লোক সাহিত্যের অন্যতম শাখা হলো কিচ্ছা। গ্রামাঞ্চলে কিচ্ছা কাহিনী বেশ জনপ্রিয়। রাজার গল্প, পরীর গল্প, ডাকাতের গল্প, গরীব প্রজার গল্প, এমন নানান রোমাঞ্চকর গল্প শুনে কেটেছে আমাদের শৈশব।
আমার বাবা প্রাথমিকের গণ্ডি পাড় হননি। কিন্তু লোক সাহিত্যে উনি কিংবা উনার সমসাময়িক লোকজনের বেশ পান্ডিত্য ছিলো। রাতের বেলায় ভাই বোনদের ঘুম পাড়ানোর জন্য বাবাই বলতেন “এক তোলা কন্যা” সহ অসংখ্য মন মাতানো কিচ্ছা। আম্মাও এমন গল্প বলতেন অনেক সময়। সেসব গল্পগুলোতে এসো সুন্দর বর্ণনা এবং ঘটনা ছিল যে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সেসব এখন পুরোপুরি মনে না থাকায় আক্ষেপে পুড়ি। আহা! আব্বা আম্মা ছাড়াও বাড়ীর ও এলাকার বড় ভাই, বোনদের মুখ থেকেও শুনেছি অসংখ্য গল্প।
শুধু কিচ্ছাই নয়, লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা ছড়া, মন্ত্র, গীতিকাব্য, লোকসঙ্গীত, মঞ্চনাটক, ধাঁধা ও প্রবাদবাক্যের সমারোহ ছিল আমাদের শৈশব জুড়ে। ছড়া, মন্ত্র, লোকসঙ্গীত বা প্রবাদবাক্য বাড়ীতেই শুনতে পারতাম অনেক। গীতিকা, লোকসঙ্গীতও শুনেছি বাড়ীতে বসে। তবে গীতিকা ও মঞ্চনাটক মঞ্চেই দেখা হতো বেশি। “কাশেম মালার প্রেম, কমলার বনবাস, রূপবান, বেহুলা লক্ষিন্দর, বিমাতার চক্রান্ত সহ অসংখ্য মঞ্চনাটক দেখেছি। শৈশবে এইসব নাটকের বইও কিনে পড়তাম। আনন্দ পেতাম।
বাংলা সাহিত্যের শুরুটা হয়েছিল মূলত লোক সাহিত্য থেকেই। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দিপাবলি (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস) পাঠ করে জেনেছি এক সময়ের শক্তিশালী লোক সাহিত্যের ইতিহাস।
আমরা যারা নব্বই দশকের আগে ও সময়ে জন্মেছি। আমরা লোক সাহিত্যের ছোঁয়া পেয়েছি ভালো ভাবেই। মঞ্চনাটক ও পুঁথি পাঠের আসরগুলোতে আমরা বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ দেখেছি শৈশবে। সম্ভবত আমি ২০০৬ সালে নরসিংদীতে থাকার সময় সর্বশেষ পুঁথি পাঠের আসরে উপস্থিত ছিলাম।
উন্নতি প্রযুক্তি কিংবা আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে লোক সাহিত্য। পাশাপাশি আমার ধারণা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বাঁধার কারনেও গ্রামাঞ্চলে মঞ্চনাটক কিংবা পুঁথি পাঠের আসরগুলো থেমে যাওয়ার একটি কারন। বর্তমানে খুব কম এলাকাতেই মঞ্চ নাটক হয়, পুঁথি পাঠের আসর জমে। কিচ্ছা, ধাঁধা, প্রবাদবাক্যের আড্ডা তো সম্ভবত নেই বললেই চলে। ইউটিউবে এসব পাওয়া গেলেও নিজেরা আয়োজনের মাধ্যমে কিংবা স্বশরীরে উপস্থিত থেকে দেখা ও শোনার যে অনুভূতি তা এখন চিরতরেই হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
আমি আমার শৈশবে শুনা কিচ্ছাগুলো এখন বাচ্চাদের বলতে পারি না। পুরোপুরি মনে না থাকায়। নিজে লেখালেখি করি বলে, বাচ্চাদেরও নিজের মতো করে কিচ্ছা শুনাই মাঝে মধ্যে। ওরা আনন্দ পায়। আরো শুনতে চায়।
লেখাটা শুরু করেছিলাম, আব্বা-আম্মার কাছ থেকে সাহিত্য শিখেছি শিরোনামে। সে বিষয়ে কিছু বলেই শেষ করতে চাচ্ছি। ছোটবেলায় আব্বা-আম্মার মুখে কিংবা অন্যদের মুখে যেসব কিচ্ছা শুনতাম, সেসেব যথেষ্ট টুইস্ট ছিলো, পরতে পরতে রহস্য লুকিয়ে থাকতো। শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত থামতে দিতাম না তাদের। সেই থেকেই মূলত গল্প লেখার ইচ্ছে জাগে। গল্প তৈরীর রসদ পাই। গল্প কিভাবে সাজাতে হয় তা শিখি। প্রাথমিক ধারণা এবং কিছু করার ইচ্ছে তখনই জেগেছিল। আমাদের অনেকের জীবনের গল্পই হয়তো এমন।
জুবায়ের আহমেদ
১৬/০৩/২০২৩ইং
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:০৯