অজুর সময় মোজার উপর মাসহ করা ।
মোজার উপর মাসহ করার বৈধতা ‘সুন্নাহ’ দ্বারা প্রমাণিত। এ সংক্রান্ত হাদীছসমূহ প্রসিদ্ধ। এমন কি বলা হয় যে, যে ব্যক্তি মাসহ এর বৈধতা বিশ্বাস করবে না সে বিদআতপন্থী। তবে যে ব্যক্তি মাসহ এর বৈধতা বিশ্বাস করার পর আযীমত-এর উপর আমলের উদ্দেশ্য মাসহ তরক করে, সে সাওয়াবের অধিকারী হবে।
উযূ ওয়াজিবকারী যে কোন হাদাছের জন্য মোজার উপর মাসহ করা জাইয। যদি পূর্ণাঙ্গ তাহারাতের অবস্থায় তা পরিধান করে থাকে এবং পরবর্তীতে হাদাছগ্রস্ত হযে থাকে।
ইমাম কুদূরী (র.) মোজার উপর মাসহকে উযূ ওয়াজিবকারী হাদাছের সাথে বিশিষ্ট করেছেন, কেননা জানাবাতের ক্ষেত্রে মাসহ বৈধ নয়, যা যথাস্থানে ইনশাল্লাহ বর্ণনা করবো।
সেই সাথে (মাসহকে তিনি) পরবর্তী হাদাছ এর সাথে (বিশিষ্ট করেছেন)। কেননা, শরীআতের দৃষ্টিতে মোজা হাদাছ বোধকারী। এখন যদি আমরা পূর্ববতী হাদাছ বলায় মাসহ জাইয বলি, যেমন মুস্তাহাযা নারী মোজা পরলো তারপর সালাতের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। তদ্রুপ তায়াম্মুমকারী ব্যক্তি মোজা পরলো, তারপর দেখতে পেলো তাহলে তো মাসহ (বিদ্যমান হাদাছ) দূরকারী হবে।
যখন পূর্ণাংগ তাহারাত অবস্থায় মোজা পরবে। ইমাম কুদূরীর এ বক্তব্য পরিধানের সময় (তাহারাতের) পূর্ণাংগতার শর্ত উদ্দেশ্য নয়, বরং (পরবর্তী) হাদাছের সময়ের জন্য।
এটা হলো আমাদের মাযহাব। সুতরাং কেউ যদি আগে দু’পা ধুয়ে মোজা পরে নেয় তারপর তাহারাত পূর্ণ করে তারপর হাদাছগ্রস্ত হয় তাহলে সে মাসহ করতে পারে। এ হুকুমের কারণ এই যে, মোজা পায়ের ভিতরে হাদাছের অনুপ্রবেশ রোধ করে। সুতরাং রোধ করার সময় তাহারাতের পূর্ণাংগতা লক্ষণীয় হবে। কেননা, সে সময় যদি তাহারাত অসম্পূর্ণ থাকে, তবে মোজা হাদাছ রোধকারীর পরিবর্তে দূরকারী হবে।
মুকীমের জন্য একদিন একরাত এবং মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিনরাত মাসহ করা জাইয। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ বলেছেন- মুকীম একদিন একরাত্র এবং মুসাফির তিনদিন তিনরাত্র মাসহ করবে।
ইমাম কুদূরী (র.) বলেন- সময়সীমার শুরু হবে হাদাছ এর পর থেকে। কেননা, মোজা হাদাছের অনুপ্রবেশ রোধকারী, সুতরাং রোধ করার সময় থেকে সময় ধর্তব্য হবে।
মাসহ করা হবে উভয় মোজার উপরাংশে আংগুল দ্বারা রেখা টানা রূপে (পায়ের) আংগুলের দিক থেকে শুরু করে পায়ের ‘সাক’ (টখনু থেকে হাটু) এর দিকে নিবে। কেননা মুগীরাহ (রা.) বর্ণিত হাদীছে রয়েছে যে, নবী (সা.) তাঁর উভয় মোজার উপর নিজের দুইহাত রেখে পায়ের আংগুল থেকে উপরের দিকে একবার মাসহ করলেন। আমি এখনো যেন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মোজার উপর আংগুল রেখে মাসহ এর চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।
উপরাংশে মাসহ করা ওয়াজিব। সুতরাং মোজার তলায়, গোড়ালীতে বা গোড়ায় মাসহ করা জাইয হবে না। কেননা মাসহ (এর মাসআলা) কিয়াস বহির্ভূত। সুতরাং শরীআত নির্দেশিত যাবতীয় বিষয়ের অনুসরণ করতে হবে।
আঙ্গুল থেকে মাসহ শুরু করা মুস্তাহাব আসল হুকুম ধৌত করণের অনুসরণে (ক্ষেত্রে)।
মাসহর ফরয হল হাতের আংগুলের তিন আংগুল পরিমাণ। ইমাম কারখী (র.) বলেন, পায়ের আংগুলের পরিমাণ। প্রথম মতটি অধিক বিশুদ্ধ যেহেতু মাসহর উপকরণ বিবেচনা বাণ্চনীয়।
ঐ মোজার মাসহ করা জাইয হবে না, যাতে প্রচুর ছেড়া আছে এবং তা দিয়ে পায়ের তিন আংগুল পরিমাণ জায়গা দেখা যায়। যদি তার চেয়ে কম হয় তাহলে জাইয হবে।
ইমাম যুফার ও ইমাম শাফিঈ (র.) বলেন, সামান্য ছেড়া হলেও মাসহ জাইয হবে না। কেননা প্রকাশিত অংশটি ধোয়া যখন ওয়াজিব হয়ে গেলো তখন অবশিষ্ট অংশও ধোয়া ওয়াজিব হবে।
আমাদের দলীল এই যে, মোজা সাধারণতঃ সামান্য ছেঁড়া থেকে মুক্ত থাকে না। সুতরাং খুলতে গেলে পরিধানকারিগণ কষ্টের সম্মুখীন হয়। বেশী ছেঁড়া থেকে সাধারণত মুক্ত থাকে, সুতরাং এর কারণে কষ্ট হবে না।
আর ‘অধিক’ এর পরিমাণ হলো পায়ের কনিষ্ঠ আংগুলগুলোর তিন আংগুল পরিমাণ। এটিই বিশুদ্ধ মত। কেননা, পায়ের পাতার মধ্যে আংগুলই হলো আসল। আর তিন হলো অধিকাংশ। তাই তিনকে সমগ্রের স্থলবর্তী গণ্য করা হবে। আর সতর্কতা অবলম্বনে অগ্রভাগ ঢুকে যাওয়াটা ধর্তব্য নয়। প্রতিটি মোজায় আলাদাভাবে এই পরিমাণ হিসাব করা হবে। অর্থাত্ একটি মোজার সবকটি ফুটো একত্রে (হিসাব) করা হবে। কিন্তু উভয় মোজার ফুটোগুলো একত্র করা হবে না। কেননা, এক মোজার ফুটো অন্য মোজার দ্বারা সফর করতে বাধা সৃষ্টি করে না। কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে লেগে থাকা নাজাসাত এর বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা, সে তো সমগ্র নাজাসাত-ই বহনকারী। ছতর খুলে যাওয়ার বিষয়টি (বিক্ষিপ্তভাবে লেগে থাকা) নাজাসাতের নজীর হিসাবে গণ্য।
যার উপর গোসল ওয়াজিব হয়েছে, তার জন্য মাসহ করা জাইয নয়। কেননা, সাফওয়ান ইবন আসসাল (র.) বর্ণিত হাদীছে তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সফরের সময় আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, যাতে আমরা জানাবাত ছাড়া পেশাব, পায়খানা ও ঘুম ইত্যাদি হাদাছের ক্ষেত্রে তিনদিন তিনরাত আমাদের মোজা না খুলি।
তাছাড়া জানাবাত সাধারণত বারংবার ঘটে না। সুতরাং মোজা খোলায় তেমন কোন অসুবিধা নেই। পক্ষান্তরে হাদাছের বিষয়টি এর বিপরীত। কেননা তা বারংবার ঘটে।
উযূ ভংগ করে এমন প্রতিটি বিষয় মাসহ ভংগ করে। কেননা মাসহ তো উযূরই অংশ বিশেষ।
মোজা খুলে ফেলাও মাসহকে ভংগ করে। কেননা রোধকারী না থাকার কারণে পায়ের পাতায় হাদাছ অনুপ্রবেশ করবে। তদ্রূপ একটি মোজা খুললেও (হাদাছ ভংগ হবে)। কেননা একই নির্দেশনায় মাসহ ও ধোয়ার হুকুম একত্র করা অসম্ভব। তদ্রূপ সময় উত্তীর্ণ হওয়া (মাসহ ভংগের কারণ)। (এ হুকুম ) পূর্ব বর্ণিত হাদীছ অনুযায়ী।
সময়সীমা যখন পূর্ণ হবে তখন উভয় মোজা খুলে ফেলবে এবং উভয় পা ধুয়ে সালাত আদায় করতে পারবে। উযূর অবশিষ্ট কার্য দোহরানো জরুরী নয়। সময়ের আগে খুলে ফেলারও একই হুকুম। কেননা, খোলার সময় পূর্ববর্তী হাদাছ পায়ের পাতায় অনুপ্রবেশ করে, যেন সে তা ধোয়াইনি। মোজা খুলে যাওয়ার হুকুম সাব্যস্ত হবে পায়ের পাতা মোজার সাক পর্যন্ত (খাড়া অংশে) এসে গেলে। কেননা মাসহের ক্ষেত্রে এ অংশটা ধর্তব্য নয়। পায়ের পাতার অধিকাংশ বের হয়ে গেলেও একই হুকুম। এটাই বিশুদ্ধ মত।
মুকীম অবস্থায় যে ব্যক্তি মাসহ শুরু করেছে, অতঃপর একদিন একরাত্র পূর্ণ হওয়ার আগেই সফরে বের হয়ে যায়, সে তিনদিন তিন রাত্র মাসহ করবে।
এ হুকুম হাদীছের শর্তহীন থাকার কারণে এটাই কার্যকর। তাছাড়া মাসহর হুকুম হল সময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং তার ক্ষেত্রে শেষ সময় বিবেচ্য হবে। মুকীম অবস্থার সময়সীমা পূর্ণ করার পরে সফর করার বিষয় এর বিপরীত। কেননা, (সময় সীমা পার হওয়া মাত্র) হাদাছ পায়ের পাতায় অনুপ্রবেশ করে যায়। আর মোজা হাদাছ দূরকারী নয়।
মুকীমের মুদ্দত (এক দিন এক রাত) পূর্ণ করার পর যদি কোন মুসাফির মুকীম হয় তাহলে মোজা খুলে ফেলবে। কেননা, সফর শেষ হওয়ার পর সফরের সুবিধামূলক হুকুম অব্যাহত থাকবে না।
আর যদি মুকীমের মুদ্দত পূর্ণ না করে থাকে তাহলে তা পূর্ণ করবে। কেননা, এ হল মুকীম অবস্থার মুদ্দত। আর বর্তমানে সে মুকীম। মোজার উপর যে ব্যক্তি ‘জারমুক’ (আবরণী মোজা) পরে সে তার উপরই মাসহ করতে পারবে।
ইমাম শাফিঈ (র.) ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, বিকল্পের আরেক বিকল্প হতে পারে না।
আমাদের দলীল এই যে, নবী (সা.) আবরণী মোজা দু’টির উপর মাসহ করেছেন। তাছাড়া ব্যবহারে ও উদ্দেশ্যে এ হল মোজারই আনুসাঙ্গিক বস্তু। সুতরাং এটা দু’পরত মোজার মতোই গণ্য।
আর মূলতঃ ‘জারমুক’ পায়ের বিকল্প, মোজার নয়। অবশ্য হাদাছগ্রস্ত হওয়ার পর জারমুক পরার হুকুমটি এর বিপরীত। কেননা, হাদাছ মোজায় পৌছে গেছে। সুতরাং অন্য কিছুর দিকে তা স্থানান্তরিত হবে না।
আর যদি জারমুক মোটা কাপড়ের হয়, তাহলে তার উপর মাসহ জাইয হবে না। কেননা তা পায়ের স্থলবর্তী হওয়ার উপযুক্ত নয়। তবে আর্দ্রতা মোজা পর্যন্ত পৌছলে জাইয হবে।
ইমাম আবূ হানীফা (র.) এর মতে ‘জওরব’ (চামড়া ছাড়া অন্য কিছুর তৈরী মোজা) এর উপর মাসহ করা জাইয নয়, তবে যদি উপরে-নীচে বা শুধু নীচে চামড়া যুক্ত হয়, তবে জাইয হবে। ইমাম আবূ ইউসূফ ও মুহাম্মদ (র.) বলেন, যদি ‘জওরব’ এমন পুরো হয় যে, অপর দিকে প্রকাশ না পায়, তাহলে এতে মাসহ জাইয হবে। কেননা বর্ণিত আছে যে, নবী (সা.) তাঁর ‘জওরবের’ উপর মাসহ করেছেন।
তাছাড়া এটা যখন মোটা হয় তখন তা পরে হাঁটা যায়। পুরো হওয়ার পরিমাণ এই যে, কিছু দ্বারা না বাঁধা সত্ত্বেও তা পায়ের গোছার সাথে আটকে থাকে। এমতাবস্থায় তা মোজার সদৃশ।
ইমাম আবূ হানীফা (র.) এর দলীল এই যে, এটি মোজার সম-মানের নয়। কেননা তা পরে অব্যাহতভাবে চলা সম্ভব নয়, যদি না তা চামড়াযুক্ত হয়। অনুরূপ ‘জওরব’ই হলো হাদীছের প্রয়োগ ক্ষেত্র। তাঁর নিকট থেকে আর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি ইমাম আবূ ইউসূফ ও মুহাম্মদ (র.) এর মতের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। আর এর উপরই ফাতওয়া দেয়া হয়।
পাগড়ী, টুপি, বোরকা ও হাত মোজার উপর মাসহ জাইয নয়। কেননা এগুলো খুলে নিতে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। আর অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যেই অবকাশ দেওয়া হয়েছে।
জখমের পট্টির উপর মাসহ করা জাইয। যদিও তা উযূ ছাড়া অবস্থায় বাধা হয়ে থাকে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) এরূপ করেছেন এবং আলী (রা.) কেও তা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাছাড়া এ ক্ষেত্রে অসুবিধা মোজা খোলার অসুবিধার চেয়ে বেশী। সুতরাং এ ক্ষেত্রে মাসহ এর বৈধতা অধিক যুক্তিযুক্ত।
আর পট্টির অধিকাংশ স্থান মাসহ করাই যথেষ্ট। ইমাম হাসান (ইবন যিয়াদ) তা উল্লেখ করেছেন। এটা সময়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কেননা এর নির্দিষ্ট সময় শরীআতের মাধ্যমে অবহিত করা হয়নি। যদি জখমের পট্টি নিরাময় ছাড়াই খুলে পড়ে যায়, তাহলে মাসহ বাতিল হবে না। কেননা, ওযর অব্যাহত আছে, আর যতক্ষণ ওযর অব্যাহত আছে, ততক্ষণ তার উপর মাসহ করা তার নীচের অংশ ধোয়ারই সমতুল্য।
আর যদি নিরাময় হওয়ার পর পট্টি পড়ে যায়, তাহলে মাসহ বাতিল হয়ে যাবে।কেননা ওযর দূর হয়ে গেছে। যদিও তখন সে সালাত থেকে থাকে, তাহলে সে সালাত নতুনভাবে আদায় করবে। কেননা বিকল্প দ্বারা অর্জনের পূর্বেই সে আসল কর্মের ক্ষমতা লাভ করেছে।
গ্রন্হ সহায়তাঃ-
আল-হিদায়া
প্রথম খণ্ড
শায়খুল ইসলাম বুরহান উদ্দীন আবুল হাসান আলী
ইবন আবূ বকর আল-ফারগানী আল-মারগীনানী(র)
মাওলানা আবূ তাহের মেছবাহ্
অনূদিত