গোয়াইনঘাটের আবহাওয়ার সাথে আসাদ এখনও খাঁপ খাওয়াতে পারেনি। হুটহাট করে বৃষ্টি নামে। বিকেলে থেকে একটানা বৃষ্টি। মুষল ধারে বৃষ্টি। অথচ প্রতিদিনের মত আজ আসাদের ছাব্বিশ বছরের জন্মদিনটিও শুরু হয়েছে বিরক্তিকর ভাবে। সিলেট গোয়াইনঘাটের শ্যাওলা ধরা এক পুরোনো বাড়ির দোতলায় সকাল আটটায় তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে হঠাৎ। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বেশ গরম পড়ছিল। জানালার বাহিরে প্রখর রোদ্রুত্তাপ। আষাঢ় মাস, বৃষ্টির বদলে রোদ ঝরছিল এটা মেনে নেয়া যায় না। তীব্র গরম উপেক্ষা করে শুয়ে থাকা রীতিমত যুদ্ধের মত মনে হচ্ছিল। আসাদের ভিতর বাস করে একটা গেঁয়ো প্রকৃতি। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোজকার মত নিজেকে সুদর্শন ভাবে সাজিয়ে আসাদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে তখন।
বাহিরে এখন বৃষ্টি। খানিক আগে সন্ধ্যা নেমেছে। আসাদ আটকা পড়েছে অফিসে। সাথে আশরাফ সাহেব থাকায় সুবিধে হয়েছে। গল্প করে সময়টা পার করে দেয়া যাবে। আশরাফ সাহেব তাদের এনজিওতে কমুনিটি ফ্যাসিলেটরের দায়িত্বে রয়েছেন। আসাদ হিসাব রক্ষকের। আশরাফ সাহেব পরহেজগার মানুষ। গায়ের রঙ কালো। রোগা পাতলা দেহে লম্বা দাড়ি। যুদ্ধের সময় আশরাফ সাহেবের বয়স ছিলো তেরো। অফিসে এক মাত্র ব্যক্তি যার সাথে আসাদ প্রাণ খুলে কথা বলে। এবং এর বেশির ভাগ কথাই ইশ্বর কেন্দ্রিক। আসাদ জানলা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। জানালার ধারে কেয়া পাতা। কেয়া পাতা বেয়ে বৃষ্টি ঝরার দৃশ্যটি মনকাড়া। আসাদ বলল, আচ্ছা আশরাফ সাহেব, আপনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আপনার কেমন লেগেছে?
কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়, শুধু বোঝানো যায় না কতটা ক্ষত পুষে বেঁচে থাকতে হয়। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আশরাফ সাহেব নিচু স্বরে বলল, মৃত্যু এক অনিবার্য নিয়তি আসাদ। পনেরো বছরের সংসারে কোন দিন আমার কাছে তেমন কিছু চায় নি রেবেকা। আমারো দেয়ার সাধ্যও ছিলোনা। পঁচানব্বই সালের এক রবিবার সকালে রেবেকা বায়না ধরলো সে সিনেমা দেখবে। আমি নামাজ কালাম পড়ি। এই বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি নি সেদিন। মুখের ওপর না করে দিয়েছি। সন্ধ্যায় রেবেকার বুক ব্যথা উঠে। প্রায়ই এমন উঠত। সেদিন ঘরে চালও ছিল না। রাতে রান্না হয় নি। রেবেকা-আমি কেউই ভাত খাই নি সে রাতে । রেবেকার বুকের ব্যথা কে আমি তেমন গুরুত্ব দিলাম না। নামাজ পড়ে শুয়ে পড়লাম। মাঝ রাতে রেবেকা মারা গেলো ঘুমের ভেতর। এইটুকু বলে আশরাফ সাহেব থামলেন।
যেন সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে। কিছুক্ষণ থেমে তারপর বলল, পরের দিন আমি একা একা সিনেমা দেখলাম। সিনেমার নাম ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। আমাদের কোন সন্তান ছিলো না। রেবেকার হয়তো এই জন্যই বুকের ব্যথা উঠত। এখন আমারো বুকের ব্যথা উঠে, সেদিন রেবেকাকে সিনেমা না দেখাতে পারার ব্যথা, সেরাতে ভাত না খাওয়াতে পারার ব্যথা।
আশরাফ সাহেবের চোখ ছলছল করছে। আসাদ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। সান্ত্বনা দিতে পারার ক্ষমতা পৃথিবীর কারোরই নেই, মানুষ শুধু নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। জানলায় এখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ঘন অন্ধকার। আশরাফ সাহেব কে বিদায় জানিয়ে আসাদ গোয়াইনঘাটের দিকে হাঁটা দিলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি চারপাশে একধরনের বিমর্ষ ভাব তৈরি করে রেখেছে। গত এক যুগের বেশি হলো আসাদ ছাতা ব্যবহার করে না। নিজেকেই টেনে নিতে পারে না যে পুরুষ, ছাতা তার কাছে বোঝা মনে হওয়া দোষের কিছু নয়। স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ল আসাদের। আসাদ তখন দশম শ্রেণির শেষ বেঞ্চের ছাত্র। আকাশে কাল বৈশাখি মেঘের ভিড় জমেছিল সেদিন। ঠাকুড়হাঁট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাজি নাদেরুজ্জামান ক্লাসে এসে ছুটি দিয়ে দিলো।
আসাদ বই গুলোকে পলিথিনে মুড়িয়ে শার্টের নিচে ডুকালো। ঠিক তখনই বৃষ্টি এলো, উথাল পাথাল বৃষ্টি। সবাই ছুটোছুটি করে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। কালো রাস্তা ধরে সবাই যখন এগুচ্ছে। সহপাঠি ববি তখন আসাদ কে পেছন থেকে নাম ধরে ডাকলো। বলল, ভিজে গেলিতো, আমার ছাতার নিচে আয় নয়তো ঠান্ডা বাধাবি।
আসাদ হেসে বলল, ভিজলে বৃষ্টির কথা বুঝতে পারা যায় আর ব্যাঙের কখনো সর্দি হয় না। কি যেন ভেবে ববি তার হাতের ছাতা গুটিয়ে নেয়, ব্যাগ কাধে নিয়ে ভিজতে ভিজতে আসাদের পাশাপাশি হাঁটা শুরু করে। সেই একটি মুহূর্তের জন্য ববি মেয়েটা আসাদের হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো। এরপর ঠাকুরহাঁট কলেজে এক সাথে কত আড্ডা হয়েছে তাদের তার হিসেব নেই। আজ ববিও নেই। মেয়েটা মারা যাবার পর থেকে সেই সিলিঙ ফ্যানটির শব্দ শুনতে ইচ্ছে করে আসাদের। যেই সিলিঙ ফ্যানে ববি তার ওড়না পেঁচিয়েছে। যেই সিলিঙ ফ্যান দেখেছে, একটি আস্ত দেহে মরছে পড়ে যেতে। দেখেছে ঈশ্বরও কখনো কখনো নিষ্ঠুরতার সীমা অতিক্রম করেন।
ভাবতে ভাবতে আসাদ গোয়াইন নদীর তীরে মামুনের চা দোকানে এসে পৌঁছায়। জনশূন্য দোকানে শুকনো মুখে মামুন বিক্রেতার চেয়ারে বসে আছে। আসাদ আবার মুখোমুখি হয় তার দীর্ঘশ্বাস ভরা স্মৃতির বেড়াজালে। মামুন নামের এই ছেলেটা আসাদের বন্ধু মুরাদের মত অবিকল দেখতে। কথার ধরণ,গায়ের রঙ কোন কিছুতেই খুঁত নেই একটুও, অবিকল যেন মুরাদ। মুরাদ আসাদের বন্ধু মহলে সবচাইতে নির্লিপ্ত একজন ছিলো। দুঃখ বলতে যার কাছে ছিল ক্রিকেট খেলায় হেরে যাওয়া। কলেজ শেষ করে সংসারের হাল ধরতে মুরাদ বিলেত যায়। বিভুঁইতে আত্মহত্যার দিন চারেক আগে, রাত দুটায় আসাদের মুঠোফোনে কল দেয় মুরাদ। মিনিট দুয়েকের কথায় মুরাদ শুধু বলে, ভালো নেই, তোর কথা বল? আসাদের কানে আজো সেই একটি কথা বেহালার সুরে সুরে কে যেন বলে উঠে ‘ভালো নেই, তোর কথা বল!’ পোস্টমর্টেমে মুরাদের দেহে কোন হৃদয় পাওয়া যায় নি। নয়তো আসাদ হৃদয় খুঁড়ে দেখতো, কি সে ব্যথা! মুরাদ জানে না, ব্যথার মৃত্যু নেই। নিজের অজান্তেই এক আজন্ম ব্যথা সে ছড়িয়ে দিয়েছে আসাদের হৃদয়ে।
মামুন কোন এক অজানা কারণে আসাদকে খুব পছন্দ করে। আসাদ চেয়ারে বসতেই চুপচাপ মামুন একটা আধা ময়লা গামছা এগিয়ে দিয়ে গেল। ছোট্ট একটা চা দোকান মামুনের। ক্যাশ বাক্সের টেবিলটায় বিস্কিটের পট গুলো সাজানো তার উপরে কলার কাঁদি আর রুটি ঝুলছে। মামুন এক কাপ চা আর বাটিতে করে দু পিস বিস্কিট দিয়ে গেল। আসাদ গামছা দিয়ে মাথা মুছে মামুনের দিকে তাকালো। মামুন মৃদু হেসে বুঝিয়ে দিলো সে ভালো আছে। আসাদ বলল,
– মামুন, আজকে আমার জন্মদিন। তোমার সাথে জন্মদিন পালন করতে চলে এলাম।
— আপনার জন্য দোয়া করি ভাই। শিঙ মাছের ঝোল দিয়ে আজ রাতে আমার সাথে ভাত খাবেন। বিথী খুব ভালো রান্না করতে জানে।
বিথী মামুনের স্ত্রী। দুজনের প্রেমের বিয়ে। তিন বছরের সংসার। বিথী কথা বলতে জানে না, বোবা। তেইশ বছর বয়েসে মামুন বিয়ে করে। মামুন একদিন তার প্রেমের গল্প শুনিয়েছিলো আসাদকে। প্রেমের গল্পে আসাদের তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু মামুনের প্রেমের গল্প আসাদের ভালো লেগেছে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে আসাদ সিগারেট জ্বালালো। চায়ে চুমুক দিয়ে গোয়াইন নদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। আসাদের গ্রামের নাম শিবপুর। চাটখিল থানার একটি চিরদুখি গ্রাম। যে গ্রামে কোন নদী নেই, বিস্তীর্ণ কোন সরিষার মাঠ নেই।
সন্ধ্যের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে আসাদের হঠাত মনটা কেমন যেন বদলে গেলো। বাহিরে আষাঢ়ের এক আকাশ কালো করা সন্ধ্যা, এটি আর দশটি রবিবারের সন্ধ্যা গুলোর মত অনর্থক কোন সন্ধ্যা নয়। বেঁচে থাকার অনেক গুলো কারণ যখন বাকি ঠিক তখনই আসাদের মনে হলো আজ রাতে সে মারা যাবে, ঘুমের মধ্যে মারা যাবে। হঠাৎ করে নির্ভেজাল এক ভালো লাগা এসে ভিড় করল তার মনে। কাক কালো মেঘ আকাশে। আকাশ বোধহয় আগামী বরষায় যে মেঘ গুলো বৃষ্টি দিবে, সেই মেঘেদের ভাড়া করেছে। হঠাৎ করেই সন্ধ্যে টা মধ্যরাতের মত শুনশান হয়ে পড়ল। ভারি ভারি বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু হয়েছে। মামুন এসে বলল,
– ভাই চলেন, বাসায় চলে যাই। কাস্টমার নাই, বৃষ্টিও বাড়তেছে।
আসাদ কিছু বলল না। তার ভয় করছে, মৃত্যু ভয়। সিগারেট ফেলে দোকান থেকে বের হলো আসাদ। গোয়াইন নদীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মামুনের দোকান বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনছে। মামুন বলল,
– চলেন ভাই। বিথী লাল চা বানাবে। ঠান্ডার মধ্যে লাল চা ভালো লাগে।
আসাদ হাঁটা শুরু করলো মামুনের পিছনে। আসাদের মনে হচ্ছে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মত তাকে এক অচেনা সুতোয় বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মামুন। মামুনের বাসায় আগে কখনো যায়নি আসাদ। মামুন পাহাড়ের একটি নির্জন টিলার পাশ দিয়ে হেঁটে একটি ছোট্ট উঠোনে নিয়ে এলো আসাদকে। উঠোন ঘেঁষে একটুখানি বারান্দা নিয়ে ছোট্ট একটা একচালা ঘর। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আছে পুরো উঠোন জুড়ে।মামুন আর আসাদ বারান্দায় এসে দাড়ালো। মামুন বলল,
– বিথী ফুল পছন্দ করে। হাসনাহেনা ফুল আর বকুলফুল। এই বলে মামুন দরজায় দাড়িয়ে টোকা দিয়ে ডাকলো,
– বিথী, বিথী। বৌ দরজা খোল।
আসাদ মুগ্ধ হলো। কি আদর করে ডাকছে মামুন। আপনজনকে হৃদয় থেকে ডাকতে পারার এমন সৌভাগ্যও অনেকের হয় না। দরজার ওপাশ থেকে প্রতিউত্তর আসবে না যেনেও মামুন ডাকছে বিথীকে। হালকা শব্দ করে দরজা খুলে গেলো। কুপি হাতে হাসি হাসি মুখ করে বিথী দাড়িয়ে আছে। কুপির আলোয় বিথীর ফর্সা গালে এক অন্যরকম লাল আভা তৈরী হলো। আসাদ নিজের ভেতরে একটা ধাক্কা খেলো। আপনজন বিয়োগেও মানুষের ভিতরে এতটা ধাক্কা লাগেনা। আসাদ দেখলো আকাশি রঙের একটি জামা পরে, কুপি হাতে বিথী নামের যে সুন্দর মেয়েটি দাড়িয়ে আছে, সে ববি। আসাদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস আসছে নাকে। মামুন বলল,
– উনার নাম আসাদ, আসাদ ভাই। আজ উনার জন্মদিন। আমাদের সাথে রাতে খাবে।
বিথী মলিন মুখে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বহুদিনের অদেখা প্রিয় মানুষের দিকে মানুষ যে ভাবে তাকায়, সহস্র শব্দ ভিতরে জমে থাকার মত করে বিথী তাকিয়ে আছে। বিথীর ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে আসাদের সম্বিত ফিরে। মামুন বলে উঠল,
– ভাই ভিতরে চলুন।
ভাসা ভাসা সে শব্দগুলোর উত্তরে বিথীর দিকে তাকিয়ে আসাদ বলল,
— নাহ মামুন, আজ যাই। কিছু কাজ পড়ে আছে।
এই বলে আসাদ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে উঠোনে নেমে এলো। হাসনাহেনা ফুলের সুবাসে ভরা উঠোনে। পিছনে অজস্র মৃত্যুকে রেখে, সিগারেট জ্বালিয়ে এক অনাগত মৃত্যুর দিকে হেঁটে চলল আসাদ। মনে পড়ে গেলো আশরাফ সাহেবের স্ত্রী রেবেকার কথা। পঁচানব্বই এর এক রবিবার মধ্যরাতে রেবেকা মারা গিয়েছিলো। তেমনি এক রবিবার সন্ধ্যায় হেঁটে হেঁটে আসাদ মধ্যরাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ২:৫৬