রাগে এবং দুঃখে জাহিদের বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। একটা ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে সে। সামনে রাখা টিপয়ের উপর দু’পা পাকিয়ে দোলাচ্ছে। স্পোর্টস চ্যানেলে পেপসি তিন জাতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের পাকিস্তান বনাম শ্রীলংকার খেলা লাইভ দেখানো হচ্ছে। শ্রীলংকা হলো জাহিদের মোষ্ট ফেভারিট ক্রিকেট টিম। খেলা মানেই ক্রিকেট এবং ক্রিকেট মাত্রই যেন শ্রীলংকার সাপোর্টার হওয়া। কারণ, ক্রিকেট পাগল বাঙালিদের জন্য শ্রীলংকাই হতে পারে অনুকরণীয় আদর্শ। ক্রিকেটের অতীত ইতিহাস খতিয়ে দেখতে গেলে দেখা যাবে শুরুতে শ্রীলংকার অবস্থান বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের চেয়েও নাজুক ছিল। ক্রিকেটের যত বড়ো বড়ো রেকর্ড রয়েছে বলতে গেলে প্রায় সবকটি রেকর্ডই শ্রীলংকার বিপক্ষে গড়া। এরা তবু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় নি। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে এবং অবশেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৯৬-এর বিশ্বকাপ তারা ঘরে তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য শ্রীলংকা ছাড়া আর কোন দেশ এতবড়ো অনুপ্রেরণা হতে পারে? অথচ জাহিদ ভেবেই পায় না বাঙালিদের মাথায় এ জিনিসটা কেন ঢুকছে না। বাঙালিদের কাছে ক্রিকেট মানেই পাকিস্তান। জাহিদের ধারণা, ক্রিকেটের স্বার্থে কোনো কোনো বাঙালি হয়ত নিজেকে পাকিস্তানি ভেবে মনে মনে গর্ববোধও করে। কেউ কেউ হয়ত এ-ও ভাবে, পাকিস্তান না ভাঙলে আজ আমরাও বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট টিম থাকতাম। জাহিদের এই ধারণা যে একেবারেই ভিত্তিহীন তা-ও নয়। বহুবার সে গোপনে জরিপ করে এর সত্যতা পেয়েছে।
ভারত-পাকিস্তানের খেলায় টিভি সেটের সামনে বসা পনের-বিশ জনের একটা দলে সতের-আঠার জন দর্শকই পাকিস্তানের সমর্থক। দু-এক জন ভারতের পক্ষে, তবে এরা প্রকাশ্যে তা বলে না পাছে ভারতের দালাল বলে আখ্যা পেয়ে যায়। যারা বাকি থাকবে তারা হলো নিরপেক্ষ সমঝদার, এরা বসে থাকে শহীদ আফ্রিদির আরো একটা রেকর্ড ভংগকারী দ্রুততম সেঞ্চুরি অথবা শচীনের আরো একটা শতক দেখার জন্য। যে কোনো দলের চার কিংবা ছক্কা হলে এরা সজোরে চেঁচিয়ে বলে … ফোর … ছক্কা।
পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করে ২৪৬ রানের একটা মোটামুটি ডিফেন্ডেবল স্কোর দাঁড় করিয়েছে। তা তাড়া করতে গিয়েই শ্রীলংকার মতো রান তাড়া করা দক্ষ দলটি হাঁপিয়ে উঠেছে। এই কিছুক্ষণ আগেও ৬৪ বলে জয়ের জন্য দরকার ছিল ৬০ রান, হাতে ছিল সাত-সাতটি উইকেট। সে অবস্থা থেকে এখন দরকার হয়ে পড়েছে ৪০ বলে ৪০ রান এবং হাতে রয়েছে মাত্র ৪টি উইকেট। অন্য যে-কোনো দিন হলে এ পরিস্থিতিতে জাহিদ দাঁতে দাঁত কেটে উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকতো। কিন্তু তার মুখাবয়বে আজ কোনো ভাবাবেগের চিহ্নমাত্র নেই। অপলক টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার বুকে আজ অনেক ক্ষোভ এবং অভিমান।
জাহিদ একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তার কথা-বার্তা চাল-চলনে ইঞ্জিনিয়ারত্বের ছাপ দেখতে পায় না কেউ। সে সরকারি চাকুরি করে এবং সেই সুবাদে সরকারি বাসা পেয়েছে। থাকে মিরপুর ১২ নম্বরের স্টাফ কোয়ার্টারে, সপরিবারে। জাহিদ একটু-আধটু লেখালেখির চর্চাও করে। সে-লেখা ডাকযোগে পত্রিকায় পাঠায়। কদাচিৎ তা ছাপা হয়, কিন্তু সবগুলো লেখার হিসাব রাখা, ও-গুলো ছাপা হলো কিনা সে ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখার সময় ও ধৈর্য কোনোটাই তার থাকে না। লেখা পাঠিয়ে সম্পাদকের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ সে কখনোই করে নি। তার যুক্তি হলো এতে লেখার প্রকৃত মান নির্ণিত হয় না। লেখা ভালো হলে একদিন না একদিন কোনো না কোনো সম্পাদকের নজরে তা পড়বেই এবং তখন নিশ্চিতভাবেই তা ছাপা হবে। তার কিন্তু ব্যাংকে প্রচুর ঋণও আছে। ওভার ড্রোন হতে হতে ঋণের পাহাড় গড়ে উঠেছে। বেতন যে খুব কম তা-ও নয়। বাংলাদেশের চাকুরি হিসাবে বরং বলা চলে বেশ উঁচু বেতনের চাকুরি। কিন্তু যৌথ পরিবারের অর্থ সংকুলান করতে গিয়ে এই টাকায় নিজের বউ-বাচ্চা নিয়ে স্বচ্ছন্দে চলা যায় না। জাহিদের ঘরদুয়ারের সাজসজ্জা আর আসবাবপত্র দেখে মোটেও বিশ্বাস হয় না সে এত বেতনের একজন পদস্থ সরকারি চাকুরিজীবী। ঘরদোরের সাধারণ সাজসজ্জার মতো তার চালচলনও অতি সাধারণ। হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে যে-রকম চাকচিক্যহীন বাল্যকাল ও কৈশোর অতিবাহিত করে এসেছিল, আজও তার পরিবর্তন তেমন একটা ঘটে নি। তাকে এক টাকা করেই টাকা গুনতে হয়, প্রতিটি টাকাই তার কাছে হিসাবযোগ্য। আরেকটি কথা না বললেই নয়, বাসার বাজার সচরাচর সে নিজেই করে থাকে, কারণ বাজার-সওদা করা তার একটা বড়ো সখ। অবশ্য কাজের ছেলেটি প্রায় সময়েই তার সংগে বাজারে যায়, কখনো সখনো তার স্ত্রী শিরিও।
শিরির অনেক দিনের আবদার ছিল একটা নূপুরের। একটা নূপুরের আর কতই বা দাম হবে। সাড়ে চারশো কি পাঁচশো - বড়োজোর সাতশো টাকা। বিয়েতে একটা আংটি পর্যন্ত দেওয়া হয় নি বউটাকে। আংটি আংটি করে তো বিয়ের ছয় বছর চলে গেল। ঘরে দুটি ছেলেমেয়েও এলো। সেবার শিরির মামা বিদেশে যাবার আগে পুরো বারো আনার সোনার আংটিটা আঙুল হতে খুলে দিয়ে গেলেন। বললেন, নে, এটা তুই পরিস। তোকে তো কিছুই দেয়া হয় নি।
হাতে একটা আংটি থাকলে আরেকটা আংটির আর কী দরকার? তাই শিরি নতুন করে আবদার করলো, আংটিতো দিতে পারলেই না। একজোড়া নূপুর করে দাও না!
কথাটার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম খোঁচা আছে। তাই জাহিদ প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে করেই হোক একজোড়া নূপুর সে শিরিকে কিনে দেবেই। সেজন্য প্রায় সারা মাসই বাজার করার সময় খুব হিসেব করে সে কিছু টাকা কম খরচ করতো, যাতে মাস শেষে কিছু সঞ্চয় থাকে। কিন্তু শেষমেষ আর সঞ্চয় থাকে না। হয় কোনো এক বাসায় জন্মদিনের পার্টি উপলক্ষে উপহার কিনতে হয়। অথবা গ্রাম থেকে কেউ কাজের খোঁজে এসে বাসায় ওঠে কয়েকদিন থাকার জন্য। এ ছাড়া বাড়ির জন্য তো হাজার পাঁচেক দিতে হয়ই। তবে বেশিরভাগ সময়েই কিছু বাড়তি টাকা পাঠাতে হয়। কখনো ছোটোবোনের চিঠি, পাঁচ মাস কলেজের বেতন বন্ধ। কলেজ ড্রেস চাই, জুতো ছিঁড়ে গেছে - মেয়েরা সেলাইকরা জুতো পরে কলেজে যায় না। একজোড়া কলেজ ড্রেসও অপমানকর।
গতমাসের বেতনে প্রায় অভাবনীয়ভাবে জাহিদ নয়শো ষাট টাকা বেশি পেয়ে গেছে। পে ফিক্সেশানে ভুল ছিল। সংশোধনের পর এরিয়ারসহ এই টাকা পেয়েছে সে। বাড়তি টাকাগুলোর কথা আর শিরিকে বলা হয় নি। মনে মনে পরিকল্পনা করেছে - এবার শিরিকে একটা সারপ্রাইজ দেয়া যাবে। চমৎকার একটা সারপ্রাইজ। সে স্বর্ণকারের দোকানে গেছে। আশেপাশের সবগুলো দোকান খুঁজেও মনের মতো রেডিমেড নূপুর পাওয়া যায় নি। অবশেষে ক্যাটালগ দেখে একটা সুন্দর ডিজাইন পাওয়া গেছে। স্বর্ণকার হিসেব করে বললো সাতশো বিশ টাকা লাগবে। জাহিদ মনে মনে ভাবলো, সাতশো বিশ টাকা! এটা কোনো ব্যাপারই না। নয়শো ষাট থেকে সাতশো বিশ টাকা গেলে আরো দুশো চল্লিশ হাতে থাকবে। তা দিয়ে শিরিকে একজোড়া জুতাও কিনে দেয়া যাবে।
নূপুর বানাবার অর্ডার দিয়ে খুব ফুর্তিতে বাড়ি ফিরেছিল জাহিদ। রান্নাঘরে ঢুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শিরিকে চুমু খেয়েছিল। সারারাত জেগে বাতি জ্বালিয়ে গল্প করেছিল - বিয়ের প্রথম দিনগুলোতে যেমন করতো।
আজ সকালবেলা থেকেই জাহিদের মনটা বেশ চনমনে ছিল। কারণ স্বর্ণকারের দোকান থেকে নূপুর ডেলিভারির তারিখ ছিল আজ। অফিসে বসে বসে সে অনেক ভাবলো কীভাবে নূপুর দেখিয়ে শিরিকে অবাক করে দেবে। সে মনে মনে অভিনয় করলো, ঘরে ঢুকেই শিরির কাছ ঘেঁষে দাঁড়াবে। তারপর সুর করে বলবে, চোখ বন্ধ – উহ্হু, একদম দেখবে না। তখন আস্তে আস্তে পকেট থেকে নূপুর বের করবে। এখানেই জাহিদ থেমে যায়। নাহ্, এটা কী করে হয়? একটা হার হলে না হয় এভাবে পরিয়ে দেয়া যেত। একটা তুচ্ছ নূপুর তো আর এভাবে পরালে ঠিক মানায় না এবং তাতে কোনো সারপ্রাইজও অবশিষ্ট থাকে না। এলেবেলে আরো কত কী মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, কিছুই স্থির হয় না। ওর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো এই ভেবে যে নূপুরটি পেয়ে শিরি যারপরনাই খুশি হবে। আনান্দে ঝলমল করতে থাকবে, অনেকক্ষণ অভিভূত থাকবে।
নূপুর হাতে পেয়ে শিরি বিন্দুমাত্র খুশি হয় নি। স্বর্ণকারের দোকান হতে নূপুর নিয়ে সোজা রিক্সা করে বাসায় ফিরে এসেছিল জাহিদ। ঘরে ঢুকে মনে মনে সাজানো কাব্যগাঁথার কোনো অভিনয়ই সে করতে পারে নি। পকেট হতে বের করে হাতে দিয়ে বলেছে, পরো তো দেখি কেমন মানায়! শিরি নূপুর জোড়া হাতে নিয়ে সামান্য নেড়েচেড়ে দেখলো। তারপর অবজ্ঞা ভরে খাটের উপর ফেলে দিয়ে বললো, নূপুর কিনবে তো আমাকে সংগে নিলে না কেন? পুরুষ মানুষ নূপুরের কী বুঝবে? তুমি বরং এটা ফেরৎ দিয়ে এসো, আমার একদম পছন্দ হয় নি। নূপুর আমি নিজে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেব।
মুহূর্তে জাহিদের মাথায় খুন চেপে গেল। এক থাবায় খাটের উপর হতে নূপুর জোড়া তুলে নিল এবং শিরি কিছু বুঝে উঠবার আগেই জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে ছূঁড়ে দিল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলো, আমার কেনা কিছুই তোমার পছন্দ হয় না, কিচ্ছু না…
আরো কিছু বলতে চাইলো, পারলো না। অত্যধিক রাগলে জাহিদ কথা বলতে পারে না, যা-ও পারে তা গুছিয়ে ওঠে না। সব মানুষেরই এমন হয়।
ঘরের মাঝখানে রাখা টিপয়টা ঘড়ঘড় করে টেনে এনে ইজি চেয়ারের সামনে রাখলো। দুপা টিপয়ের উপরে উঠিয়ে পাকিয়ে প্রচণ্ড রকম দোলাতে লাগলো। তার অন্তর পুড়ে কেবলই খাক হতে থাকলো।
ঘটনার অকস্মিকতায় শিরি প্রথমে হকচকিয়ে গেল। তারপর কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, কী এমন দোষের কথা বলেছি যে তুমি এমন করলে?
জাহিদ কোনো উত্তর দেয় নি। যেমন ছিল তেমনই টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে থাকলো। যেন খেলার উত্তেজনায় এখন তার সর্বাংগ কাঁপছে। একটা ঝামটা মেরে বের হয়ে দ্রুত পায়ে শিরি রান্না ঘরে ঢুকলো।
*স্খলন, একুশে বইমেলা ২০০৩ 'স্খলন'-এর ডাউনলোড লিংক
**স্খলন-এর উপর সমালোচনামূলক আরেক উপন্যাস 'খ্যাতির লাগিয়া', একুশে বইমেলা ২০০৪ 'খ্যাতির লাগিয়া'র ডাউনলোড লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩২