somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিশুকালের খেলা, গায়ে মাখি ধুলা

০৩ রা মে, ২০১১ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন আকাশটা আরেকটু নীল ছিল। এই তামাপোড়া শহরে আরেকটু খোলা বাতাস ছিল। কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে ২-১টা মাঠ ছিল ছোট-বড়-মাঝারি। মিষ্টি চেহারার কয়েকটা বাড়ির সামনে একচিলতে উঠান ছিল। এমনকি, দানবীয় বাক্সমার্কা অ্যাপার্টমেন্টের বদলে ২-৩-৪ তলা দালান গুলোর ছাদেও একটুখানি হাঁটার আর পাশের বাসার মেয়েগুলোকে দেখে চোখ জুড়াবার ব্যবস্থা ছিল। তখন আমরা গায়ে ধুলো মাখতাম, তখন আমরা ছুটোছুটি করে খেলতাম। অবু দশ-কুড়ি-নাড়ি-ভুড়ি, চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি বলে বাটাবাটি করতাম কে চোর আর কে পুলিশ হবে। ৪টা করে হাত একসাথে থেকে হঠাৎ আকাশে ছুঁড়ে দেখতাম কে
হয় চোর, ব্যাটার কপালে ম্যালা দুঃখ। তখন আমরা শিশু ছিলাম, আমাদের একটা মাটিগন্ধী শৈশব ছিল, এই কঠিন শহরেও আমরা বিদেশী ক্রিকেট আর ফুটবলের আগেই মাটির খেলার খোঁজ পেয়েছিলাম।

এসব অর্থহীন খেলার আগেই শোনা হয়ে গিয়েছিল নানা রকম ছড়া কাটা, ঐ বয়সে সবচেয়ে অপমানজনক ছিল যার মাথা ন্যাড়া তার জন্য একখানা চার লাইনের ছড়া---
"বেল মাথা চাইর আনা,
চাবি দিলে ঘুরেনা,
চাবি হইলো নষ্ট,
বেল মাথার কষ্ট।"
শুধু ছড়া কেটে ছেড়ে দিলে এক কথা ছিল, সাথে যে যখনি সুযোগ পেত মাথায় তবলা বাজিয়ে যেত, ওদিকে মা-বাপদের একটা ধারণা ছিল যে মাথাটা টাক্কু বেল করলে চুল হবে ঘন কালো, কাজেই নিয়মিত শুনতে হতো ঐ ছড়া, তবলার বোলের সাথে। ঐ যে মাথায় ন্যাড়াবেলের ব্যাপারে আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছিল, এখনো চুল কাটাতে গেলেই অস্বস্তি লাগে, কদমছাঁট হয়ে যাবার আগেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি ঝটপট।

মানুষ হয়েছি এই কঠিন শহরে একা, মাঝে মাঝে নানাবাড়ি গেলে খালাতো মামাতো ভাই-বোনরা খেলতো পুতুল আর রান্নাবাটি, ২-৪ দিন খেলেই উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম, এ জিনিসে পোষাবে না। বোনেরা ছড়া কাটতো আরো কিছু, কি যেন---
"আকাশ থেকে নেমে এল ছোট্ট একটি প্লেন,
সেই প্লেনে বসে ছিল একটি ছোট্ট মেম,
মেমকে আমি জিগেস করলাম হোয়াট ইজ ইউর নেম,
মেম আমাকে উত্তর দিল
মাই-নেম-ইজ-বিউ-টি-ফুল।"
এই বলে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়তো, যদিও এই ছড়ায় এত হাসির কি আছে, এখনো বুঝিনি। মাঝে মাঝে সবাই হাত পাততো, আবার চলতো ছড়া, প্রতি শব্দে একেকজনের হাতে ছোঁয়া--"ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা"। যার হাতে পড়তো "যা", সে বাদ পড়ে গেল। তবে একটু উৎসাহ পেলাম "ফুল টোকা" তে, মহা গ্যান্ঞ্জামের খেলা। ভাগ হয়ে যেত দুই দলে, প্রত্যেক দলে একজন হতো রাজা, ২ দিকে বসতো ২ জন। বিপক্ষের একজন এসে ধরবে রাজার চোখ, আর আরেকজন এসে জোরসে একটা টোকা মেরে ফেরত যাবে তার দলে, চোখ খুলে রাজাকে গিয়ে ধরতে হবে কে মেরে গেল, ধরতে পারলেই সে বাদ, এভাবেই চলতে থাকবে যতক্ষণ না এক পক্ষের সব খেলোয়ার ধরা পড়ে। গ্যাণ্ঞ্জামটা ছিল, মহা দুই নম্বুরি হতো, যার চোখ ধরা হলো সে যেকোনভাবে হোক একটু দেখার চেষ্টা করতো। না পারলে, আগে থেকেই দলের মাঝে চোখ-হাতের নানা রকম ইশারা ঠিক করাই থাকতো, কে টোকা দিয়েছে সেটা ধরার জন্য। বিরক্ত হয়ে শেষমেশ কষে চোখ বাঁধার ব্যবস্থা হলো এক্কেবারে র্যাব স্টাইলে, কিন্তু কিসের কি, যে পক্ষ ধরা খাবে তারা একেবারে সাংবাদিকদের মতই হাউকাউ শুরু করে দিত চুরি-চোট্টামির অভিযোগ এনে, বেশিরভাগ দিনই খেলা শেষ হতো অমীমাংসিতভাবে।

তারপরে একটু বড় হয়েছি, তবে অতটা বড় না যে বড়দের সাথে খেলতে পারি, কিন্তু লাফঝাঁপ পারি হালকা, বোন আর প্রতিবেশিনীরা লোকজনের অভাবে মাঝে মাঝে ডাক দিতেন "কুতকুত" খেলায়। ১০০ ভাগ রমনীয় খেলা, টিভিতে পেপসির বিজ্ঞাপনে যেমনটা দেখায়, সাকিব আল হাসান উল্টো মুখ করে একটা ইটের টুকরো (যেটাকে চারা বলে) ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আর তারপরে একদমে কুতকুত কুতকুত বলতে বলতে এক পায়ে লাফিয়ে সেই চারাটাকে ঠেলে ঠেলে কোর্টের শেষ মাথায় নিতে হবে, ৪ আর ৬ নম্বর ঘরে গিয়ে আবার ২ পা ফেলা যেত। আপুদের দড়িলাফেও মাঝে মাঝে অংশ নেয়ার সুযোগ হতো, দড়িতে পা বেঁধে পড়ে তাদের বিনোদন দেয়া ছিল আমাদের মত "দুধভাত" দের কাজ, মানে কিনা, তোমরা খেলার অংশ নও, তবে থাকতে পারো আরকি, কান্নাকাটি করো না। দুধভাত নেয়ার ব্যবস্থা সব খেলাতেই ছিল, যে পিচ্চিটা বড়রা খেলায় না নিলে গিয়ে বাপ-মাকে নালিশ করে সাধের খেলাটা পণ্ড করে দেয়ার ব্যবস্থা করবে তাকে ঠাণ্ডা করার রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেমন আমাদের নেতারা গত ৪০টি বছর ধরেই জনগণকে দুধভাত বানিয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছেন খেলারামের খেল।

একেবারেই উপভোগ করতে পারতাম না যে খেলাটা, তার নাম "কানামাছি।" একবার চোর হয়েছ তো তোমার দফা শেষ, চোখ বেঁধে মাঝখানে ছেড়ে দেয়া হবে আর তোমার কাজ হলো তোমার আশপাশে ঘুরে ঘুরে যারা "কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ" বলে গায়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে (আসলে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে যাচ্ছে) তাদের পাকড়াও করা। সিনেমাতে মাঝে মাঝে নায়ক-নায়িকা এই মহা রোমান্টিক খেলাটা খেলে থাকেন, আগেকার বাদশাহ-বেগমরাও নাকি খেলতেন আর সেখানে আনারকলিরা বরাবরই একটু খেলিয়ে সেলিমের আলিঙ্গনে ধরা দিতেন, কিন্তু এই বান্দা সারা জীবনে আনারকলি দূরে থাক কোন ম্যাডাম ফুলিও ধরতে পারেনি, শুধু কিল খেয়ে "ফুল" হওয়া ছাড়া। তারচেয়ে বরং "কুমির-কুমির" খেলাটা ভাল ছিল, ৪-৫ টা জায়গা ঠিক করা হতো উঠানে দাগ দিয়ে, ওগুলো হল জেগে ওঠা চর, বাকি জায়গাটুকু কুমিরের সম্পত্তি, মানে জল। যে ক'জন খেলোয়ার থাকতো চর থাকতো তারচেয়ে ২-৩টা কম, কোন চরে একসাথে দু'জনের বেশি থাকতে পারবে না, কাজেই দৌড়ে দৌড়ে জায়গা বদল করতে হতো কুমিরের হাত এড়িয়ে, ধরা পড়লে নিজেকেই হতে হবে কুমির। যে কুমির হতো তার বেশ কষ্ট, বিশেষ করে যখন অন্যরা চর থেকে অল্প একটু জলে নেমে "কুমির তোর জলে নেমেছি" বলে নাচ দিতো, পুরো গা জ্বলে যেত।

একদম বাচ্চাকালের আরেকটা খেলা ছিল, ওপেনটি বায়োস্কোপ। জেমসের গানটা মনে আছে? ওই যে---
"ওপেনটি বাইস্কোপ,
নাইন টেন টেইস্কোপ,
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা।"
এই ছড়া বলতে বলতে রেলগাড়ির মত লাইন করে একদল ঘুরে ঘুরে যেত হাত উঁচু করে রাখা ২ জনের মাঝ দিয়ে, ছড়া শেষ হবার সাথে সাথে হাত নামিয়ে
একজনকে পাকড়াও করে ফেলা হয়, যে ধরা খাবে তার কাজ হলো ঐ দু'জনের ছড়ানো পায়ের উপর দিয়ে লাফ দেয়া। লাফ দিতে গিয়ে মাঝে মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়লেও উৎসাহের অভাব নেই, ধুলা না লাগলে আর খেলাধুলা কি? ওটার সাথেই চলতো "এলন্ডি লন্ডন" নামের আরেকটা খেলা, যে চোর, সে পেছন ফিরে থাকবে, অন্যরা একটু দূর থেকে তার দিকে এগিয়ে আসবে, চোর "এলন্ডি লন্ডন" বলেই ঝট করে পেছন ফিরে তাকানোর আগেই একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে, যদি নড়াচড়া ধরা পড়ে তবে একদম আগের জায়গায়। যে সবার শেষে থাকবে, সে হবে পরবর্তী চোর। চোরের ভোগান্তি আরো বেশি ছিল "সাত পাতা" খেলায়, তার কাজ হলো ৭ রকমের পাতার নাম বলা, অন্যরা সেগুলো যোগাড় করে প্রতিটা থেকে ১টা করে টুকরো নিয়ে কোথাও লুকাবে, চোরের কাজ সেগুলো খুঁজে বের করা, যদিও বেশিরভাগ সময়ই সেটা পাওয়া ছিল একটা অসম্ভব ব্যাপার।

যখন মোটামুটি ছোটাছুটি খেলার পর্যায়ে চলে এলাম, তখন শুরু হলো "ছোঁয়াছুয়ি" বা চোর-পুলিশ খেলা, নিয়ম খুব সরল, চোর ধাওয়া করবে অন্যদের পেছনে, যাকে ছুঁয়ে দেবে সে হবে চোর। (আহা, তখন কতই নিষ্পাপ ছিলাম, বালিকাদের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে দিতাম ছুট, এখন হলে ধরা দিতাম যেচে)। এর একটু জটিল আর দলীয় সংস্করণ ছিল "বরফ-পানি", এক দল আরেক দলকে ধাওয়া করতো, বিপক্ষ দলের কাউকে ছুঁয়ে "বরফ" বলে চিৎকার দিলেই তাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না তার দলের কেউ এসে তাঁকে ছুঁয়ে "পানি" না বলবে। দলের লোকজনকে উদ্ধার করতে হতো বলে ব্যাপারটায় বেশ বীরত্বের ভাব ছিল, অনেক বেশি দৌড়াতে হতো বলে মাঠটাও লাগতো বড়, আর সত্যি বলতে কি, মাঝে মাঝে কোন "বরফ" বালিকাকে উদ্ধার করতে পারলে ঐ বয়সেই নিজেকে বেশ আলেকজান্ডার মনে হতো। দৌড়-ঝাঁপের আরেকটা খেলা ছিল দাঁড়িয়াবান্ধা, কেন যেন নিয়মটা ভুলে গেছি, আর ছিল গোল্লাছুট, সেখানে একটা স্তম্ভ বা ঘাঁটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকবে একটা দল, আরেক দলের কাজ হলো লম্বা দম নিয়ে ঐ ঘাঁটির আশপাশে ঘুরে আসা, এবং সুযোগ পেলেই ঐ স্তম্ভটাকে ছুঁয়ে প্রতিপক্ষের হাত এড়িয়ে নিজের কোর্টে ফিরে আসা, তাতে বিপক্ষের একজন খেলোয়ার বসে যাবে, এভাবে চলবে শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কাছাকাছি নিয়ম "বউ-চি" বা "বুড়ি-চি" খেলার, শুধু স্তম্ভের বদলে ওখানে নিজেদের একজনকে সাজাতে হতো বউ, তাকে ছুঁয়ে আসতে হতো। "মাংস-চোর" খেলাটাও ছিল এটার আরেক সংস্করণ, বিপক্ষ দল একটা দাগের পেছনে থাকতো, সামনে একটা ঘরে থাকতো মাংসরূপী ইটের টুকরো, আরেকদলের লক্ষ্য ছিল একই সাথে একদমে প্রতিপক্ষের কোন খেলোয়ারকে ছুঁয়ে বসিয়ে দেয়া আর মাংসটা চুরি করে খেলা জেতা, তবে ধরা পড়লে নিজেকেই বসে যেতে হবে। খেলাটা কঠিন, বেশিরভাগ সময়েই দমের অভাবে ধরা পড়ে যেতে হয়, একেবারে হাডুডুর মতই বিপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরে তখন।

সন্ধ্যার পরে যদি ঘরে আটকা পড়ে যেতাম, তখন চলতো "চোর-পুলিশ-সাহেব-গোলাম", চার টুকরো কাগজে চারটা নাম লেখা হবে, প্রতিটায় আলাদা পয়েন্ট থাকবে, না দেখেই চারজন চারটা তুলে নেবে, যে পুলিশ পাবে, তাকে অনুমান করতে হবে কে চোর। যদি পারে, চোরের পয়েন্ট টাও সে পাবে, না পারলে, শূন্য। বালিশ মারামারি ছিল আরেক বিনোদন, যদিও অভিভাবকদের মহা আপত্তি ছিল ওটায়, বালিশগুলোর ১২টা তো বাজতোই, সাথে ঘরের দু'চারটা জিনিসও অক্কা পেত। তখন অত লোডশেডিং ছিলনা, মাঝে মাঝে হলে সেটা বিনোদন, পড়ায় ফাঁকি মেরে নেমে যেতাম সবচেয়ে গা ছমছম খেলায়, শুদ্ধ ভাষায় যার নাম "লুকোচুরি", বাচ্চাদের ভাষায় "টিলোস্প্রেস", "পলান্তিস" ইত্যাদি। চোর মুখ ঢেকে গুণবে ১০০ পর্যন্ত জোরে জোরে, এই ফাঁকে বাকিরা লুকাবে, এরপর চোর খুঁজে বের করবে সবাইকে। যদি চোর দেখার আগেই কেউ তার গায়ে ছুঁয়ে দিতে পারে, তবে সে বেঁচে গেল, যদি চোর কাউকে দেখে ফেলে আগেই, তবে সে ফেঁসে গেল, পরের চোর হিসেবে। চোর হওয়াটা এখানে আনন্দের বিষয় ছিল না মোটেই, ছাদের আর বাড়ির কোণাকান্ঞ্চি থেকে অন্ধকারে কে কখন হালুম করে "এসপ্রেস" বলে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে, এই ভয়ে সারাক্ষণ বুক কাঁপতে থাকতো, আর গ্রামের বাড়িতে এই খেলা মানে পুরো ভূতুড়ে অবস্থা।

গ্রামে গিয়েই একটা খেলা ডেখেছিলাম যেটা শহরে কখনো দেখিনি, সেটার নাম "মুলাবাড়ি।" একটা ভেজা গামছা পাকিয়ে শক্ত করা হতো, সেটা হলো "মুলা", তারপর একজন সেটা নিয়ে ধাওয়া করতো সবাইকে, নাগালে পেলেই ধুমধাম বাড়ি, যার গায়ে লাগতো সে বুঝতো মুলা জিনিসটা আসলে বেশি সুবিধার না, গাধা ছাড়া আর কারো ওটার পেছনে দৌড়ানো উচিতও নয়। "ডাঙ্গুলি" খেলাটা একটু বিপজ্জনক দেখে ২-১ বারের বেশি খেলতে দেয়া হয়নি, একটা চোখা বাঁশের টুকরোকে একটা গর্তের মাঝে রেখে আরেকটা পাটকাঠি জাতীয় কিছু দিয়ে গদাম বাড়ি দেয়া হতো, বিপক্ষের উদ্দেশ্য থাকতো সেটা উড়ন্ত অবস্থায় ধরে আউট করা, বেসবলের বাংলা ভার্সন বলা যায় আরকি। ব্যথা পাবার ১০০ ভাগ সম্ভাবনা নিয়েও অবশ্য "বম্বাস্টিং" খেলেছি নিয়মিত, অনেকে ওটাকে বলতো "পিঠ জ্বলান্তিস" বা "কিং-কুইন"। একটা টেনিস বল নিয়ে যাকে নাগালে পাও তাকেই গায়ের জোরে মেরে বসতে হবে, যার গায়ে লাগবে সে আউট, লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং হবে বিজয়ী, তবে ২ দলে ভাগ হয়েও খেলা যায়। টেনিস বল লাগতো আরেকটা খেলাতেও, সেটা "সাত চারা", একটা ইটের উপর ৭টা চারা (ইটের টুকরো) বসিয়ে দূর থেকে বল মেরে সেগুলো মাটিতে ফেলেই ভোঁ দৌড় দিতে হবে, এবং তারপর বিপক্ষের হাত এড়িয়ে আবার ওই চারাগুলো ইটের উপর বসাতে হবে। বিপক্ষের কাজ হবে বলটা নিয়ে চারাভাঙ্গা দলের গায়ে লাগানো, বলাই বাহুল্য, এখানেও গায়ে বল মারার ব্যাপারে কোনরকম দয়ামায়া চলতো না, চারা বসানোর বীরপুরুষ হওয়া তাই খুব একটা সোজা কাজ ছিল না।

একদম শেষে যেটার কথা মনে পড়ছে, নিজে সেটায় বিশেষ সুবিধা করতে পারতাম না, সেটা হলো "মোরগ লড়াই"। এক হাত দিয়ে এক পা ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে অন্যদের গুঁতোধাক্কা দিয়ে বৃত্ত থেকে বাইরে ফেলতে হতো, দামড়া ছেলেপেলেদের আধিপত্য ছিল সেখানে বেশি। তবে জেতার জন্য কি শিশুরা খেলে? আজকে যখন দেখি শিশুরা "মার্ক্স অলরাউন্ডার" বা "চ্যানেল আই ক্ষুদে প্রতিভা" হবার জন্য মরণপণ লড়াইতে নামে, বাদ পড়ে যাওয়ার পড়ে বুড়ো-হাবড়া বিচারকদের মায়াকান্না দেখে ছোট্ট নিষ্পাপ মুখগুলোতে তীব্র বেদনার ছায়া নামে, তখন মনে পড়ে অর্থহীন ওপেনটি বাইস্কোপের ছড়া। ক্লাস ওয়ান-টু তে পড়া বাচ্চাগুলো যখন কোচিং আর প্রাইভেট টিউটরের যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে গম্ভীর বাবু হয়ে যায়, মনের আকাশে খেলতে থাকে সন্ধ্যাবেলার লুকোচুরি। বাক্স অ্যাপার্টমেন্টের গ্রিল ধরে থাকা শিশুটা যখন কম্পিউটার গেমস নিয়ে বসে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তখন মনে হয় খুব বেশি কি পিছিয়ে গেছি আমরা ঐ বয়সে খোলা মাঠে বরফ-পানি খেলে? নাকি আসলে আমরা অতীতচারী, এখনো বেঁচে আছি পায়ের নিচে ঘাসের ছোঁয়া আর ধুলো মেখে বালির ঘর বানানোর মিথ্যে স্বপ্ন নিয়ে? হতেও পারে, তারপরেও সন্তান যেন আমার বুনো মানব হয় আমার চেয়েও অনেক বেশি, যন্ত্রঘেঁষা পণ্ডিত দিয়ে আমি মাটির পৃথিবীকে পাথরের দানবে বদলে দিতে চাই না, আমার সন্তানের সবুজ শৈশবকে ধুসর করে দিতে চাইনা, শিশু যেন আমার বেড়ে ওঠে ধুলো আর মাটিতে, ধুলো মাখা তার ছোট্ট হাতগুলো দেখে আরেকবার যেন বলতে পারি--"ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা।"

ভালো থাকুক আমাদের সন্তানেরা, দুধে-ভাতে না হোক, আলোতে আর বাতাসে।

[লেখাটা মাথায় এসেছিল আমার ভার্সিটির এক জুনিয়র, তানজিনা আফরিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে, অবাক হয়ে দেখেছিলাম আমাদের শৈশবের খেলাধুলাগুলোর কি আশ্চর্য মিল। তাই কৃতজ্ঞতা সহ লেখাটা তাকেই উৎসর্গ করা হলো।]
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×