এত কবি কেন......
কবিতা কি?
এককথায়, ছন্দোবদ্ধ পদকেই কবিতা বলা যায়। ছন্দই কবিতার প্রাণ, ছন্দই কবিতাকে তার স্বরূপগত বৈশিষ্ট্যে উন্নীত হতে সাহায্য করে। কিন্তু কেবল ছন্দই কবিতার সব ও শেষ কথা নয়। কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ তার অলংকার। কবিতার মধ্যে কবির কল্পনাশক্তির প্রকাশ, অনুভূতির উচ্ছ্বাস বাণীমূর্তিতে ধরা পড়ে। বস্তুত মানব মনের ভাবনা কল্পনা যখন অনুভূতির রঙে রঞ্জিত হয়ে যথাযথ শব্দসম্ভারে বাস্তব, সুষমামণ্ডিত, চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় রূপ লাভ করে তখনই তা হয়ে ওঠে কবিতা।
কবি কে?
বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে কোনো একটি সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায় তখনই জন্ম হয় কবিতার। খুব সহজেই অনুমান করা যায় কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি। বাইরের জগতের রূপ-রস, স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা, অনুভূতি কল্পনাকে যিনি অনুভূতিস্নিগ্ধ ছন্দোময় শিল্পরূপ দিতে পারেন তিনিই কবি।
এত কবি কেন?
সোস্যাল মিডিয়ায় কবি ও কবিতার আধিক্য দেখে শক্তি চট্টোপধ্যায়ের একটা লেখার কথা মনে পরে যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই লেখাটি নিয়ে খুব বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। আজ সেই পুরোনো লেখাটির কথা মনে হল, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে লেখাটি শেয়ার করি।
লেখাটির নাম-ই 'এত কবি কেন?'
কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই লেখাটিতে:
'গদ্যের ঘাড় মটকে পদ্য আদায় করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে।...এখন যারা কবিতা লেখে তাদের বেশিরভাগই লেখে এক ধরনের ভাঙচুরময় গদ্যে। কেন লেখে? লেখা সহজ বলে।... কবিতা লেখার প্রথম শর্ত ছন্দ।'
তারপর এক মোক্ষম কথা বলেছেন শক্তি:
'আমার কাছে যদি কোনও তরুণ কবি আসে, লেখা দেখায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে শেকসপিয়ারের সনেট অনুবাদ করতে বলি।...সে কবি আর দ্বিতীয়বার আমার কাছে আসে না। সে তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে চলে যায়। সহনশীলতা ও সম্পাদকীয়তা ওর রক্তে। ও ঘষে-মেজে সেই তরুণের একটি কবিতা 'দেশ'-এ ছাপিয়ে দেয়।...সেই তরুণ কিন্তু হয়ে উঠল জবরদস্ত কবি। তাকে এখন ঠেকায় কে? সুনীল কবিতার যত বড়ো পৃষ্ঠপোষক তত বড়ো শত্রু।'
এরপর শক্তি নিজের যুগের কথা, বন্ধুদের কথা, পত্রিকার কথা, কবিসম্মেলনের কথা বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন।
জীবনানন্দ দাশের সেনেট হলে কবিতা পাঠ সম্পর্কে লিখছেন:
'সেই প্রথম জীবনানন্দকে চাক্ষুষ করি। তাঁর কয়েকটি কবিতা শুনি। তিনি মনে মনে এক ধরনের কবিতা পড়ে চলে গেলেন। কেউ শুনল কী শুনল না- সেদিকে দৃকপাত পর্যন্ত করলেন না। আমার সেই বয়সে মনে হয়েছিল, কবি হতে হলে এরকমটাই হতে হবে।'
তারপর লিখছেন:
'পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ছোটোখাটো গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। দুদেশের অবস্থা একইরকম। কবিতা ছাপা ছাড়া এদের মূল কাজ হচ্ছে একে অন্য গোষ্ঠীকে গালাগাল দেওয়া। সমালোচনামূলক গালাগাল নয়। খুবই ব্যক্তিগত, নিচু স্তরে নেমে এসে পরস্পরের কুৎসা করা।'
বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কবি শামসুর রাহমানকেও ছেড়ে কথা বলেননি শক্তি। তিনি লিখছেন:
'স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার' বইটি শামসুর রাহমানের শেষতম কবিতার বই। আমায় উৎসর্গ করা। বইটি হাতে পেয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম কদিন ধরে। পড়ে উঠতে পারলাম। কিন্তু এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। শামসুরের কবিতায় সে-ধার গেল কোথায়?'
বিতর্ক সৃষ্টি করবেন বলেই বুঝি লেখা। বাংলাদেশের তরুণ কবিদের সম্পর্কে লিখছেন:
'(বাংলাদেশের) যে সব পত্রিকাগুলো পাই তার মধ্যে পাঠযোগ্য কোনও লেখা খুঁজে পাই না। ভুল ছন্দে কী সব বিচিত্র লেখা। আমাদের এখানকার তরুণ রচনা থেকে অনেক কাহিল।'
অতঃপর বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছেন:
'ও (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) যে কীভাবে মহাকবি তৈরি করে চলেছে প্রতি হপ্তায় এবং মহিলা কবি। এত মেয়ে পদ্য লেখে।...আমার তো মেয়েদের কবিত্বে খুব সামান্য আস্থা আছে। এতখানি বয়সেও কবিতা সিংহ ভুল ছন্দে কীভাবে কবিতা লিখে চলেছে।'
যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এই নিবন্ধের অনেক বক্তব্যের সঙ্গে সহমত নই, তবু ভাবতে অবাক লাগে, শক্তি এতটা অকপট হলেন কীভাবে?
কবি বলেই কি!
প্রসংগত বলছি, সেই ১৯৮২ সনে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন টিএসসিতে কবিতা সম্মেলন হয়েছিলো- যা ছিলো মূলত এরশাদ বিরোধীতার প্রথম সূত্রপাত কিম্বা বিদ্রোহ। তখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কবিরা জমায়েত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। মফস্বলের অনেক কবিরাই আত্মীয়তার সূত্রে কিম্বা চেনাজানার সূত্রে অনেকেই বিভিন্ন হলে ছাত্রদের সাথে অবস্থান করছিলেন। তা দেখে চারু কলার ছাত্র কার্টুনিষ্ট হুদা টিএসসি'র কবি ও কবিতা সম্মেলন স্থানে হাতে লেখা কয়েকটি পোস্টার সেটে দিয়েছিলেন- "দেশে কবি ও কাকের সংখ্যা সমান"। সেই পোস্টারের বক্তব্য নিয়েও ব্যাপক বিরুপ আলোচনা সমালোচনা হয়েছিলো। তবে পোস্টারের বক্তব্য সমর্থন করে বিখ্যাত কবি, লেখক ভাষাবিদ হুমায়ুন য়াযাদ খুব প্রসংশা করেছিলেন।
স্যোশাল মিডিয়াও কয়েকজন কবি ছাগলের নাদির মতো কবিতা নেদে যাচ্ছেন। সেই কবিতায় না আছে ছন্দ, না আছে অর্থ, না আছে কোনো বিষয়বস্তু! তবুও তারা কবি। ওরা যদি স্ব-সম্মানে কবিতা না ছাড়ে তাহলে শক্তি প্রয়োগ করে কবিতা ছাড়ানো উচিৎ কবিতার সম্মান রক্ষার্থেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১০:২৮