৪
সানজুর সময়ে চাং পার্বত্য এলাকায় শুয়াই-জান নামের এক ধরনের সাপ দেখা যেত, যার লেজে ধরতে গেলে সে ছোবল মারত, ফনায় ধরতে গেলে লেজ দিয়ে আঘাত করত, আর পেটে ধরতে গেলে ফনা আর লেজ দুটো দিয়েই আক্রমন করত। সানজুর মতে দক্ষ জেনারেলের আর্মি সেই শুয়াই-জান সাপের মতই লড়ে। কারন তার আর্মির যোগাযোগ ব্যাবস্থা এমন যে, এক অংশে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে আরেক অংশ ওয়াকিবহাল থাকে। তাদের সমন্বয় এতো চমৎকার থাকে যে, এক অংশ যখন সামনে থেকে শত্রুকে ব্যস্ত রাখে তখন অন্য অংশ শত্রুর পাশ দিয়ে অথবা পেছন দিয়ে আক্রমন করে বসে।
প্রয়োজনের সময় আপাত শত্রুর সাথেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হয়। খ্রীস্টের জন্মের সাড়ে আটশো বছর আগে কারকারের যুদ্ধে এসিরিয়ান রাজা সালমানেসের বিরুদ্ধে ১২ জন আরব রাজার যৌথবাহিনী লড়েছিল। এরপর নেপলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ান কোয়ালিশন, ১ম আর ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র আর অক্ষশক্তি, এবং গালফ ওয়ারে সাদ্দামের বিরুদ্ধে কোয়ালিশন রনাঙ্গনে যৌথবাহিনীর লড়াইয়ের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। সানজুর মতে দুই চরম প্রতিপক্ষকেও যদি এক নৌকায় করে নদী পার হতে সম্মত করা যায়,আর মাঝ নদীতে গিয়ে যদি তুফান ওঠে, তখন প্রান বাঁচাতে তারা একে অন্যকে এমনভাবে সহায়তা করে, যেন ডান হাত আর বাম হাত একসাথে কাজ করছে। তাই সব যুদ্ধে পালাবার পথ বন্ধ করে দিয়ে সৈন্যদের লড়তে বাধ্য করার চে যৌথবাহিনী গড়ে সহজেই বিজয় অর্জন সম্ভব।
৫
সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত দখল করে ফেলল, তখন যুক্তরাষ্ট্র উতলা হয়ে উঠল সৌদি আরবের নিরাপত্তা নিয়ে। দখলদার ইরাকি আর্মির বিরুদ্ধে ইউ এস আর্মির যুদ্ধটাকে কেউ যেন আবার ক্রুসেড না ভেবে বসে, সেজন্য ইউ এস জেনারেল শোয়ার্জকফের নেতৃত্বে একটা বহুজাতিক বাহিনী গঠন করা হল। শোয়ার্জকফ তার বহুজাতিক এই বাহিনীকে পাঁচ ভাগ করে ইরাক সৌদি সীমান্ত বরাবর মোতায়েন করলেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বহুজাতিক মুসলিম সেনাবাহিনীদের নিয়ে গড়া জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ড নর্থ আর জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ড ইস্ট কে বসালেন কুয়েতের ঠিক বিপরীতে; যেন ডিফেন্সে থাকা ইরাকি বাহিনীকে তারা এনগেজ রাখতে পারে। আর পশ্চিমা সেনাদের নিয়ে গড়া দুই কোর নিয়ে তিনি ইরাকের ভেতর দিয়ে ঢুকে কুয়েতকে ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। এবার বহুজাতিক মুসলিম সেনাবাহিনীদের নিয়ে গড়া জয়েন্ট ফোর্সেস কমান্ড এঁর হাতে কুয়েত বিজয় করিয়ে দেখালেন। সাপও মারলেন, আর লাঠিও ভাংলেন না আরকি।
সানজু বলেন বাহিনীর সবার মনোবল একটা নির্দিস্ট মানে উন্নীত রাখা সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব। এই মান নির্ধারন নিশ্চিত করা যেতে পারে ব্যাক্তিগত দৃস্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে, প্রনোদনা দিয়ে অথবা চাপিয়ে দিয়ে। মনের জোর ছাড়া যুদ্ধজয় অসম্ভব। আর এই মনোবলকে কাজে লাগাতে চাই প্রজ্ঞা। কখনো কখনো যুদ্ধে কিছু লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যা আত্মহত্যার সামিল, কিন্তু পরিস্থিতির খাতিরে এমন সিদ্ধান্তই হয়ে উঠে জয়ের একমাত্র বিকল্প; এই পরিস্থিতিতে সৈন্যদের মনোবলই বলে দেয় কী সিদ্ধান্ত নেয়া বাস্তবসম্মত।
মনে রাখতে হবে যে সৈন্যদের সবাই একিলিসের মত বীর যোদ্ধা না। কিন্তু একজন জেনারেলকে জানতে হয় কিভাবে প্রত্যেকের সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে হয়। কেউ হয়ত সম্মুখযুদ্ধে খুব ভাল যোদ্ধা নন, কিন্তু হতে পারেন ঝানু লজিস্টিশিয়ান অথবা চমৎকার গুপ্তচর কিংবা অব্যর্থ তীরন্দাজ। তার কাজ প্রাকৃতিকভাবে সুবিধাজনক এলাকায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল সেনাদের মোতায়েন করিয়ে, শক্তিশালী সেনাদল নিয়ে ঝুঁকি মোকাবেলা করা। যোগ্য একজন জেনারেল এমন ভাবে তার আর্মি চালায় যে এককভাবে প্রত্যেক সৈন্যের স্কিল লেভেল যাই হোক না কেন সামগ্রিকভাবে তারা সবাই জেনারেলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিবেদিতপ্রান হয়ে লড়ে যায়।
৬
যুদ্ধে রণ পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন, আর শত্রু প্রতিনিয়ত আপনার পরিকল্পনা জানার চেষ্টা করে যায়। অন্যের সাথে রণ পরিকল্পনা আলোচনা করলে তা নানান উপায়ে ফাস হয়ে যেতে পারে। জেনারেল হিসেবে সেনাদলের ভেতর সমন্বয় আর সার্বিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আপনাকে অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন। আপনার নির্দেশনা আর কার্যক্রম নিয়ে আপনার সৈন্যরা নানান আলোচনা করবে, এ থেকে গুজবের ডালপালা গজায়, আর আপনার শত্রু এইসব গুজবে প্রায়ই বিভ্রান্ত হবে। বিভ্রান্ত শত্রু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। তাই সানজুর মতে, জেনারেল হিসেবে আপনাকে হতে হবে শান্ত, ন্যায়পরায়ন আর রহস্যময়। প্রয়োজন ছাড়া তার অফিসার আর সৈন্যরা আগে থেকে তার মুল পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনা। তার পরিকল্পনা আর সেনাদলের বিন্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি তার শত্রুকে বিভ্রান্ত রাখেন, ক্যাম্প পরিবর্তন করে আর উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এগিয়ে গিয়ে তিনি শত্রুর কাছ থেকে নিজ উদ্দেশ্য গোপন রাখেন।
যুদ্ধের মোক্ষম সময়ে তিনি নৌকা পুড়িয়ে অথবা ব্রিজ গুড়িয়ে দিয়ে তার নিজ আর্মির পিছুহটার সব পথ বন্ধ করে দেন, যেন তারা মরিয়া হয়ে লড়ার ইন্ধন পায়। তিনি তার আর্মি নিয়ে শত্রুদেশের গভীরে চলে যান, যেন কেউ শত্রুর হাতে ধরা পড়ার ভয়ে একা পালাবার সাহস না করে। সেনাদল পরিচালনায় একজন জেনারেল তার আর্মিকে সংগঠিত করেন, প্রেষনা দেন, তাদের লক্ষ্য ঠিক করে দেন আর প্রশিক্ষন দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখেন। উপযুক্ত প্রেষনা পেলে সৈন্যরা যুদ্ধে প্রান দিতে দ্বিধা করে না।
৭
যুদ্ধে প্রতিবেশি রাস্ট্রের সাথে মৈত্রী অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। এহেন মৈত্রী একদিকে যেমন আপনার অভিযানের প্রস্তুতিতে সহায়তা করতে পারে, অন্যদিকে আপনাকে এই নিশ্চয়তা দেয় যে যুদ্ধ শুরু হলে আপনার বন্ধু প্রতিবেশি রাস্ট্রটি শত্রুর সাথে হাত মেলাবে না। শক্তিশালী রাস্ট্র যার অন্যান্য আরো অনেক মিত্র রাস্ট্র আছে, এমন রাস্ট্রের সাথে যুদ্ধে জড়ানো বিপদজনক। কারন আপনার চে শক্তিশালী রাস্ট্রের সাথে লাগতে গেলে স্বভাবতই আশেপাশের রাস্ট্রগুলো ঐ শক্তিশালী রাস্ট্রের সাথেই মৈত্রীতে বেশি সচ্ছন্দ্য বোধ করবে, আর মিত্রহীন অবস্থায় শুধু নিজের সামর্থ্য দিয়ে আপনার পক্ষে বিজয়ী হওয়া দুরূহ।
মৈত্রী আর বশ্যতার পার্থক্য বোঝা জরুরী। উপযুক্ত মিত্রতা যুদ্ধের সময় সহায়তার নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু কোন মিত্র ছাড়াই যুদ্ধে জেতার সামর্থ যদি আপনার থাকে, সেক্ষেত্রে সবসময় আপনি আপনার পরিকল্পনা গোপন রাখুন আর যুদ্ধে নামার আগে আপনার শত্রুকে ক্রমাগত মিত্রহীন করার চেস্টা করুন।
৮
আপনার আর্মিতে ভাল কাজের জন্য স্বীকৃতি আর অপরাধের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করুন। মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত পুরস্কারও দিন। উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম বদলে যুগোপযোগী নিয়মের প্রচলন করুন। সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার চেস্টা করুন আর আপনার অধস্তনদের কাছে প্রত্যাশিত থাকার চেস্টা করুন। আপনার সৈন্যরা যেন পরিস্কার ভাবে জানতে পারে তাদের কী করতে হবে, কিন্তু আপনার মুল পরিকল্পনা সময়ের আগেই তাদের কাছে প্রকাশ করে দেবেন না। সবসময় ইতিবাচক সম্ভাবনার বিষয়ে তাদের সাথে আলোচনা করুন, কিন্তু অযথা আশঙ্কার কথা বলে তাদের মনোবল নস্ট করবেন না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেকোন গড়পড়তার আর্মিও আহত বাঘের মত লড়তে পারে। একজন চতুর জেনারেল তার সৈন্যদের এই মানসিকতার পুর্ন সদব্যবহার করতে জানেন।
৯
যেকোন যুদ্ধে সাফল্য নির্ভর করে আপনি আপনার শত্রুর উদ্দেশ্য আর পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে কিভাবে পরিকল্পনা করেন, তার উপর। যুদ্ধে জেনারেলরা কখনো সামনের সারিতে এসে যুদ্ধ করেন না, তাই শত্রুর পার্শ্বদেশ দিয়ে আক্রমন করলে প্রতিপক্ষ জেনারেলদের কুপোকাত করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। যুদ্ধে একেই বলে চাতুর্য। যুদ্ধে নতুন একজন কমান্ডারের নিজেকে চেনাবার প্রয়োজন আছে, সৈন্যরা যেন তার উপস্থিতি টের পায়, তা খুব জরুরী। এঁর একটা উপায় হল আগেকার কিছু অকার্যকর আদেশ বাতিল করে নতুন ফলপ্রসু আদেশ প্রদান।
জেনারেলদের দৈহিক আর নৈতিকভাবে সাহসী আর দৃঢ়চেতা হতে হয়। শত্রু সুযোগ দেয়া মাত্রই তারা বোঝার চেস্টা করেন যে এটা কোন টোপ কিনা। তারপর শত্রু তার সে ভুল শুধরে নেবার আগেই তারা শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। শত্রুর দুর্বলতাকে কব্জা করতে চেস্টা করুন, একে দরকষাকষি আর কালক্ষেপনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করুন। আপনি যদি নিয়ন্ত্রন করতে পারেন যে কবে কোথায় যুদ্ধ করবেন, সেক্ষেত্রে আপনার জেতার সম্ভাবনা বেশি। অকারনে নিয়ম ভাংবেন না, আর জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে যুদ্ধে জড়াবেন না। যুদ্ধের শুরুতে নিজেকে দুর্বল আর যুদ্ধে অনিচ্ছুক হিসেবে উপস্থাপন করুন, অপেক্ষা করুন শত্রুর ভুল চালের জন্য। তারপর সুযোগ আসামাত্র এমন ক্ষিপ্রতায় শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন যেন সে আর ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ না পায়।