ছোটকালে আমি এত কিছু বুঝতাম না। বোকা ছিলাম, অবুঝ ছিলাম, নাদান ছিলাম। কোরবানির সময় সবাই গরু আনতো। টাকা কম লাগার জন্য অনেকে ভাগে কোরবানি দিত। আর তার জন্য দেখতাম অনেকে কয়েকদিন আগেই গরু কিনত। দেখতাম গরুটা খালি হাম্বা হাম্বা করে, আর খালি কান্দে। চোখ দিয়া খালি পানি পড়ে। আমি বুঝতাম না। বোকা ছিলাম, অবুঝ ছিলাম, নাদান ছিলাম।
ঈদের দিন সকাল থেকে চাপাতি দা নিয়া মোল্লারা ঘোরাঘুরি করতো, মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলেরা ঘোরাঘুরি করতো এলাকায়। তাদের চোখে মুখে খুশি খুশি ভাব, চোখ চকচক করে। আমারও খুশি খুশি ভাব। কেন জানি না। কিন্তু সবাই খুশি তাই আমিও খুশি। নতুন জামা পাইতাম না কোরবানি ঈদে। পুরান জামাটাই ইস্ত্রি কইরা পরতাম। আর নতুন জামা এমন একটা ভাব নিয়া ঘুরতাম।
যথারীতি সকাল বেলা লোকজন আইসা গরুটারে বাইন্ধা ফেলতো। বাইন্ধা শোয়াইয়া ফেলতো। আমার তখন খুব হতভম্ব অবস্থা। বুক ধক ধক করতেছে। গরুটারে আমি খাবার দিছি, মাথায় হাত বুলাইয়া আদর করছি। গরুটা আমার আদর বুঝছে। সে কান নাড়াইছে, মুখটা আমার হাতের সাথে ঘষা দিছে। গরুটারে সবাই এমন কইরা বান্ধে কেন? মা গো বইলা দৌড়াইয়া মায়ের কাছে যাইতাম। মা বলতো আরে ছেড়া, কোরবানির ঈদ, জবাই দিবো না? ধুর ভোদাই!
এই কথা গুলা বন্ধুদের কাছ থেকে শুনা। আর তাদের কাছেই শুনলাম কোরবানির ইতিহাস।
তাদের অনেক বড় নবী, তার নাম ইব্রাহিম বাদশা। সকল মুসলমান খিস্টান ইহুদীদের হল বড় নবী। একদিন আল্লাহপাক তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়া বলল, হে ইব্রাহিম বাদশা, তোমার প্রিয় জিনিস আমার জন্য কোরবানি কর। ইব্রাহিম বাদশা তো পড়সে বিপদে। অনেক চিন্তা করে সে বুঝলো, তার ছেলে ইসমাইল হলো তার প্রিয়। তাই সে তার বউ বিবি হাজেরারে বললো, বউ আমি পোলারে কোরবানি করমু। বিবি হাজেরা উথাল পাথাল কান্না শুরু করে দিল, কিন্তু ছেলেরে তো আল্লাপাকের জন্য কোরবানি দেয়া লাগবো। সে ছেলেরে চুমা দেয়, আদর করে। তেল সাবান দিয়া গোছল করায়। তারপরে সুন্দর করে সাজাইয়া গুজাইয়া বাবার সাথে পাঠায়। বাবা বড় একটা ছুরি নিয়ে চলল ছেলে কোরবানি দিতে। দূর পাহাড়ে নিয়া কোরবানি দেয়ার সময় আল্লায় খুশি হইলো, খুশি হইয়া বললো হে ইব্রাহিম, আমি তোমার ভক্তিতে খুশি হইছি। তুমি একখান পশু কোরবানি দেও। ইব্রাহিম বাদশা খুব খুশি। একটা পশু কোরবানি দিয়া পোলারে নিয়া বাসায় আসলো। এই হইলো কোরবানির ইতিহাস।
আমার জানি কেমন কেমন লাগলো। আমি বললাম, ছেলের জন্য বাবা মায়ের ভালবাসা নাই, জবাই করতে গেল স্বপ্ন দেখে, এতে আল্লায় খুশি হয়? আল্লারে খুশি করতে মানুষ জবাই করতে গেলে আল্লায় খুশি হয়? আর আল্লায় যদি সময় মত খুশি না হইতো, তাইলে কি এখন ঈদে মুসলমানেরা ছেলে কোরবানি দিতো? আর তার বাপ মা ই বা কেমন বাপ মা, যে নিজের ছেলেরে জবাই দিতে যায়? সেই মা ই বা কেমন মা যে নিজের ছেলেরে গোছল দিয়া জবাই করতে পাঠায়? সে স্বামীর লগে ঝগড়াঝাঁটি মারামারি করতে পারলো না? সেই বাবা বলতে পারলো না আমার ছেলে আমি জবাই দিমু না, লাগে আমি নিজে জবাই হব? আল্লা ফাল্লা মানি না, আমার ছেলে আমি দিব না! আমার বন্ধুরা আমার এইসব কথা শুইনা দেয় ধমক। তখন তারা বলল, বিবি হাজেরা হইলো সকল মায়ের আদর্শ মা। বাবা ইব্রাহিম বাদশা হইলো সকল বাপের আদর্শ বাপ। তাদের মত কেউ নাই।
আমি বললাম, আচ্ছা এইবার আমার একটা কথার উত্তরদে, আজ রাতে যদি তোদের আল্লাহ্ তোর বাবাকে স্বপ্নে বলে তোকে কোরবানি দিতে। তাহলে কি তোর বাবা তোকে কাল সকালে গোসল করাইয়া তোকে কোরবানি দিবে। তারা কোন উত্তর দিতে পারল না।
আমার বন্ধুর ঈমান কম নাই, বিশ্বাস কম নাই, আল্লাভক্তি কম নাই। সেও কম মুসলমান না।
অনেক বছর পরে পুরান ব্যাপার স্যাপার গুলা নিয়া আবার চিন্তা করতে শুরু করলাম। অবুঝ নাদান হইতে লাগলাম। কেন ঠিক জানি না। রক্তারক্তি দেখলে আবার কান্না পাইতো। সেটা হিন্দু, মুসলমান কিংবা বোদ্ধ হোক। কয়েকজন মিল্লা একটা নির্বাক পশুরে চাইপা ধইরা হাসতে হাসতে জবাই দিতেছে, আনন্দে চোখ মুখ জ্বল জ্বল করতেছে, এই দৃশ্য কোন দিন আমি দেখতে পারতাম না। পেট গুলাইয়া বমি আসতো। মনে হইতো এতে নিজের মনের পশু প্রবৃত্তি কোরবানি হইতেছে না, আরো পশু প্রবৃত্তি বাড়তেছে। নির্বাক প্রাণীরে সবতে মিল্লা সবার সামনে চাইপ্পা ধইরা জবাই করা, এতে বাহাদুরীর কী আছে? ক্লাস ৮ম এর পরে আমি কোনদিন এই কাটাকাটির সামনে যাই না। আমি সেই সব করুন চাইনি দেখতে পারতাম না। চোখ দিয়ে ক্যামনে জানি পানি চলে আসত।
নতুন করে নানা ধরনের বই পড়া শুরু করলাম। জানলাম পৃথিবীর নানান দেশে নানান ধর্মে নানান রকম আনন্দ উৎসব আছে। কোন কোন অঞ্চলে কেউ কেউ মানুষ পোড়াইয়া খাইয়া ফেলে, কোন কোন অঞ্চলে উৎসবে রক্তারক্তি খুনখারাবী করা হয়। গ্ল্যাডিয়েটর ফাইট হয়, এক পক্ষ আরেকপক্ষরে মাইরা ফাটায়া ফেলে, একজন আরেকজনেরে জবাই দেয়। কোন কোন অঞ্চলে খোলা ময়দানে যৌনতা চলতে থাকে, উৎসব-আনন্দ-ফুর্তি। ওইসব অঞ্চলে সেইটাই উৎসব, সেইটাই তাদের আনন্দ করার উৎস। চারপাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়াইয়া গ্ল্যাডিয়েটর ফাইট দেখে, একজন আরেকজনার নাড়িভুঁড়ি বাইর কইরা ফেলতেছে, মগজ বাইর কইরা ফেলতেছে, রক্তারক্তি করতেছে, তা দেইখা আনন্দে চিৎকার দেয়। হাততালি দেয়। এখনও টিভিতে রেসলিং খেলা হয়; রক, আন্ডারটেকার আর বিগশো একজন আরেকজনরে মাইরা রক্তারক্তি করে। তা দেইখা মানুষ খুব মজা পায়। উৎসব হয়। আনন্দ হয়। স্টোন কোল্ড স্টিভ অস্টিন বিয়ারের ক্যান খুইলা ছুইড়া মারে। আবার কিছু কিছু অঞ্চলে মেয়েদের যখন বিয়ে হয়, সেই রাতে বিছানা রক্তাক্ত হওয়াটা সম্মানের বিষয়। সেই রাতে যদি বিছানায় রক্তপাত না হয়, সেই মেয়েকে অসতী- কুলটা বইলা গণ্য করা হয়। এবং সেইটা খুবই অসম্মানের বিষয়। এরকম হইলে সেই মেয়ের বাবা মার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। মেয়েটারেও তারা নিজেরাই হত্যা করে বেশিরভাগ সময়।
এই রকম নানা ধরনের প্রথা বহু যুগ ধইরা নানা জায়গাতে চইলা আসতেছে। এখনও আছে। সেই সেই অঞ্চলের লোকজন খুব ধুমধামের সাথেই উৎসবগুলা পালন করে। তাদের কাছে এই ব্যাপারটাই খুব স্বাভাবিক, বরঞ্চ এই সব প্রথার ভিন্ন কিছু দেখলেই তারা আশ্চর্য হয়।
অনেক আগের দিনে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিজের সন্তানরেও বলি চড়ানো হইতো। এইটাই ছিল সে সময়ের ধর্ম, সে সময়ের প্রথা। এতে মানুষের একটু খারাপ লাগলেও আপত্তি করতো না। পরিবারে কয়েকটা পোলাপান থাকলে একটা তারা দেবতারে দিত। দেবতা বলি পাইয়া খুশি হইতো বইলা তারা বিশ্বাস করতো। বলি না পাইলে গোস্বা করতো। অসুখ বিসুখ দিতো। অভিশাপ দিতো। ঝড় বন্যা হইতো। আর বলি পাইলে গোলাভরা ধান হইতো, পুকুর ভর্তি মাছ হইতো। দেবতার মন্দিরে তাই পোলা বা মাইয়াটারে জবাই দেয়া লাগতো। পাশে নানান উৎসব হইতো। বাদ্য বাজতো। মানুষ নাচগান করতো। যেই দেশে যেই নিয়ম। যেইখানে যেই ধর্ম। যেইখানে যেই আচার।
সভ্য মানুষ অনেক কিছুই করে আবার অনেক কিছুই করে না। আধুনিক মানুষ পুরান নিয়মকানুনগুলা পালটায়, যুগের সাথে সাথে সবকিছুই পরিবর্তন হয়। কারণ সবকিছুই পরিবর্তনশীল। আগে দেবতার নামে মানুষ বলি দেয়া ছিল মামুলি ব্যাপার, এখন ঈশ্বরের নামে গরু ছাগল জবাই দিতেও প্রশ্ন জাগে, এই জবাইতে আসলেই ঈশ্বর খুশি হয় কিনা! গরু মারায় ঈশ্বরের খুশি হবার কারণ কী? প্রকাশ্যে শিশুকিশোরদের সামনে রক্তারক্তিতে ভালবাসা আর ত্যাগ শেখা যায় কিনা! মুসলমানদের আইসিস এখন মানুষ জবাই দিতেছে হাসতে হাসতে,এরা এইসব ছোটবেলা থেকে প্রাকটিস করতেছে না তো?
বর্তমান সময়ে দেখতে পাওয়া যায় অনেকে তাদের স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্য ৭-৮টা গরু কোরবানি দেয়। আরে আপনার টাকা আছে সেটা আর কতভাবে মানুষকে দেখাবেন। আমি -৮টা গরু না কিনে একটা কিনেন। বাকিটাকা কোথাও দান করে দেন। আপনি ভাল ভাবে খেতে পারেন আর দেখা গেল আপনার বাসার পাশের ছেলেটা খেতে পাচ্ছে না। এই কেমন পৃথিবী। এই কেমন তাদের আল্লাহ্ র বিচার। এই কোরবানির মধ্য দিয়ে তিনি কি ধরনের শিক্ষা দিতে চান?
পোলাপানের সামনে উৎসব আনন্দ ফুর্তি কইরা দেখাইয়া দেখাইয়া করে না। এগুলা দেখাইয়া স্ট্যাটাস বাড়ায় না। সেইটা সভ্য মানুষের লক্ষণ না। আধুনিক মানুষের লক্ষণ না। রক্তারক্তি কোন বীরত্বের বিষয় না, নির্বাক পশুর উপরে বীরত্ব ফলানিরও কিছু নাই। এইটা দুঃখের বিষয়। সকল মৃত্যুই দুঃখের, নিষ্পাপ নির্বাক প্রাণীর মৃত্যুও দুঃখের। প্রয়োজনীয়, তবে দুঃখের।
সবাইরে কোরবানি ঈদের শুভেচ্ছা। কোরবানি দেন, আনন্দ করেন, কিন্তু গরু ছাগল জবাই দেয়াটা একটু আড়ালে কইরেন। সবাইরে কসাই বানাবার দরকার নাই। ছোট ছোট ছেলেদের চাপাতি রাম দা থেকে দূরে রাখেন। অনুগ্রহ করে সব বাচ্চাদের রক্তারক্তির ধারে কাছে রাইখেন না। এত জলদি জলদি বীর মুসলমানের ছেলে বানাবার দরকার নাই। আরো সময় আছে, রক্তারক্তি-ত্যাগ-আনন্দ-ফুর্তি অনেক করা যাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৮