ডাক্তারদেরকে আমি রোগের চেয়েও বেশি ভয় পাই। তাই হয়ত আমার সাধারনত অসুখ হয় না। তাদের সাথে সবসময় আমার দা-কুমড়া সম্পর্ক। যেখানে আমি বরাবরাই কুমড়া। ডাক্তার যখনই বলে “ভয় পাবা না! মনে বল রাখ”। তখন ভয় বেড়ে যায় আরো বেশি।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আমি ডাক্তারদের ভয় পাই। এখনো ভয়ে থাকি।
এর শুরু সেই বাচ্চাকালে। তখনও ডাক্তারদের চিনতে শিখি নি। মা নিয়ে যেতো টীকা দিতে। দেখতাম কিছু মানুষ ব্যাগ থেকে একটা কিছু বের করে শরীরের নরম জায়গাগুলোতে পুশ করে দিচ্ছে। আমার বয়সী সব বাচ্চাদেরও একই হাল। নরম জায়গা পেলেই পুশ। তখন তো দল বেঁধে কান্নার বয়স, একজনের কান্না দেখলে বাকিরাও শুরু করতাম। কিন্তু আমাদের সমবেত কান্নাও ডাক্তারদের দিল ভিজাতে পারতো না। বরং একজনে না পারলে কয়েকজনে মিলে ধরে পুশ করতো।
তার কিছুদিন পর শুরু হলো দাতেঁর ডাক্তারের অত্যাচার। আমার বন্ধুদের দেখতাম আপনাআপনি দাঁত নড়ে পড়ে যাচ্ছে। আমার তো পড়ে না। ওদিকে পুরনো দাঁতের নিচ দিয়ে নতুন দাঁত উঁকি দিচ্ছে। আব্বু ধরে নিয়ে গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বেটাও মহৌৎসাহে সাঁড়াশি অভিযান চালাতো আমার দাঁতের উপর। চপস্টিক দিয়ে ভাত খাওয়ার মতো করে দাঁত তুলে আনতো। বছরে কয়েকবার করে চলত এই অত্যাচার। ওহ...সেই কথা মনে পড়লে এখনো গা ঘিনঘিন করে!!
একটা জোকস মনে পড়ল...
দাঁতের ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে কথা হচ্ছে—
ডাক্তার: ভয় পাবেন না। এই ওষুধটা খেয়ে নিন, দেখবেন দাঁত তুলতে একদম ব্যথা পাবেন না, সাহসও বাড়বে।
রোগী: (কাচুমাচু হয়ে) জ্বী আচ্ছা।
ডাক্তার: এবার নিশ্চয়ই সাহস বেড়েছে?
রোগী: বেড়েছে মানে! এবার দেখি কোন হালায় আমার দাঁত তুলতে আসে।
ইশ, কেউ যদি এরকম ওষুধ দিতো।
আরেকটা যন্ত্রণার ব্যাপার ছিল দাঁত তোলার পর খাওয়া দাওয়া। দাঁত তোলার পর কয়দিন সব শক্ত খাবার বন্ধ, শুধু দুধে ভেজানো পাউরুটি।
এরপর খৎনা...না থাক, এইটা বলা যাবে না। খেখ খেখ!!
তবে আমার আরেক কাজিনের ঘটনা বলি। ওই বয়সে প্যান্টের জিপারে অনেকেরই আটকে যেত। আমার ওই কাজিনের আবার এটা হত রুটিন করে। একবার তো পুরাই ধুন্দুমার অবস্থা, তার চিৎকারে পুরো এলাকা কাঁপে, কিন্তু জিপার নড়ে না। কয়েকজনে জিপার উপরে নিচে টানাটানির বৃথা চেষ্টা করলো। চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া মানুষ দাপাদাপি করলে যেমন আরো বেশি ডুবে যায়, তার চামড়া তেমনি আট্কালো। ডাকা হলো ডাক্তার। ডাক্তার মহাশয় এসেই এক গাল হাসি দিয়ে বললেন শুভ কাজের এখনই সময়। ব্যস, হয়ে গেলো খৎনা!
পরের ঘটনা ঘটেছিল বুয়েটে। বাঁধনের আয়োজনে হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছিল। এক বন্ধুর চাপাচাপিতে আমিও নিতে রাজি হলাম। গিয়ে শুনি আগে ব্লাড স্ক্রিনিং করতে হবে। আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ। কিন্তু ততক্ষণে অনেকগুলো টাকা দিয়ে ফেলেছি, কি আর করার। বসলাম রক্ত দিতে। সিরিঞ্জ ঢুকাতে না ঢুকাতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তারপর কি হলো মনে নেই....। যখন হুঁশ ফিরলো তখন দেখলাম আমার মুখের উপর বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে। কয়েকটা চেয়ার একসাথে করে আমাকে শোয়ানো হয়েছে, ঘিরে আছে কয়েকজন। ঘটনা বুঝতে একটুও দেরি হলো না। আমি উঠে দাড়িয়ে আমার বন্ধুকে নিয়ে তাড়িতাড়ি সরে পড়লাম।
এরপরের ঘটনা এই কিছুদিন আগের। কিছু টেস্ট করার দরকার ছিল। গেলাম ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। আগের ঘটনার পর থেকে আমি এখন সিরিঞ্জের দিকেই তাকাই না। এই সুযোগে হতচ্ছাড়া নার্স চার চারটা টেস্ট টিউব ভরে রক্ত নিয়ে নিল!!! ওইদিনই ডাক্তার চোখ, জিহ্বা আর কি-সব হাবিজাবি দেখে বলে দিল আমার নাকি অ্যানেমিয়া, মানে রক্তশূন্যতা। কি যন্ত্রণা! আমি ১০০% সুস্থ মানুষ। দুইদিন আগেই কেওক্রাডং জয় করে আসছি। আরে ভাই, আমার মতো রোগা পাতলার কাছ থেকে এক টেস্ট টিউব রক্ত নিলেই মাথা চক্কর দেয়। আর তো চার চারটা! রক্তশূন্যতা তো হবেই! যত্তসব!!
সেদিন সিঁড়ি বেয়ে বাসায় উঠছিলাম। এই গরমের মধ্যে ছয় তলায় উঠলে সবাই হাঁপায়। আমি হয়ত একটু বেশি হাঁপাই। আমার ছোট বোন আমাকে হাঁপাতে দেখেই ফতোয়া দিয়ে দিল এটা অ্যাবনরমাল পালপিটিশন। আমার নিশ্চিত রক্তশূন্যতা। লে হালুয়া! আমার বোনও তো হবু ডাক্তার!!