পাশ্চাত্যের এনলাইটেনমেন্ট ধারনাটি নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক আছে।পাশ্চাত্যে এ বিষয় নিয়ে সর্বপ্রধান লেখাটি জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের “What is Enlightenment”. অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে(১৭৮৪)ব্যক্তি ও সমস্টিগতভাবে মানুষের আলোকপ্রাপ্তির মানে খুজেছিলেন কান্ট তার ছোট এ রচনায়। লেখাটি ছোট হলেও,অত্যন্ত প্রভাবশালী,খানিকটা দুর্বোধ্যও বটে।বিংশ শতাব্দীতে এসে প্রবন্ধটির গুরুত্বপূর্ণ পাঠ-পর্যালোচনা করেন ফরাশি দার্শনিক ফুকো।তিনি কান্টের এ রচনাটির সার সংক্ষেপ করে খুলে খুলে নির্দেশ করেন প্রবন্ধটির নানা তাৎপর্য। যারা কান্টের এ রচনাটি পড়তে চান তারা যেন ফুকোর লেখাটিতেও নজর বুলান।কান্টের প্রবন্ধটি একই সাথে দার্শনিক ও রাজনৈতিক।কান্ট মানব জাতিকে তার স্ব-আরোপিত নাবালকত্ব থেকে মুক্তি দেয়ার কথা বলেন। মানুষ অন্যের নির্দেশনা ছাড়া যতক্ষণ নিজের বিচারবিবেচনা ব্যবহার করতে অক্ষম হয় ততক্ষনই মানবজাতির নাবালকত্ব। এই অপরিপক্কতা থেকে মুক্তিই ,কান্টের মতে, এনলাইটেনমেন্ট।অন্যের বরাত ছাড়া ভাবতে পারা ,নিজের যুক্তিবৃত্তি অনুসারে চলতে পারা সাবালকত্বের লক্ষণ বলে কান্ট মনে করেন।ফুকো বলছেন,কান্ট মানবতাকে একটা মুহূর্ত হিসেবে গণ্য করেছেন,যে মুহূর্তে মানবতা কোন অথরিটির পরোয়া না করে তার যুক্তি জ্ঞান ব্যবহার করতে চলছে।মানুষের ইম্ম্যাচুইরিটি তার স্ব-আরপিত(self-incurred)।নিজের অবস্থা পরিবর্তন করে,জানার সাহস ও স্পর্ধা দিয়ে মানুষ পেরিয়ে যেতে পারে তার নিজের সৃষ্ট অপরিপক্কতাকে।এনলাইটেনমেন্টের মূল কথাই হোলঃ Sapere aude! অর্থাৎ “have the courage to use your own reason”।
কান্ট অপরের কতৃত্ব মান্য করার এলাকা ও নিজের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যবহারের এলাকাকে আলাদা করেছেন।সামরিক শৃঙ্খলা,রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ও ধর্মীয় কতৃত্বের ক্ষেত্রে ‘ভাববেনা, শুধু মানবে’ এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।এই আদেশগুল যখন আর মানার প্রয়োজন হবেনা তখন মানবতা সাবালক হবে বলে কান্ট মনে করেন।
কান্ট যুক্তির প্রাইভেট ও পাবলিক ব্যবহারের মধ্যেও পার্থক্য টেনেছেন।যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার প্রায়শই যুক্তির স্বাধীন ব্যবহার নয়।নানা পেশায় অংশগ্রহণ করার ফলে ব্যক্তি যখন সমাজের একটা নির্দিষ্ট অংশে পরিণত হয় তখন নিজের অবস্থানকে জাস্টিফাই করতে যুক্তির ব্যবহার করতে থাকে।নির্দিষ্ট লক্ষ অর্জনের জন্য ব্যবহার করা যুক্তি যুক্তির ব্যক্তিগত ব্যবহার,সার্বজনীন ব্যবহার নয়।প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বা জনসাধারনের ক্ষেত্রে যুক্তির ব্যবহার কীভাবে সম্ভব করে তোলা যায় কান্টের ইশারাকৃত এই প্রশ্ন ফুকোর কাছে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
ক্যান্টের রচনার কথা উল্লেখ করে ফুকো বোঝাতে চান যে এনলাইটেনমেন্ট একটি দার্শনিক ভাবধারা।একজন যুক্তিবান মানুষ হিসেবে বা যুক্তিপূর্ণ মানবতার সদস্য হিসেবে কেউ যখন যুক্তির খাতিরে যুক্তি দিবেন,কোন প্রাপ্তি বা অর্জনের আশা ব্যতিরেকেই সেটাই এনলাই্টেনমেন্ট।
ফুকো আমাদেরকে ধরিয়ে দিচ্ছেন যে,mankind শব্দটির ব্যবহারে কান্টের এনলাইটেনমেন্টের ভাবধারায় পুরো মানবজাতিকেই অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা আছে।সে যাই হোক,১৯৪৭ সালে প্রকাশিত dialectic of Enlightenment গ্রন্থে হরকহেইমার ও অ্যাডরনো এনলাইটেনমেন্ট ভাবধারার কিছু শক্ত সমালচনা হাজির করেছেন।তাদের মতে,এনলাইটেনমেন্টের ভাবধারা মুলত পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ভাবধারায় উজ্জীবিত।পাশ্চাত্যের বা ইউরোপের মূল্যবোধকে উপস্থাপিত করাই এটার লক্ষ্য।বিশ্বের সর্বচ্চ মূল্যবোধগুলো যেন নির্ণীত হবে পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আর আভিজাতদের দ্বারা। তাদের মতে, instrumental logic পণ্যদ্রব্যের আকার নিয়েছে।পন্য যেমন মুল্য আর প্রাপ্তির ভিত্তিতে বিচার্য,যুক্তি উপস্থাপনের ব্যপারটিও তেমনি।তবে এনলাইটেনমেন্টের বহুমুখী সমালোচনার সাথে পরিচিত হওয়ার আগে আজ কান্টের প্রবন্ধটি থেকে কিছু উক্তি শুনে রাখতে পারিঃ
=যুক্তিজ্ঞান অর্জনের জন্য একমাত্র প্রয়োজন মুক্তির।
=প্রকাশ্যে নিজেদের যুক্তি ব্যবহারে জনগণকে সর্বদাই স্বাধীনতা দিতে হবে।
=মানবজাতির অপরিহার্য নিয়তিই হোল উন্নতি করা।
=জনগন নিজেদের জন্য যা চায় না তা রাজা তাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না,কারন রাজার আইনজারির কর্তৃত্ব(Legislative authority) জনগনের সামস্টিক আকাঙ্খাকে রাজার ইচ্ছার সঙ্গে একত্রীভূত হওয়ার উপর নির্ভরশীল।
= প্রজাদের চাইবার অধিকার বজায় রাখতে হবে
=সকল খাঁটি ও ধরে নেয়া (imagined) উন্নয়ন জনজীবনে শৃঙ্খলা আনছে বলে মনে করলে রাজা তার প্রজাদেরকে তাদের নিজেদের মত করে আত্মিক উন্নয়নে সম্মত থাকবেন যদিও আধ্যাত্মিক বিষয় শাসকের এখতিয়ারভুক্ত নয়।তবে রাজা সচেতন থাকবেন যে, কেউ আত্মিক উন্নয়নে(salvation)কিছু করতে চাইলে অন্যকেউ যেন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।
=আলোকিত শাসকই বলতে পারেন, যত ইচ্ছা যুক্তি তর্ক করো কিন্তু আইন মানতে হবে।[ফুকো এটির নাম দিয়েছেন যৌক্তিক স্বৈরতন্ত্র।স্বাধীনভাবে বুদ্ধি ব্যবহার করতে দিলেই আনুগত্য নিশ্চিত করা হবে।]