জেল খানার সাহিত্য......
কারাগার সাহিত্য বা Prison literature বিশ্বসাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রিজন লিটারেচার হল, বন্দিদশায় লেখা রোজনামচা, কবিতা গল্প উপন্যাস সাহিত্য। অথবা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কারাগারের কাহিনী ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ফিকশন, নন ফিকশন ইত্যাদি লেখা। আবার যেই লেখার দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছে সেই সাহিত্যকেও প্রিজন লিটারেচার বলা হয়।
জেলখানার সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীন রোমান দার্শনিক রাজনীতিবিদ সেভেরিনাস বোথিয়াসের লেখা Consolation of Philosophy বইয়ের কথা বলতে হয়। বইটা লেখা হয়েছে ৫২৪ খৃ. কারাগারে বসে। এখন বিশ্বসাহিত্যে এটি অন্যতম ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের মর্যাদায় উন্নীত। ইতালির বিখ্যাত কবি দান্তে আলিগিয়েরি (১২৬৫-১৩২১ খৃ.) ফ্লোরেন্সে নির্বাসনের শেষ দিকে লিখেছিলেন 'ডিভাইন কমেডি' নামের জনপ্রিয় দার্শনিক উপন্যাস। খৃস্টধর্মের সংস্কারক প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার ওয়ার্টবার্গ কারাগারে বসেই 'নিউ টেস্টামেন্ট' জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
জেলখানায় লেখা আরও কিছু বিখ্যাত বই হলো- নাজিম হিকমতের ‘জেলখানার চিঠি’, অ্যান্তোনিও গ্রামসির ‘প্রিজন নোটস’, থমাস পাইনের ‘দ্য এজ অব রিজন’, হুগো গ্রোশিয়াসের ‘অন দ্য ল অব ওয়ার অ্যান্ড পিস’, বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফি’, হিটলারের আত্মজীবনী ‘মেইন ক্যাম্ফ’, ডানিয়েল ডিফোর ‘হিম টু পিলোনি’, মার্কো পোলোর ‘চীন ভ্রমণের কথা’ এবং ও হেনরির লেখা অনেক বিখ্যাত ছোটগল্প। ভলতেয়ার ১৭৫৭ সালে ফ্রান্সের কুখ্যাত বাস্তিল কারাগারে বন্দি থাকার সময় তার বিখ্যাত মহাকাব্য ‘হেনরিয়াদ’ লেখা শুরু করেন।
বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ জেলে বসে লিখেছেন। কারাগৃহেই মিগুয়েল দ্য সর্ভেন্তিস ‘দন কিহোতে’-বইয়ের প্রথম খণ্ড লেখেন।
মহাত্মা গান্ধী পুনে জেলে থাকাকালীন লিখেছিলেন 'মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ'। জওহরলাল নেহরুর ‘আত্মজীবনী’, ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি’, ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’। জেলে বসে জয়প্রকাশ নারায়ণ লিখেছিলেন 'প্রিজন ডাইরি'। সতীনাথ ভাদুড়ীর 'জাগরী' উপন্যাস জেলখানায় অসহযোগ আন্দোলনের সময় লিখেছেন। নকশাল আন্দোলনের সময় জেলের কথা লিখেছেন জয়া মিত্র, 'হন্যমান' এবং 'জেলের ভিতর জেল',- লিখেছন মীনাক্ষী দেবী। আজিজুল হক কারাগার জীবন নিয়ে লিখেছিলেন দুই খন্ডে, 'কারাগারে আঠারো বছর'।
মার্টিন লুথার কিং জেলে থেকে লিখেছিলেন, letters from Birmingham jal'. এজরা পাউন্ড এর 'pisan cantos' কবিতা সংকলন জেলখানায় বসে লেখা। নেলসন ম্যান্ডেলা জেলে বসে লিখেছেন- Conversation with myself।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জেলখানায় বসে লিখেছেন- ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ: ইমারজেন্সি অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ', ‘কারাগারে কেমন ছিলাম ২০০৭-২০০৮’। বিএনপির নেতা সাবেক এমপি দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবুর লেখা- জেলখানার ভেতর বাহির, আলো আঁধারের জেলখানা, আমার জেল আমার ঘর, জেল জীবনের কথা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বন্দি হন। জেলে বসে লিখেন ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ নামে একটি বই।
ফরাসি বিপ্লব কালে মার্কি দ্য সাদ সাড়া জাগানো 'লুনাটিক অ্যাসাইলামে' এবং অন্তর্ঘাতমূলক বই ‘120 ডেজ অব সোদোম’ জেলখানায় বসে লিখেছেন।
ইসলামি ইতিহাসের প্রিজন লিটারেচারঃ
ইসলামি ইতিহাসেও কারাগার সাহিত্যের দৃষ্টান্ত কম নয়। বিখ্যাত হানাফী ফকিহ ও উসুলবিদ শামসুল আইম্মাহ মুহাম্মদ সারাখসির (৪৯০ হি.) কথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। একটা মাসআলার দরুণ কারাগারে যেতে বাধ্য হন ৪৬৬ হিজরিতে। কারাগারে তাকে থাকতে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর। এই সময়ে তিনি ১৫ খণ্ডে ‘মাবসুত’ কিতাবখানা রচনা করেন। বর্তমানে এটি প্রায় ৩০ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। হানাফী ফিকহশাস্ত্রের একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে এটি স্বীকৃত। এছাড়াও কারাগারে বসেই ব্যাখ্যা করেছিলেন শাইবানী রহ.-এর ‘আস-সিয়ারুল কাবির’।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.(১২৬৩-১৩২৮ খ্রী.) প্রায় সাত বছরের কারাজীবনে তিনি লিখেছিলেন ‘আস-সারিমুল মাসলুল ফি সাতিমির রাসূল’, 'কবর জিয়ারত', 'মাযারপূজা', 'পীরপুরস্তি', 'মৃত মানুষের কাছে প্রার্থনা' ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি কারাগারে থেকে বিভিন্ন চিঠি লিখেছিলেন যা একজন গবেষক সেগুলো একত্র করে বের করেছেন ‘রাসায়েল মিনাস সিজনি’ নামে। সংকলনটি সম্প্রতি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তুরস্কের দরবেশ আলেম বদিউজ্জামান সাইদ নুরসীকেও (১৮৭৭-১৯৬০ খৃ.) জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে কামাল আতাতুর্কের জেলখানায়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ সংকলন ‘রাসায়েলে নুর সমগ্র’ তিনি রচনা করেছেন জেলে বসে। তার সেইসব রচনায় উঠে এসেছে কারাগার জীবনের কষ্ট যন্ত্রণার কথা।
মিসরে জামাল আবদুন নাসেরের শাসনকালে ইসলামপন্থীদের উপর জুলুম নির্যাতনের স্টিম রোলার নেমে এসেছিল। অনেকেরই লেখায় সেই অন্ধকার দিনগুলির কথা উঠে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জয়নাব আল-গাযালীর লেখা ‘আইয়ামুম মিন হায়াতী’। এখানে উঠে এসেছে জামাল আবদুন নাসেরের জুলুম নির্যাতনের অনেক চিত্র। বিশেষভাবে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সালে ইসলামপন্থী ব্রাদারহুডের সদস্যদের উপর নেমে আসা নির্মম নির্যাতনের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন।
হামিদা কুতুব ইবরাহিম একজন মিসরীয় সাহিত্যিক। ২৯ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালে তাকেও বন্দি করা হয় নাসেরী কারাগারে। ছয় বছর তাকে থাকতে হয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। বের হওয়ার পর তিনি উপন্যাসের আঙ্গিকে লেখেন ‘রিহলাতুন ফি আহরাশিল লাইল’ (রজনির ঝোপঝাড়ে যাত্রা)।
জেল খানার সাহিত্য পরিসর অনেক বিস্তৃত। কেউ আগ্রহী হলে গুগল করে অনেক তথ্য-উপাত্ত পেতে পারেন। আমিও গুগল ঘেটে অনেক তথ্য নিয়েছি।