মনটা ভাল নেই, ভয়াবহ রকমের নিঃসঙ্গতা কাজ করছে। পরীক্ষা শেষে বান্দরবন ট্যুরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, গরম আর পোলাপানের এহেন গড়িমসিতে তা কালবিলম্ব হতে হতে এক সময় ট্যুরই ভেস্তে গেল। দিন তিনেক মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখে ঢাকা শহরের অলি-গলি ঘুরে ঘুরে কাটালাম, নিছক চেনা-পরিচিতজনদের থেকে একটু দূরে থাকতেই। এরপরেও মনটা শান্ত হচ্ছিল না। হঠাতই একদিন সন্ধ্যায় কাকতালীয়ভাবে বন্ধুবর শ্যাম পুলক দেখা করে জানাল, উপন্যাস লেখার কাজে সে পরশুই খাগড়াছড়ি যাবে- শান্তি বিহারে। চোখ চকচক করে উঠল। ব্যাস, সেখানেই প্ল্যান হল- আমার সাথে প্রথমে সে বান্দরবন যাবে, সেখানে আমরা যাব স্বর্ণ মন্দির, নীলগিরি, বগা লেক আর কেওক্রাডাং। এরপরে যাব খাগড়াছড়ি- শান্তি বিহারে। ভালই হল- মাত্র ২ জনের এমন জায়গায় যাওয়া যত ঝুঁকির ততই আনন্দ!! এডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে গেল। :
পরদিনই টিকেট কেটে ফেললাম। ঢাকা থেকে বান্দরবন যায় ইউনিক, শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ পরিবহনগুলো। প্রত্যেকেরই নন এসি- সিটিং সার্ভিসের ভাড়া ৬২০ টাকা করে। ৫ তারিখ রাত ১০:৩০ টায় আরামবাগ থেকে ইউনিক পরিবহনে রওনা হলাম। বান্দরবন শহর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশখানি উপরে পাহাড়বেষ্টিত পরিচ্ছন্ন শহর। যাওয়ার পথে রাইচা আর্মি ক্যাম্প পার হবার পর থেকেই ধীরে ধীরে গাড়ি উপরের দিকে ওঠা শুরু করল। পৌছলাম সকাল ৭:৩০ এ।
শহরের পাশের স্বর্ণমন্দির দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয় বিকেলে, তাই ফেরার দিনের জন্য তা রেখে গন্তব্য ঠিক হয়েছিল নীলগিরি। বাস থেকে নেমে ছোট ঘরের কাজ সেরেই ৫০ টাকায় রিজার্ভে একটা অটোরিক্সা নিয়ে ১০ মিনিটে চলে আসলাম ‘তিন নম্বর’ এ। নীলগিরি, রুমা কিংবা থানচি যাওয়ার বাস এখান থেকেই ছাড়ে। নীলগিরি’র বাস সকাল ৮:০০ টায়, ভাড়া জনপ্রতি ১৬০ টাকা করে। নীলগিরি যাওয়ার বাস ১২ টায় আরও একটা আছে, তবে একটা বাস এই রাস্তায় দিনে একবারই যায় অথবা আসে। একই বাস একবার গেলে ঐদিন ফেরত আসার নিয়ম নেই। পাশের হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে ৮টার বাসে রওনা হলাম, বাসের ছাদে চড়ে। আড়াই ঘন্টা যাবত বাস একটু একটু করে উপরে উঠতে থাকলে ঠিক কি পরিমাণ উপরে ওঠে কল্পনা করুন, নীলগিরি ঠিক ততখানিই উঁচু। যেতে যেতেই দেখতে পাবেন আকাশের মেঘ আস্তে আস্তে আপনার অবস্থান সীমায় নেমে আসছে, আসলে আপনিই মেঘের উচ্চতায় চলে যাচ্ছেন। এবং, একসময় চলে যাবেন মেঘের উচ্চতার উপরে, মেঘ আপনার নিচে। পথিমধ্যে দু’ চোখ যতদূর যায় দেখবেন শুধু সুউচ্চ পাহাড় আর পাহাড়, আপনি সবকিছু ছাড়িয়ে উপরে, অসম্ভব রকমের উপরে।
এই রাস্তায় ভ্রমণপথের আনন্দ সবচেয়ে বেশি পাবেন যদি গাড়ির ছাদে ওঠেন। ভাই, ক্ষেইপেন না। দেখেন, চারপাশের গিরিখাদ দেখলে ভয় লাগবে, সেই ভয় পার করে আসার পরের অনুভূতিই তো অসাধারণ। গাড়ি যদি নিচে পড়ে, তাহলে ভাই আপনি গাড়ির ভিতরে থাকলেও পড়বে, জীবনের ঝুঁকির চিন্তা সেক্ষেত্রে অনর্থক। তবে, হ্যা, ছাদে উঠলে পথিমধ্যের দু’পাশে মাঝে মাঝে কিছু গাছের কাঁটাওয়ালা ডাল আসে, মাথা একটু নিচে করে সেগুলো এড়িয়ে গেলেই হলো। ছাদে উঠে কাঁটার বাড়ি খাইলে আবার আমারে দোষ দিতে পারবেন না।
তবে যদি আপনি শুধুই নীলগিরিতে গিয়ে দু’চারটা ছবি তোলার জন্যই আসেন, পথিমধ্যে যাত্রাপথ নিয়ে যদি আপনার কোন আগ্রহ না থাকে তাহলে খামাখা ছাদে উঠার দরকার নাই।
নীলগিরি যাওয়ার পথেই পড়বে চিম্বুক পাহাড়। সেখানে গাড়ির যাত্রাবিরতিও দেয় ১৫ মিনিটের। অবশেষে ১০:৩০ এ আমরা পৌছলাম নীলগিরিতে। ৫০ টাকার টিকেট কেটে উঠে গেলাম নীলগিরি’র চূড়ায়। আর্মিরা নীলগিরি পাহাড়ে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন রকম স্থাপনা নির্মাণ করেছেন পাহাড়ের কিনারে দাড়ানোর জন্য, মূলত ছবি তোলার জন্য।
এসবকে ছাপিয়ে নীলগিরি আসল সৌন্দর্য নীলগিরি পাহাড়ে নয়, এর চারপাশে। নীলগিরি থেকে দেখতে পাবেন পূর্বে বয়ে গেছে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সাঙ্গু নদী, উত্তরে চিম্বুক পাহাড়, পশ্চিমে সুউচ্চ পর্বতশ্রেনী আর সে পর্বতশ্রেনীর মাঝে মাঝে পাহড়ি আদিবাসীদের গ্রাম। উপরে নীলাকাশ, কিন্তু নিচে সাদা মেঘ। এখানেই নীলগিরি’র কৃতিত্ব।
পরবর্তী গন্তব্য রুমা। রুমা’য় রাত্রিযাপন করে সেখান থেকে যাব বগা লেক। নীলগিরি থেকে বান্দরবনের বাস ছাড়ল ১২:৩০ এ, আবার ছাদে চড়ে এসে নেমে গেলাম ‘বারমাইল’/‘ওয়াই জংশন’ এ। বান্দরবন থেকে আসার সময় এই ‘ওয়াই জংশন’ এ এসেই দু’দিকে দুটো রাস্তা গেছে- একটি ক্রমান্বয়ে উপরে উঠে নীলগিরি পাশ দিয়ে গেছে থানচি তে, আরেকটি এখান থেকে ক্রমশ নিচে নেমে গেছে পরবর্তী সাড়ে ৩ ঘন্টা- ভাড়া জনপ্রতি ৭০ টাকা। সাবধান!-এ রাস্তায় আবার বাসের ছাদে চইড়েন না। পাহাড়ের কোল ঘেষে, পাহাড় কেটে বানানো এ রাস্তায় দু’পাশের কাঁটা গাছের সংখ্যা অনেক বেশি, এক্ষেত্রে ছাদে উঠলে বিপদে পড়বেন। রুমা ঘাটে পৌছে সেখান থেকে জনপ্রতি ৩০ টাকা ভাড়ায় ‘চাঁদের গাড়ি’ নামের স্থানীয় জিপ গাড়িতে চড়ে আধা ঘন্টায় চলে আসলাম রুমা বাজারে, আসল রুমা উপজেলায়। এসেই শাপল ভাই নামের এক ট্যুরিস্ট গাইড এজেন্ট এর মাধ্যমে ২ বেডের এক রুম ৫০০ টাকায় ঠিক করে হোটেলে উঠে পড়লাম। গোছল সেরে বের হয়ে আসলাম রুমা ঘুরে দেখতে। প্রথমেই বগা লেক যাওয়ার গাইড ঠিক করে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে রিপোর্ট করে আসলাম। উল্লেখ্য, গাইড এর রেট নির্ধারিতঃ দিনপ্রতি ৫০০ টাকা, সাথে আমি যেখানে থাকি, যা-ই খাই, তার থাকা-খাওয়ার খরচও আমাকে বহন করতে হবে। রুমা’য় বিপদে পড়লাম মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে। আমার ছিল বাংলালিংক আর এয়ারটেল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রুমা’য় শুধু এই দুই কোম্পানিরই লাইন নাই, বাকিগুলার মোটামুটি সার্ভিস আছে।
রুমা দেখে প্রাণ জুড়ে গেল। বন্ধুবর জিজ্ঞেস করেছিল- ‘রুমা দেখতে কেমন- এক লাইনে বল’, আমি বললাম ‘Well, Ruma has a lot of stairs.’ পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাড়ি, তাই রুমা’য় প্রচুর সিড়ি। পর্বত কন্যা সাঙ্গু নদীর ঠিক পাড়েই রুমা দেখতে একদম প্রাচীন কোন জনপদের রাজধানীর মত এক মফস্বল শহর। ব্যস্ত আদিবাসী ও স্থানীয় বাঙ্গালিদের এই শহরই সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে শান্তির এলাকা। রুমা’য় কোন মারামারি-কাটাকাটি নেই, এমনকি চুরি-ডাকাত ও নেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পাহাড়ি আদিবাসীরা যথেষ্ট সৎ, আপনি যদি ভুলে লাখ টাকার মানিব্যাগ ফেলে রেখে যান, আর তা যদি কোন আদিবাসী পেয়ে থাকে, তবে সে সেটা চুরি তো করবেই না, বরং তা স্থানীয় থানায় দিয়ে আসবে। দুশ্চিন্তার যদি কিছু থাকে তবে সেটা আদিবাসী নয়, বাঙ্গালিদের নিয়ে। রূমা’য় শুধু অবাক হয়েছি একটা দৃশ্যেঃ রুমা বাজারের পাশেই রুমাদেব বৌদ্ধ বিহার দেখতে উপরে উঠে দেখলাম বৌদ্ধ ভিক্ষুরা টেলিভিশনে রেসলিং দেখছেন আর চুরুট টানছেন।
পর্বতশৃঙ্গের বুক চিড়ে নেমে আসা শত শত ঝর্নাধারা এক হয়ে হৃদয়ের ক্ষরণের মত সাঙ্গু বয়ে গেছে রুমা’র পাশ দিয়ে, নদীতে চলছে নৌকা, পাড়ে গোছল করছে গ্রামের ছেলে-মেয়ে-বুড়োঃ সে এক অসাধারণ স্থান।
এখন কেওক্রাডাং পেরিয়ে আরও বেশ অনেকদূর পর্যন্ত রাস্তা হয়ে গেছে, গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু গাড়িতে করেই পুরোটা পথ গেলে মজাটা পাব না। তাই ঠিক করলাম- বগা লেক পর্যন্ত যাব গাড়িতে, আর বগালেক থেকে কেওক্রাডাং যাব হেঁটে। মাত্র ২ জনের পক্ষে পুরো এক জিপ ভাড়া করা বেশ খরুচে হয়, তাই খরচ বাঁচাতে পরদিন সকালে বগালেকগামী এক ট্রাকে চড়ে পড়লাম আমরা ২ জন আর আমাদের গাইড আপেল মল্লিক ভাই, স্থানীয় বাঙালি বৌদ্ধ। বাঙালি গাইড নিচ্ছি বলে আমাদের একরকম ভয় ছিল, কিন্তু শেষমেশ কোন সমস্যাই হয়নি, বরং আপেল ভাই বেশ ভালভাবে সাহায্য করেছেন, আমাদের অনেক খরচ কমিয়ে দিয়েছেন, যাত্রাপথের আশাপাশের স্থানসমূহ ও বান্দরবনের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বলেছেন। বগালেক যাওয়ার পথের অভিজ্ঞতার কথা আমি কোনদিনই ভুলবনা। সেই অসাধারণ অভিজ্ঞতা অবশ্য আমি এখানে লিখব না। অনুভূতির সবকিছুই আগে থেকে বলে দেয়া ঠিক না, কিছু সাসপেন্স থাক।
বগা লেকের উচ্চতা ও প্রকৃতি নিয়ে বেশ প্যাচ আছে। উইকিতে লেখা বগালেকের উচ্চতা ৩৫০০ ফুট, অথচ কেওক্রাডাং এর উচ্চতা ৩১৯৬ ফুট। এবং, নিজে ভ্রমণ করে আসায় এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে, বগা লেক থেকে কেওক্রাডাং বহু বহু উঁচু। আবার, বাংলাপিডিয়ায় বলা আছে- এর পানি বেশ অম্লধর্মী এবং একারণে এতে কোনো শ্যাওলা বা অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ নেই, এবং কোনো জলজ প্রাণীও এখানে বাঁচতে পারেনা। অথচ, লেকের পানি বেশ সুপেয় এবং শ্যাওলা সহ লেকে প্রচুর মাছ শুধু যে আছেই তা না, লেকে নামতেই মাছগুলো শরীরের বিভিন্ন চিপা-চাপায় প্রবেশ করে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।
স্থানীয় বিশ্বাস অবশ্য ভিন্ন- স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায় ড্রাগনকে "বগা" বলা হয়। ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করতেন। কিন্তু একবার কয়েকজন এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূঁড়াটি জলমগ্ন লেকে পরিণত হয় এবং গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। যদিও এই উপকথার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই, তবুও উপকথার আগুন উদগীরণকারী ড্রাগন বা বগা এবং হ্রদের জ্বালামুখের মতো গঠন মৃত আগ্নেয়গিরির ধারণাটির সাথে মিলে যায়। তবে রহস্যের বিষয়- প্রতি বছর মে মাসের শুরুর দিকে বগা লেকের পানি স্বাভাবিক স্বচ্ছতা থেকে ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে যায়। এবং, আরও রহস্য যে, প্রতি অমাবশ্যতার রাতে লেকের পানি লালচে রঙ ধারণ করে। স্থানীয়দের বিশ্বাস এ তাদের ড্রাগন দেবতার কর্ম। বগালেকে হোটেল ভাড়া জনপ্রতি ১০০, আর খাবার প্রতি বেলায় জনপ্রতি ১০০ টাকা করে। হোটেলে ব্যাগ রেখেই চলে আসলাম বগালেকে ঝাপিয়ে পড়তে। ঘাটে এসে দেখি- লেকে এক লাল পরী গোছল করছে।
লজ্জ্বার মাথা খেয়ে পরী এবং লেকের কিছু ছবি তুলেই নেমে পড়লাম লেকে।
দুপুরের খাবারের পর রওনা হলাম কেওক্রাডাং এর উদ্দেশ্যে। এখানেই একটু ভুল করে ফেলেছিলাম- সাধারণত আমার প্রতিদিনই ২/৩ কি.মি. হাটা পরে, কিন্তু, সমতলে হাঁটার অভ্যাস দিয়ে যে পাহাড়ে কিছুই হবে না সে অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই খাবারের পর অন্তত আধা ঘন্টা বিশ্রাম নেয়া উচিৎ ছিল। ভরপেটে রওনা হয়ে পথে বেশ ভুগিয়েছিল। যাই হোক- ক্রমে উপরে উঠে যেতে লাগলাম। পথিমধ্যে ৩টা ঝর্ণা পড়ল। ৩ নম্বর ঝর্ণা বেশ চওড়া এবং নামকরা- ‘চিংড়ি ঝর্ণা’। কিন্তু, গরমের সময় যাওয়ার দুর্ভাগ্যবশত ঝিরি তে পানি তেমন ছিলই না।
পথিমধ্যে কয়েকবার করে বিশ্রাম নেয়া লাগল। বোতল ভর্তি গ্লুকোজ আর স্যালাইন মেশানো ঝিরির ঠান্ডা পানি খেয়ে নিচ্ছিছিলাম। বর্ষাকালে পাহাড় ভ্রমনে আরও কিছু জিনিস নিয়ে নিবেনঃ মশার জন্য অডোমস কিংবা কুইনাইন ট্যাবলেট, জোঁকের জন্য লবন, চাকু আর ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ। পথিমধ্যের রাস্তা কখনও খাড়া উঠে গেছে, কখনও হালকাভাবে, কখনওবা সমতল আবার কখনও প্রয়োজনে কিঞ্চিত নেমেও গেছে। দার্জিলিং পাড়ায় এসে প্রায় আধা ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে নিলাম। কারণ এরপরে পুরো ১ কি.মি. টানা উঠে গেছে উপরে, কোনও সমতল নেই। অবশেষে ৭ই মে, দুপুর ১২:৫০ এ আমি বাংলাদেশের পঞ্চম সর্বোচ্চ (এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃতগুলোর মধ্যে) পর্বতশৃঙ্গ ‘কেওক্রাডাং’ এর চূড়ায় আমার ক্লান্ত-শ্রান্ত পদখানি বহুকষ্টে রাখলাম।
আমি আগে জানতাম কেওক্রাডাং ২ নম্বর শৃঙ্গ। বেশ কিছুদিন আগে শুনি ৩ নম্বরে এসেছে। কেওক্রাডাং জয়ের ঠিক কিছুক্ষণ আগে জানতে পারি- ৫ম নম্বরটিকে জয় করতে চলেছি।
১। সাকা হাফং- ৩৪৮০ ফুট (যেতে লাগে ৩ দিন)
২। জতলং- ৩৩৪৮ ফুট
৩। দুমলং- ৩৩০৬ ফুট (যাওয়া-আসা ৭ দিন)
৪। তিন মাথা- ৩১৪৩ ফুট (যাওয়া-আসা ৬ দিন; এ থেকে ৩ দেশ দেখা যায়)
৫। কেওক্রাডাং- ৩১৯৬ ফুট
৪ আর ৫ নম্বরের উচ্চতা দেখে কপাল কুঁচকেছেন জানি। আমার কিছু করার নাই। অনলাইন, ব্লগ, বাংলাপিডিয়া এবং কেওক্রাডাং এর উপরের প্রস্তর ফলকে- সবার উচ্চতার হিসাবই ভিন্ন ভিন্ন। এমনকি কখনও সে পার্থক্য হাজার ফুটেরও। আর, তাজিংডং এর কথা? তাজিংডং সেরা দশের মধ্যেও নাই। অথচ, কোন এক রহস্যময় কারণে তাজিংডং কেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া আছে!!
যাই হোক, কেওক্রাডাং বিজয়ের পর সে অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। অসম্ভব।
চিত্ত যেথা ভয়শুন্য, উচ্চ যেথা শির
দিগন্তজোড়া আকশ্চুম্বী শত শত পর্বতের মাঝে সর্বোচ্চ পদে আসীন আমি। সে এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ। অতুলনীয়। কেওক্রাডাং এর চুড়ায় ঠান্ডা বাতাস অল্পক্ষণের মধ্যে শরীর সব অবসাদ জুড়িয়ে দিল। এত ঠান্ডা যে এখানে রাতে নাকি ২টা কম্বল নিয়ে ঘুমাতে হয়।
বলে রাখছি- বান্দরবন দর্শনীয় স্থানে ভরা এক রহস্যময়ী দেশ। আমি আগে ভাবতাম আমাদের দেশটা এত সুন্দর, শুধু অল্প কয়েকটা জিনিসেরই কমতি। শুধু ৪টা জিনিসই আমাদের দেশে নাই- গুহা, বরফাঞ্চল, মরুভূমি আর আগ্নেয়গিরি! শেষের ২টা’র কোনই দরকার নাই। প্রথম ২টা হলে ভালই হয়। তো, কিছুদিন আগে জানলাম- আমাদের দেশেও গুহা’র খোঁজ পাওয়া গেছে। এইবার ভ্রমণে গাইড থেকে জানতে পারলাম- ১টা না, আবিষ্কৃতগুলার মধ্যেই অন্তত ৮টা গুহা আছে। আবার এমন একটা অঞ্চল আছে যেখানে শীতকালে বরফ জমে থাকে। তার উপর আবার, এখনও বান্দরবনের বহু জায়গা তো আবিষ্কারের বাকিই আছে। অনেক জায়গাই আছে এখনও মানুষের পা পড়ে নাই। তবে, আমার মত গ্রীষ্মে আসলে আসল সৌন্দর্য অর্ধেকই মিস করবেন। বর্ষার সময় ঝর্ণাগুলাও পানিতে ভরে যায়, পাহাড়গুলাও সবুজে ছেয়ে যায়, আবার যাত্রাপথে গরম ও কম থাকে। তবে, ঠিক বর্ষায় না এসে বর্ষার পর আসা ভাল। তাতে কাদাপানির রাস্তায় কোন বিপত্তির আশঙ্কা নেই। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ঝর্ণাগুলো পানিতে ভরপুর থাকে। বরং এসময় দিনের বেলা চলতেও আরাম হবে। বর্ষা এবং বর্ষার পর আকাশে মেঘও থাকবে প্রচুর। মেঘ বয়ে যাবে আপনার শরীর ভেদ করে, হারিয়ে যাবেন মেঘের ভিতর। বান্দরবনে দেখার মত কিছু দর্শনীয় স্থানের নাম, গমন সময় ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করছিঃ
১। যাদিপাই ঝর্ণা- (যেতে ৫ ঘন্টা ; একইসাথে ৩ রংধনু দেখা যায়)
২। ডাবল ফলস/ত্লবং- (যাওয়া-আসা ৩ দিন)
৩। জিংসাং সেতার (যাওয়া-আসা ৪ দিন ; ৫টা ফলস এক জায়গায়)
৪। তিনরলতি- (৮ দিন ; ৮টা ঝর্ণা)
৫। রাইক্ষ্যাং লেক+ঝর্না – (৫ দিন ; স্বচ্ছ নীল পানির লেক)
৬। সাত বাই কুম – (স্বচ্ছ পানির লেক + সূর্যের আলো পড়েনা পাহাড়ের নিচ দিয়ে এমন ঝিরি)
৭। রুমনা পাড়া’য় ৩টা গুহা + গুহার ভিতরে ঝর্ণা (যাওয়া-আসা ৪ দিন)
৮। বাদর গুহা (যাওয়া ৩ ঘন্টা ; বানরে ভরা গুহা)
৯। দারুছড়ি পাড়া (৩ দিন ; শীতকালে বরফ জমে থাকে)
......এমনই বহু বহু সৌন্দর্য্যের হাতছানি এই বান্দরবনে। দর্শনীয় স্থানের খোঁজ জানতে নির্ভরযোগ্য এই সাইটে ভিজিট করতে পারেনঃ http://www.banglatrek.org। সবগুলা জায়গা দেখা এক ট্যুরে সম্ভব নয়। আবার, যাবার পথও একটা নয়, বিভিন্নদিক থেকে বিভিন্ন ভাবেই যাওয়া যায়। আপনি কোন কোন জায়গায় যেতে চান তা আপনার গাইডকে বললে সে-ই সবচেয়ে কোনটা আগে, কোনটা পরে হবে এবং কম সময়ের গমন পথ বেছে দিতে পারবে। আমি যেমনঃ একটা প্যাকেজ ঠিক করে রেখেছিঃ- ডিসেম্বরে বগা লেক>রুমনা পাড়া>দারুছড়ি>রাইক্ষ্যং লেক – ৮ দিনের এই ট্যুরে মোটামুটি পর্বতশৃঙ্গ, গুহা, লেক, ঝর্ণা, বরফাঞ্চল সবই দেখা হবে।
বান্দরবনের পাহড়ে আছে ১১ জাতির আদিবাসী। একেকজনের রীতি-নীতি একেক রকম। চাকমা-মারমা যেমন পাহাড়ের নিচের দিকে, বিশেষ করে সমতলে থাকতে বেশি পছন্দ করে, ব্যোম রা তেমনি যত উপরে পারা যায় থাকতে পছন্দ করে। চাকমা-মারমা কন্যাসন্তানের অধিকারের ব্যাপারে যতটা সচেতন, ব্যোম কিংবা মুরং(ম্রোং) রা ততটাই রুক্ষ। মুরং রা তো রীতিমত টাকা দিয়ে বউ কিনে আনে। বিয়ের পর ছেলে তেমন কাজ করে না, যেহেতু বউ কিনে নিয়েছে, তাই বাড়ির বউকেই চাষবাস সহ সব কাজ করতে হয়। এমনকি ভিন্ন জাতের ছেলের সাথে যদি কোন মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ঘটে মুরং রা ছেলে-মেয়ে উভয়কেই জবাই করে ফেলে।
কেওক্রাডাং এ উঠতে সাড়ে ৩ ঘন্টা লাগলেও ফিরতে লাগল মাত্র ২ ঘন্টা। ফেরার পথে অনেক দূর থেকে দেখা পাওয়া পাহাড়ের খাঁজের মাঝে বগা লেকের দৃশ্যটি মনে রাখার মত। কেওক্রাডাং যাওয়ার পথে ছিল প্রচন্ড রোদ, মেঘের দেখা নেই। অথচ, নেমে আসার পরেই আকাশ কালো হতে শুরু করল। রাতে কান ফাটানো বিদ্যুৎ চমকে এলো ঝুম বৃষ্টি।
দিক-বিদীর্ণ সে বিজলিগুলো যেন সে রাতে স্বয়ং ড্রাগন দেবতার আবির্ভাব ঘটিয়েছিল।
বৃষ্টি তো উপভোগ করলাম, কিন্তু সকালে ফেরার সময় টের পেলাম বিপত্তি। বৃষ্টিতে রাস্তার মাঝে মাঝে কোথাও পানি জমে গর্ত হয়ে গেছে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির চাকা এসব গর্তে পড়ে যখন কাত হয়ে যায় বারবার তখন মনের অবস্থা কি হয় ভেবেই দেখুন! এই প্রথম বেশ ভয়েই ছিলাম। তবে-ভালই ভালই ফিরলাম, এরা আসলেই ভাল গাড়ি চালায়। শুনেছি সরকার এ রাস্তা পাকাকরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। রাস্তা’র সংষ্কার অতি জরুরী তবে ইটের রাস্তা পর্যন্ত হতে পারে কিন্তু পিচঢালা রাস্তা কোনমতেই করা ঠিক হবে না এখানে। আর, রাস্তা যেমনই হোক, চালাতে হবে এখানকার চালকদের দিয়েই। শহরের চালক শহুরে গাড়ি নিয়ে এ রাস্তায় আসলে আমি বাজি ধরে বলতে পারি- তার ১০ টা গাড়ির মধ্যে ৯টাই পাহাড় থেকে নিচে পড়বে, বাকি ১টা একেবারে নিচে না পড়লেও ছোট-খাট কিছু দুর্ঘটনা হবেই। উল্লেখ্য, পাহাড়িদের এ অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যহত হয়ে আছে সরকারের গড়িমসির কারণে। সম্ভবত, তারা পাহাড়ি আদিবাসী থুক্কু উপজাতি বলেই।
ট্যুরের এই ২ দিন ভালই গেল, আর পরের ২ দিন গেল কুফার মধ্যে। বগালেক থেকে ভয়ংকর রাস্তার অভিজ্ঞতা নিয়ে রুমা হয়ে বান্দরবন ফিরলাম। বান্দরবন এসে জানলাম এখান থেকে খাগড়াছড়ি’র সরাসরি গাড়ি নাই। রাঙামাটি হয়ে যেতে হবে। কিন্তু রাঙামাটি’র সর্বশেষ বাস সাড়ে ৩ টায়। আর তখন বাজে ৩টা। দৌড়ে রাঙামাটির বাসের বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের সিট পাব কিনা তার নাই ঠিক আবার স্বর্ণমন্দিরও দেখা হয় নাই। ঠিক করলাম- আজ স্বর্ণমন্দির দেখে রাতে বান্দরবনই থেকে যাই। আগামীকালের ভোরের বাসের টিকেট কেটে গেলাম স্বর্নমন্দির দেখতে। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে থাকায় গেইট থেকেই আটকে দিল, ভিতরে ঢুকতে দিল না।
ফিরে এসে নাস্তা সেরে উঠে পড়লাম খাগড়াছড়ি’র গাড়িতে। পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টি নামলে যা হয়- ছোট-বড় ঢল নেমে পড়ছে রাস্তায়, কোথাও মাটি সহ স্রোত নেমে আসছে। অথচ, ড্রাইভার গাড়ির গতি কমাল তো নাই-ই যেন ফাঁকা রাস্তায় আরও বাড়িয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি গাড়ির সামনের পানি সরানোর ডান্টি নাই, সামনের জানালা ঝাপসা হয়ে উঠছে। আমি প্রমোদ গুমলাম। কিন্তু, আমাদের ড্রাইভার এসবের কিচ্ছু তোয়াক্কা না করে আড়াই ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে নিয়ে আসল খাগড়াছড়ি তে। খাগড়াছড়ি নেমে প্রথমেই ঢাকায় ফেরত আসার রাত ৯টার সর্বশেষ বাসে ৫২০ টাকায় টিকেট কেটে ফেললাম। এরপর বের হয়ে যাকেই বলি- শান্তি বিহার যাবেন নাকি কিংবা শান্তি বিহার কিভাবে যাব- সবাই বলে ‘শান্তি বিহার’ আবার কোথায়? মহা মুশকিল তো!! অবশেষে রহস্য উদ্ধার হল- শান্তি বিহারের প্রকৃত নাম- ‘শান্তিপুর অরণ্য কুটির’। এরা সে নামেই চেনে। বলল- পানছড়িতে চলে যান। খাগড়াছড়ি থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকার সিএনজি নিয়ে চলে আসলাম ২৫ মেইল দূরের পানছড়িতে। এসে শুনলাম- শান্তি এখান থেকেও আরও ৮ মেইল দূরে। মহা জ্বালা! অবশেষে সেখান থেকে আবারও রিজার্ভ ৫০০ টাকা দিয়ে সিএনজি নিয়ে আসলাম শান্তি বিহারে। বিশ্বাস করেন- দেখেই প্রশান্তি চলে আসল। ক্যামেরা বের করলাম কিন্তু সে যাত্রায় সে আর কাজই করল না। শান্তি বিহারে বন্ধুবরকে রেখে বহু স্মৃতি নিয়ে উঠে পড়লাম ঢাকার বাসে। অবশেষে ভোড় ৬ টায় টানা ২৩ ঘন্টার যাত্রাশেষে ফিরলাম বাসায়। ফিরে আসলাম স্বর্গের খুব কাছাকাছি থেকে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


