১
প্রতিটা মানুষেরই কিছু না কিছু গল্প থাকে
গভীর ও গোপন
কেউ প্রকাশ করে, কেউ বুকে চেপে রাখে
সারাটা জীবন
২
হঠাৎ হঠাৎ খবরগুলো টিভিতে ভেসে ওঠে -
প্রিয়, হাস্যোজ্জ্বল মুখসকল, স্বজন বা অস্বজন লোকগুলো
আর নেই, আজ ভোরে বা দুপুরে মারা গেছেন
প্রতিটা মৃত্যুই স্মরণ করিয়ে দেয়- এভাবে তুমিও
একদিন হঠাৎ ‘খবর’ হয়ে যাবে।
৩
একদিন মুখ দেখেই বুঝে যেতে- আমার ভেতরে
উত্তাল নদী। তখন তোমার তীব্র আকুলতা।
জীবনে এমন সময়ও আসে, যখন হৃদয়ে থাকে না
প্রেম, এবং তুমিও আমাকে একটুও বোঝো না।
৪
আমাদের চোখে একবিন্দু ঘুম ছিল না
বুক উপচে ভূরি ভূরি গল্প বের হতো সারারাত
রাত শেষ হলে মনে হতো- হায়, কিছুই যে হলো না বলা
কী যে উদ্দাম ছিল আমাদের দিনগুলো, কী যে
বেপরোয়া, দুর্নিবার ছিল আমাদের প্রেম
একবার সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়লো। রেলিঙে ঘন হয়ে
দাঁড়িয়েছিলাম তুমি আর আমি। দুরন্ত গতিতে
ছুটে চলছে লঞ্চ। হঠাৎ তোমার হাত চেপে বললাম,
চলো, বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিই। তুমি যেন জানতে,
অমনি লঞ্চের কিনারে এসে একসারিতে দাঁড়ালে।
প্রেমের জন্য এভাবেই জীবন এত তুচ্ছ হয়ে যেত
মুহূর্তের জন্যও আমার ভাবনা থেকে আড়ালে চলে গেছো –
আমার মনে পড়ে না কখনো এমনটা ঘটেছে
আমি শুয়েছিলাম খাটে। তুমি নানা কাজে বাইরে যাচ্ছিলে,
আবার ঘরে ঢুকছিলে। একবার হলো কী,
ঘরে ঢোকার কালে আমার দিকে তাকাতে ভুলে গেলে,
বেরোবার কালেও আঁচলে তোমার চোখ ঢেকে যায়
কীভাবে এত নিষ্ঠুর, ভুলোমনা হলে তুমি? একটুকরো
চাহনি না ছুঁড়েই তুমি ঘর থেকে বেরোতে পারো,
বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সেদিন সারারাত পার হয়ে যায়,
আমার অভিমান ভাঙাতে।
গ্রামের রাস্তায় আমরা রিকশায় যাচ্ছি দূরে এক
বিয়ে-বাড়িতে। এত মানুষের আনাগোনা! তুমি অস্থির,
ভীষণ অস্থির। আচানক অগণিত পথিকের চোখ ফাঁকি দিয়ে
আমার মাথা একঝটকায় টেনে নিলে বুকের কাছে,
কিছু বুঝে উঠবার আগেই অনবদ্য এক চুম্বন
এঁকে দিলে গালে। এমনটা আরো একদিন ঘটেছিল, তোমার
মনে পড়ে কিনা দেখো। বিরাণ এক চকের মাঝখান
দিয়ে আমরা হাঁটছি। গ্রামের সবগুলো চোখ জানালা
গলে আমাদের উপর স্থির। আমার ছুটি শেষ। আমাকে এগিয়ে
দিচ্ছ। আজও তুমি বড্ড ব্যাকুল। ছটফট করছো যন্ত্রণায়।
একটু দূরে ছোট্ট এক ঢিভি। ওখানে যেতেই ফিসফিসিয়ে
বললে- ‘জলদি নীচু হও, বসো।’ ঝড়ের মতো একমুহূর্তের
চুমুতে যেন সমগ্র সুখ লুফে নিলে। আমিও বিস্মিত, সুখে।
তুমি বললে- এটুকু না হলে আমি আজ মরেই যেতাম।
‘আজ আমি মরেই যেতাম’ – তোমার সেই ব্যাগ্রব্যাকুল
কথাটুকু এখনো কানে বাজে, সেই তৃপ্তিভরা মুখের
হাসি এখনো চোখে রঙিন আলো ছড়ায়।
আমাদের প্রেম ছিল ঝড়ের মতো। আমাদের কথা আর গল্প
ছিল অনন্ত আকাশের মতো অফুরন্ত। তোমার আত্মা আমার
আত্মার ভেতরে, আমার আত্মা তোমার আত্মার ভেতরে
একাকার হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছু
বুঝতাম না। তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমার পা
চলতো না। আমার বুকে কান্না জমে পাথর হয়ে যেত,
আমি কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারতাম না।
ছুটি শেষে চলে যাবার সময় বহু পথ হেঁটে হেঁটে তুমি আমার
সাথে আসতে। গ্রামের শেষ মাথায় এসে থামতে।
আমি চলে যাচ্ছি, বার বার পেছন ফিরে চাইছি।
আমার পা চলে না। হায়, আরেকটা দিন যদি থাকা যেত!
দিনগুলো কেন অনেক অনেক দীর্ঘ হলো না, রাতগুলো কেন
মুহূর্তেই ভোর হয়ে যায়?
গ্রামের শেষ মাথায় এসে থামতাম। তারপর আড়িয়াল বিলের
দীর্ঘ দু মাইল রাস্তা পায়ে হেঁটে পার হতাম, ধূ-ধূ চোখে
দেখা যেত, তুমি তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছো।
অতদূর থেকেও যখন হাত নাড়াতাম, তোমারও হাত তুলতে
একটুও দেরি হতো না; আমার চোখ বেয়ে দরদর করে
পানি পড়তো, আমি বাতাসের স্বননে শুনতে পেতাম,
তুমিও ফুঁপিয়ে কাঁদছো। তোমাকে রেখে চলে যাওয়া কী যে
কষ্টের, তা শুধু জানতো ভাষাহীন দীর্ঘ পথ ও পথের ধূলিকণা।
তারপর যেখানেই থাকতাম, তোমার প্রতিটা কথা,
প্রতিটা হাসি আমার কানে অবিরাম বাজতো, আমাকে বিভোর
করতো। আমার চিন্তায়, মগজে, মননে সতত তুমিই থাকতে
তোমাকে আমি ধ্যান করতাম ঘুমের ভেতরে
তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আমি পাগল হয়ে যেতাম
তারপর উন্মাদের মতো ছুটে আসতাম তোমার প্রেমপুণ্যের
কাননে।
তখন তো মুঠোফোন ছিল না। ল্যান্ডফোনও ছিল না
আমাদের। আমাদের ছিল চিঠি। তোমার চিঠির জন্য
অস্থির হয়ে উঠতাম। মরুভূমিতে শীতল বৃষ্টি নিয়ে
তোমার চিঠি যখন আসতো, চিঠির ঘ্রাণের ভেতর আমি
বুদ্ হয়ে ঘুমিয়ে যেতাম।
তোমার প্রতিটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ আমাকে আন্দোলিত করতো।
আমার প্রতিটা কষ্ট তোমার চোখে অশ্রু ঝরাতো।
আমার প্রতিটা কথাকে তুমি ভাবতে কবিতা।
তোমার প্রতিটা চাহনি আমার রোমকূপ ছুঁয়ে যেত।
শৈশব, কৈশোরে মায়ের কোল, বাবার হাত ছিল
আমার সব আনন্দের উৎস। তারুণ্যে ছিলে তুমি; যৌবনে,
মধ্যযৌবনেও তুমি। জীবনকে মধুর এবং অর্থবহ করলে
তুমি; এবং এখন পড়ন্ত জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে
তোমার সান্নিধ্যের অপেক্ষায় থাকে সমস্ত হৃদয়।
তুমি যখন ঘরে ঢোকো, আমার চারপাশে আলোর ঘ্রাণ
ছড়াও, মনে হয়, আমি আজও সেই উদ্দাম যৌবনে
পড়ে আছি।
অশিতিপর বয়সেও প্রিন্স ফিলিপ যখন রানি এলিজাভেথের
কক্ষে ঢুকতেন, রানির মুখমণ্ডল আলোকিত হয়ে উঠতো।
তুমি তবে বুকে হাত রেখে বলো, তোমারও কি এমনটা হয় না কখনো
রানি এলিজাভেথের মতো? পড়তি জীবনে স্ত্রীর চেয়ে বড়ো সঙ্গী
আর কে আছে ভুবনে? কেউ নেই। স্বামী-স্ত্রীরাই মধুরতম বন্ধু।
কিন্তু আবেগ যেমন ক্ষণস্থায়ী, প্রেমও তেমনি স্থায়ী নয়। বলতে
পারো, প্রেম একসময় মরে যেতে পারে, কিংবা প্রেম
হারিয়ে যেতে পারে জীবন থেকেও।
তুমি কি জানো, একজন পুরুষের প্রথম কবে ভালোবাসায়
ঘাটতি দেখা দেয়? ভাবনাটা খুব নিষ্ঠুর, কিন্তু ঘটনাটা খুব
বাস্তব। প্রথম সন্তান জন্মের পরই প্রতিটা পুরুষ টের পায়,
স্ত্রীর ভালোবাসা কমতে শুরু করেছে। প্রতিটা পুরুষই
বুঝে ফেলে- তার ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
আমারও মনে হতো, আগে তোমাকে যতখানি কাছে পেতাম,
এখন পাচ্ছি না, আগে তোমার যতখানি মনোযোগ পেতাম,
এখন তা থেকে ঢের কমে গেছে। কিন্তু এটাই জীবন।
বাস্তবতা এটাই। তাই ভাগ হওয়া ভালোবাসা মেনে নিয়েই
তোমার প্রেমেতে অন্ধ ছিলাম।
কিন্তু তুমি কি ভেবেছিলে, সেই ভালোবাসা একদিন
একেবারেই উবে যেতে পারে?
তুমি কি জানতে, একদিন তুমিও হয়ে উঠবে যে-কোনো
সাধারণ নারীর মতোই হৃদয়হীনা, নিষ্ঠুর, যার অন্তরে
একবিন্দু প্রেমও অবশিষ্ট থাকবে না?
ছোটোবেলায়, যখন প্রেম বুঝতাম না, তখন এ গান খুব
প্রিয় ছিল – এক হৃদয়হীনার কাছে, হৃদয়ের দাম কী আছে?
সারাটা জীবন প্রেমের জন্য উৎসর্গ করে পড়ন্ত বিকেলে মনে
হচ্ছে, সত্যিই, পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই।
খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, নির্মল মেঘের দিকে তাকিয়ে
একবার বলো- তোমার কোমল হৃদয়ের গভীরে
কী করে ধরে রেখেছ এত নির্মম, কঠিন একটা মন, যে মন
থেকে সমস্ত প্রেম, মায়া, আর মমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে?
সেই তুমি কীভাবে ‘প্রেমিকা’ থেকে আমূল বদলে গেলে, হয়ে উঠলে
নিরেট মমতাহীনা? এই যে নৃশংস চোখে তোমার আগুন
ঠিকরে পড়ে, তোমার কি একবারও মনে পড়ে না,
এই চোখে একদিন নদী ছিল, রহস্যের পাহাড় ছিল,
আর ছিল আবেগের অশ্রু, যা আমাদের ভালোবাসাকে ভিজিয়ে
দিত, শক্ত বাঁধনে আটকে দিত!
এর জন্য তুমি দায়ী নও, দায়ী নই আমিও।
দায়ী হলো এক রাক্ষস, যার নাম সংসার।
আমরা যখন সংসারে ঢুকে পড়ি, তখন প্রেম খুব কোণঠাসা
হয়ে পড়ে। প্রেম পড়ে যায় বিপাকে। সংসার আমাদের চাহিদা
বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন বাড়ে সে চাহিদা। বাড়ে হিমশিম।
বাড়ে অস্থিরতা। টানাপোড়েন বাড়ে। বাড়ে আমাদের দূরত্ব।
আমাদের অজান্তেই অবহেলিত প্রেম একদা নীরবে
পালিয়ে যায়।
আমরা কি পারি না ভুলে যেতে এ গঞ্জনার সংসার?
আমরা কি পারি না ফিরে যেতে আগের সেই
টগবগে দিনগুলোতে?
আমি জানি না, তুমিও জানো না- তোমার বুকেও
হয়ত সর্বগ্রাসী মহামারি বেঁধেছে গোপন বাসা
নীরবে ক্ষয় হচ্ছ তুমি, ক্ষয় হচ্ছি আমি
হয়ত হঠাৎই আমরাও একদিন ‘খবর’ হয়ে যাব
বুকে নিয়ে অতৃপ্ত ভালোবাসা।
চলো তবে, সমূলে ঝেড়ে ফেলি মানসিক ব্যাধি-
হৃদয়নাশা জেদ ও ক্রোধ, ফিরে যাই বাঁধভাঙা প্রথম যৌবনে
আবার সেই উদ্দাম প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠি।
যতদিন বেঁচে আছি, বাঁচতে চাই প্রেমে। প্রেমই জীবনকে
মহিমান্বিত করে, প্রেমই জীবনকে করে অর্থবহ।
চলো, এই দুরূহ সংসার থেকে নিই ছুটি।
১২ এপ্রিল ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১২:১৬