মা মারা গেছে ১৯৮০ সালে, যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মা ছাড়া কীভাবে বেঁচে থাকা যায়- এটাই ছিল আমার সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয়। মা ছাড়া কি একটা সংসার চলতে পারে?
সব মায়ের প্রকৃতি একই। আমার স্ত্রীকেও দেখি, সন্তানরা কীরকম ভাবে যন্ত্রণা দেয়। কিন্তু আশ্চর্য, সব যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে এবং কখন কার জন্য কী খাবার বানাইতে হবে, কে না খেয়ে আছে, কে গোসল করে নাই এখনো- সবকিছু তার নখদর্পণে।
অনেকের মতো আমিও জানতাম না গতকাল মা-দিবস ছিল। অথচ সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পরই হঠাৎ মনে হলো - বাবাকে একটা কল দিই। এমনটা হয় সব সময়ই- মনে হয় না বাবা বেঁচে নেই। কিন্তু মুহূর্ত পরেই ভুল ভাঙে - বাবা এখন সকল কলের উর্ধে, আল্লাহর খাস দরবারে পৌঁছে গেছে অনেক আগেই।
ফেইসবুকে শেষ পর্যন্ত বাবাকে নিয়েই একটা স্টেটাস দিলাম গতকাল।
কী বাবা, কী মা- দুজনই একটা সন্তানের জন্য অসীম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যাদের অস্তিত্বের সাথে সন্তানদের অস্তিত্ব আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত, অনেক দুঃখ-কষ্টের মাঝে একজন বাবাও যখন 'ওহ মাগো' বলে আর্তনাদ করে ওঠে - তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়- আল্লাহ আমাদের জন্য মা-কেই শেষ আশ্রয়স্থল হিসাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন।
মাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম অনেক আগে। আমার ছোটো ছেলেকে কয়েক বছর আগে পড়ে শোনাই। সে খুব তন্ময় হয়ে শুনছিল। পড়া শেষ হলে সে বলল- শুনতে শুনতে আমার খুব খারাপ লাগছিল। আমার ছোটো ছেলের এসব কবিতা বোঝার কথা না, কিন্তু মায়ের কথা এমনই কথা, যা এই ছোটো ছেলের ছোটো মনকেও নাড়া দিয়েছিল।
কবিতাটা নীচে শেয়ার করলাম।
**
আমরা খুব গরীব ছিলাম
আমার মায়ের একটা টিনের স্যুটকেস ছিল, যার রং ছিল জংপরা সবুজ
কাঁড়ের এক কোণে ওটা সযত্নে তুলে রাখতো মা, আর মাঝে মাঝে
নামিয়ে তা থেকে বের করতো পাতাবাহারের ছাপাঅলা একটা লাল পলিয়েস্টার শাড়ি;
আমরা ছোটো ছোটো ভাইবোনেরা উৎসুক চোখে দেখতাম স্যুটকেসের ভেতরে
মায়ের মহামূল্য সম্পদগুলো- গোলমতো একটা সিঁদুরের কৌটো ছিল,
আমি এখনো জানি না আমার মুসলমান-জননীর কী প্রয়োজন ছিল ঐ সিঁদুরের।
আর যা যা ছিল, যদ্দূর মনে করতে পারি, কয়েকটা স্বর্ণের বালা, দুল, কিছু চুড়ি;
একটা বহুদিনের পুরোনো তিব্বত স্নো'র কৌটোও ছিল, হয়ত-বা।
আমার মায়ের স্যুটকেসটা জীর্ণ হতে হতে
ওর আংটা-টা হয়ে গিয়েছিল খুব ঢিলে;
একটা তালাও ছিল তাতে, চাবিটা কোথায় যেন লুকিয়ে রাখতো মা,
কেননা, তার আঁচলের গোছায় কয়েকটা চাবি ঝনাৎ শব্দ করতো, স্যুটকেসের চাবিটা
নিশ্চয়ই ওখানে দেখি নি।
মা যখন ভাঙা স্যুটকেসটা নামাতো, ওটা খুব ঝনঝন বা
ঠনঠন শব্দ করতো।
মাঝে মাঝেই মাকে দেখতাম স্যুটকেস নামিয়ে
তা থেকে শাড়িটা বের করতো, আর মলিন মুখে তা পরতো। শাড়ি পরে আমার মা
কোথাও বেড়াতে না গিয়ে রসুইঘরে ঢুকতো রান্না করতে, কিংবা ধান ভানতে,
কিংবা রাস্তার ওপার হতে নাড়ার আঁটি এনে গুছিয়ে রাখতো দুয়ারে। তারপর বাবা যেদিন
মেঘুলা বাজার থেকে একটা নতুন কাপড় কিনে আনতো মায়ের জন্য, মা তার
পরনের শাড়িটি খুলে, বহু যত্নে ভাঁজ করে ভাঙা স্যুটকেসের ভেতর সাজিয়ে রাখতো।
শৈশব হতে শুরু করে আমার ১৩-১৪ বছর বয়সে মায়ের
মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাকে শাড়িটি পরতে দেখেছি।
মা আমাকে প্রায়ই বলতো, ‘আমার এই শাড়িড্যা তর বউরে দিমু।’
মায়ের বালা, চুড়িগুলোও কোনো একদিন আমার বউয়ের হবে, মা বলতো।
আমি পরিবারের বড়ো ছেলে, এজন্য এটাই নিয়ম।
আমরা সে-সময় অতিশয় গরীব ছিলাম। আমার বাবা ছিল
একজন দরিদ্র চাষা, যার নিজের কোনো জমি ছিল না; আমার মা
সেই দরিদ্র চাষার আহ্লাদী ও লক্ষ্মী স্ত্রী ছিল, যাকে
পরনের কাপড়ের অভাবে প্রায়ই তুলে-রাখা
শাড়ি পরতে হতো। আমরা অতিশয় গরীব ছিলাম, আর আমার বাবা ও
মায়ের ছিল দুরবিন চোখ- তার সন্তানেরা ভবিষ্যত পালটে দেবে।
৩০ কি ৩২ বছর পেরিয়ে গেছে। মায়ের ভাঙা স্যুটকেসটা কোথায় যে হারিয়ে গেছে, জানি না।
পাতাবাহারের ছাপাঅলা লাল শাড়িটা আমার চোখে এখনো দিব্যি ভাসে।
ওটার খবরও জানি না।
কাববোর্ডের ভেতর থকে থকে সাজানো স্ত্রীর শাড়িগুলোর দিকে তাকাই-
অকস্মাৎ বেহেশ্ত হতে নেমে এসে আমার মা যদি এগুলো দেখতে পেত,
আনন্দে অজ্ঞান না হয়ে সে যেতই না- তার গরীবের ঘরে আজ কী
সুন্দর সুন্দর চাঁদ ফুটেছে, একঝাঁক নাতি-নাতনি, যারা জানে না
তার দাদিমা একদিন কত্ত গরীব ছিল, যাকে পরনের কাপড়ের অভাবে
প্রায়ই তুলে-রাখা শাড়ি পরতে হতো।
১ নভেম্বর ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০২০ দুপুর ১২:০৫