somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এডগার এলান পো' এর ছোটগল্প:: ''এ টেল অফ ragged মাউন্টেন"

৩১ শে মে, ২০১০ দুপুর ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সময়টা ছিল ১৮২৭ সালের শেষভাগ। ভার্জিনিয়ার চার্লোটেসভিল শহরে থাকি, এমন একটা অবস্থায় অগাস্টাস বেদলোর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ভদ্রলোক বয়সে তরুণ, এবং পুরোপুরি অন্যরকম স্বভাবের একজন মানুষ, যেজন্য সহজাতভাবেই তার সম্পর্কে আমার আগ্রহ আর কৌতূহল তৈরি হয়েছিল।
তার ব্যক্তিজীবন-আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে কোনকিছু অনুমান করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা, এমনকি তার পরিবার আছে কি নেই- সে সংক্রান্তও কোন সন্তোষজনক তথ্য আমার কাছে ছিলনা। সবচেয়ে বড় কথা হল, এই যে আমি তাকে তরুণ বলছি, তবুও সংশয় রয়েই যাচ্ছে আদতেই সে তরুণ কিনা ; কারণ, দেখলে তাকে তরুণই মনে হত, কিন্তু তার তারুণ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলবার অবকাশ ছিল বইকি : মাঝে মাঝে তাকে ১০০ বছরের বৃদ্ধ ভাবতেও আমার বেগ পেতে হয়নি, বরং মনে হয়েছে এটাই উচিৎ ছিল।

বয়স নিয়ে এই যে সংশয়, এর পুরো দায়ভার তার কিম্ভুতকিমাকার চেহারার। একেতো রোগা- ঢিঙঢিঙে গড়ন, চওড়া-আনত কপাল, রক্তশূন্য মুখাবয়ব, তার উপর অধিকাংশ সময়ই সে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকত। তার চিবুকটা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড়, মুখের ভিতরে দাঁতের হিজিবিজি অবস্থা : চকচকে হলেও এমন এলেমেলো দাঁত আমি জীবনেও দেখিনি। হয়ত ভাবছেন, তার হাসিটা বদখত রকমের ছিল; না সেরকমটা ছিলনা, তবে সেই হাসিটাও কেমন যেন পানসে-একঘেয়ে। তাতে কোন আদি-অন্ত ছিলনা, সেই হাসিতে বরং অমোচনীয় বিষাদের একটা পরশ ছিল। তার চোখ দুটোও বড়বড় - অনেকটা বিড়ালের চোখের মত গোলগোল। চোখের তারা দুটোও বিড়ালগোত্রীয় প্রাণীদের মতই আলোর হ্রাস-বৃদ্ধিতে উঠা-নামা করত। আবেগ-উচ্ছাসে চোখের মণি দুটো যেভাবে জ্বলজ্বল করত, অমনটাও সচরাচর দেখেছি বলে মনে পড়েনা ; দেখে মনে হত আলো নিঃসরিত হচ্ছে, তবে সেটা প্রতিফলিত আলো নয়- মোম বা সূর্য থেকে যেমন আলো বের হয় তেমন। তবুও সেই আলো এতটাই স্থির আর বিবর্ণ ছিল যে, চোখটাকে কোন মৃতলাশের চোখ ভাবলে দোষ দেয়া যাবেনা।

এই উদ্ভটতা তার মাঝে প্রচুর বিরক্তিকর অভ্যাসের জন্ম দিয়েছিল, যাদের সে কখনো-সখনো প্রবোধ দিয়ে, বা অনেকটা মাফ চাওয়ার মানসিকতায় প্রতিনিয়ত সামাল দিয়ে যাচ্ছিল। আমি খুব দ্রুতই এরগুলোর সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, তাই অস্বস্তি কেটে গেল কয়েকদিনেই। আরও একটা বিষয় হল, তার শারীরীক গড়নটা একটু ভালমত খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এখন যেরকম লাগে চিরদিন সে তেমনটি ছিলনা। তার মানে, দীর্ঘদিন বাতরোগে ভুগে ভুগে তার চেহারা থেকে সৌন্দর্য তো হারিয়েছেই, তার জায়গা নিয়েছে এই অস্বাভাবিকতা। আর এমন একটা সময়েই আমাদের দেখা।

বেশ কয়েকবছর ধরেই একজন ডাক্তারের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ছিল সে। ডাক্তার ভদ্রলোকের নাম টেম্পলেটন - বয়স ৭০ এর আশেপাশে। সম্ভবত সারাগোটায় বেদলোর সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল, এবং তখন থেকেই তার চিকিৎসায় বেদলো আরাম বোধ করত, কিংবা না করলেও মনে মনে ভাবত আরাম পাচ্ছে, এমন। ফলে বেদলো তার সাথে একটা চুক্তি করে, যার শর্তানুসারে বেদলো তাকে একটা সম্মানজনক বাৎসরিক দেবে, বিনিময়ে সে তার সমস্ত চিকিৎসাজ্ঞান বেদলোকে সুস্থ করার কাজে লাগাবে।

ডাক্তার টেম্পলেটন যৌবনে শুধু দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এরপর প্যারিসে গিয়ে তার আমূল রূপান্তর ঘটে - তিনি মেসমার চিকিৎসা পদ্ধতি রপ্ত করেন। এটা বোধহয় একধরনের চৌম্বকীয় প্রতিষেধক ; বেদলোর তীব্র ঘাড়ব্যথার অনেকটাই এতে উপশম হয়েছিল, তার সাফল্যে বেদলোর আত্মবিশ্বাস চরমে পৌছেছিল- সে এটাকেই নিরাময় ভাবতে শুরু করেছিল। ডাক্তার সাহেবও, চিরাচরিত অত্যুৎসাহী মানুষদের মত, তার চোখের মণির সমস্যা ঠিক করতে আদাজল খেয়ে নামেন, বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি চালাতে চালাতে তিনি ফলাফলও পেয়েছিলেন; সেই পরীক্ষাটা এখন এত পরিচিত যে তা হয়ত আর কোন মনোযোগই আকর্ষণ করেনা, কিন্তু আমি যেসময়ের কথা বলছি, তখন সেই পরীক্ষাটা এমনকি আমেরিকাতেও বিরলপ্রায় ছিল। যে সহজ কথাটা বোঝাতে চাইছি তা হল, এই পরীক্ষার প্রভাবে ডাক্তার সাহেব আর বেদলোর মধ্যে একটা হিপনোটাইজিং সম্পর্ক গড়ে উঠছিল- চাইলে একে চৌম্বকীয় সম্পর্কও বলতে পারি। অবশ্য আমি কথাটাকে সংকীর্ণ করতে এটা বলবোনা যে, সম্পর্কটো শুধু বেদলোর ঘুম নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, উপরন্তু ক্ষমতাটা চরম অবস্থা ধারণ করেছিল। এই যে আবেশ দিয়ে ঘুম পাড়ানোর প্রয়াস- শুরুতে তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল। ৫-৬বারের চেষ্টায় তিনি আংশিক সফল হন, তবে প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। এভাবে বারের বার বারোতম বারে তিনি মহাসাফল্য পান। এরপর থেকেই বেদলো খুব দ্রুত ডাক্তার সাহেবের বশীভূত হতে থাকে; সেটা এমন পর্যায়ে যে, আমি যখন দুজনের সাথে প্রথম পরিচিত হই, ঠিক সেই মুহূর্তেই বেদলো ঘুমিয়ে পড়েছিল স্রেফ ডাক্তারের ইচ্ছার জোরে। এমনকি ডাক্তার রুমেৱর বাইরে থেকে ইচ্ছা করলেও সে ঘুমিয়ে পড়ত। সত্যিই অবাক হবার মত ব্যাপার! তবে এই ১৮৪৫ সালে এসে নিয়মিত একই জাদু হাজারোবার দেখে দেখে এমন চোখ সওয়া হয়ে গেছে যে, এ ধরনের অলৌকিক ঘটনাকেও অবলীলায় লৌকিক হিসেবে চালিয়ে দিতে পারি।
বেদলোর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে সর্বোচ্চরকম সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিল, তার কল্পনাশক্তিও বাড়ছিল; সেই কল্পনাগুলোর অধিকাংশই সৃজনশীল। সন্দেহ নেই, মুড়ি-মুড়কির মত মরফিন আসক্তিই এই অতিরিক্ত প্রবণতাগুলোর যোগান দিচ্ছিল- একদিন
মরফিন না নিলে তার বাঁচা-ই দুরূহ হয়ে উঠেছিল। সাধারণত সকালের নাস্তার সময় অথবা নাস্তা শেষে এক কাপ কড়া কফি খেয়ে তার মরফিনের নেশা চাপত (সকাল আর দুপুরের মাঝের সময়টাতে সাধারণত সে কিছু খেতনা), এরপর সে হাটতে বেরোত; একাই হাটত অধিকাংশ দিন, দু-একদিন সঙ্গে কুকুর নিত। গন্তব্য হতে পারে চার্লোটেসভিলের দক্ষিণ-পশ্চিমের পরিত্যক্ত পাহাড় বা এর আশেপাশে।

নভেম্বরের শেষদিককার কথা। দিনটা ছিল হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন, গরমও পড়েছিল কিছুটা, অদ্ভুত একটা সিজন চলছিল। এই সিজনটাকে আমেরিকানরা বলে ইন্ডিয়ান সামার। প্রতিদিনকার মত সেদিনও বেদলো পাহাড়ে হাটতে বেরিয়েছিল। সমস্ত দিন চলে গেল, কিন্তু সে আর ফিরলোনা।
রাত আটটার দিকে, ততক্ষণে তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সবাই চিন্তিত, আমরাও তার খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি, এমনসময় অপ্রত্যাশিতভাবে সে এসে উদয় হল। তার শরীর-স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন পরিবর্তন চোখে পড়লনা, তবে তাকে কিছুটা নিস্তেজ লাগছিল। কারণ হিসেবে সে যা যা বলল, আর যা শুনলাম, তাকে বোঝানোর জন্য একটা শব্দই যথেষ্ট: গাজাখুরি। তবুও তাকে অবিশ্বাসও করি কিভাবে!

‘একবার ভেবে দেখুন’ এটাই ছিল বেদলোর প্রথম কথা। এরপর চলতেই থাকল।

‘চার্লোটেসভিল থেকে নয়টা নাগাদ বেরিয়েছিলাম। শুরুতেই পাহাড়ে গেলাম; তখন আর কয়টা বাজে; এই বড়জোর ১০টার মত। একটা গুহার ভেতরে ঢুকে পড়লাম, কেন যেন গুহাটা এর আগে চোখেই পড়েনি। দেখে বেশ আগ্রহ জাগল; আমি গুহার ভেতরের পথের বাকধরে হাটতে লাগলাম। ভেতরে ঢুকে তো পুরো থ আমি! ভেতরের দৃশ্যটা যে কী সুন্দর ; আমি বলে বোঝাতে পারবোনা। আমার মনে হচ্ছিল এটা কোন বিষণ্ন মরুভূমি, সেখানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী নেই, তবুও নিঃসঙ্গতাকে আমার কুমারী মেয়ের মত লাগছিল। বিশ্বাস না করে পারলাম না, এই সবুজ ঘাসের চাপড়া আর ধূসর শিলার উপর আমিই প্রথম মানুষ হিসেব পা রেখেছি। বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এই জায়গাতে কোন ঝামেলা ছাড়াই পৌছিয়ে আমিই প্রথম মানুষ, নিভৃতির নাগাল পাওয়া প্রথম অভিযাত্রী’।
‘ঘন বেরসিক কুয়াশা, যা ইন্ডিয়ান সামারকে ইউনিক করেছে আর প্রায় সবকিছুর উপর জমে ভারী হয়ে থাকে. পরিবেশটাকে আরও অস্পষ্ট করে তুলল। ব্যক্তিগতভাবে কুয়াশাটাকে আমার তৃপ্তিকরই লাগল। যাহোক কুয়াশাটা এতই ঘন্ যে আমি আমার সামনের কয়েক গজ দূরত্বের জিনিসও দেখতে পাচ্ছিলাম না। পথটা আকাবাকা-সর্পিল, সূর্যও নেই সেখানে; তাই কোনদিক থেকে এসেছিলাম ভুলে গেলাম। ততক্ষণে মরফিনের নেশাও ধরে গেছে- ব্যস, বাইরের পৃথিবীর পৃথিবীর সবকিছুকে মায়ার জালে জড়ানো মনে হতে লাগল : পাতার কাপাকাপি, ঘাসের ডগার ফিসফাস, মৌমাছির গুনগুন, শিশিরপতনের টুপটাপ, বাতাসের নিঃশ্বাস ছাড়া- সবমিলিয়ে আমার কাছে এক অখণ্ড ব্রহ্মান্ডের নিদর্শন বলে মনে হল; যদিও জানি, এ এক প্রফুল্লতার আর ভাড়ামির মহাকাব্যিক-মহাকেলো ভাবনা’।
‘যা হয় হোক, ভেবে আমি হাটা ধরলাম; কয়েকঘন্টা হাটলামও। সেসময় কুয়াশা আরও ঘন হয়ে এসেছে- আমি অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম। ফলে এক না বলা অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরল- দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। আমি সামনে এগুতে ভয় পাচ্ছিলাম, পাছে অনেক নিচের অতলে হারিয়ে যাই, এই আশঙ্কায়। হাজারো অশুভ চিন্তা আমায় কুকড়ে দিচ্ছিল - ভুতুড়ে পাহাড়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শোনা গল্পগুলো মনে পড়তে লাগল, পাহাড়ে ঘাপটি মেরে থাকা জংলিদের ভয়ও ছিল ; চিন্তাগুলো যতটা অশুভ ততটাই অস্পষ্ট’।
‘আচমকাই ড্রামের উচ্চশব্দে আমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটল’।
‘আমার চমক তখন চরমে। এই পরিত্যক্ত পাহাড়ে বাদ্য-বাজনা আসবার প্রশ্নই আসেনা। এই পরিত্যক্ত-জীর্ণ পাহাড়ে আমি কোন দেবদূতের তূরীর শব্দ শুনলেও বোধহয় এতটা অবাক হতাম না। যাইহোক, শব্দোৎসব চললোই, সেইসাথে বাড়তে থাকল ঝামেলাও। একটা ঝুনঝুন শব্দ হতে লাগল, যেন একগোছা চাবির শব্দ; আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি এক কালো-আধ নেংটো লোক চিৎকার দিয়ে আমার পাশ দিয়ে দ্রুত দৌড়ে গেল। লোকটা আমার এতটাই কাছাকাছি চলে এসেছিল যে, তার গরম নিঃশ্বাসও আমার মুখে এসে লাগছিল। তার হাতে স্টিলের একটা রিঙের মত ছিল; সেটা ঘোরাতে ঘোরাতেই সে দৌড়াচ্ছিল। সে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ামাত্রই পিছু পিছু হা করে আর জ্বলন্ত চোখে আরও একটা বিশাল জন্তু এসে ঢুকল। আমার চোখ ভুল না করলে সেটা ছিল একটা হায়েনা।

‘এই ভয়াল জন্তু-দর্শন আমার ভয় বাড়িয়ে দেয়ার পরবির্তে স্বস্তি দিল, কারণ এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হলাম আমি আসলে স্বপ্ন দেখছি; নিজের চেতনা জাগাতে চেষ্টা করলাম। সাহস করে এগুলাম। চোখ ঘষলাম, চিৎকার করলাম, শরীরে চিমটি কাটলাম। ছোট্ট একটা পানির প্রবাহ দেখে আমি সামনের দিকে হেলে আমি মাথা-হাত-ঘাড় খুব ভালমত ধুয়ে ফেললাম। এতে করে এতক্ষণ পর্যন্ত যেসব ইন্দ্রিয়বিভ্রাট বিরক্ত করছিল, সেগুলো দূর হয়ে গেল। আমি জেগে উঠলাম, হাটতে শুরু করলাম নতুন মানুষ হিসেবে, অজা্না পথে’।

‘চেষ্টা-তদবির করে শেষমেষ বায়ুমন্ডলের দেখা পেলাম, হেটে হেটে একটা গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। আবছা সূর্যের আলো আর গাছের ছায়া ঘাসের শরীরে লুটোপুটি খেল। আমি সেই ছায়ার দিকে অনেকক্ষণ অবাক তাকিয়ে রইলাম। ছায়ার ধরনটা আমায় বাকরুদ্ধ করে দিল। উপরে তাকিয়ে দেখি এটা একটা তালগাছ’।
আমি কিছুটা ভয় নিয়েই উঠে দাঁড়ালাম, কারণ এতক্ষণ যে ভাবছিলাম আমি স্বপ্ন দেখছি, এই ভাবনাটা আমার কোন কাজেই আসবেনা। আমি দেখলাম, সেইসাথে অনুভবও করলাম, আমার সেন্স কাজ করছে; এই বোধটাই আমাকে একটা উপন্যাসের জগতে নিয়ে গেল। হঠাৎই তাপ অসহনীয় হয়ে উঠল, একটা উটকো গন্ধে বাতাস ভরে উঠল। একটা শান্ত, কিন্তু প্রবাহমান কলকল ধ্বনি, অনেকটা ধীরে বওয়া নদী থেকে উঠে আসার মত, কানে আসছিল। সেই কলকল ধ্বনি অসংখ্য মনুষ্যকণ্ঠের সাথে মিশে গিয়ে চাপা গুঞ্জনের মত শোনাচ্ছিল।
‘আমি যখন চূড়ান্ত বিস্ময়ে এই গুঞ্জন শুনছিলাম, সেসময় একটা সাময়িক দমকা হাওয়া বেয়াড়া কুয়াশাকে ঝেটিয়ে বিদায় দিল- ঠিক যেভাবে জাদুকর জাদুদন্ড ব্যবহার করে থাকে’।

‘কুয়াশা কেটে গেলে নিজেকে একটা উচু পাহাড়ের পাদদেশে আবিষ্কার করলাম। পাহাড় বরাবর সুবিস্তৃত সমতলে আমি তাকিয়ে থাকি, সেই সমতলে একেবেকে বইছে একটা রূপসী নদী। সেই নদীর ধারে একটা শহর; সাধারণত আরব্য রজনীতেই আমরা এ সমস্ত শহরের দেখা পাই, কিন্তু এই শহরটা আরব্য উপন্যাসের শহরকেও হার মানায়। আমি এর প্রতিটি প্রান্তকে উপলব্ধি করতে পারছিলাম, যেন ছোট্ট মানচিত্রে আস্ত শহরটা গায়েব হয়ে গেছে। এতবেশি রাস্তা- শেষই হচ্ছিলনা; একটা আরেকটাকে কিভাবে য অতিক্রম করেছে ঠাহর পাচ্ছিলাম না- উল্টেপাল্টে যাচ্ছিল সবকিছু। গলিগুলো শহুরে গলির চেয়েও চাপা, ঐটুকু গলিতে লোকে লোকারণ্য। রাস্তার পাশের ঘর-বাড়িগুলোকে মনে হচ্ছিল জীবন্ত ছবি। প্রায় সব বাড়িতেই বড় ব্যালকনি, সুন্দর সুন্দর সিড়ি, কোন কোনটাতে মিনার, দেয়ালে লাগোয়া জানালা- সত্যিই অদ্ভুত। রাস্তার পাশে বাজার; বাজারে জিনিসপত্রে ভরপুর – সিল্কের কাপড়, ছুরি-কাচি, দামী গহনা। এর বাইরেও জিনিসের কমতি নেই : ব্যানার, পালকি, হাতি-ঘোড়ার সাজসাজ রব, বাদ্য, পেটাঘড়ি, বর্শা, আর রূপার পারদ দেয়া গদা, এগুলোকেও বাদ রাখা যাবেনা। আর মানুষ তো ছিলই; পাগড়ি-আলখাল্লা পরা ঘন দাড়িওয়ালা কালো-হলুদ মানুষ, আর তাদের কোলাহল, এর ফাকে ফাকেও ছুটে বেড়াচ্ছিল ফিতে বাধা ষাড়, অন্যদিকে নেংটি ইদুর, যাদের দেখে নোংরা লাগলেও পবিত্রতার প্রতীক ভাবা হয়, সেগুলোও চিৎকার করছিল- মসজিদের কার্নিশে উঠে পড়ছিল , কোনটা আবার মিনারেও লেগে ছিল। এতসব পতঙ্গভর্তি রাস্তায় মানুষের দীর্ঘ লাইন, যার শেষ হয়েছে একেবারে নদীতীরে। সকলের একটিই উদ্দেশ্য- পুণ্যস্নান। নদীর মধ্য দিয়ে ভারী বোঝাইভর্তি জাহাজ চলাচল করছিল, ফলে জাহাজের খোলের সাথে নদীপৃষ্ঠের একটা বড় সংঘর্ষ হচ্ছিল। শহরের সীমানার বাইরে অসংখ্য তাল-নারিকেল গাছ, সাথে আরও অসংখ্য লম্বা-লম্বা বয়েসী গাছ। এখানে-ওখানে ধানক্ষেত, কৃষকের ছনের ঘর, বড় পুকুর, জিপসি ক্যাম্প, এর মাঝে কলসি মাথায় নদীতে পানি আনতে যাচ্ছে কোন বাড়ির চাকরানী, এমনই দেখছিলাম’।

‘আপনারা নিশ্চয়ই বলবেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি- কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি। যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা বুঝেছি- সবই সত্যি; এখানে স্বপ্নের কোন অবকাশই নেই। সবকিছুই প্রকটভাবে আত্মবিদারী। প্রথমে আমারও সন্দেহ হয়েছিল সত্যিই জেগে আছি কিনা, কিন্তু এরপরই অনেকগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হলাম আসলেই জেগে আছি। কেউ যখন স্বপ্ন দেখে, আর স্বপ্নের মধ্যেই সন্দেহ করে সে স্বপ্ন দেখছে, তখন সেটা আর স্বপ্ন থাকেনা; ঘুমন্ত মানুষটিও কিছুক্ষণের মধ্যে জেগে উঠে। নোভেলস ইরস তো আর এমনি এমনি বলেননি , ‘আমরা স্বপ্ন দেখছি, এটা স্বপ্ন দেখা মানে আসলে আমরা প্রায় জেগেই আছি’।
আমি যেমনটা বলেছি আমার চিন্তাগুলো সেভাবেই ঘটলে, মানে আমি স্বপ্ন দেখছি কিনা সন্দেহ না জাগলে, এটা হয়ত স্বপ্নই হত; কিন্তু সন্দেহ অনুযায়ীই সবকিছু হওয়ায় একে আমার অন্যরকম ভাবতে হলই।

‘সেক্ষেত্রে আমি বলব, আপনি বোধহয় ভুল করেছেন’ কথাটা বলে ডাক্তার টেম্পলেটন আলোচনায় ঢুকলেন, এবং নিজেই বাকিটা বললেন ‘তবুও বলতে থাকুন। এরপর আপনি উঠে দাঁড়ালেন, আর পাহাড়ের নিচের শহরে নামলেন; এমনটাই তো..’

ডাক্তারের কথা শুনে বেদলো রীতিমত চমকে উঠল, ‘আরে, আমি তো সত্যিই নেমে পড়েছিলাম’।
‘শহরে নেমে আমি জনসমুদ্রের মধ্যে পড়ে গেলাম। প্রায় প্রতিটি পথের বাকেই মানুষের ভীড়, সবাই একই দিকে জোর পায়ে হাটছিল- সবার মাঝেই একটা প্রকাশ্য উত্তেজনা দেখতে পাচ্ছিলাম। চট করে মনে হল, এখানে আমার অনেক কিছু করণীয় আছে, কিন্তু ‘কী’ তা ঠিক বুঝতে পারছিলামনা। লোকজনের মাছে টুক করে নিজেকে চালান করে দিলাম, যদিও তাদের চোখে-মুখে কোন সম্প্রীতি ছিলনা। যাহোক, ঘোরালো পথে অল্পক্ষণের মধ্যেই শহরে ঢুকে পড়লাম- শহরজুড়ে কেবল হানাহানি, বিশৃঙ্খলা। মুষ্টিমেয় ভারতীয়-ইউরোপিয়ান আর বৃটিশ অফিসারের একটা ছোট্ট দলের সাথে নেটিভদের দাঙ্গা চলছিল। আমি অফিসারদের পক্ষ নিলাম, ততক্ষণে লুটিয়ে পড়ােএক মৃত অফিসারের অস্ত্র তুলে নলিাম- যুদ্ধ বেধে গেল, যদিও এই যুদ্ধ কী নিয়ে হচ্ছে-কেন হচ্ছে, কিছুই জানিনা। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের প্রতিপক্ষ দল সংখ্যায় ভারী হয়ে উঠল , তারা আমাদের ধাওয়াতে ধাওয়াতে একটা কুঠিতে নিয়ে এল। আমরা কুঠির মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেও নিরাপত্তা নিয়ে আর শঙ্কা থাকলনা। কুঠির ছাদের ফুটো দিয়ে আমি নদীর মধ্যে গড়ে উঠা একটা প্রাসাদের পাশে উত্তেজিত জনতাকে দেখতে পেলাম; সেই জনতা প্রাসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল। একটু পর প্রাসাদের উপরের জানালায় একজন মেয়েলী চেহারার লোককে দেখলাম; নিজের পাগড়ি খুলে সেটাকে দড়ি বানিয়ে সেই দড়ি বেয়ে বেয়ে সে জানালা থেকে নিচে নেমে এল। কাছে-পিঠে একটা নৌকাও যোগাড় করে রাখা ছিল, তাতে চড়ে সে নদীর অন্যপাড়ে চলে গিয়ে চম্পট দিল্।

‘এবার আমার প্রাণে নতুন স্পন্দন পেলাম। আমার সঙ্গীদের উদ্দেশে তড়িৎ কিছু প্র্রেরণামূলক কথা বললাম, এতে কাজও হল। বেশ কয়েকজনকে পাশে পেয়ে কুঠি থেকে আক্রমণ শানালাম, আমরা উত্তেজিত জনতাকে ধাওয়া করলাম। শুরুতে তারা পিছু হটল। এরপর তারা দল পাকাল, উন্মত্ত লড়াই চালানো শুরু করল, এরপর আবারও পিছু হটল- এভাবেই চলছিল। ইত্যবসরে আমরা কুঠি থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে এসেছিলাম। চাপা রাস্তার ঝুলন্ত বড়বড় বাড়িগুলো দেখে তাজ্জব হবার যোগাড় আমার- ঐসব বাড়ির গহীনে কোনদিনই বোধহয় সূর্যের আলো পৌছায়না। দঙ্গল জনতা এবার আমাদের উপর হামলে পড়ল- তীর-বল্লম ছুড়তে লাগল; আমরা সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে তীরের কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। মালয়দেশীয় ছুরির সঙ্গে এগুলোর অনেক মিল : আদলটা সাপের শরীরের মত, দৈর্ঘ্যে বেশ বড়, কালো রঙ, আর এর ফলায় বিষ মাখানো। আচানক একটা তীর এসে আমার কপালের ডানপাশে বিধল। মাথাটা চক্কর দিল, আমি ধপাস করে পরে গেলাম। আসন্ন মৃত্যুভয় আমাকে ছেকে ধরল। আমি উঠতে চাইছিলাম, তবু পারছিলাম না- এককথায়, আমি মারাই গেলাম’।

আমি বেদলোকে হাসতে হাসতে বললাম ‘তাহলে নিশ্চয়ই বলবেন না যে, আপনি যা দেখেছেন সবই সত্যি; কারণ আপনি মারা গেছেন এটা তো আর হতে পারেনা’।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম বেদলো কোন রসিকতাপূর্ণ জবাব দেবে, কিন্তু আমি তার প্রতিক্রিয়ায় অবাক হলাম : সে ইতস্তত শুরু করল. মুখে নেমে এল রাজ্যের নীরবতা। আমি ডাক্তার টেম্পলেটনের দিকে তাকালাম। সেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল, তার দাঁত কটমট করছিল, তার চোখের মণি দুটো খুবদ্রুত এদিক-ওদিক করছিল্। খুবই কর্কশস্বরে সে বেদলোকে বলল- ‘কী হল, থামলেন কেন; চালিয়ে যান’।
বেদলো সাহস পেয়ে বলতে শুরু করলো।
‘বেশ কয়েকমিনিট আমার চেতনা-অনুভূতি সবকিছু অন্ধকারে-অনস্তিত্বে, মৃত্যুর উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন রইল। এরপর ধুম করেই আত্মার ভেতর ইলেকট্রিক শক খেলাম যেন, এর সাথে আলো আর স্থিতিস্থাপকতার বোধও ফিরে এল। এর পুরোটাই আমার অনুভব, কিন্তু কিছুই চোখের দেখা নয়। মনে হল মাটি থেকে উঠে পড়েছি, কিন্তু আমার কোন শারীরীক উপস্থিতি বা দর্শনযোগ্য কোন সত্তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভীড় কমে এসেছিল, থিতিয়ে পড়েছিল কোলাহলও। শহরটাকে দেখে নতুন এক শহর মনে হচ্ছিল। আমার এই বায়বীয় সত্তার নিচে পড়ে আছে আমার লাশ- মাথায় তখনো বিধে আছে তীর, বিকৃত হয়ে গেছে পুরো মাথাটাই ; আবারো বলছি- ব্যাপারগুলো আমি অনুভব করছিলাম, কিন্তু সচক্ষে দেখিনি। আমি কোনকিছুর প্রতিই আগ্রহ পাচ্ছিলাম না, এমনকি লাশ দেখেও মনে হচ্ছিল, এ আর এমন কী!’
‘ইচ্ছাশক্তি-মনের জোর, কোনটাই তেমন কাজ করছিলনা, তবুও কোথা থেকে যেন তাড়না পাচ্ছিলাম : ফুরফুরে মেজাজে শহর থেকে বেরিয়ে এলাম। যে ঘোরালো পথের বাকে বাকে হেটে শহরে ঢুকেছিলাম, সেটাই খুঁজতে শুরু করলাম। সেই সংকীর্ণ পথ, যেখানে হায়েনার সাথে চোখাচোখি হয়েছিল, সেখানে আবারো ফিরলাম, কিন্তু ফিরেই গ্যালভানিক ব্যাটারির শক খেলাম বোধহয় - বাস্তববোধ, ইচ্ছাশক্তি, বস্তুবোধ একে একে ফিরে আসতে লাগল। আমি আবারো আগের আমি হলাম, এরপর বাড়ির পথ ধরলাম। তবে আমার আত্মা কিন্তু বাস্তবের স্পষ্টতা হারালোনা- একমুহূর্তের জন্যও বলবোনা যা দেখেছি, সবই ভ্রম ছিল; নো, নেভার’।

‘অব্যশই না’- টেম্পলেটন বেশ জোরের সাথে কথাটা বললেন, তার কণ্ঠে একটা গাম্ভীর্যও টের পেলাম। কথাটার রেশ থাকতে থাকতেই তিনি বললেন , ‘ভ্রম তো নয়ই, এমনকি এটাও বলা যাবেনা যে, এর অন্যকোন নাম আছে- কম্প্লিকেটেড ফ্যাক্টর। আমরা নাহয় স্রেফ ধরার জন্যই ধরে বলি, আজ আপনি যে মানুষটা হয়ে ফিরে এসেছেন তার আত্মাটা একটা অভাবনীয় মনস্তাত্ত্বিক আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে চলে এসছে। এবার তাহলে এই অনুমানের উপরেই আমাদের জোর দেয়া যাক। বাকি কথাগুলোর ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা আছে; সেগুলোও দেয়া হবে। এই যে আমার হাতে একটা জল-রঙে আকা ছবি আছে; আমার অবশ্য এটা অনেক আগেই দেখানো উচিৎ ছিল, কিন্তু ব্যাপারটা এতই ভয়ানক যে ইচ্ছে সত্ত্বেও দেখাতে পারিনি’।

আমরা টেম্পলেটনের ছবিটটার দিকে তাকালাম। আমি এতে তেমন অসাধারণত্ব কিছু খুঁজে পেলাম না, কিন্তু এই ছবিই বেদলোকে গ্রাস করলো। এটা একটা পোরট্রেইট- অবিশ্বাস্যরকম নিখুঁত, সম্ভবত বেদলোর নিজেরই পোরট্রেইট।
টেম্পলেটন গুরুগম্ভীর গলায় বললেন,‘একটু ভালমত চোখ বুলান, আর ছবির সময়কালটা খেয়াল করুন। অতটা ভাল বোঝা যাচ্ছেনা। এইতো পেয়েছি, এইদেখুন- ১৭৮০ সাল। ছবিটা আমার এক মৃতবন্ধৃর- ওর নাম ওলদেব। কলকাতায় থাকতে দারুণ ভাব জমেছিল আমাদের; তখন ওয়ারেন হেস্টিংসের শাসন ছিল। আমার বয়স তখন টেনেটুনে ২০। তাইতো সারাটোগাতে আপনাকে প্রথম দেখেই আপনার আর এই ছবিটার বাড়াবাড়ি রকম মিল দেখে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে, চিকিৎসা করতে রাজী হয়েছিলাম। এরপর যা যা করেছি সেগুলো আপনার সার্বক্ষণিক সহচর হতে। বন্ধুর বিদেহী আত্মার স্মৃতিই আমাকে প্রবলভাবে্ ডেকে গেছে আপনার সাথে থেকে যেতে; এছাড়া আপনার প্রতি একটা ভয়শূন্য কৌতূহল তো ছিলই’।
‘পাহাড়, পবিত্র নদী আর নদীবিধৌত যে শহরের পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা আপনি দিয়েছেন, ওটা আসলে ভারতের বেনারস। চিতে সিং এর বিদ্রোহের কারণে দাঙ্গা, রাহাজানি ছিল সেসময়ের প্রাত্যহিক ঘটনা- ওয়ারেন হেস্টিংসও বোধহয় তার শাসনামলের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন। পাগড়ি দিয়ে দড়ি বানিয়ে যে লোকটাকে আপনি পালাতে দেখেছেন সে চিতে সিং স্বয়ং। কুঠির ভেতর আশ্রয় নেয়া সিপাহী-অফিসারদের মধ্যে হেস্টিংসও ছিলেন। সেই দলের একজন হিসেবে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি দাঙ্গা ঠেকাতে, আর বাঙালির ছোড়া বিষাক্ত তীরবিদ্ধ হয়ে কুঠির বাইরে পড়ে থাকা অফিসারটিকে বাঁচিয়ে তুলতে। সেই অফিসারটিই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওলদেব। এই যে খাতাটা (কথা বলতে বলতে টেম্পলেটন একটা খাতা দেখালেন, যাতে কয়েকপৃষ্ঠা ঝরঝরে অক্ষরে লেখা। বোঝাই যাচ্ছিল খুব বেশিক্ষণ আগে লেখা হয়নি) পড়লে বুঝবেন, আপনি যত্তসব ঘটনা কল্পনা করছিলেন পাহাড়ের ভেতর, আমি ঠিক সেই ঘটনাগুলোই ঘরে বসে কাগজে লিখে রেখেছি!’

এর সপ্তাহখানেক পরে চার্লোটেসভিলের পেপারের একটা রিপোর্টে আমার চোখ থেমে গেল:
আমরা অতি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে জনাব অগাস্টাস বেদলো, যিনি তার শিষ্টাচার দিয়ে চার্লোটেসভিলের একজন সুজনে পরিণত হয়েছিলেন, তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।
জনাব বেদলো অনেক বছর ধরেই নিউরালিয়াতে ভুগছিলেন, বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু এটাও তার মৃত্যুর একমাত্র সম্ভাব্য কারণ নয়। অনুমেয় কারণটা একই সাথে অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য। চার্লোটেসভিলের পরিত্যক্ত পাহাড় থেকে ঘুরে আসার পর তার ঠাণ্ডা-জ্বর হয়েছিল, মাথায় রক্ত জমে গিয়েছিল। এটা উপশমে ডাক্তার টেম্পলেটন রক্তস্রাব পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি বেদলোর কপালে জোঁক লাগিয়ে দেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেদলোর মৃত্যু হয়। পরে দেখা যায়, জগে যে জোঁকটা রাখা ছিল, ভুলবশত সেটা ছিল মারাত্মক বিষাক্ত ধরনের জোঁক - পুকুর-জলাশয়গুলোতে এই বিষাক্ত জোঁকগুলো প্রচুর দেখা যায়। এমন একটা বিষাক্ত জোঁকই বেদলোর কপালের সাথে লেপ্টে ছিল। প্রাণীটা দেখতে অনেকটাই জোঁক-চিকিৎসার জোঁকের মত হওয়ায় পার্থক্যটা সেভাবে চোখে পড়েনি।

বিঃদ্রঃ বিষাক্ত জোঁকের সাথে সাধারণ জোঁকের পার্থক্যটা খুব সহজেই বোঝা যায়। বিষাক্ত জোঁকগুলো কুচকুচে কালো, আর এর চলনবলনও সাপের মত।


আমি পত্রিকার সম্পাদকের সাথে দেখা করে দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বললাম। সাথে এটাও জিজ্ঞেস করলাম Bedloe এর নামের বানানে ‘e’ টা বাদ দিয়েছেন কী ভেবে।
আমি এভাবে বললাম, ‘দেখুন বানানসংক্রান্ত স্বাধীনতা আপনার আছে, কিন্তু আমি যতদূর জানি বেদলো নামের বানানে শেষে একটা ‘e’ হবে’।
‘স্বাধীনতা? আরে না না ওসব কিছু না’ সম্পাদক জবাব দিলেন। ‘এটা আসলে টাইপিং মিসটেক। দুনিয়াশুদ্ধ মানুষ বেদলো বানানে L, O এর পরে ‘e’ দিয়ে লেখে। আমিতো কস্মিনকালেও এর অন্যরকম বানান শুনিনি’।

‘এই তাহলে’- বিড়বিড় করে কথাটা বলে আমি জুতা পরতে শুরু করলাম, আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম ‘ সত্য কখনো কখনো কল্পনার চেয়েও আজগুবি হয় : বেদলো বানানটা ‘e’ বাদে Bedlo হিসেবে লিখলে- একে উল্টে দিলে কী হয়? – Oldeb! অথচ এই লোকটা বলছে কিনা এটা একটা স্রেফ টাইপিং মিসটেক! হা হা হা......

হিমালয় ৩১.৫.১০

বি:দ্র: এটা খসড়া অনুবাদ।।। মূল অনুবাদে আরও সংশোধন ও পরিমার্জন হবে।।। ধন্যবাদ।।।

৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×