দেশ বলে কিছু আছে বলেই বিশ্বাস করে না। তারাও বিশ্বাস করে, পৃথিবীর সব দেশের প্রলিতারিয়েতরা সংঘবদ্ধ হবে, তার জন্য যদি নিজের দেশ গোল্লায় যায় তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই’।

মানুষের আবেগকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে এটা তিনি খুব ভালোই জানতেন। বক্তৃতায় তাই সেই আবেগকে কাজে লাগাতেন। সাধারন মানুষ কি চায়, তাদের মানসিকতা কী, কী তারা শুনতে চায়, এটা তিনি খুব ভালো বুঝতেন। শুধু কি তাই? বক্তৃতার মধ্যে পাতার পর পাতা নির্ভূল উদ্ধৃতি দিয়ে যেতে পারতেন। তার স্মৃতিশক্তিও ছিলো ঈর্ষণীয়। এই সব বক্তৃতায় ব্রিটিশদের তীব্রভাবে আক্রমন করতেন। তিনি ফরাসীদের আর আমেরিকানদেরও এক হাত নিতেন। তবে রাশিয়ানদের বিরূদ্ধে কোন তীক্ষ্ণ মন্তব্য করতেন না।
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×