এসএসসি পরীক্ষা শেষ!!! আবার কারো কারো দু-একটা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা বাকি আছে। এরপর লম্বা একটা ছুটি। এরপরেই শুরু হবে ভর্তি যুদ্ধ। ঢাকায় বাইরের শিক্ষার্থীরা ঢাকায় শীফ্ট করবে কি করবে না এ নিয়ে টানাপোড়নে থাকে আর ঢাকার শিক্ষার্থীরা কোন কোন কলেজ অপশনে দিবে এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে। পরে দেখা যায় জিপিএ ফাইভ পেয়েও ভালো কলেজে চান্স নিতে ঘাম ছুটে যায়।
এই প্রথাগত ধারা ছাড়াও কিন্তু আরো একটি পথ আছে - পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট/ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং। জানি, অনেকে এই লাইনটি পড়ার পর নাক শিটকাবেন কিংবা পোষ্টটি পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। একটু কষ্ট করে পরেই দেখুন না, আপনার না হয় অন্য কারো কাজে হয়তো লাগতে পারে!
সারা দেশে ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট আছে যেগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স করানো হয়। এই চার বছরে মোট আটটি সেমিষ্টার পার করে হয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। প্রত্যেক সেমিষ্টারে ৭ টি করে বিষয় থাকে অর্থ্যাৎ নতুন সেমিষ্টার মানে নতুন বই। প্রত্যেক সেমিষ্টারে ২১ ক্রেডিট ফিক্সড থাকে। ৭ সেমিষ্টারে মোট ৪৯টি বিষয়ে পড়ানো হয়। অষ্টম সেমিষ্টারে থাকে ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট/ইন্টার্নশীপ।
এখন আমি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভালো এবং খারাপ দিক উভয় ই তুলে ধরছি।
ভালো দিক:
১। পরাশুনার খরচ কম যা গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য একটা ভালো দিক। প্রত্যেক সেমিষ্টারে আপনাকে ৫ হাজার এর বেশি খরচ করতে হবে না, অর্থ্যাৎ ৬ মাসে ৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২৫০০ টাকা সেমিষ্টার ফি, ১২০০ টাকা বই এবং বাকি সব আনুষাঙ্গিক খরচ। দাড়ান! যত টাকা খরচ করবেন তার বেশি ই কিন্তু রিটার্ন পেয়ে যাবেন। কিভাবে? বলছি, বিশ্ব ব্যাংক থেকে প্রত্যেক মাসে ৮০০ টাকা করে বৃত্তি দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। আর সেমিষ্টার শেষে ভালো রেজাল্ট করলে এবারে ১৬০০ টাকা! অর্থ্যাৎ মাসে ৮০০ করে ৬ মাসে ৪৮০০ এবং সেমিষ্টার শেষে ১৬০০, টোটাল ৬৪০০টাকা! আর ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট/ইন্টার্নশীপ অর্থ্যাৎ ৮ম সেমিষ্টার পার করলে ১৩১০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়।
২। ক্যারিয়ার নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না। পড়াশুনা শেষে বেকার থাকতে হয় না। ডিপ্লোমা শেষেই চাকরি পাওয়া যায়।
৩। আর্টসে কিংবা কমার্স নিয়ে এসএসসি পাশ করেছেন? কিন্তু এখন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় নিয়ে পড়ার ইচ্ছা জেগেছে? তাহলে এটাই আপনার একমাত্র উপায় কারন সকল বিভাগের শিক্ষার্থীরাই ভর্তি হতে পারবে।
৪। সরকারি চাকরিতে বেতন কিন্তু মাশআল্লাহ! সরকারি চাকরিতে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ১০ গ্রেডের বেতন পায় এবং সাব এসিষ্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করে যা দ্বিতীয় শ্রেনীর কর্মকর্তার পদ।
৫। কেবল মাত্র বই পুস্তকের মাঝে ডিপ্লোমা স্টুডেন্টরা সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রতিদিন ল্যাব ক্লাস/প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের মাধ্যমে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয় প্রতিটা শিক্ষার্থীকে।
খারাপ দিক:
১। ডিপ্লোমা কারিকুলাম বাংলায় অর্থ্যাৎ আপনাকে সব বিষয় বাংলায় পড়ানো হবে। অর্থ্যাৎ বলতে গেলে এই চার বছর আপনি ইংলিশ থেকে দুরে থাকবেন।
২। চাকরি তাড়াতাড়ি পাওয়া গেলেও বেতন অনেক কম থাকে। শুরুতে ৮-১০ হাজারের বেশি বেতন কোনো প্রাইভেট কম্পানী আপনাকে অফার করবে না।
৩। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কম। ডুয়েট, সাষ্ট, জাষ্ট, ইনষ্টিটিউশন ওব ইঞ্জিনিয়ারস, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ওপেন ইউনিভার্সিটি ছাড়া বর্তমানে আর কোনো সরকারি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য সুযোগ রাখেনি। এছাড়া প্রথম সারির প্রাইভেট ইউনিতেও ডিপ্লোমা হোল্ডারদের ভর্তি নেয় না।
৪। ডিপ্লোমা স্টুডেন্টদের সম্পর্কে আমাদের সমাজের ভুল ধারনা থাকায় সবাই একটু হেয় চোখে দেখে।
৫। সরকারী ইনষ্টিটিউটগুলোতে রাজনীতির প্রকোপ বেশি। রাজনীতির সাথে জড়ানো মানে রেজাল্ট খারাপ হওয়া শুরু।
ভালো খারাপ দিক তো তুলে ধরলাম। এবার একটু গাইডলাইন দেই কিভাবে আপনি আপনার শিক্ষা জীবন আর কর্পোরেট জীবনে ভালো কিছু করতে পারবেন।
১। চাকরীর ক্ষেত্রে সব সময় সরকারি ইনষ্টিটিউটগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়। অতএব সরকারি ইনষ্টিউটে চান্স পেলে ভালো নয়তো জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করাই ভালো। (প্রাইভেট পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আমাকে ভুল বুঝবেন না। সরকারি ইনষ্টিটিউট আর প্রাইভেট ইনষ্টিটিউটের ল্যাবের মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। তাই সরকারি ইনষ্টিটিউট সব সময় প্রাধান্য পাবে।)
২। মেকানিক্যাল/ইলেক্ট্রিক্যাল/সিভিল পারলে এই তিনটি সাবজেক্ট নিয়ে নিয়ে পড়তে চেষ্টা করুন। চাকরির বাজারে এই সাবজেক্টগুলোত চাহিদা বেশি এবং আশা করি আগামী বছরগুলোতেও চাহিদা থাকবে। ভর্তির সময় সর্বোচ্চ ১০টা সাবজেক্ট/১০টা ইনষ্টিটিউট পছন্দের তালিকায় দেয়া যায়। উপরের ৩টি সাবজেক্ট বার বার বিভিন্ন ইনষ্টিটিউটে দিন। দেখা গেলো আপনি ঢাকা, কুমিল্লা আর চট্রগ্রাম পলিটেকনিকে মেকানিক্যাল পছন্দের তালিকায় দিলেন। আপনি ঢাকায় থাকেন কিন্তু কুমিল্লায় চান্স পেলেন, সমস্যা নেই - প্রথম সেমিষ্টারের পর চতুর্থ সেমিষ্টার পর্যন্ত খালি সিটের বিপরীতে এক ইনষ্টিটিউট থেকে আরেক ইনষ্টিটিউটে ট্রান্সফার হওয়া যায়।
৩। চাকরির শুরুতে বেতন যতই হোক না কেনো, ঢুকে যান। বেতন আপনাআপনি বাড়বে। আর কর্মক্ষেত্রের এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে আপনি অন্যত্র অ্যাপ্লাই করতে পারবেন - তখন আপনাকে বেটার অ্যামাউন্ট অফার করবেই।
৪। নিজে নিজে ইংলিশ চর্চা করতে থাকুন। মুভি দেখুন, ইংলিশ পত্রিকা পড়ুন। নিজের ইংলিশ নিজেই উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান।
৫। রাজনীতি এড়িয়ে চলুন। কোনো মিটিং মিছিল থাকলে পাশ কাটিয়ে যান। এর মানে এই না যে সিনিওর ভাইদের মুখের উপর না করে দিবেন। ক্লাস আছে বলে কিংবা আসতেছি এই কথা বলে চলে যাবেন। পোলাইটলি এসব ম্যাটার হ্যান্ডেল করবেন।
৬। অবশ্যই ধৈর্য, কষ্ট এবং বিএসি করার ইচ্ছা থাকতে হবে। যারা ডুয়েট সহ অনান্য সরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে ইচ্ছুক তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকবেন। এসময় চাকরির ধারে কাছেও যাবেন না। গাজিপুরে অনেক কোচিং আছে যেগুলোতে প্রিপারেশনের জন্য কোচিং করা হয়। এছাড়া ইনষ্টিটিউশন ওব ইঞ্জিনিয়ারস এ দুই বছর মেয়াদি AMIE কোর্স আছে যা বিএসসির সমপরিমান। এখানে দুই বছরে ২২ টি বিষয়ে পড়তে হয় (কোনো ক্লাস হয় না, নিজের তাগিতে পড়তে হয়) এবং পরীক্ষা বুয়েট, চুয়েট, রুয়েট - এ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ডিপ্লোমা স্টুডেন্টদের জন্য বিভিন্ন প্রাইভেট ভার্সিটিতে সন্ধ্যাকালীন কোর্স আছে। চাকরির পাশাপাশি পড়াশুনা ও করতে পারবেন।
অনেক জ্ঞান ঝারলাম!! আপনাদের কোনো জিজ্ঞাসা কিংবা কোনো তথ্য জানতে চাইলে কমেন্ট সেকশানে উল্লেখ করুন। আমি সময় করে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিবো।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৪৭