প্রমীলার সাথে আমার একটা ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার আছে, সেটি অবশ্য বেশ পরের ঘটনা। সেই ব্যাপারটা শুধু প্রমীলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি; প্রমীলা থেকে সারাক্লাসের মেয়েদের মধ্যে সেই ভুল বোঝাবুঝি ছড়িয়ে পড়েছিল।
তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। ছুটির ঘণ্টা পড়লে যথারীতি ক্লাস থেকে বেরিয়েছি। মেইন রোডে ওঠার আগে বিশ-পঁচিশ গজ রাস্তা। আমি সেই রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। এই জায়গাটুকুতে ছাত্রছাত্রীদের তখন প্রচুর ভিড়, একটি মাত্র গেইট দিয়েই সবাইকে বের হতে হয়। ঠেলাঠেলি করে হাঁটছি, এমন সময়ে আমার স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেল। কী যে বিড়ম্বনা, একপাশে চেপে গিয়ে নীচু হয়ে কিছুক্ষণ গিঁঠু দিয়ে ফিতাটি আটকাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় অবশ্য ততক্ষণে কমে গেছে। অগত্যা জুতাজোড়া হাতে নিয়ে খাতার পাতা ছিঁড়ে কাগজে মোড়ালাম, তারপর বইখাতার সাথে জড়িয়ে নিলাম।
গেইট পেরিয়ে মেইন রোডে পা ফেলেই দেখি রাস্তার ওপারে আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে। ওরা সবাই স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা কি বুঝতে পারছে যে আমার বইখাতার নীচে কাগজে মোড়ানো ছেঁড়া স্যান্ডেলটি লুকানো আছে? আমি লজ্জাবোধ করতে লাগলাম। আবার বেশ পুলকিত বোধও করলাম, এতগুলো মেয়ের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া কি কম কথা!
আমি গোবেচারা, লাজুক, তবুও আমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে দিলাম, মৃদু করে। প্রত্যুত্তরে ওরা কেউ হাসলো না। ওদের কী হয়েছে? প্রতিদিন এখান থেকে ওরা দু-দলে ভাগ হয়ে যায় - একদল যায় দক্ষিণ দিকে, যাদের বাড়ি নারিশা, শিমুলিয়া, মেঘুলা, গ্রামে, যেমন সায়ন্তনী, বীনা, শামীমা এবং প্রমীলা। আরেক দল উত্তর দিকে যায়, যেমন নার্গিস, শাহনাজ, বিউটি, নাজনীন। ওদের গ্রামের নাম ঝনকী, সুতারপাড়া, মুন্সীকান্দা, গাজীরটেক, ইত্যাদি। মনে মনে বললাম, ওরা দুদিকের যাত্রী, এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে কেন?
কিন্তু আমি তো আর যেচে গিয়ে ওদের কাছে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি না। প্রথমত, মেয়েদের সাথে কথা বলার জন্য অতখানি সপ্রতিভ ও বাকপটু আমি নই; দ্বিতীয়ত, ওদের সাথে অহরহ কথা বলার মতো অত সাহসও আমার নেই, অতখানি ঘনিষ্ঠতা কিংবা সখ্যতাও গড়ে ওঠে নি।
আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে উত্তর দিকে মোড় নিচ্ছি, তখনই সবগুলো মেয়ে একযোগে উত্তর মুখে রওনা হলো এবং তখনো ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ক-রি-ম। খানিকটা রুক্ষ ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সায়ন্তনী ডেকে উঠলা। বললো, আস্তে হাঁটো।
আমি আস্তে আস্তেই হাঁটছিলাম।
সায়ন্তনীর কঠিন দৃষ্টিতে আগুন ঠিকরে পড়ে। ওর ঠোঁটের কোণে বক্র হাসির আভা, কণ্ঠে চাপা ক্ষোভ। লক্ষ করি, সবগুলো মেয়ের মধ্যেই তখন একরূপ।
সায়ন্তনী বললো, তোমার কাছে আমরা একটা সংজ্ঞা শিখতে চাই।
আমি মনে মনে গর্বের হাসি হাসলাম। আমি যে ক্লাসের সেরা ছাত্র মেয়েদের কাছে তাহলে আমার এই স্বীকৃতিটুকু আছে! ওরা আজকাল আমার কাছ থেকে সামান্য হলেও কিছু জ্ঞান আহরণ করতে চায়।
যুগপৎ আমি আরেকটি বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলাম। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে সবসময় ‘তুইতোকারি’ করে কথা বলে, ওরা হঠাৎ আমার সাথে ‘তুমি’তে চলে এলো কেন?
আমি আড়ষ্ট মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, কীসের সংজ্ঞা রে?
সায়ন্তনী বললো, আচ্ছা, আমাগো একটু ভালো কইরা বুঝাইয়া দেও তো পদার্থ কাহাকে বলে?
আমি মনে মনে হেসে উঠলাম, ওরে গণ্ডমূর্খের দল, গত পাঁচ বছর ধরে এই পদার্থের সংজ্ঞা পড়ছিস, আজও তার সঠিক সংজ্ঞা বুঝতে পারলি না? গর্দভের দল রে!
মুখে বললাম, পদার্থের সংজ্ঞা পারছ না? এর চাইতে সহজ সংজ্ঞা তো মনে হয় সায়েন্সে নাই। ভালো কইরা শোন, আমি বুঝাইয়া বলতেছি, যার ওজন আছে এবং কিছু পরিমাণ জায়গা দখল করার ক্ষমতা আছে, তাহাকেই পদার্থ বলে। মনোযোগ দিয়া শোন, আমি আবার বলতেছি ...।
আর বলিতে হইবে না, সায়ন্তনী বললো, কও তো, আমাগো কি ওজন আছে এবং আমরা কি কিছু পরিমাণ জায়গা দখল করিবার পারি?
নিশ্চয়ই, আমি হেসে দিয়ে বললাম, তোদের একেক জনের ওজন তো মাশাল্লা কম কইরা হইলেও চল্লিশ সের হইব। এবং পাঁচ হাত বাই চার হাত মাপের খাটটাও দখল কইরা থাকছ, অতএব ...।
অতএব, আমরা সব্বাই পদার্থ, তাই তো? এবার বলো অপদার্থ কাহাকে কহে?
বিদ্ঘুটে প্রশ্ন তো? বিজ্ঞান বইয়ের কোনো জায়গাতেই অপদার্থের সংজ্ঞা দেয়া নেই। কিন্তু পদার্থের সংজ্ঞা তো আছে। পদার্থের বিপরীত শব্দ হলো অপদার্থ, অর্থাৎ যা পদার্থ নয় তাই অপদার্থ।
আমার বুদ্ধিমত্তা খুব প্রখর, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি সাহিত্য ও বিজ্ঞান মিলিয়ে অপদার্থের সংজ্ঞা দিলাম, যাহা পদার্থ নহে তাহাই অপদার্থ, অর্থাৎ যাহার কোনো ওজন নাই, জায়গা দখল করিতে পারে না, তাহাকে অপদার্থ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।
হঠাৎ সবগুলো মেয়ে একযোগে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, তাইলে তরে (খাঁটি সম্বোধনে ফিরে এসে) আইজ কওন লাগবো প্রমীলা অপদার্থ হইল কেমনে। ওরা একসাথে চিল্লাপাল্লা করে উঠলো। ওদের ডামাডোলে মাথা আউলে গেল। বললাম, তোগো প্রশ্ন বুঝতে পারি নাই।
নাজনীন এবার ঘাড় উঁচু করে সামনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞাসা করে, তর পণ্ডিতগিরির ক্যাঁথা পুড়ি, প্রমীলারে অপদার্থ কইলি ক্যা আগে তার জবাব দে।
নাজনীনের সঙ্গে সবগুলো মেয়ে কলকলিয়ে তেড়ে উঠলো, আমি সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে গেলাম। ওদের প্রশ্নের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমাদের ক্লাসের পণ্ডিত ছেলেগুলো আমাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেছে। আমি একা ও অসহায়। তদুপরি, সিনিয়র ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র আমার অসহায়ত্বকে বেশ উপভোগ করছে, আর মেয়েগুলোর পক্ষাবলম্বন করে ওদের মন জয় করার চেষ্টা করছে। সায়ন্তনীদের পেছনে অন্যান্য ক্লাসের বেশ কয়েকটা মেয়ে যোগ হয়েছে।
আমি বললাম, কে প্রমীলারে অপদার্থ কইছে?
তুই কইছস, তুই কইছস। ওরা চেঁচিয়ে উঠলো।
আমি ভীষণ ধাঁধায় পড়ে গেলাম। বললাম, আমি কখন প্রমীলারে অপদার্থ কইলাম? আমি কক্ষনো কাউরে অপদার্থ কই নাই।
খবরদার মিথ্যা কথা কবি না, অবশ্য অবশ্যই তুই প্রমীলারে অপদার্থ কইছস। ক, কস নাই?
না, কই নাই।
কইছা।
কই নাই।
চুপ মিথ্যুকের হাড্ডি- একশবার কইছা।
কুন সুমায় কইলাম?
ঐ যে কিবরিয়া স্যার যখন মেয়েদের বকছিল, তুই কইছিলি প্রমীলা একটা অপদার্থ।
আমার মাথায় আসমান ভেঙে পড়লো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো, আমি কই নাই। কই নাই। প্রমীলারে অপদার্থ কই নাই।
বিউটি বললো, প্রমীলার মতন মেয়েরে যে অপদার্থ কইবার পারে তার শাস্তি না হইয়া পারে না।
নাজনীন ঝাঁঝালো স্বরে বললো, তরে দশবার কান ধইরা ওঠ-বস করন লাগবো।
ঝিনুক তেঁজে ফেটে পড়লো, বললো, তর হাড়মাংস আমরা চিবাইয়া খামু।
শামীমা বললো, আমরা তর ঘাড় মটকামু, হাড্ডিগুড্ডি গুঁড়া কইরা ছাড়ুম।
সায়ন্তনী বললো, তুই ছাড়া অন্য কেউই এই কথা কইলে তারে আমরা জুতা দিয়া পিডাইতাম।
আমার কানের লতি জ্বলতে থাকলো। আমি রাঙ্গা হয়ে উঠলাম, লজ্জা ও অপমানে। কাঁদো কাঁদো হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তরা কি নিজ কানে শুনছা আমি প্রমীলারে অপদার্থ কইছি?
এতক্ষণ প্রমীলা নিশ্চুপ ছিল। এবার সে অগ্রভাগে এসে বললো, নিশ্চয়ই কইছস, আমি স্পষ্ট শুনছি তুই আমারে অপদার্থ কইছস।
কিন্তু আমিও নিশ্চিত, আমার অন্তর্যামী সাক্ষী, শুধু প্রমীলা কেন, জীবনে এই ‘অপদার্থ’ শব্দটি দ্বারা অন্য কাউকেই আমি গালি দিই নি। আমার মনের কথাটা ওদের বোঝাতে পারলাম না। ওরা বোঝার চেষ্টাও করলো না।
আসমা, যে আমাদের দু-ক্লাস সিনিয়র ছিল, বাল্যবিবাহের কারণে ইতোপূর্বে যার দু-বার ফল-বিপর্যয় ঘটেছিল বলে গত দু-বছর ধরেই সে ক্লাস নাইনের ছাত্রী, মায়াবী চেহারার সেই শ্যামলা মেয়েটি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এলো। বললো, তোমাকে কিন্তু শাস্তি পাওনই লাগবো (সে আগাগোড়া ‘তুমি’ করেই বলতো)।
নার্গিস সবচাইতে তীব্র আঘাত হানলো। বললো, আয়নায় তর নিজের চেহারা কখনো দেখছস? দেখতে তো এক্কেবারে বান্দরের মতন! সে কিনা আবার আরেকজনরে কয় অপদার্থ।
নার্গিসের কথায় আমি খুব কষ্ট পেলাম। আমার অসহায় মুখাবয়ব ভীষণ ম্লান ও করুণ হয়ে গেল। আমার অন্তরে নার্গিসের জন্য একটা অন্য রকমের স্থান ছিল। কবির আমার ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেটদের একজন। নার্গিস ওর ছোটোবোন, ওরা দু ভাইবোন একই ক্লাসে পড়ে। ওদের বাসায় আমার হরহামেশা যাওয়াআসা হয়। কবিরের সাথে ওদের বাংলা ঘরে বসে অনেক গল্পগুজব করি, পড়াশোনা ছাড়াও বাইরের জগত নিয়ে। মাঝে মাঝে নার্গিস সে ঘরে আসে। নার্গিসকে দেখলে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ওর চেহারাটা ঠিক আমার কর্পুরা খালার মতো। ও যখন সামনে দিয়ে হেঁটে যেতো আমার নাকে একটা অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগতো - আমার কর্পুরা খালার গায়ে এরকম ঘ্রাণ ছিল। আমার কর্পুরা খালা নেই। নার্গিসকে দেখে আমি খালার কথা ভাবতাম।
সেই নার্গিস, আমার কর্পুরা খালার ছায়া, আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহপাঠীর ছোটোবোন, আমাকে এতখানি অপমান করে কথা বললো? আমি মাথা নীচু করে হাঁটছিলাম। নার্গিসের কথায় ওর দিকে তাকাতেই দরদর বেগে আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার করুণ চাহনি দেখে কেন যেন হঠাৎ ওদের মায়া হয়, আস্তে আস্তে শোরগোল থেমে যেতে থাকে।
আসমা মুখে সহানুভূতির হাসি ফুটিয়ে বললো, আমার শাস্তিটা কিন্তু একটু অন্য রকমের।
আমি কথা বলতে পারলাম না। মেয়েদের কথা কিংবা কাজের প্রতিবাদ করার সাহস ও শক্তি কোনোটাই আমার নেই। আমি তার দিকে তাকালাম।
আসমা বললো, শাস্তিটা হইলো আমাদের সবাইকে আজ তোমাদের বাসায় বেড়াইতে নিয়া যাইবা। পারবা না?
*অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, একুশে বইমেলা ২০০৫
অন্তরবাসিনী ডাউনলোড লিংক
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১১:০১