৫
সকালে উঠে ব্যালকুনিতে বসে রঙ চা খাচ্ছি আর গত কাল রাতের ঘটনা নিয়ে চিন্তা করছি।এমন সময় ফোনে রিং বেজে উঠলো। নয়নের ফোন।
- হ্যালো
ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠ
- ইশান , গতকাল রাতে আমার বাসায় চুরি হয়েছে ।
- কী বলিস ,কি চোরে নিল ? নিশ্চই আমার বাসায় যে এসেছিল একই ব্যাক্তি তোর বাসায় গিয়েছিল।
- না মনে হয়।
- তাহলে কে ।
- এটা ছোট খাট চোর। আমার বিশেষ গোপন পরিচ্ছেদ চুরি করেছে। দুটাই লাল রঙয়ের । ব্যালকুনি থেকে নিয়েছে, হাহা ।
- তোর ফাজলামো স্বভাব গেল না আর । এগুলো বলার জন্য এত সকালে ফোন দিয়েছিস ।
- রাগ হচ্ছিস কেন ?
- রাগ হব না তো কি হব । এত দিন হয়ে গেল আইজার রহস্যের কোন কুল কিনারা করা গেল না। রাজ ঠাকুরের ও কোন খোজ নেই। বুড়ো লোকটা কোন বিপদে পড়ল কিনা কে জানে। আজ সকালে ফোন দিয়েছিলাম। কেউ ধরলো না ফোন।
- তুই এক কাজ কর।
- কী কাজ ?
- যে মেয়েটা তোকে ফলো করে ওইটাকে ক্ষপ করে ধরে ফেল। দেন সোজা কাজী অফিস । দেন বিয়ে। বাসর রাতে বিবাহিত বউ তোকে সব খুলে বলবে। দেখা যাবে আইজার সম্পর্কে ও সে অনেক কিছু জানে ।
- তোর ফাজলামো শেষ হয়েছে ?
- না এখনও শেষ হয় নাই।
- তাহলে রাখি ,ফাজলামো দেখার সময় নাই এখন।
- দাড়া দারা রাখিস না ।
- বল কি বলবি।
- ইগনাসিও সম্পর্কে কিছু তথ্য জোগার করেছি। ইগনাসিও নামে এক ব্যাক্তি ১৫০০ সালের দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। কিন্তু যে নথি থেকে এগুল পেয়েছি। সেখানে তাকে একজন সাধারন ব্যাবসায়ি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পারস্য থেকে সুদৃশ্য কার্পেট নিয়ে আসতো সে। আর যাওয়ার সময় মশলা নিয়ে যেত ।
- তাহলে আকিয়াব বন্দর থেকে যে ইগনাসিও রহস্যজনক ভাবে হারিয়ে যায় তার সাথে এর তো কোন মিল নাই।
- আমার তো মনে হয় দুই জন একই ব্যাক্তি ছিলেন। দস্যু পরিচয় লুকানোর জন্য কার্পেট ব্যাবসায়ীর বেশ ধারন করেছিল।
- এটা ও হতে পারে।
- আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে তিনি পারস্য থেকে দাস-দাসী ধরে নিয়ে আসতেন।পারস্যর দাসীদের এদেশে চাহিদা ছিল প্রচুর।
- তাহলে তো কিছুটা মিলে যায়। কারন দাস ব্যাবসায়ীরা ভালো ছিল না। জোর জবর দস্তি করেই তারা মানুষ জনকে ধরে নিয়ে আসতো।
- হ্যা, কেন যে সেই সময় জন্মালাম না। তাহলে পারস্য দেশের একজন সুন্দরী আমার বউ হত।
- তু আবার ফাযলামী শুরু করছিস ??
- ওকে আর করব না । আর শোন গত কিছুদিন ধরে এক মোচ ওয়ালা আমাকে ফলো করছে।যেখানেই যাই সে ও আমার পিছনপিছন যায়। ইচ্ছা করছে ধরে প্যাদানী দেই ।তুই তো সৌভাগ্যবান।সুন্দরী ফলো করে । বিয়ে টিয়ে করতে পারবি ক্ষপ করে ধরে । আমি এই মচুয়াটাকে নিয়ে কি করব ??!!
- তুই না একটু আগে বললি আর ফাজলামী করবি না ?!
- ওহ সরি, মিসটেক হয়ে গেছে ।
- হুম।ওকে রাখি।আরো তথ্য পেলে জানাবি আমাকে বাই ।
- বাই
পর্ব-৬
আমি এখন আছি টেকনাফ থেকে ১০-১৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বের জায়গা, দক্ষিন পাড়ায়। এখানের ছোট স্থানীয়দের একটা কটেজে উঠেছি । কাওকে না জানিয়েই এসেছি ।কেননা রিজভি আহমেদের বক্স এ একটা ম্যাপ পেয়েছি। যেটা তিনি তার চিঠিতে উল্লেখ করেননি । বিশেষ ভাবে একটা ছোট ছিদ্রের মধ্যে প্যাচানো অবস্থায় ছিল ম্যাপটা । দুই ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি সাইজের কাগজটা । আগে থেকে জানা না থাকলে কেউ ই স্বল্প স্ময়ে এটার হদিস পাবে না। চোর কেন বাসায় এসছিল এখন কিছুটা পরিস্কার হলাম।এই ম্যাপের খোজেই এসেছিল ।কিন্তু না পেয়ে সে চিরকুট রেখে যায় । গুপ্তধনের ব্যাপার জরিত মনে হয় এর সাথে । কিন্তু একটা ব্যাপার ক্লিয়ার হচ্ছে না।গুপ্তধনের জন্য কেউ এভাবে মরিয়া হয়ে উঠে নাতো । অন্য কোন ব্যাপারও আছে এর সাথে । সেই ব্যাপারটা কি বের করতে হবে। আপাততো ম্যাপের দেখানো জায়গা ,একবার দেখে আসতে হবে। দক্ষিন পাড়া থেকে শুরু ম্যাপ। রিজভি আহমেদ মারা যাওয়ার আগে এখানে এসেছিলেন। ম্যাপের দেখানো মত দক্ষিন দিকে গেলার । প্রায় পাচ কিমি পাহাড়ি এবড়ো থেবড়ো রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসলাম। একটা মাউন্টেন বাইক হলে ভালো হত। সহজেই পারি দেয়া যেত। এর পর আসলে বাইক নিয়ে আসা লাগবে।
ম্যাপটা শেষ হল সাগরের তীরে এসে।এদিক দিয়ে দক্ষিন পূর্বে সাগরের মধ্যেই আছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সাগরের এই সাইডের তীরে খুব একটা লোক আসে না। পাহাড়ী লোকজন আসে ।জংলায় ঢাকা তীর। কিন্তু সৌন্দর্য্য উপচে পরছে ,বুনো সৌন্দর্য্য । ঘড়ির দিকে খেয়াল করলাম সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। একটু পরেই অন্ধকার নামল। বড় চাঁদের আলোয় ভালই পথ দেখা যাচ্ছে। চার দিকের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছি। তাছাড়া রাতে এখানকার মোটা মোটি একটা ম্যাপ মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে যাওয়াই নিরাপদ বেশি। দিনে টিকিটিকির ভয় থাকে। বলা তো যায় না। টিকটিকি ফলো করতে করতে এখানে ও এসে পড়েছে কিনা।তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ঝোপ ঝাড়ের মধ্যে কেউ লুকিয়ে আমার উপর চোখ রাখছে । কিন্তু ব্যাক্তিটা কে বোঝা যাচ্ছে না। আমি তার উপস্থিতি না বোঝার ভান করে প্রায় আধা কিমি দূরে একটা বাঁক ঘুরে এলাম। উদ্দেশ্য অনুসরন কারির পিছন দিক দিয়ে উঠবো গিয়ে। এমন সময় ঝোপের মধ্যে একটা মাউন্টেন বাইক দেখতে পেলাম। দুষ্ট বুদ্ধি এল মাথায় । বাইক টা শুকনো বালিতে তিন চার ইঞ্চি ডেবে গেছে । আমি সেটাকে টেনে তীরের হাটু পানিতে নিয়ে রেখে দিলাম।উদেশ্য সাইলেন্সার আর স্পার্ক প্লাগে পানি ঢুকুক। স্টার্ট না দিতে পেরে যে ঝামেলায় পরবে ব্যাটা, সেটা মনে মনে চিন্তা করেই সুখ অনুভব করতে লাগলাম। অনুসরন কারীর পিছনে যাওয়ার সীদ্ধান্ত বাদ দিলাম। চলে এলাম কটেজে । গোসল করে ঘুম দিলাম ।সেই ঘুম ভাংল পরদিন আঁটটায় । কটেজের লোকেশনটা অনেক সুন্দর । পাহাড়ের উপরে। ছন আর পাহাড়ি গাছ গাছলা দিয়ে বানানো ঘরটা। কটেজ না বলে বাড়ি বলাই ভালো। ।কারন এর একপাশে এক চাকমা দম্পতি সপরিবারে থাকে। মাঝে মধ্যে টুরিষ্ট আসে । সেটা তাদের বাড়তি ইনকামের একটা পথ।খুব বেশি আসে না টুরিষ্ট এদিকে।প্রকৃ্তি প্রেমি কিছু লোক আসে মাঝে মধ্যে । পাহারী গুল্মের চা খাচ্ছি কটেজের সামনে ফাকা জায়গায় বসে । এমন সময় এক সুন্দরীর আগমন । এই সেই মেয়ে যে আমাকে ফলো করেছিল । ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম। মৃদু হাসি দিয়ে বলল
-বসতে বলবেন না ?
-হ্যা অবশ্যই ।
একটা চেয়ার টেনে নিল সে নিজেই।
-আমি নায়রা
-ইশান
- আপনার নাম আমি জানি।
- হুম সেটা স্বাভাবিক। যেভাবে টিকটিকির মত পিছু নিয়েছিলেন। না জেনে শুনে তো নেননি । তবে আমি আপনার নাম টিকটিকি রেখেছিলাম। পাকাপাকি ভাবে না অবশ্য। এখন যেহেতু নাম জানলাম।আগেরটা বাদ।
মৃদু হাসলো নায়রা ।
- আপনি ভালই রসিকতা জানেন ।
- আমার এক বন্ধুর থেকে শেখা ।
- হুম,গুড ।
- তো আমার কাছে নিশচই মজার কথা শুনতে আসেননি ?
- নাহ, সেটা আসিনি।
-তাহলে কেন এসেছেন?
- নাম তো আগেই বলেছি। আমি ইন্ডিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এখন নিউ ইয়র্ক টাইমস এ জার্নালিষ্ট হিসেবে কর্মরত আছি । পূর্ব পুরুষ সবাই ইন্ডিয়াতে বসবাস করেছে। তবে ১৫০০ শতকের দিকে আমাদের এক পূর্ব পুরুষ নাকি মিশর থেকে এদেশে এসেছিল।চিটাগংয়ের কোথাও সে থাকত।
- এত বছর পরে পূর্ব পুরুষের খোজ নিচ্ছেন কেন ? তাও আবার দস্যু ছিলেন যতটুকু জানি ইগনাসিও । এরকম মানুষকে তো মানুষ পরিচয় দেয়া থেকে বিরত থাকে। গুপ্তধন রেখে গিয়েছিলেন নাকি তিনি কোন ? হরিলুটের মাল।
নায়রার মুখ লাল হয়ে গেল, পূর্ব পুরুষের কুকর্ম তাকে লজ্জিত করছে। এভাবে একজন ভদ্রমহিলাকে কথা বলা উচিত হয়নি আমার ।সামলে নিল সে।আবার বলা শুরু করলো
- নাহ , এটার জন্য না। আমি যতটুকু জেনেছি ইগনাসিও কালো যাদু বিদ্যার চর্চা করতেন। এক সময় সিদ্ধিও লাভ করেন । তিনি মারা যাওয়ার আগে তার অর্জিত সকল বিদ্যা লিপিবদ্ধ করে যান। সেখানে এমন সব যাদুর কথা আছে। যেগুলো খারাপ কারো হাতে গেলে মানুষের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে ।
- ইন্টারেস্টিং লাগছে আপনার কথা গুলো । আর আপনিই যে ভালো মানুষ সেটার প্রমান কি ? বইটা আপনার হাতে গেলেও যে মিস ইউজ হবে না তার গ্যারান্টি কি ?
- আমি তো বলি নাই আমার হাতেই আসা লাগবে । আমি চাই এটার কোন মিস ইউজ যাতে না হয় । আর আপনাকে এত দিন ফলো করে যা মনে হল আপনি ভালো লোক। বিশ্বাস করা যায় ।
- আর আপনি যে গল্প শুনালেন সেটাই বা কত টুকু বিশ্বাস যোগ্য ??!! এমন হতে পারে না যে গুপ্ত ধনের জন্যই আপনি পিছু নিয়েছেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনের জন্য বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলেছেন ?
- স্বপ্নের মেয়েটা অনেক সুন্দর তাই না ?লুকিয়ে লুকিয়ে গোসল করার দৃশ্য দেখেন আবার ।
বলেই রহস্যময় হাসি দিল নায়রা ।
চমকে উঠলাম আমি ।।এই মেয়ে আমার স্বপ্নের কথা জানলো কিভাবে ?! আমি তো কাউকে বলি নাই । এমন কি নয়নকে ও না। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- আপনি কিভাবে জানলেন স্বপ্নের কথা ?
- একদিনে সব বলে দিলে শেষ হয়ে যাবে । আরেকদিন বলব। আর হ্যা গত কাল বাইকটা আপনি পানিতে নিয়ে ফেলেছিলেন তাই না ?
- হুম।
- কি যে কষ্ট হয়েছে ওটাকে স্টার্ট দিতে ।
লজ্জা পেলাম অনেক। এমন একটা কাজের জন্য । তাকে সরি বলব। এমন সময় দেখি সে উঠে চলে যাচ্ছে । আমাকে কিছু বলার সুজোগ না দিয়েই। আমি রহস্যময়ী নায়রার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম...
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪০