গল্পঃ রোদেপোড়া মুখ!
স্কুল থেকে যখন বাসায় ফিরলাম, আমার পুরো মুখটা তখন লাল হয়ে আছে! রক্তের মতো লাল!
টকটকে!
ভালো করে দেখে নিলাম কেউ আছে কি না আশেপাশে!
এরপর টুক করে লুকিয়ে রুমে ঢুকে পড়লাম। দরজা আটকাতেই দেখি আম্মু আমার পড়ার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
আর যাই কোথায়? পালাবার রাস্তা মাত্রই নিজ হাতে বন্ধ করলাম। এখন উপায় একটাই!
রুমের এদিক-সেদিকে দৌড়াদৌড়ি করা। আর আম্মু যখনই মারতে আসবে, আগেই কান্না করে দিয়ে মাফ চাওয়া।
"আম্মু সরি। আর হবে না। প্লিজ। মাফ করে দেন এবার। আর দেরী করবো না। আম্মু, মারবেন না। আমি আর খেলবো না। আর না। কখনো। মারবেন না আপনি।" এভাবে কাকুতি মিনতি করছিলাম মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু প্রতিদিন কি আর এক ট্রিক্স কাজে দেয়? রেগেমেগে আগুন হয়ে থাকা আম্মুকে ওসময়ে ঠান্ডা করে কে! দুই চারটা লাঠি আর খুন্তির বাড়ি খেতেই হয়। কোনটা হতের তালুতে। আবার কোনটা হাত সরিয়ে নেবার সময় আঙুলের নরম হাড়ে।
এরপর সবকিছুই ঠান্ডা হয় একসময়।
আম্মুও পরম মমতা নিয়ে আমার হাতের আঙুলে মলম লাগিয়ে দিয়ে যান। সেই মলমে আমার ব্যাথা কমে, কিন্তু হাত মুঠো করার শক্তি পাই না।
পরদিন স্কুল শেষে আবার সব কিছু ভুলে যাওয়া!
সবাই যখনই আমাকে দেখে খেলতে ডাক দিতো, বাড়ির রাস্তা ফেলে মাঠের দিকে দৌড়। তারপর ব্যাথা আঙুল নিয়ে ঠিকভাবে মুঠো করতে না পারা হাতটা দিয়ে ব্যাটের গ্রিপ কোনমতে ধরে আবার ইচ্ছেমতো ক্রিকেট খেলা। কবজির মোচড়ে একের পর এক ফ্লিক আর পাওয়ারফুল ড্রাইভশটে রান বের করে আনি দলের জন্য। কখনো স্কয়ার কাট, আবার কখনো হাঁটুগেড়ে সুইপ-রিভার্স সুইপ শটে ফিল্ডারদের নাকানিচুবানি খাওয়ানো।
বল ঠিকমতো ধরতে না পেরেও সর্বচেষ্টা দিয়ে স্পিন করিয়ে ব্যাটসম্যানকে পরাস্ত করা।সাথে দুর্দান্ত ফিল্ডিং!
রোদে খেলে যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন আবার আম্মুর হাতে মার আর আব্বুর কাছে বকা খাওয়া অবধারিত ছিলো। ছোটবেলা থেকে একটু ফর্সা হওয়ায় রোদে কিছুক্ষণ থাকলেই লাল হয়ে যেতো মুখ। এটাই হয়ে দাঁড়ালো আমার কাল। চাইলেও মিথ্যা বলে বাঁচতে পারতাম না।
একদিন আম্মু বাসায় ঢুকতে দিলো না। আমি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। মধ্যদুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করতে থাকা এলাকার মানুষরা আড়চোখে আমায় দেখতে থাকে। আর আমার লজ্জা, বিরক্তি বাড়তে থাকে। তবুও ঢুকতে দেয় না। বিকেলে আম্মু পাশের বাসার আন্টিদের সাথে গল্প করতে বের হয়।
আমার সামনে দিয়েই হেঁটে যায়।
অথচ আমাকে যেন চেনেই না। তাকায়ও না একটাবার!
সন্ধ্যা নামতে শুরু করলো, মাগরিবের আজানও দিবে হয়তো একটুপর। সে আজান শুনে আম্মু বাসাতেই যাবে নামাজ পড়তে। তখনো মনে হয়, আমার সাথে কথা বলবে না। না চেনার ভান করে থাকবে।
আমার মাথায় জিদ উঠে গেলো।
আমি বাসার সামনে থেকে চলে আসলাম। যাবোই না আর বাসায়!। যা ইচ্ছা করুক!
এরপর যতোই আফসোস করুক আর খুঁজে পাবে না আমাকে। ভালো হবে তখন! একটু নাহয় ক্রিকেটই খেলি। খেললে কি কেউ খারাপ হয়ে যায়? আমার ভালো লাগে খেলতে। আমার ভালো লাগার কি কোন দাম নেই? দিতে হবে না দাম।
হাঁটতে থাকলাম রাস্তা ধরে।
কাঁধে স্কুলব্যাগ। পরনে স্কুলড্রেস আর জুতো। সারাদিন বিশ্রাম নিতে না পারার কারণে আমার শরীর ক্লান্ত থাকার কথা। কিন্তু তবুও আমি হেঁটে যাচ্ছি। একমাত্র জিদের কারণে।
আমাদের বাসা থেকে একটু হেঁটে সামনে গেলেই হাইওয়ে। আমি সেই হাইওয়ে ধরে হাঁটতে লাগলাম। সন্ধ্যার লাল আভা আকাশ থেকে মুছে আস্তে আস্তে অন্ধকার নামলো। তারপর আকাশে চাঁদও উঠলো। আমার হাঁটতে কোন সমস্যাই হচ্ছিলো না। কিছুক্ষণ পরপর বিকট শব্দের হর্ন আর প্রচন্ড উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাধিয়ে যাওয়ায় বুঝছিলাম যে গাড়ি আসছে।
হাইওয়ে সাধারণত একটু জনমানবহীন এলাকা দিয়ে হয়। বিশাল আকৃতির মাঠের বুক চিরে পিচঢালা রাস্তা! আবার কখনো ছোটখাট খালের উপর দিয়ে বানানো পুল পেরিয়ে যেতে হয়।
উজ্জ্বল চাঁদের আলো।
প্রচন্ড বাতাস।
আর জ্যোৎস্নায় আলোকিত হওয়া চারপাশের অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশ। হাঁটতে হাঁটতে একসময় বাড়ির কথা ভুলেই গেলাম এগুলোর কারণে।
কতোক্ষণ এভাবে পাগলের মতো হেঁটেছি, মনে নেই। একটা সময় পা ব্যাথা করতে লাগলো। অনেক পথ হেঁঁটে এসেছি। এদিকটা একদম নির্জন! দুরপাল্লার যানবাহ্ন ছাড়া কিছুই চলে না এপথে। তাও যায় অনেক সময় পরপর।
আকাশের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে রাত গভীর হচ্ছে। আর না পেরে রাস্তার পাশেই বসতে হলো। ধানক্ষেত এটা। বেশ দূরে একটা মাচার মতো দেখা যাচ্ছিলো। একটু এগিয়ে ওখানে যেয়ে বসলাম।
তখনই হাউমাউ করে কান্না এলো। এই অবস্থায় কীভাবে বাড়ি যাবো, আশেপাশে বাড়িঘরও নেই। আক্ষরিক অর্থেই খালি একটা জায়গা। পা এতোটা ব্যাথা!
শরীর এতোটা ক্লান্ত!
এতো দুরের পথ ফেরবার মতো ক্ষমতা নেই আমার।
আম্মুর মুখটাই তখন মনে পরছিলো বেশী। আম্মু নাহয় একটু রাগ করেই আমাকে বাসায় ঢুকতে দেয় নি, কথা বলে নি। তাই বলে আমি এতো জিদ ধরে চলে আসবো? নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিলো তখন প্রচন্ড।
আমি নিজেই তো আম্মুর কথা মানি না। আবার তার উপরেই রাগ করি।
বেশীক্ষণ ভাবতে পারি নি। সারাদিন কিছুই না খাওয়া, তারপর এসবের পর শরীর আর পারছিলো না। ওখানেই ঘুমিয়ে পড়লাম। আসলে ঘুম চলে আসলো। আটকাতে পারি নি।
সূর্যের আলো যখন আমার চোখে এসে পড়লো, ঘুমটা তখন ভাঙলো! চোখ মেলে দেখি, সূর্য উঠছে। আকাশটা সম্পূর্ণ লাল হয়ে গেছে। লাল সেই রঙ ছড়িয়ে পড়েছে শিশির ভেজা ধানক্ষেতেও। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। শিশির পড়ে আমার কাপড়,ব্যাগও ভিজে গেছে। এই প্রথম বাড়ির বাইরে আম্মুকে ছাড়া রাত কাটালাম আমি।
আর দেরী করা যাবে না। বাসার দিকে রওনা দিলাম।
বাসায় যেয়ে দেখি হুলস্থুল কান্ড! আম্মু বিছানায়। মাথায় পানি ঢালছে খালামণি। আব্বু সারারাত বাইরে, আমাকে খুঁজেছে। আর কারো কথা নাই বলি! যখন বাসায় ঢুকলাম, আম্মু চিৎকার দিয়ে উঠহে আমাকে জড়িইয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। প্রচন্ড শক্ত করে দু'হাত দিয়ে আমাকে আকড়ে ধরে রেখেছিল। যেন আর ছুটে যেতে দেবে না কোথাও!
সেদিন!
সেই মুহূর্তে!
সে তখনই আমি প্রথম বুঝলাম, মায়ের ভালোবাসা কতোটা শক্তিশালী হয়!
এরপর আর কখনো অবাধ্য হতাম না তাদের। আমাকেও আর রাগ করতো না। মাসখানেক খেলা বন্ধ ছিলো। আমিই যেতাম না আর।
তারপর একদিন আব্বু ডেকে আমাকে বললো, "তোর কি ক্রিকেট খুব ভালো লাগে?"
কিছু বলছিলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কয়েক সেকেন্ড পর উত্তর দিলাম, "আগে লাগতো। এখন আর লাগে না।"
"ভালো লাগে কি কখনো এতো দ্রুত হারায়? মিথ্যে বলিস কেন? তুই পরশুও তো মাঠে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলতে গিয়েছিলি। তাহলে?"
অনেকদিন পর সেদিন একটু খেলতে গিয়েছিলাম। সত্যিই! আব্বু জেনে ফেলবে এতো তাড়াতাড়ি ভাবি নি। উত্তর না দিয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম।
"ক্রিকেটার হতে পারবি? অনেক বড়? সবাই তোর খেলা দেখে একনামে চিনবে। হতে পারবি এরকম?"
আমি তবুও নিশ্চুপ!
"এদিকে আয় তো!"
এগিয়ে গেলাম!
আব্বু পিছনে লুকিয়ে রাখা একটা ব্যাগকে সামনে আনলেন। এরপর ভিতর থেকে প্লাস্টিকের আবরণে মোড়ানো, স্টিকার লাগানো দারুণ সুন্দর এক ব্যাট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, "এই নে। জন্মদিনের উপহার এটা। ক্রিকেটের জন্য মন খারাপ করে থাকতে থাকতে ভুলেই গেছিস আজ তোর জন্মদিন!"
প্রচন্ড খুশিতে যেমন লাফ দিয়েও উঠলাম, তেন্মনি লাফ দেবার পর আবেগে চোখে পানি চলে। মিষ্টি অশ্রু!
আমার জীবনের প্রথম ক্রিকেট ব্যাট ছিলো সেটা। অনেক পছন্দের অনেক প্রিয় একটা ব্যাট।
***
ড্রেসিংরুমে বসে একমনে পুরোনো কথাগুলো ভাবছি। আমার ছেলেবেলার কথাগুলো! আম্মু-আব্বুর সেই চাওয়া পূরণ হবে কিনা কে জানে!
তবে এগিয়েছি অনেকটা!
মাথায় হেলমেট!
হাতে গ্লাভস!
পায়ে কেডস আর সবুজ প্যাড!
আর গায়ে জার্সি!
আমার বাংলাদেশের!
ক্যাপ্টেন ডেকে আজ সকালে মাথায় ক্যাপ পরিয়ে দিলো। ছোটমানুষ বলে ক্যাপটাও ছোট। কেমন জানি টাইট লাগছিলো!
এরপর থেকেই আমি খানিকটা নস্টালজিক হয়ে একা একা থাকছি। ভাবছিলাম আম্মুর মুখটা। টিভিতে আমাকে দেখাবে নিশ্চই? নিজের ছেলেকে পর্দায় দেখে সেদিন রাত্রে দেয়া কষ্টটার জন্য আমাকে মাফ করে দিবেন নিশ্চয়! যতোটা বড়ই হই না কেন! তাদের কিছু আজীবন ছোট!
টস হয়ে গেছে।
কোচ রেডি হতে বলেছেন। আমরা টসে জিতেছি। আর আমাকে ওপেন করতে হবে।
ব্যাট হাতে বাউন্ডারি রোপের ভিতরে পা দিলাম। মানুষের প্রচন্ড গর্জনে কেমন জানি লাগছিলো। মনে হচ্ছে কাঁপছি!
আর চোখেও পানি এসে দৃষ্টি ঘোলা করে দিচ্ছে। প্রথম ব্যাটটা যখন উপহার পেয়েছিলাম, ঠিক তখনের মতো!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:১৭