কত দিন?
একটানা অনশন করে ধর্মঘটকারী কত দিন বেচে থাকার আশা করতে পারেন?
এর উত্তর ৬০ দিনে কিছু কম বা কিছু বেশি। এটা নির্ভর করে অনশনকারীর দেহে সঞ্চিত চর্বি এবং তার কৌশলের ওপর।
ফিজিওলজিস্টরা বলেন, কোনো মানুষের দেহের ৪০ শতাংশ যদি কমে যায় তাহলে তার পরে বাচার সম্ভাবনা থাকে না। অনশন শুরুর তিন থেকে পাচ দিনের মধ্যে সেটা বিপজ্জনক হয়। এই সময়ে শক্তি উৎপাদনের জন্য দেহ তার চর্বি ভাঙতে শুরু করে। লিভার যখন চর্বি ভাঙা শুরু করে (সাধারণত লিভার গ্লুকোজ ভাঙে), তখন কিটোন বডিজ (Ketone Bodies) নামে এক ধরনের টক্সিক বাইপ্রডাক্ট সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে আরেকটি বাইপ্রডাক্ট এইসটোন (Acetone) সৃষ্টি করে যেটা মাংস (ফুসফুস) দিয়ে বেরোতে পারে। এইসটোনের গন্ধ অনেকটা নাশপাতির মতো। এই সময়ে ব্রেইন তার প্রয়োজনে কিটোন বডিজ-কে অক্সিডাইজ করতে পারে। এরপর রক্তপ্রবাহে এ বেশি কিটোন বডিজ হতে পারে যে তার ফলে কিটোঅ্যাসিডোসিস হতে পারে। এটা অনশনকারীকে দ্রুত মৃত্যুর মুখে নিয়ে যায় বিশেষত তিনি যদি ডায়াবেটিক হন।
তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকে অথবা অনশনের শুরুতে দেহের ওজনের ১৮ শতাংশ কমলে অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। দেহ তখন স্টারভেশন মোড (Starvation Mode) বা অনশন অবস্থায় চলে যায় এবং দেহ চেষ্টা করে সব কিছু ব্যালান্স করে চলতে। দেহ তখন আক্ষরিক অর্থে নিজেকে খেয়ে বেচে থাকতে চেষ্টা করে।
যে ৬০ দিনের কথা সাধারণত বলা হয়, তাতে ধরে নেওয়া হয় যে ধর্মঘটকারী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তার দেহে প্রায় ২৪ পাউন্ড বা ১২ কেজি চর্বি আছে। স্টার্টিং পয়েন্টে যার বেশি চর্বি থাকে সে বেশি দিন বাচতে পারে।
অনশন ধর্মঘটকারী কিছু কৌশলে তার প্রতিবাদী দিনের সংখ্যা বাড়াতে পারেন। মার্গারেট থ্যাচারের শাসন আমলে ১৯৮১-তে উত্তর আয়ারল্যান্ডে বেলফাস্টে ববি স্যান্ডসসহ যেসব আইরিশ রিপাবলিকান অনশন ধর্মঘট করেন তারা সলিড খাবার খাননি। কিন্তু তরল বা লিকুইড ডায়েটে তারা ছিলেন। মাঝে মাঝে তারা দু এক চামচ লবণ খেয়েছিলেন। এরা যদি সেটা না করতেন তাহলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে দেহ দ্রুত বঞ্চিত হতো এবং ব্লাড প্রেশার খুব নিচে চলে যেত। ববি স্যান্ডস অনশন ধর্মঘটের ৬৬-তম দিনে মারা গিয়েছিলেন।
কৌশলী অনশন, রিলে অনশন, শাহবাগী অনশন
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনী অনশন ধর্মঘট করেছেন জেলবন্দি টার্কিশ মার্কসবাদীরা। ডরমিটরি স্টাইল জেলখানাকে পশ্চিমি স্টাইলের জেলখানায় রূপান্তরের প্রতিবাদ তারা করেন অনশন ধর্মঘটের মাধ্যমে। তবে ধর্মঘটকারীরা যেন বেশি দিন বেচে থাকতে পারেন, সেজন্য তারা লবণ, চিনি ও ভিটামিন ক্যাপসুল খান। এর ফলে তাদের ওজন কমে যাওয়াটাকে প্রতিদিন কয়েক আউন্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছিলেন। তারা ৩০০ দিনের বেশি ধর্মঘট করতে পেরেছিলেন।
আমেরিকায় সৎ মেয়েকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত চার্লস রবার্ট ম্যাকনাব স্পোকেন কাউন্টি জেলে ১২৩ দিনের বেশি অনশন ধর্মঘট করেন। তিনি মাঝে মাঝে পানি ও কফি খেয়েছিলেন এবং এই ১২৩ দিনের বেশি অনশন ধর্মঘট করেন। এই ১২৩ দিনের মধ্যে তার মানসিক অবস্থা মূল্যায়নে তিন দিনের জন্য যখন তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছিল তখন তিনি কিছু সলিড খাবার খেয়েছিলেন।
ডিসেম্বর ২০১১-তে আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটি ভিন্নধর্মী গ্রুপ অনশন ধর্মঘট করে। ওই সময়ে অকুপাই ওয়াল স্টৃট বা ওয়াল স্টৃট দখল করো এই ব্যানারে তিন ব্যক্তি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা অনশন শেষ করলে নতুন তিন ব্যক্তি অনশনে যোগ দেন। এটা ছিল একধরনের রিলে অনশন ধর্মঘট। তারা কোনো সলিড ফুড খাননি। ১৪ দিন পরে এই ধর্মঘট শেষ হয়।
এসব অনশন ধর্মঘটের পাশাপাশি মঙ্গলবার ২৬ মার্চ ২০১৩-তে আওয়ামী সরকার পৃষ্ঠপোষিত শাহবাগ মঞ্চে অভিনীত ‘আমরণ অনশন’ -এর ঘটনাটি স্মরণ করা যেতে পারে। ‘শহীদ রুমী স্কোয়াড’ নামে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের’ একটি দল রাত পৌনে এগারোটা থেকে ন্যাশনাল মিউজিয়ামের মেইন গেইটের সামনে অনশনে বসেন। কিন্তু সাত দিন পরে সোমবার ১ এপৃল ২০১৩-তে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী (এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী) এ কে খন্দকারের সঙ্গে আলোচনার পরে রাত নয়টার দিকে আমরণ অনশন কর্মসূচি স্থগিত করেন নব্য মুক্তিযোদ্ধারা। এই অনশনকারীরা সাত দিনের কোন সময়ে কত ঘণ্টা অনশন করেন এবং তারা সলিড ও লিকুইড, উভয় ধরনের খাবারই বর্জন করেছিলেন কি না সেটা জানা যায়নি।
মাহমুদুর রহমান সলিড বা লিকুইড কিছুই খাচ্ছেন না। বলা যায়, পূর্ণ অনশন ধর্মঘট তিনি করছেন।
কিন্তু এর পরিণতি কোথায়?
যতীন দাশের মতো ৬৩ দিন পরে মৃত্যু?
অথবা ভগৎ সিংয়ের মতো ১১৬ দিন পরে অনশন ভঙ্গ?
মাহমুদুর রহমানের লক্ষ্য
ইতিমধ্যে মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন তিনি আমরণ অনশন ধর্মঘট করছেন তিনটি দাবি আদায়ে। এক. তার মা মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আবুল আসাদের অপরাধ তিনি যে প্রেস থেকে সংগ্রাম ছাপান, সেই একই আল ফালাহ পৃন্টিং প্রেস থেকে ১১ এপৃলের আমার দেশ ছাপা হয়েছিল। দুই. আল ফালাহ প্রেসের ১৯ জন কর্মচারীকে মুক্তি দিতে হবে। এবং তিন, আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা খুলে দিতে হবে।
অনেকেই মনে করেন মাহমুদের এই তিনটি দাবিই ন্যায় ও যৌক্তিক। বিশেষত তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যখন স্বীকার করেছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
কিন্তু এখন পর্যন্ত মাহমুদের দাবি সরকার মেনে নেয়নি।
এখানে মনে রাখতে হবে অনশনের সূচনায় যতীন দাশ ও ভগৎ সিংয়ের স্বাস্থ্য ভালো ছিল এবং তারা যুবক ছিলেন। মাহমুদুর রহমান মধ্য বয়সী এবং বছরখানেক আগে লন্ডনে তার চোয়ালে একটি জটিল সার্জারি হয়েছিল। তা ছাড়া রিমান্ডে থাকার সময়ে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
এসব ফ্যাক্টর বিবেচনা করলে এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে মাহমুদুর রহমানের পক্ষে ৬০ দিন অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং মাহমুদুর রহমানকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে তিনি কি করবেন?
তার শুভকামী এবং দৈনিক আমার দেশ পাঠকদের অনেকেই মনে করেন মাহমুদ অনেক আগেই তার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সততা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন যদি তিনি অনশন ভাঙেন তাহলে কেউই তাকে শাহবাগী অভিনেতা বলবে না। কেউই তাকে ভণ্ড বলবে না। তাই নিজে বেচে থাকার জন্য এবং আমার দেশ পত্রিকাটিকে বাচিয়ে রাখার জন্য তিনি অনশন ভাঙতে পারেন।
সরকারের ঝুকি : পশুত্ব বনাম মনুষ্যত্ব
ঘড়ির কাটা ঘুরছে।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
মাহমুদুর রহমান মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
আওয়ামী সরকারের ঝুকি বাড়ছে।
ফিরোজা মাহমুদ জানিয়েছেন ডিবি হাজতে নেয়ার প্রথম দিকে অর্থাৎ ১১ এপৃলে তার স্বামীর ওজন ছিল ৭১ কেজি। এই লেখার দিনে তার ওজন হয়েছে ৫৪ কেজি। অর্থাৎ, তার ওজন প্রায় ২৪ শতাংশ কমে গিয়েছে। তিনি এখন স্টারভেশন মোডে আছেন। এটা খুবই বিপজ্জনক। শুধু দৈহিক নয়, কোনো মানসিক বৈকল্যেরও শিকার হতে পারেন মাহমুদ।
আজ থেকে বহু যুগ আগে বৃটিশ সরকার এই ধরনের ঝুকি না নিয়ে গান্ধীকে জেলমুক্তি দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারও এখন সেটা করতে পারে।
মাহমুদকে চোখ বাধা অবস্থায় টর্চার করা হয়েছিল। কারা চোখ বেধেছিল, কারা টর্চার করেছিল এসব নামই এখন অনুমিত এবং আলোচিত হচ্ছে। এরা ভবিষ্যতে মারাত্মক বিপদে পড়বে।
কোনো বাহিনীর কর্মচারি, কোনো মন্ত্রী বা উপদেষ্টা যদি বলেন তারা “ওপরের নির্দেশে” টর্চার করেছেন তাহলেও তাদের বিপদ হবে। একটা সময় আসে যখন মানুষকে তার বিবেক দ্বারা চালিত হতে হয়। তখনই তার মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়Ñ পশুত্ব দূর হয়। ভবিষ্যতে মাহমুদকে যদি আবার টর্চার করতে বলা হয় তাহলে নির্দেশদাতার বিরুদ্ধে অবশ্যই বিদ্রোহ করতে হবে। ঠিক তেমনই, মাহমুদের চিকিৎসায় যদি বিন্দুমাত্র অবহেলা অথবা গাফিলতি হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে বিপদে পড়বেন। বিশেষত এই লেখাটি পড়ার পর তারা জানবেন অনশন ধর্মঘটে মানুষের আকস্মিক মৃত্যু ঘটতে পারে।
সুতরাং এই লেখাটিকে আইন বিভাগ, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টারা যদি অতি সময়োচিত সতর্কবাণীরূপে গ্রহণ করেন তাহলে সবার মঙ্গল হবে। আশা করা যায় সরকার অবিলম্বে তৎপর হবে।
ঘড়ির কাটা ঘুরছে।
পুরো লেখা এখানে http://www.dailynayadiganta.com/new/?p=169148

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



