~একটা ছোট অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা যাক- মাদ্রাসার ফান্ডিং এর জন্য যাকাত কালেকশন করাটা অতীব জরুরী। আর দশটার মতো আমাদের গ্রামের মাদ্রাসার ফান্ডিং এর জন্য ও মাদ্রাসার হুজুর সাধারণত ১০ রমজানের আগে আশে পাশের মার্কেটগুলোতে চিঠি দিয়ে আসে। ২০ রমজানের পর থেকে চিঠি সমেত যাকাত কালেকশনে যেতে হয়, যে দোকানে আগে থেকে চিঠি দেওয়া হয়না তারা সাধারণত দান করেনা। যাকাত কালেকশনে গেলে দেখা যায় এক একজনের মনোভাব কেমন। এমন কিছু কিছু মানুষ আছে যারা খামে করে অনায়াসে হাজার দু'হাজার টাকা দিয়ে দেয়। আবার এমন ও অনেক দেখা যায় ২০ টাকা দিতে ৪০ টা প্রশ্ন করে, অথচ প্রশ্ন করার ফাকে একজন ভিক্ষুককে ৫০/১০০ টাকা দিয়ে দিচ্ছে। যারা যাকাত কালেকশন করে তাদেরকে ভিক্ষুকের থেকেও অধম মনে করে, ভাবে যে তাদের এই দু'টাকার উপর নির্ভর করে আপনার পরিবার পর্যন্ত দিব্যি অনায়াসে চলে যাচ্ছে। অথচ নিজের বেতনের টাকা থেকে এখানে সেখানে যাতায়াত করে এতিমের জন্য ফান্ডিং এর ব্যবস্থা করে ঐ হুজুরগুলো।
~আপনারা যাকাত দিতে বললে একটা মানুষ কেন যাকাত দিবে? মনুষ্যত্ববোধ কংবা মানবিকতাবোধ থেকে মানুষের সম্পদের প্রতি মায়া বেশি। সে কেনইবা আপনাদের উল্লেখকৃত ধর্মের বাণী মেনে যাকাত দিবে যখন আপনারাই কখনো যাকাত দিতে পারতেছেন (সামর্থ্য অর্জন করতে পারছেন না)না?
~এমনটা কি হতে পারেনা যে আপনারা মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন, সবাইতো আর ধর্মের সঠিক বাণী সম্পর্কে অবগত নয় কিংবা কখন যাকাত দিতে হবে, তার জন্য সম্পদের পরিমাণ কত হতে হবে কিংবা কেমন হারে যাকাত দিতে হবে! এমনটা কি হতে পারেনা যে আপনাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য যাকাতের নাম করে কিংবা মানবিকতাবোধের দোহাই দিয়ে মানুষের টাকা খসাচ্ছেন!
~আবু বকর (রাঃ) এর মতো আল্লাহ ভীরু, ওমর (রাঃ) এর ক্ষিপ্র-সাহসী, ওসমান (রাঃ) এর মতো ধনী, আলী (রাঃ) এর বীর, এদের কোন বৈশিষ্ট্যটি আপনার মধ্যে বিদ্ধমান যে আপনি কাউকে ধর্মের পথে আহবান করলেই সে ফিরে আসবে (হেদায়াত আল্লাহ প্রদত্ত, আমি শুধুমাত্র কার্যপদ্ধতির কথা বলছি)। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর কোন বৈশিষ্ট্যটি আমরা আমাদের বাস্তবিক জীবনে প্রতিপালন করতে পেরেছি যে, শুধু কোরানে কিংবা হাদিসে উল্লেখ আছে বলে সে (একজন মানুষ) আপনার আহবানে সাড়া দিবে, যেখানে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) আল্লাহর পথে মানুষকে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন।
~আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ইসলামের ৫টি মৌলিক ফরজ কাজের (৫টি ভিত্তি) পর সবচেয়ে মহৎ কিংবা গৌরবের অথবা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অর্থ উপার্জন করা।
~আপনার কছে অর্থ থাকলে আপনি সেখান থেকে যাকাত আদায় করে বিত্তবান মানুষদেরকে বলতে পারবেন, আমার নিজের সম্পদ থেকে আমি যেভাবে যাকাত আদায় করেছি একজন মুসলিম হিসেবে তোমার ও উচিত তোমার সম্পদ থেকে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করা। মানুষ এতে উদ্ধেলিত হবে, ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবন করতে সামর্থ্য হবে, তাদের অন্তরে মানবিকতাবোধ সৃষ্টি করে দিবেন আল্লাহ।
~বর্তমান জগত একমাত্র সম্পদের প্রতিই সংবেদনশীল। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে যেখানে আপনার কোনো অবদান নেই, সেখানে আপনার কোন স্পিরিচুয়াল ফ্যাক্ট এর কারনে মানুষ আপনার বেধে দেওয়া অনুশাসন (অনুশাসন আল্লাহ ও তার রসুলের প্রদত্ত, কিন্তু সেটা মানুষের সামনে উপস্থাপন তো করছেন আপনি!) মানবে!
~মানুষ তাকেই অভিভাবক হিসেবে মেনে নেয় যে তার থেকে হয় বিত্তবান নয়তো ক্ষমতাশালী কিংবা প্রজ্ঞাবান (বর্তমান সমাজে জ্ঞানীদের মূল্যায়ন করা হয়না বললেই চলে)। যেহেতু আপনি তার থেকে কোনো দিক দিয়েই এগিয়ে নেই তাহলে সে আপনাকে কেন নেতা হিসেবে মেনে নিবে, কেনইবা আপনার নির্দেশ মানতে সে বাধ্য থাকিবে!
~যাকাত দিতে হবে কাকে, যার সম্পদ আছে নিশ্চয়ই তাকে। সম্পদ ই যদি না থাকে তাহলে যাকাত আদায় করবেন কিভাবে? ইসলামে যাকাতের বিধান থাকার অর্থ হলো আপনাকে অর্থ -সম্পদ বাড়ানোর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, আর আপনার অর্জিত সেই সম্পদ থেকেই পরবর্তীতে যাকাত দিতে হবে।
~আপনারা যদি এমনটা ভাবেন যে, সম্পদ যতো কম তত সহজে এবং ততো দ্রুত হিসাব চুকিয়ে জান্নাতে চলে যেতে পারবেন, এমনটা হলে তো ইসলামে যাকাতের বিধানই আসতোনা। অর্থ-উপার্জন না করে নিজেদেরকে হ্যায় প্রতিপন্ন করে রাখা কিংবা দুনিয়াটাকে জেলখানা ধরে নিয়ে জীবন যাপন করার মধ্যে কোনো বাহ্যিক কিংবা আধ্যাত্মিক সফলতা নেই। ১সেকেন্ড বেচে থাকেন সেটাতেই সাফল্য নিহিত থাকবে যদি বীরের মতো বাচতে পারেন।
~এটাইতো ইসলামের মর্মবাণী, তাই নয় কি!
~সারাজীবন সুদী সমাজের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে ফেনা তুলে ফেললেও কোনো লাভ হবেনা, যদিনা কার্যত কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে না পারেন। ~আমি ব্যবসা করতেছিলাম, কোনো কারনে ব্যবসায় লোকসানের সম্মুখীন হই কিংবা বাড়ি বানাচ্ছিলাম অথবা আমার পরিবারের কোনো সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়েছে, এই মুহুর্তে আমার টাকা দরকার। আমকে তো সুদ ছাড়া কোনো আর্থিক লেনদেন করা প্রতিষ্ঠান টাকা দিবেনা, অথবা কোনো আত্নীয়ের কাছেও আমি এই মুহুর্তে টাকা পাবোনা। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সুদি কারবার ছাড়া অন্য কোনো উপায় কি আমাকে দেখাতে পারবেন যেখান থেকে আমি বিনা সুদে লেনদেন করতে পারবো? হ্যাঁ, একটা রাস্তা আছে, যদি আপনি আমাকে সুদ ছাড়া অর্থ ধার দেন। এমনি করে সকল আমি আমরা হয়ে সকল আপনি আপনাদের কাছ থেকে সুদ ছাড়া যদি অর্থ ধার নিতে পারি তাহলে কেন সুদি কারবারের দিকে ঝুকবো! কিন্তু আপনার ভাষায় তো কম টাকা অর্জন করে জীবনযাপন করলে অল্প সময়ে হিসাব দিয়ে বেহেস্তে চলে যেতে পারবেন অথচ সারাজীবন সুদের বিরুদ্ধে কথা বলে ফেনা তুলে ফেলতেছেন!
~~অর্থনীতির ভাষায় একটা কথা আছে, “সমাজে যে পণ্যের ভোক্তা যত বেশি তার উপযোগ ততো বেশি।”
~উপযোগ যত বৃদ্ধি পাবে যোগানের পরিমাণ ও তত বাড়াতে হবে। প্রাইস তথা মূল্য বাড়িয়ে চাহিদার খোরাক মিটানো যায় ঠিক, তবে এই ক্ষেত্রে আমরা যেহেতু এতোটা ধর্মভীরু হতে পারিনি তাই আমাদের জন্য যোগান দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই! যেহেতু যোগানের সাথে দামের সম্পর্ক বিপরীতমুখী সেহেতু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে ইচ্ছাকৃতভাবে এর যোগান কমিয়ে দেয় যাতে করে দাম বৃদ্ধি করতে পারে। এর ফলাফল ই হলো সমাজে সুদি কারবারের ব্যপক প্রচলন।
~একটি বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি। এইতো দুইদিন আগে, মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হচ্ছি। হাতে একটি ফাইল নিয়ে হিজাবসহ বোরকাবৃত এক মহিলা একটি কন্যা শিশু কোলে নিয়ে মসজিদের মুসল্লিদের কাছে এই বলে সাহায্য প্রার্থনা করছে যে, আমি নও-মুসলিম, আমার স্বামী আমাকে তালাক দিয়ে চলে গেছে, আমার মেয়েটার ......... অসুখ (নামটা ঠিক মনে রাখতে পারিনি) ধরা পরছে। মেয়ের চিকিৎসার জন্য আপনারা কিছু দান করুন।
~সে আমাদের কাছে সাহায্যের জন্য এভাবে আসবে কেন, আমাদের কি উচিৎ ছিলোনা তার বাসায় যেয়ে তার খোজ খবর নিয়ে তার প্রয়োজনে তাকে সকল ধরণের সাহায্য সহযোগিতা করে আসা?
~ইসলামে দান তথা সদকা দেওয়ার বিধান আছে। অভুক্তদের পানাহার করানোর প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, অসুস্থদের সেবা করার প্রতি। আপনি যদি অর্থ উপার্জন ই না করেন তাহলে মানব সেবা করবেন কিভাবে? মানব সেবাতো ধর্মের অলিখিত মূলনীতিগুলোর একটি।
~শেষাংশে আপনাদের কাছে একটি আহবান, কার্যত ভিন্নভাবে ভাবতে শিখুন, আগে আগে বেহেস্তে পারি দেওয়ার মনোভাব দূর করে (ভাবছেন কিভাবে, আপনারা ধর্মীয় নেতা হয়ে অন্য মানুষের কর্মের হিসাব চুকানোর আগে আল্লাহ আপনাদেরকে বেহেস্ত দিয়ে দিবে!) সবাইকে নিয়ে বেহেস্তে যাওয়ার পথ সুগম করুন। ~অর্থার্জনে মনোযোগী হোন। ~যাকাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরির জন্য আপনারাই প্রত্যক্ষভাবে (পরোক্ষভাবে তো অনেক হলো, এখন সময় এসেছে ভিন্নতার স্বাদ নেওয়ার!) সবার পূর্বে এগিয়ে আসুন। ~সুদি কারবার যাতে মানুষ করতে না পারে সে জন্য বিনা সুদে মানুষের প্রয়োজনে ঋণ দেন। ~বেশি বেশি যাকাত আদায় করে মানুষকে স্বচ্ছল হতে সাহায্য করুন। ~বিধর্মীদেরকে তাদের অত্যাধিক প্রয়োজনে প্রত্যাশা ব্যতিরেকে দান করুন, এতে করে তারা ইসলামের সুশিতল ছায়াতলে আসবে। ~নও-মুসলিমদের বেশি বেশি সাহায্য করুন, যাতে তারা ইসলামে প্রবেশ করেছে বলে আর্থিকভাবে কষ্টে ভুগছে এটা ভাবার প্রয়োজনবোধ না করে। যাকাত (দান) থেকে রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন যাতে সেখান থেকে বেকারদের জন্য নিত্যনতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়।
নোটঃ উপস্থাপন কৌশল কিংবা লেখার যে কোনো অংশ প্রয়োজনে সংশোধনকরা হতে পারে।
~বিঃদ্রঃ ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশ্য করে লেখাটা লেখা হয়েছে। গোঁড়ামি, ইসলাম আর দুনিয়ার জীবনকে আলাদা করে ভাবা, সমাধানের পথ না খুঁজে একই ওয়াজ বার বার করে মুখে ফেনা তুলা, কখনো কখনো ইসলামকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়া কিংবা নিজেদের অতীত গৌরবকে ভুলে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে থাকা থেকে উত্তরীত হওয়ার আহবান জানিয়ে একটি খোলা বার্তা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৯ রাত ৮:৩২