-নাজমুল ? এই নাজমুল
-অ্যাঁ ... হুম , বল ।
-একটু দোকানে যাতো বাপ ।
-উমম ... কি ?
-বললাম দোকানে যা । হুইল পাউডার নিয়ে আয় এক প্যাকেট , কাপড় গুলো ভেজাব ।
-কি , আমি পারব না । বুয়াকে পাঠাও ।
-বুয়া আসলে কি তোকে বলি ? বুয়া আসেনি আজকে । দুপুর হয়ে যাচ্ছে । যা না , সারাদিন তো কম্পিউটারের সামনেই বসে থাকিস । এক দৌড়ে যাবি আর আসবি । ছোটটা আনিস । পরে তোর বাবা বাজারে গেলে বড়টা আনিয়ে নেব । জলদি যা ...
-ঝামেলা করতেও পারো তুমি ! ছুটির দিনটা একটু শান্তিতে ঝিমাব তাও দেবে না ?
দাও টাকা দাও !
::::::::::::::::::::::::::::: ___ :::::::::::::::::::::::::::::
-নাজমুল ?? এই নাজমুল !!
আরে এই নাজমুইল্যা কই গেলি !
-ইশশ !!! কি বিপদ ! আবার কি ???
-হারামজাদা তুই এদিকে আয় ! এটা কি ??
-কই কি ? এতো চেঁচাও কেন ?!
-চেঁচাই ! ইবলিশ ! চেঁচানোর কি দেখছিস ! এটা কি , জবাব দে !!
বল এটা কি ?!
-...সিগারেট...
-এটা তোর পকেটে এলো কিভাবে ?? বল! এটা তোর প্যাণ্টের পকেটে কেন ??
-ইয়ে ... আমার প্যাণ্টে ছিল ?!
-কিছু জানো না, না ? এক থাপ্পড় মারবো !
-আহ! রাগছ কেন ?? শুনবে তো আগে ।
-কি শুনবো হ্যাঁ , কি শুনাবি তুই ?? ইচড়ে পাকা শয়তান !! তোর বাবাকে দেখেছিস কোনদিন সিগারেট পকেটে নিয়ে ঘুরতে ?? - এই শিখিয়েছি তোকে !
-আহা শুনবে তো আমার কথা , ওটা আমার সিগারেট না , মানে আমি রাখি নি ।
শাকিল কালকে ফাজলামো করে ঢুকিয়ে দিয়েছে পকেটে । বিশ্বাস কর আমি কিচ্ছু জানি না !
-তুমি কিচ্ছু জানো না , না ?? আমার সাথে ইতরামি হচ্ছে । শয়তানের বাচ্চা ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে সোজা করে ফেলব তোকে । তোর পকেটে বুয়া ২ দিন ম্যাচ পেয়েছে কাপড় ভেজাতে গিয়ে – আর তুমি কিচ্ছু জানতে না , না ?
-আহহা!! কেন বুঝছ না , এটা আমার ইচ্ছাকৃত ...
-চোপ!! একটা কথাও বলবি না ! আজ থেকে ওই ফালতু রাস্তার ছেলেদের সাথে মেশা তোর বন্ধ । আর একদিন পা বাড়িয়েছিস ওদের সাথে , তো তোর পা কেটে কুচি কুচি করে ফেলব বটী দিয়ে ।
আর যতদিন এই সিগারেট না ছেড়েছিস , ততোদিন আমার ঘরে তোর জায়গা নেই !
-আহাহা! ঘরে যায়গা নাই । বললেই হল ! থাকো তুমি তোমার ঘরে । আমি চললাম । দেখি কতোক্ষন তোমার ঘর নিয়া থাক তুমি !
-যেখানে খুশি যা । আমার ঘরে কোন অমানুষের জায়গা নাই ! কলেজ পার হয়ে ভার্সিটিতে পা রাখসে আর একবারে দুনিয়ার সাত রঙ দেখে ফেলসে ! তাকে এখন শয়তান বন্ধুগুলির সাথে সিগারেট- গাঁজা খেয়ে স্মার্টনেস দেখাতে হবে ।
-গালি দিতেস আমাকে দাও , মানুষকে গালিগালাজ করবা না ।
-ওরে বাবা ! তুই আমাকে শেখাবি ? দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে হারামজাদা !
-হাহ ! গেলাম ! যতক্ষন না কানবা – আমি ফিরব না । মনে রেখ !
-কোন অমানুষের জন্য আমি কানবো না ! ছি ছি ছি , কোনদিন চিন্তাও করি নি আমার ছেলে আমার আড়ালে সিগারেট ফুঁকবে । আজকে সিগারেট ধরেছে , দু দিন পরে গাঁজা টানবে , ইয়াবা ধরবে ! ছিইহ !!
:::::::::::::::::::::::::::::::::::: ___ ::::::::::::::::::::::::::::::::::::
-এই খালি যাবা ?
-কই যাইবেন ?
-টি এস সি ।
-চলেন । ১৫ টাকা ।
-না টি এস সি না । চল সামসুন্নাহার হলের সামনে চল ।
-২০ টাকা ।
-এই তোমারে জিজ্ঞাস করসি কয় টাকা ?? কথা এত বেশি বল ক্যান ??
-না মানে কইয়া না নিলে অনেকে ভেজাল করে । এল্লেইজ্ঞা ।
-আমারে দেখে কি ভেজাল পাবলিক মনে হইতেসে ?!
-না । তয় কওন তো যায় না কার মনে কি । পরে আবার কোন বিপদে পরি । আমরা তো গরিব মানুষ ।
-গরিব মানুষ আমরাও । আমরা তো চাকরি করি না । তোমাদের চেয়ে আমাদের দুঃখ কম না কোনদিক দিয়া – বুঝলা ? সামান্য কিছুতেই জবাবদিহি করা লাগে এখনো ।
আচ্ছা মামা বামে একটু রাখো তো দুইটা সিগারেট নেই ।
-এইযে মামা তিনটা গোল্ডলিফ দেও ।
-ভাইজান একটা কথা কই ?
-কি ?
-আপনি কি এইদিকে থাকেন ?
-কেন ?!
-না এমনি একটা দরকার ছিল ।
চা সিগারেটের টং দোকানওয়ালার তার কাছে কি দরকার থাকতে পারে মাথায় আসলো না নাজমুলের ।
সে বুঝি বুঝে ফেলল তার মাথায় কি ঘুরছে ।
-
-না মানে ভাইজান , আসলে আপনারে দেইখা মনে হইল , ভালো মানুষ । মনটাও ভালো । মনে হইলো মাইনষেরে সাহায্য করবেন ।
-বাহ! চেহারা দেখে মনের খবরও বোঝ ?! তাইলে চা সিগারেট না বেচে হাত দেখা শুরু কর , লাভ হবে ।
-কি যে কন ! ইয়া, মানে ভাইজান , ওইযে দেখতাসেন না বুড়াটা গুজা হইয়া বইয়া আছে , ওর কাছে , ওর কিছু সাহায্য দরকার ।
-সাহায্য টাহায্য করতে পারব নারে ভাই । টাকা পয়সা নাই ।
-ভাইজান ও আসলে ভিক্ষুক না । ভালো মানুষ । একটা বিপদে পড়ছে ।
গ্রাম থিকা আসছে আজকে ভোরে তার মেয়ের সাথে দেখা করতে । ওর মেয়ে নাকি কোন গারমেন্টস এ কাজ করে । তার নাতিটা নাকি কি এক কঠিন অসুখে পড়সে । অনেক টাকার দরকার । সে জমি বেইচা টাকা নিয়া আসছিল কিছু । কিন্তু, আইসাই বাটপারের হাতে পরে । তারে সহজ সরল বোকা পাইয়া টাকা গুলা মাইরা দিয়া ভাগসে ।
গুলিস্তান থিকা বাসে ওঠে মিরপুর যাইতে । শাহবাগ আইনা নামায় দেয় টাকা নাই দেইখা । তখন থিকা এইখানে বইসা ফোঁপাইতাসে । আপনি যদি তারে তার মেয়ের কাছে পৌঁছায় দিতেন , বুড়া মানুষটা উপকৃত হইত ।
-আচ্ছা দেখি ।
-চাচা , শুনছেন ?
শব্দ নেই ।
-এইযে চাচা । এইদিকে তাকান । আপনি যদি আমাকে খুলে বলেন , আমি হয়তো আপনাকে সাহয্য করতে পারব ।
এইবার ফিরে তাকালো শীর্ণদেহী রোদেপোড়া চামড়ার বৃদ্ধ লোকটা । দুচোখ লালচে ।
অর্থহীন , উদভ্রান্ত, উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলো ।
বুকের ভিতরটা কেমন যেন ছ্যাৎ করে উঠল নাজমুলের ! এরকম অসহায় মানুষের বিপদের দুটো টাকাও মানুষ মারে ?!?
-চাচা নাম কি আপনার ? খেয়েছেন কিছু সকাল থেকে ?
হতাশাসূচক মাথা নাড়ল বৃদ্ধ । মুখদিয়ে কিছু বের হল না ।
-আসেন আমার সাথে । ওঠেন একটা হোটেলে গিয়ে বসি । খেতে খেতে সব শুনব চলেন ...
:::::::::::::::::::::::::::::: বিকাল ৫ টা ৩০ ::::::::::::::::::::::::::::
-ভাইজান দিয়া আইছেন হেরে ?
-হুম ! লেবু চা দাও তো, আর দুটা বেনসন ।
-আজকে বেনসন ছাড়া হবে না । মনটা হালকা লাগছে !
-বেচারা কি বিপদটাতেই না পরসিল । খুইজা পাইলেন কেমনে ওর মেয়ের ঠিকানা ?
-মেয়ের ঠিকানা পাইনি । ডিরেক্ট ওর নাতি যে হাসপাতালে আছে ওইটায় গেলাম । তবে খুজে বার করতে কষ্ট হয়েছে ।
-যাক । কিন্তু , বেচারার টাকা গুলি যদি ফেরত দেওন যাইতো ওর খুব উপকার হইত ভাইজান ।
-হুম, তাতো হতোই । কিন্তু , যে নিয়েছে সে কি আর ফেরত দেয়ার জন্য নিয়েছে ??
তবে আমি যতটা করার চেষ্টা করেছি , বাকিটা আল্লাহর হাতে । অসহায়ের সহায় তো তিনিই ।
ও যে এই ফাঁকে এ টি এম বুথেও ঢূ মেরেছিল , সেটা আর বলল না । নেক্সাস ডেবিটটা মানিব্যাগেই ছিল । ওর নিয়ত ছিল বৃত্তির টাকার ওয়ান-থার্ড কাউকে দান করবে । আজ বুঝি সেই সুযোগটাও মিলে গেছে । নিয়তটা পূরণ হল । ৬ হাজার ৫০০ টাকা তুলেছে সে । প্রায় সবটাই তুলে ফেলেছে । মকবুল মিয়ার মেয়ের হাতে চুপেচুপে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে হসপিটালের বেডে পরে থাকা ছোট্ট নাতিটার জন্য
একাউন্ট টা ওর প্রায় শুন্য এখন , কিন্তু তাতে কি ? মনটা যে তৃপ্তিতে পরিপূর্ণ । মনের একাউন্টের এমাউন্টটাই এ মুহূর্তে ভারি মনে হচ্ছে ...
-এহহে !!
ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে আতকে উঠল ! খেয়ালই করে নি সময় কোন দিক দিয়ে বয়ে গেছে ।
ঘড়ির কাঁটা ৬ এর ঘরের দিকে যাচ্ছে ! শিট !!
ওর রেগুলার শিডিউল আজ বোধহয় ভেস্তে গেল !
-মামা এই নাও তোমার কাপ ধর ! লেট করে ফেললাম ! কত হইসে সিগারেট সহ ?
-ভাইজান আপনি ছোডখাড ফেরেশতা । আপনার কাছ থিকা আইজকা টাকা লইলে আমার পাপ হইব ! টাকা লাগবো না
-ধুর ফালতু কথা বাদ দাও । আমার টাইম নাই । কত হইসে বল ...
- আচ্ছা শুধু চায়েরটা দেন ৮ টাকা । বেনসন দুইটা আমার পক্ষ থিকা ...
হন্তদন্ত করে উড়তে উড়তে হাজির হল নাজমুল সামসুন্নাহার হলের সামনে ।
আজকে মনে হয় আর দেখা হবে নাহ ! মুষড়ে পড়তে চাইছে মনটা !
দিনের শেষে হিসেবের খাতায় তার নিজের বলে রইলো না কিছুই ! হায় – এরই নাম বুঝি ভাগ্য !
নাইফার এদিক দিয়ে যাবার কথা সাড়ে পাঁচটায় । প্রতিদিন তাই যায় ।
আর নাজমুল তার দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য , সিগারের ধোঁয়া ছাড়ে এই জায়গাটায় হেলান দিয়ে । হাতে থাকে শাকিলের গিটার ।
আজকে গিটারটা নেই । নেই শাকিলও । ওর কোন প্রিপারেশন ও নেই ! একদম হযবরল ! অবস্থা ।
নাহ, আজকে দেখলেও বোধহয় লাভ হত না ।
এই মেয়েটার নজরে পড়বার জন্য কত কিই না শিখতে হয়েছে তাকে । শাকিল কে দীক্ষাগুরু বানাতে হয়েছে । সিগারটাও ওর জন্যই ধরা ।
কিন্তু, প্রতিদিনই নিরাশ বদনে ফেরা ছাড়া কিছু করার থাকে না । মেয়েটা ভিষন দেমাগি মনে হয় । এত সুন্দর এই ওকে, যেন দেখেও দেখে না । সামনে দিয়েই হেটে কি সুন্দর চলে যায় হলে ।
নাহ! সবই ব্যার্থ ! শুধু শুধুই এতো এতো কিছু করা , সব পন্ডশ্রম !
জীবনটা সত্যিই বড় বেশি অর্থহীন – বড় বেশি নিষ্প্রান !
বিতৃষ্ণা এসে গেছে ওর এই অর্থহীন জীবনটার প্রতি !
অনেক হয়েছে আর নাহ !!
আজ থেকে সে আর শাকিলের ধ্যান ধারনায় চলবে না । ওই মেয়ের জন্য এখানে ছুটে ছুটেও আসবে নাহ !
আজথেকে আর পড়বে না ওর পায়ের চিন্হ তার পানে । আজ থেকে তৃষিত নয়নযুগল তার স্বপ্নিল দৃষ্টি মেলে দেবে না ওই মধুমালতির আয়ত দুচোখের সাগরের গভিরতায় দু-দন্ড সাঁতার কাটার প্রতিক্ষায় ...
হ্যাঁ, আজকের পরে সে হারিয়ে যাবে ! হারিয়ে যাবে, যেমনিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এই সিগারের ধোঁয়া তার প্রতিটা মুহূর্তের প্রানরস শুষে নিয়ে ...
সত্যিই আর সে ফিরে ফিরে আসবেনা কারো পিছুটানে ... কোনওদিন না !!
উল্টো ঘুরে পা বাড়লো । সিগারে কষে শেষ টানটা দিল ...
-এইযে ! শুনছো ?? এদিকে !
-কে !!!
ভুত দেখছে নাতো ?!?
নাইফা তাকিয়ে আছে ওর চোখে চোখে ।
-ওটা ফেল !
-কি ? (যেন শুনতে পায় নি )
-বললাম হাতের সিগার টা ফেল । আমার সিগারের ধোঁয়া সহ্য হয় না । ফেল বলছি ! নইলে আমি উলটো হাটা ধরলাম !
--এইযে ফেলে দিলাম ! একেবারেই ফেলে দিলাম !
(বলার আগেই ছেড়ে দিয়েছে সিগারটা হাত থেকে । )
-চল কোথাও বসি । সন্ধাটা সুন্দর ! কি বল ??
-হ্যাঁ ... হুমম ...
-ললিপপ খাবে ?? সিগারেট না এখন থেকে তুমি ললিপপ ঠোটে রাখবে বুঝেছ ! – হি হি হি হি
নাজমুলের কানে কিছু ঢুকছে না ! এতোদিনের ফুসফুসে নেয়া ধোঁয়াগুলো যেন একযোগে বেরিয়ে আসতে চাইছে কান দিয়ে ।
আর নাইফার হাসির শব্দের সাথে সে ধোঁয়া মিশে গিয়ে হঠাৎ করেই যেন মনে হতে লাগলো সন্ধাটা বড় বেশি সুন্দর !
...... একটু বেশিই সুন্দর ......
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৯