থাক, কাঁদুক! এভাবেই তো শুরু হয়!!
প্রথম সাক্ষাতের রূঢ়তা মানতে অনেক সময় লাগে। নির্লিপ্ত, নিরাবেগ, পাথুরে অনুভুতিকে যতই আদর্শ মানা হোক এই সমাজে, শিশুরা ভালবাসাহীনতাকে মেনে নিতে খুব কষ্ট পায় এখনো।
সেই কবে থেকে দেখতে দেখতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে ঐন্দ্রিলার চোখ। কিন্তু বুকের ভেতরে কষ্টের ঢেউটা, প্রতিবার নতুন করেই অনুভূত হয়। একদম সেই প্রথম দিনের মতো করেই।
বাহিরের দিকে দৃস্টি ফেরালো ঐন্দ্রিলা। রুমের একমাত্র কাঁচের দেয়ালের বাইরেই সুনীল আকাশ। শেষ বিকেলের প্রোগ্রাম করা দৃশ্য। ছেঁড়া ছেঁড়া হালকা সাদা মেঘগুলি মাঝে মাঝেই ছায়া ফেলছে ঘন সবুজের বিস্তৃত ঘাসের বিছানায়। কোন সন্দেহ নেই তী এর মানসিক অবস্থা চিন্তা করেই এটা বাছাই করা হয়েছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ ঐন্দ্রিলার খুব জানতে ইচ্ছা করলো-
"আচ্ছা, মানুষের স্রষ্টা কি সত্যিই কোথাও আছেন? তিনি আসলেই দেখতে পাচ্ছেন তার সৃষ্টিকে? তিনি কি বুঝতে পারছেন- এই অবুঝ শিশুর কষ্ট?"
ঐন্দ্রিলার বেড়ে উঠা যেখানে; সেখানে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ত্ব নেই। মানুষই সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষই পূজ্যনীয়। কিন্তু তাদেরকে জানতে হয়েছে সব ধর্মের ইতিহাস, উৎপত্তি, তার প্রভাব ও তার ধ্বংসের কারণ। তাই মাঝে মাঝেই ঐন্দ্রিলার খুব স্রষ্টায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, যিনি একসময় মানুষকে আবেগ, অনুভুতি, রাগ, ইর্ষা, সন্দেহ আর ভালোবাসার ক্ষমতা দিয়ে তৈরী করেছিলেন। যিনি শিশু কে জন্ম দিতেন মায়ের শরীর থেকে, কোন মানুষের কোষের টেস্ট টিউব প্রোডাক্শন হিসাবে নয়।
আচ্ছা, ঈশ্বর কি কষ্ট পান? যখন মানুষ নিজের শরীর থেকে ভ্রুণ তৈরী করে ল্যাবোরেটরিতে! যে সমাজে মা, বাবা বলে কোন শব্দ নেই। মানুষের লিঙ্গভেদ এখন মূল্যহীন। সবাই ক্লোন উৎপাদনক্ষম!
ছোটবেলায় ঐন্দ্রিলার খুব ইচ্ছা করতো একটা বাচ্চার 'মা' হতে। নিজের শরীরের ভেতরে একটা শিশু বেড়ে উঠছে, এটা ভাবতেই একটা তীব্র সুখানুভুতি হতো! যদিও সে নিজেই জানতো- এটা হরমোনজনিত কারণে সৃষ্ট একটা ভাবনা! তারপরও তার ভাবতে খুব ভালো লাগতো। সে জানে, তাকে এভাবেই বানানো হয়েছে! যাতে, শিশুসদনে যথাযথভাবে তার কর্তব্য পালন করতে পারে।
কাঁধে, ছোট তুলতুলে হাতের ছোঁয়ায়- ঐন্দ্রিলা ভাবনার স্রোতে বাঁধা পড়লো। ঘুরে তাকাতেই ঐন্দ্রিলার বুকের ভেতরে মাথা গুঁজে তাকে জড়িয়ে ধরলো তী। কান্নাটা থামিয়েছে; কিন্তু সে এখন ঐন্দ্রিলাকে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকবে।
ঐন্দ্রিলা কিছু বললো না। থাকনা বেচারী। এই দেবশিশু থেকে মানুষে রূপান্তরিত হতে, সময় কিছুটা তো নেবেই।
"আচ্ছা ঐন্দ্রিলা, তুমি কেন ওদের মতো না? আমার একদম ওদের ভালো লাগে না!"
অস্ফুটে কথাগুলি বলেই আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো তী ।
কি করে বোঝাবে ওকে।?
মানুষ অনেক বদলে গেছে! নিজেদের আবেগ অনুভুতির নিয়ন্ত্রিত রূপান্তর করেছে। ভালোবাসা, কাম, ক্রোধ, লিপ্সা এখন যান্ত্রিক পরিমাপে। শারীরিক সম্ভোগ এখন কেবল যন্ত্রের ডিজিট মাত্র। আদর্শ পৃথিবীতে
মানুষ এখন অনুভুতিশীল রোবট তৈরী করেছে কেবল শিশুদের লালন পালনের জন্য। যারা একদিন বিবর্তিত হয়ে পরিনত হবে আদর্শ মানবে!
যান্ত্রিক বুকের ভেতরের হাহাকারটা প্রকট ভাবে টের পায় যন্ত্রমানবীটি!
বুকের সাথে আর একটু জোরে আকড়ে ধরে তী কে।