somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে

১৩ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ভোরের দৈনিকের সাহিত্যের পাতায় ছন্দের কবিতা পড়ছি। "অনুরাগের লাল প্রসূন"। জনাবা শামসিরা বেগম, আপনি এখনো লিখছেন ভাবিনি। পয়ার ছন্দে। বিষয় বস্তু একই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইরানী লাল গোলাপ আর তাজমহলের উপমা । যৌবন বিদায় নিয়েছে কবে। শীতে ঝরে যাওয়া ফলসার পাতার মত বছর ফুরিয়ে যাচ্ছেন আপনি। চলৎঅক্ষম শরীর ঘুণে কাটছে তো কাটছেই। রক্তনালী চর্বির পলিতে স্তব্ধ হতে চায়। অচল হৃদপিণ্ড, তারপরও শয্যাশায়ী হৃদয় টলমলে শাপলা পুকুর। এই নি:সরিত সময়ে, উৎসবের সমাপ্তিতে সে কোন আবেগ যা আপনার মনে কনফেটি ছড়ায়?

*
সিমন্তী, তোমার মায়ের কথা বলছিলাম। তুমি তোমার মায়ের অর্ধেকও হতে পার নি। গান গাইতে। সুর ছিল কণ্ঠে কিন্তু ক্ষুধার্ত থাক নি। আজ রাতে কোথায় আছ জানি না। আমি ভাল নেই। দাবার হাতির মত ধূসর রঙে আটকে আছি।

সেই ঘরটাতেই থাকি এখনো। যেখানে উঠেছিলাম আমরা। হন্ত দন্ত হয়ে । কাজীর অফিস থেকে সরাসরি। বিয়ের জন্য সব পুরুষের একটা ভয় থাকে । আশঙ্কা থাকে। উত্তেজনা ছিল তার চেয়ে বেশী। ঘরে ঢুকে আমি দেয়ালে ঠেসে তোমাকে আঁকড়ে ধরলাম - আই লাভ ইউ, সিমি। আজ থেকে সারাক্ষণ আমার তুমি। এখানে শুধু দুজন।
নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জানালায় প্রতিবেশীর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তুমি সতর্ক হলে, রবিন! আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।

দেয়ালে পলেস্তার ওঠানো। বাড়ি ওয়ালা চুনকাম করে নি। ছাদে মাকড়সার মিহিন জাল পিস মিশনে শান্তির পতাকার মত উড়ছিল । আলোর স্বল্পতা। সুইচ নামাতেই বাতি জ্বলল।

প্রথম রাতটা নিরাভরণ কেটেছে সেই ছোট বাসায়।

ঘর ঠিক করে বিকেলেই বেরিয়ে পড়েছি। কম খরচে অনেকগুলো রজনীগন্ধা পেয়ে গেলাম। ভুট্টা রজনীগন্ধা। ফুলের গন্ধে বাড়ি নেচে উঠল। এভাবেই আমাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছিল।

***
এর পর নিউমার্কেট থেকে সিলভারের পাতিল, তাওয়া, খুন্তি কেনা হল। সারাদিনের খেটে খুটে বিকেলে ছোট আয়নায় তুমি নিজেকে দেখছিলে। তোমার বাসায় সবাই খুঁজে হন্যে। তোমার রক্তচক্ষু বাবা পুলিশে ফোন করে যাচ্ছে। যদিও তুমি বিয়ের বয়েসী, সার্টিফিকেটের প্রমাণে তিনি তোমাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বানাচ্ছেন। অথচ এত শক্ত তোমার শেকড়, তুমি নড়ো নি। ভিম দিয়ে স্নানঘর ধুয়ে নিচ্ছ। ঝাঁট দিচ্ছ। কাপড় ভাঁজ করে রাখছ। এক ব্যান্ড রেডিও ছিল ঢাকা শহরে মেসের জীবনে। তুমি কাপড় দিয়ে মুছে ওকেই নিজের সংসার ভাবছিলে। এর মধ্যে কত বার ঘুরে ফিরে দুজন দুজনকে বুকে টেনে নেই। ওয়ালটজ নাচের ভঙ্গীতে ঘুরে ঘুরে চুমো খাই। যেন একটা খেলা। তারপর ভোর হয়, ফের অফিস যেতে হয়। তুমি দরজায় দাঁড়াও। জ্যাকেটের পকেট থেকে খুচরো পয়সা ঝন ঝন শব্দ করে খসে পড়েছিল পায়ের কাছে। তুলি নি। আধুলি কুড়োতে গিয়ে আমরা একটুও বিচ্ছিন্ন হতে চাই নি।

হোটেলের আইড়মাছের চ্যাপ্টার ক্লোজ করে, বাড়িতে রান্না শুরু হল। সাদা ভাত, ডিম কষানো । বিকেলে প্যাকেটের গায়ে লেখা নিয়মে নুডলস। আমি ভাবতাম এত ভাল ডিমের তরকারী কেউ খায় নি, সবাইকে নেমন্তন্ন করে জানিয়ে দেই। অবশ্য আমি যেমন অগোছালো, আমার বউও তাই। বই ছড়িয়ে থাকতো ফ্লোরে, মোজা, একটা বলপেন, চুলের কাঁটা, রুমাল, পার্স। আমি অফিসের কাগজ নিয়ে আসতাম বাড়িতে। ফ্লোরে শুয়ে সেরে নিতাম।

শুয়ে লেখা লেখি আমার বদ স্বভাব। তবে কবিত্ব তখন ছুটিতে। ফ্লোরের পাতলা তোষকে শুতেই ঘুম আসত। তুমি বলতে এ আমাদের সমুদ্র সৈকত। পিছন থেকে তোমাকে আঁকড়ে ধরতাম। লাল কাঁকড়ার মত সজোরে। বলতাম, সিমি, চুলের বেণীর ডান গোছাটা বামপন্থী। বাম গোছা ডানপন্থী। আমি ডান পন্থী হবো না। বামপন্থীও নই। কাল রহস্যের বিন্যাসে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।

**
অফিস থেকে কিছু টাকা টাকা ধার পেয়েছিলাম। টুকটাক আসবাব কিনলাম। পাপোষ ছিল না দরজার সামনে। কিনে আনলাম। একটা নেমপ্লেট লাগালাম। দেখতে দেখতে দশ মাস কেটে গেল।

আমি সুখী ছিলাম । কিন্তু একটা সত্য মনে পড়লে কষ্ট পেতাম। খস খস করত বুক। আমি আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় প্রেম। সে বলে নি। বন্ধুদের মহলে কিছুই অজ্ঞাত থাকে না। আর সেটা জেনে যাবার পর হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। যেন প্রথম প্রেম নিয়ে আমার কৌতুহল নিছক উন্মাদনা।

লোকমুখে শুনেছি প্রথম প্রেম আমরণ বেঁচে থাকে। পায়রার মত ঘুরে ঘুরে আসে। মোবাইল ফোন কেনার পর তার ব্যস্ততা বাড়ল। সে ফোনবুকে পুরো নাম লিখতো না। কতগুলো সাংকেতিক নাম লিখতো। কি এমন গোপনীয়তা থাকে যা সঙ্কেতে থাকতে হবে? আর স্বামীর কাছে স্ত্রীর প্রাইভেসী দরকার কি? কথাটা পারলে বোকামী হত। সিমি ভাবতো আমি সিক। সন্দেহপ্রবণ। তারপর একদিন রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে তাকে বিছানায় পেলাম না।

সিমি ছোট বারান্দায় বসে কাঁদছিল। আমি বুঝতে পারি পার্থর জন্য কাঁদছে। কৌতুহল দমন করে বলেছিলাম, কি হয়েছে জান? তুমি এত রাতে বারান্দায় ? কোন ব্যাড ড্রীম?

পিঠে হাত পেয়ে সে চমকে উঠল। বলল, না কিছু না, ঘুম আসছে না।
আপসেট ফর সাম রিজন? বোরড? মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যাও।
আচ্ছা করব।

আমি টের পাই হাতের মুঠোয় একটা ফোন, তখনও সবুজ বাতি জ্বলছে । ফোনের ব্যবহারটা বেড়ে গেছে খুব।
***
এক শনিবার বাসায় ঢোকার সময় পাপোষের উপর নতুন কিছু চোখে পড়ে যায়। একটা সিগারেটের পোড়া ভগ্নাংশ । সম্ভবত: বিদেশী ব্র্যাণ্ড। বলা বাহুল্য আমি অধূমপায়ী। ঢুকতেই স্মোকের গন্ধ আসোর কারণ নেই। গন্ধটা বাড়তে থাকে। বেডরুমেও গন্ধটা ঢুকে গেছে।

সিমি কি এলাচি চিবোচ্ছিল? খেতে বসে কি অতিরিক্ত যত্ন পেলাম? জোর করে মাছের টুকরো পাতে তুলে দিচ্ছিল । তখনি খেয়াল হল ফর্সা হাতে একটা পোকার কামড়ের দাগ। আমি অনুমান করি কেউ বাড়িতে এসেছিল। আর সেই আসামী অসতর্ক দংশনে চিহ্ন রেখে গেছে ।

আমি নিজেও কেমন হয়ে যাচ্ছিলাম। অফিসে আসি । যাই। ভাবনাগুলো প্যাচ খায়। সিমি রূপবতীই মেয়ে। গুণও অনেক। আমার সাধ্য নেই তাকে ধরে রাখার। সে কি হতাশ? ছোট ফ্ল্যাটে একটু জোরে গান করলে কমপ্লেইন আসে । চাকুরী করতে চায় । ডিগ্রী পাসে ভাল কিছু পাবে না। বাবার নাম করে গেলে চাকুরী হয়ত পেত। কিন্তু সে জেদ ধরে পত্রিকার কাটিং জমায়। তারই মধ্যে খরচ মেটাতে হাঁপিয়ে উঠছিলাম আমরা দু'জন।

সে যখন বাজারের খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন হত, মনে হল সচ্ছলতা আর প্রেম মুখো মুখি তর্ক করছে। এই দ্বন্দ্বে শান্তি দিতেই সে পুরনো অধ্যায়ে ঢুকে গেছে।

***
ও তখন স্নান ঘরে। মগ দিয়ে পানি ঢালা শুনতে পাচ্ছি। খুব সন্তর্পণে তার পার্সের জিপার খুলে ডায়েরীটা উল্টাই। চমকে উঠে দেখি দুটো নতুন নম্বর লেখা তাতে। একটা হল "পারস" ০১৯১২৯১১১১, নিচে মন্তব্য - এয়ারপোর্টে সোমবার । "পার" নামটা পার্থর সংক্ষিপ্ত! যার তার সঙ্গে সে গান শিখতে যেত। "স" মানে সয়েল সাইন্স।

আমি নিশ্চিত হই সিমি মানসিক ভাবে অসুস্থ। নইলে কি করে দু'জনের সুসম্পর্ক সত্তেও পার্থের মত থার্ড ক্লাস যুবককে ডেকে আনে দেয়।। ভাবলাম তাকে ডাক্তার দেখালে ঠিক হবে।

পরের সোমবার পার্থকে হাতে নাতে ধরতে লাঞ্চ-টাইমে বের হয়ে এলাম। বিকট জামে পথে দু ঘন্টা দেরী হল। উদ্দেশ্য সফল হল না।
সিঁড়িতে একই সিগারেটের গন্ধ পেয়েছি। শুনেছি পার্থ কাস্টমসে চাকুরী নিয়েছিল।
দরজায় কান পেতে শুনি। পুরুষের কণ্ঠ..দুজনের সপ্রতিভ মুহূর্ত ...
কথা বুঝতে চেষ্টা করি। সিমি বলছিল
আই টোল্ড ইউ। এটা এক্সিডেন্ট। নেভার লাভড হিম। ইমোশনাল হয়ে বিয়ে করেছি।
কেন করলি? এখন বাসিস না?
না পার্থ। ও বাসে। আমি অভিনয় করে যাচ্ছি। রবিন গুড বয় বাট ইউ নো আমি তো তোমাকে চাই, সোনপাখি। আমি এস্কেপ চাই।

আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। ভদ্রতা ভুলে গালি দিলাম বেজন্মা, কুত্তার বাচ্চা । দরজায় আঘাত করে বললাম,
দরজা খোল গাদ্দার মাগী। রান্না ঘরের চাপাতি দিয়ে আমি ওকে টুকরা করে ফেলব।

দরজা খুলতে দেরী হয়
আমি সজোরে লাথি দেই। সিমি!
কেউ নেই।
সিমি! ১০ মিনিট পর সিমি ভেতর থেকে বলল,
এই কি হল। দর্জা তো ভেঙ্গে ফেলবা।
এত দেরী কেন? ভিতরে কে?
কে থাকবে? আমি বাথরুমে ছিলাম।
লাইয়ার, ভিতরে কে আছে তা জান না? আমি কি দুধের পোলা?
রবিন, ইউ আর সিক, রাস্তার ছেলেদের মত বিহেভ করতেছ
নো, টেল মি ভিতরে কে?
কে থাকবে? তুমিই বলো, মেয়েটা হেসে ফেলে সহজ করতে চায়।
আমি ওর গলা টিপে ধরতে চাই। প্রস্টিটিউটের সঙ্গে সংসারের চেয়ে তাকে মেরে ফেলা ভাল। কিন্তু আমি বাস্তবে ফিরে আসি। বলি,
না কিছু না। অফিসে গণ্ডগোল হয়েছে। একটু মাথা গরম। আই এম সরি। বেসিনে মুখে পানি নিয়ে কুলি করি। গল গল করে বমি করি।

ফিরে দেখি তখনও মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে মন ভার করে বসে আছে। অপরাধীরাও অনুতপ্তের ভান করে। জান, কুল ডাউন। আমি জানি অফিসের ঝামেলা না, টেল মি কি প্রবলেম? আমি জোর করে হেসে বললাম,
না, টুডে আই এম রিয়েললি টায়ার্ড।
**
এর পর থেকে সিমিকে আমি খেয়ালে খেয়ালে রাখি।
খেয়াল করেছি সে ঘুমে কথা বলত কারো নাম ধরে। স্যরি বলত । তার সেল ফোনে কলের লিস্ট দেখতে থাকি। কিন্তু দিনে কেউ যেন কল করেনি। তবে কি সে সব কল লগ মুছে দেয়? কেন?

*
ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধু এই সমস্যাটা জানতো। সাইকিয়াট্রিস্ট ড. ফারুকের সঙ্গে দেখা করি তাদের পরামর্শে। বলি,
-ডা. আমার ওয়াইফ মনে হয় সিক। সে রাতে প্রলাপ বকে। তার অ্যাফেয়ার ছিল । সেটা সে এখনো ধরে রাখে। আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে মানে নি। এসব কারণেও হতে পারে সে আমাকে আর ভালবাসছে না। আমার অজ্ঞাত সারে সে এক্স এর সঙ্গে রিলেশন রেখে যাচ্ছে।
ড. ফারুক মনযোগ দিয়ে শুনে বললেন
-কত দিন ম্যারেজ?
-এক বছর হবে সামনে
-দেখেন আপনি এডাল্ট মানুষ। ছেলেদের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। স্ত্রীদের একটু ঘনিষ্ঠ সময় দিন। হয়তো আপনার ধারণা ভুল। আচ্ছা, আপনি তাকে কতটা ভালবাসেন? যদি ১ থেকে ১০ এর মধ্যে স্কেল করি?
-সার্টেইনলি ১০ এ ১০।
-সে আপনাকে ভালবাসে কতটুকু? ১ থেকে ১০ এ
-শিউর না, সম্ভবত ৪/৫
-আপনি যে তাকে সন্দেহ করেন সে বোঝে
-না
-আপনার আগে প্রেম করেছেন?
-জি, আমি স্কুল জীবনে সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম এক মেয়ের জন্য।
-তারপর?
-আমি করি নি। আসলে ওসব ভুলে গেছি। এখন সিমন্তীর জন্য ভালবাসা কারো সঙ্গে ভাগ করব না। কোন দিনও না।

**
ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে পাশের রুম থেকে একটা ফাইল এনে দিলেন।
-কেসটা আমি নিজে এনালাইসিস করব। এখানে একটা স্প্রেডশিট দিচ্ছি। ১ সপ্তাহ খেয়াল করবেন। যা দেখছেন, ভাবছেন। সব তথ্য রেকর্ড করবেন। এই নিন খাতা।
----------------------------------
ঘটনা: _
তারিখ:__ সময়: _
সন্দেহজনক ব্যক্তি __
----------------------------------
তার পর আমাকে বললেন আপনি এমন ভাবে এটা টেক কেয়ার করবেন যাতে আমার সিমি না জানতে পারে। আপনার স্ত্রীকে কৌশলে এখানে আনতে হবে, ড. ফারুক হাসলেন, ডু য়ু থিঙ্ক ইউ কেন ব্রিঙ হার হেয়ার?
তারপর হঠাৎ বললেন, যদি কিছু না মনে করেন, আপনার স্ত্রীর ফোন নম্বরটা দিতে পারবেন?

আমি ডা. ফারুককে অনুনয় করে বললাম, আমি সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চাই। আই লাভ হার। প্লিজ একটু দেখুন। যদি দরকার হয় ওকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাব ধার করে হলেও।

*
আমি পরের সোমবার অফিসে সিক কল করি। বাইরে ঘুরি সকাল ১১.৩০ পর্যন্ত। দূর থেকে দেখেছিলাম কে কে ঢোকে বাড়িতে। ১২ টায় বাড়ি এলাম। সিমি আমাকে দেখে অদ্ভুত আচরণ করল,
-আরে, তুমি এত জলদি? অফিস শেষ?
-না, মেইনরোডে মারামারি হয়েছে। যেতে পারিনি। পেট খালি। ঘরে কিছু থাকলে দাও খাই। খেয়ে চলে যাই।
-ভাত বসাতে হবে। তুমি কি নিচ থেকে একটু সওদা এনে দিতে পারবা? এক হালি ডিম আর গোল আলু।
আমি যাব যাব করে আর গেলাম না। আমি জানি এটা ধূর্ত লক্ষণ। উঠে যাওয়া মাত্র ফোনে ঐ ছেলেকে না করে দেবে।

ঠিক ২.০০ টায় কলিং বেলের পাখিটা বেজে উঠল।

আমি উঠে দরজায় যাই। একটা ফর্সা মায়াবী চেহারার তরুণ শান্তিপুরী ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। ও পার্থ নয়! তবে কে? ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
স্লামালেকুম, এটা কি পূষন/কিরণ দের বাসা? কৌশলে ভুল ঠিকানার ভান করছিল সে।
না, কত নম্বর চান?
৩৫/১
না, ওটা উল্টোদিকের বাসা।
তরুণটি দ্রুত নেমে যায়।
খুব পরিচিত মুখ কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। ও কে তাহলে। নামটা জিজ্ঞেস করলে হত। সে সত্যি নাম নাও বলতে পারত। কিন্তু সে চলে গেছে।
আমি না থাকলে তরুণটি ঘরে ঢুকত। সিমির সঙ্গে গল্প করতো। বেডরুমে যেত। ঘুরতে ঘুরতে পাহাড় পর্বত নদী সব মিশে গেল কল্পনায়। একটা গুহায় আটক জন্তুর মত লাগছিল। চারদিকে কর্কশ বাদুর উড়ে বেড়াতে থাকল।
**
সিমি!সিমি..আই হেট ইউ সিমি। ইউ আর মিন। আমার সঙ্গে একটিং। স্লাট, হারামি! ইংরেজিতে গালি দিতে দিতে আমি বসে পড়ি মেঝেতে।
সিমি শুনে ফেলল। রান্না ঘর থেকে বের হয়ে কি হয়েছে প্রশ্ন করতেই তার গালে সজোরে চড় কষে দিলাম।
সে আর্তনাদে লুটিয়ে পড়ল। কাঁদতে থাকল।
আমি নিজেও তাকিয়ে থাকলাম। একী হল! রাগে অন্ধ হয়ে প্রিয় স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছি। আমি নপুংসক। আমি নরাধম।

সিমি, আমি স্যরি। প্লিজ।

দরজা দিয়ে বাতাসের মত সে নেমে গেল। সে আর ফিরে এল না।

আমার একলা থাকা চূড়ান্ত হল।
আমি অনেক খুঁজেও তাকে পেলাম না।
*
জীবন থেমে থাকে নি। আমি ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলাম। ঝর ঝর করে কাঁদলমা, আমার স্ত্রীকে এনে দিন। ও কেন আমাকে ছেড়ে অন্যত্র যাবে?

সিমি কোথায় গেছে জানি নি । অনেক বার ফোনে কথা বলতে চাইলাম। রিং হল। বেজে চলল কেউ ধরে নি। হয়তো সে ফোনটা ফেলে দিয়েছে।

আমি অনুতপ্ত হই। আবার মনে হয় এরকম নষ্ট মেয়ের সঙ্গে সংসার না করাই শ্রেয়। ভালবাসা না থাকলেই ভাল হত। মনস্থির করি রেল লাইনে হাটতে চলন্ত ট্রেনে হারিয়ে যাব।


***
আমি একলা বেঁচে আছি, সিমি। খুব একলা। এখন সহ্য করে গেছি একলা থাকা।
গতকাল পেঁয়াজ কাটার যন্ত্র কিনেছি নিউমার্কেট থাকে। ঝিনুকের মত হা করে খুলে থাকে সেটা। উপরের পাটিতে সারি সারি চিকন ছুরি। স্পেনিশ গিটারের মত সারিবদ্ধ ধারালো তার। কিন্তু কাটিং গেজেট গান গাইতে জানে না।
যন্ত্রটা পেঁয়াজের শরীর এমন ভাবে স্লাইস করে নিচ্ছিল বাইরে থেকে তাকে মনে হয় সব ঠিক আছে।
অথচ ভিতরে টুকরো টুকরো। বজ্রাঘাতে মৃত মানুষ যেমন খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে তেমন করে দাঁড়িয়ে ছিল পেঁয়াজটা। আমার নিজেকে মনে হল সেই সবজীর টুকরোর মত অসহায়।
***
সিমি, তোমাকে ছাড়া আমার পারি না। তুমি অন্য কাউকে নিয়ে থাকবে ভাবতে পারি না। তুমি যদি একবার ফিরে আস আমি ভুলেও তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না।

ঘরে অনেক জায়গায় সিমির উপস্থিতি টের পাই। অনেকগুলো রূপালি চামচ কিনেছিলাম। মেহমান আসুক না আসুক স্ফটিকের কয়েকটা পেয়ালা ।অতিথিরা যাতে জানে সংসারে দুধের সরের মত সুখ । কর্ণফ্লেক্সের মত আনন্দ ভেসে থাকে দুধের উপর। টেবিলে এক ডজন ছুরি রাখা ছিল। আমি কি সেই ছুরি। রক্তিম টমেটোকে সে নিমেষেই কেটে ফেলে। মেয়েরা দু:খ পেলে নাকি ভোলে না। ফোন করি প্রতিদিন। ওর ফোন কেউ ধরে না।

সিমির চলে যাওয়ার পিছনে কারণ খুঁজে পাই নি। আমি কি ব্যর্থ পুরুষ? আমি রাতের যোগ্য পুরুষ ছিলাম না? চাহিদা না পেলে মেয়েরা মুখে বলে না। সে অসুখী ছিল। যখন জল চাইতো আমি নিজের তৃষ্ণা মেটানোর পর কল বন্ধ করে চলে গেছি। বিছানার পিছনে একটা জামগাছের ছবি বাঁধাই করে এনেছিলাম। আমি ভাবছিলাম ঝড় উঠেছে। আমরা দুজন ছোটা ছুটি খেলছি । বৃষ্টি ঝরছে আর তাকে গাছের কাণ্ডে আটকে ফেলেছি। সে প্রথম দিনের মত বলছে, রবিন, না, আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।

সিমন্তীর একটা ছবি আমার মানি ব্যাগে।

তার দিকে তাকিয়ে বলি, সিমন্তী, ভুল শুদ্ধ সব মিলিয়েই আমি। তুমি এক মুহূ্র্তের ভুলটাকে মনে রাখ। কত বিকেল জেলের মত খলশে মাছ তুলে এনেছি খালুইতে। সন্ধ্যায় সমুদ্রের পারে ঝিনুক কুড়াতে গিয়ে সজোর আঁকড়ে ধরেছি তোমাকে। সিরাজিতে সম্পূর্ণ করে দিয়েছি ঠোঁট। এসব রেখে এক মূহুর্তের আঘাত তোমাকে চিনিয়ে দিল।

---
[আপডেট]
সিমি তিন মাস পর ডা. ফারুকের কাছ থেকে ফোন পায়।
-মিসেস সিমন্তী, আমার চেম্বার থেকে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। আপনাকে আরজেন্ট দরকার। আমার চেম্বারে দেখা করেন।

মাইন্ড হিলার সাইকো ক্লিনিক।
৩২ এলিফেন্ট রোডে দোতলায়।

সিমন্তী সময় মত সেখানে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল রবিন যে ব্যবহার করেছিল তা তার জানা । আর জানতে চেয়েছিল কবে থেকে এই সন্দেহ তৈরী হয় । সিমি বলেছিল,
-চার মাস আগে। আমার এক বন্ধু বিকেলে বাড়ি এসেছিল। সে অফিস থেকে এসে দেখে ক্রুদ্ধ হল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল এর সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমি ভাবতে পারি নি ও এত মিন।
-তারপর? সে আপনাকে ফলো করতো?
-হ্যা। এমন কি ফোন করলেও আড় পেতে শুনতো। এরকম অবস্থা হয় যে আমার বান্ধবীর কাছে সাহায্য চাই। সে বলেছিল এরকম হয়। সেরেও যায়।
-তাকে কিছু বলেন নি
-না
-আর?
-আমার ইনসমনিয়া ছিল। জেগে বসে থাকতাম। উল্টোদিকের বাড়িতে এক ছাত্র রাত জেগে পড়তো। জানলায় দেখা যেত তাকে। ও আমাকে ঐ বাচ্চা ছেলেটার বিষয়েও আমাকে জিজ্ঞেস করেছে।

ডা. ফারুক চশমা টেনে কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিল। আপানার হাসব্যাণ্ড আপনাকে মানসিক অসুস্থ বলে দাবী করলেও কেস স্টাডি বলছে তিনি নিজেই অসুস্থ। এই দেখুন বিহেভিয়ার চার্ট । উনি সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। দীর্ঘদিন একলা থেকেছেন। মর্বিড জেলাসি এণ্ড ইনসিকিউরড ফিলিংস থেকে সার্টেইন কেসে রোগীর নিউরোকগনিটিভ সিস্টেম এফেক্ট হতে পারে।
সিমন্তী বিষাদ নিয়ে বলেছিল,
-তাহলে
এটা পার্সোনালিটির একটা কমন সমস্যা। এক পর্যায়ে রোগী হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হতে পারে, কল্পনায় গন্ধ অনুভব করে, শব্দ শোনে, এমন কি অবাস্তবকে দেখতে পায় । উনি প্রেমে আহত হয়েছিলেন। আর আপনাকেও সে মনে করছে তাকে ছেড়ে চলে যাবেন।

ডাক্তার আশ্বস্ত করে বলেছিল যে রবিনের অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার মত। তবে ঘনিষ্ট মানুষের সঙ্গ প্রয়োজন। তাই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। অষুধগুলো সিমন্তীকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, মোবাইল ফোনটা স্টিমুল্যান্ট হিসেবে কাজ করছে। তাই ফোনটা আপাতত লুকিয়ে রাখবেন।

---
[আপডেট]

সিমন্তী এক মাস পর এক বিকেলে তুমি ফিরে এসেছ। ডাক্তার সাহেব অবশ্য আমাকে জানিয়েছিলেন সেটা। তার ঋণ শোধ হবে না। তুমি পাল্টে গেছে। আর আরেকটা সুখের বিষয় তোমার বাবা আমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছে।

ডা. ফারুক ভাল মানুষ। আমার ধারণা আমি সিজোফ্রেনিয়ার আক্রান্ত নই। তিনি অপেশাদারের মত একটা মিথ্যে বলেছিলেন তোমাকে। তা না বললে তুমি ফিরেই আসতো না । তবে তোমার পরিবারকে কিছু জানিয়েছিলেন ডাক্তার সাহেব। কি সেটা একটা রহস্য।

[সর্বশেষ আপডেট]
সময় কেটে গেছে। বছর দুই আগে আমাদের একটা মেয়ে হয়েছে। টুলটুলি নাম। ও দেখতে মায়ের মতই কিন্তু বাবার ভক্ত খুব। গত কাল রাতে ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। দু বছরের পুতুল আমার দুই বাহুর ভিতর ঘুমিয়েছে। তুলতুলে পা আমার শরীরের উপর তুলে সে ঘুমায়।

ওর মাও অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। ঘুমাক। ভালবাসাটা এতদিন পর দু'খণ্ড হয়ে গেছে। আর সিমন্তী সত্যি সত্যি বঞ্চিত হতে শুরু হয়েছে।
=
ড্রাফট ১.০/ অনুশীলন গল্প
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:২৬
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×