somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাতারের ডায়রী (শেষ পর্ব)

০২ রা আগস্ট, ২০০৭ দুপুর ২:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৯.
ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোজেক্টে কাতার আসা, বেশ কয়েকবার তাই এখানকার শিল্প এলাকায় যেতে হলো। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার প্রায় সব শিল্প-কারখানাই তেল-গ্যাস ভিত্তিক। পরিকল্পনা থাকলে কতটা দারুণভাবে সবশিল্পকে একসাথে ইন্টিগ্রেড করা যায়, সে ব্যাপারে কাতারকে আদর্শ ধরা যেতে পারে। দোহা থেকে প্রায় সত্তর-আশি কিলোমিটার দূরে উত্তরাঞ্চলে পুরো একটা শিল্প শহরই গড়ে তোলা হয়েছে, যার নাম ‘রাজ-লাফান ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি’। লিক্যুফায়েড নেচারাল গ্যাস, রিফাইনারি, গ্যাস-টু-লিক্যুইড, ফার্টিলাইজারসহ তেল-গ্যাস ভিত্তিক সব শিল্পই এখানে ঠাই পেয়েছে, শহর থেকে দূরে, সমুদ্রের তীরে আর খনিগুলোর কাছে হয় এমন একটা জায়গায়।

দোহা থেকে রাজ-লাফান যাবার পুরো রাস্তাটাই যেন মরুভূমির বুকে কালো সাপের মত শুয়ে থাকা হাইওয়ে। হাইওয়ের কিছুদূর পর পর রাডার সারভেলান্স সিস্টেম থাকলেও গাড়িগুলোর স্পিডোমিটারের কাটা প্রায়ই দেড়শো কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই করে।
নিশান পেট্রলে চড়ে বাইরের মরুভুমির আর কতটাই আঁচ করা যায়! তাই রূক্ষতার বদলে সৌন্দর্য্যটাই ধরা পড়লো বেশি। এখানকার মরুভুমি সমতল, একদম বালুকাময় না হয়ে মাটি একটু পাথুরে, রং একটু লালচে। চোখ মেললে দূরে বেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর পর ধু-ধু মরুভুমির মাঝে এখানে ওখানে কিছুটা ঝাপ-ঝাড় আর হয়তো দুয়েকটা বাড়িঘর। আর ভাগ্য খুব ভাল থাকলে কয়েকটা ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো উটও দেখে ফেলতে পারেন।
আর সবচেয়ে দারুণ লাগে রাতের বেলা; মরুর বুকে রাতের হাইওয়ে - এক কথায় অসাধারণ।

রাজ-লাফান যাবার পথে পড়ে আরেকটা শহর, আল -খোর। এটা যদিও দোহার পর কাতারের অন্যতম একটা শহর, কিন্তু দেখে বাংলাদেশের সাধারণ যে কোনো উপজেলা শহরের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। আসলে সবাই এখন দোহামুখী। কারণটা খুব সহজ, দোহা কেন্দ্রিক আধুনিক কাতারের সবকিছুই এখন দোহায়।

১০.
হাতে সময় খুব কম আর কাজ খুব বেশি থাকায় এবার আর দোহা কিংবা অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি হলো না। তবে বেশ কয়েকবার যাওয়া হলো কাতার ইউনিভার্সিটি,তাও কাজের ছুতোয়। এর অবস্থান দোহার উত্তর প্রান্তে। আর্কিটেকচারাল ভিউটা সুন্দর। মিশরীয় এক ভদ্রলোকের ডিজাইনে জ্যামিতিক খাঁজে এমবেডেড আরবীয় ধাঁচের নকশা করা অনতিউচ্চ বিদ্যালয় ভবন- দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ভবন। মেয়েদের ভাগে কোনো পুরুষ শিক্ষার্থীর প্রবেশ একেবারে নিষেধ। মেয়েদেরও ছেলেদের অংশে আসা মানা। শুধু শিক্ষকরা উভয় অংশে যেতে পারেন বাধা ছাড়াই।
কাতারীরা দেরীতে হলেও ইদানীং বোধহয় শিক্ষার মূল্য বুঝতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের প্রায় দ্বিগুন দেখে অন্য আরব দেশের তুলনায় নারীশিক্ষার ব্যাপারেও কাতারকে একটু এগিয়ে থাকতে দেখা গেল।
আসলে শিক্ষাব্যবস্থায় কাতার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পুরাতনের পাশাপাশি বাংলাদেশের মত এখানেও উঠছে নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে কোনোটাই বাংলাদেশের মত ভুইফোঁড় কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়। সবই হচ্ছে সরকারের 'কাতার ফাউন্ডেশন' নামক সংগঠনের পরিকল্পনায় ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে। সম্পূর্ণ আলাদা কায়দায়, অন্য উদ্দেশ্যে। গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি এই ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে হচ্ছে তা হলো বিশ্বের সবচেয়ে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাতার ক্যাম্পাস চালু করা। ইতিমধ্যেই এখানে আছে কার্নেগি মেলনের বিজনেস স্কুল, কর্ণেল ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত মেডিক্যাল স্কুল,জর্জটাউনের ফরেন সার্ভিস স্কুল, টেক্সাস এ এন্ড এম-এর ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, ভার্জিনিয়া কমনওয়েল্থের স্কুল অব আর্টস। এই দারুন সব স্কুলগুলোতে কেবল কাতারীরাই পড়তে পারবে, প্রয়োজনে স্কলারশীপসহ। বোঝাই যাচ্ছে,পেট্রোডলারের সদ্ব্যবহারও এরা করতে জানে।
দেখছিলাম আর আফসোস হচ্ছিল। আমার দেশেও যদি এমনটা হতো! কত মেধাবী বাঙালী সন্তানের সুযোগ হতো দেশে থেকেই এই স্কুলগুলোতে পড়ার, কমে যেত ব্রেন ড্রেইন। দেশে থেকেই যদি বিশ্বের সবশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের জ্ঞান আহরণ সম্ভব হয় তাহলে আর লাগে কিছু?

১১.
বর্ষা-বাদল-বৃক্ষ-বন-বসন্তে বোনা বঙ্গদেশের সন্তান বলেই হয়ত মরুভূমি আর লু হাওয়ার দেশ ততটা টানে না, তবু সব মিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতিই হল কাতারে। যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে দুইবারই গ্রীষ্মকাল হওয়ায় খুব বেশী উপভোগ্য হয়ে উঠে নাই কাতার ভ্রমণ। এত বেশি হিউমিডির সাথেও এর আগে বোঝাপড়া ছিল না। কিন্তু তারপরও যখন ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসলো, একটু আফসোসের কাটা যে মনের মধ্যে খচখচ করলো না তা নয়। অনেককিছুই তো দেখা হলো না কাতারের। এখানকার প্রাচীন স্থাপত্য, সভ্যতার অবশেষ কিংবা জাদুঘর দেখা হলো না। হলো না পাম ট্রি আইল্যান্ডে যাওয়া, যদিও মনে হলো ওখানে আর যাওয়া যায় না, কিছুই আর নেই সেখানে। আরবদের পারিবারিক জীবন কাছ থেকে দেখার শখ ছিল, এত অল্প সময়ে তা সম্ভব নয়। খুব ইচ্ছে ছিল এখানকার অতীত জীবনপ্রবাহ সম্পর্কে জানার, পারলে শহর ছেড়ে বেদুইনদের (যদি থাকে আদৌ) জীবন কাছ থেকে দেখার। হয়ে উঠে নাই।

তবু বলতে হয়, ভালো একটা অভিজ্ঞতাই হলো। শহরের দোতলা বক্স বাড়িগুলোর দেয়ালে দেয়ালে চৌকোণা সূক্ষ আরবীয় খাঁজ, ছোট করে ছাটা দাড়ির কাতারি পুরুষের শুভ্র আরব পোষাকে দুপ-দুরস্ত চলাফেরা, চেনা-অচেনা যেই হোক অসম্ভব আন্তরিকতায় সালাম-কুশলাদি বিনিময়, ছায়াহীন দোহার রাস্তায় খাসির শর্মা খাওয়া, গরম বাঁচিয়ে রাত বারোটার ফুটবল, সেলান(sea line)এ শয়তানের সাহস নিয়ে তরুণদের কার রেস এবং মুখোমুখি সংঘর্ষের ডুয়েল, কাতারি রুটি-মাংস-জয়তুন, এদের অনেককিছুই মনে থাকবে অনেকদিন।

তাই যখন ফিরছিলাম, দশ দিনের পুরো প্যাকেট একটা ট্যুর শেষে, তখন মনে হলো দোহা শহরকে আপন করে নেবার অনেক উপকরণই বোধহয় মনে জমা হয়ে গেছে।

(শেষ)

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×