তিন মেয়ের জন্মের পর দুটি ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু দুই ছেলেই খুব অল্প বয়সে মারা গেলে পিতামাতা দিশাহারা হয়ে যান। ৩রা ডিসেম্বর জন্ম হয় ৩য় সন্তানের। এবার জনৈক গুনিন পরামর্শ দেন-পরদিন সূর্যোদয়ের আগে ত্রৈলকানাথ আর লক্ষীপ্রিয় দেবীর ঘরে যেই আসবে-তার কাছে যদি এই সন্তানকে মাত্র এক মুঠো খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হয় তবে এই শিশুর বাঁচার সম্ভাবনা আছে।
বাবা-মায়ের সারারাত ঘুম হয়না। সন্তান বিক্রি হয়ে যাক। তারপরও তাদের শিশুটি দুনিয়ায় বেঁচে থাক।
সূর্যাস্তের আগেই ঘরের দোর খোলার জন্য কে যেন আওয়াজ দিলো।
বাবা-মা দোর খুলে দেখেন- কয়েক মাস আগেই শিশু জন্ম দেয়া আরেক মা- তাদের শিশুটিকে নেয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
এই মহিলার কাছেই মাত্র এক মুঠো খুদের বিনিময়ে শিশুটিকে বিক্রি করে দেয়া হয়। তাই শিশুটির নাম হয় ক্ষুদিরাম।
আর যে মা শিশুটিকে কিনে নেন- সে হলো ক্ষুদিরামেরই আপন বোন। নিজের ভাইকে সে চায়নি অন্য কেউ কিনে নিয়ে যাক। তাই, সে এক মুঠো খুদ নিয়ে সারারাতভর নিজ পিতামাতার গৃহের বাইরে দাঁড়িয়েছিলো- নিজ ভাইকে আপন মাতাপিতার কাছ থেকে কিনে নেয়ার অপেক্ষায়।
মেদিনিপুরে ক্ষুদিরাম যত বড় হতে থাকে। বাড়তে থাকে তার দুঃসাহস। পাশাপাশি জনহিতকর কাজ। ১৯০৬ সালে কাঁসা বা কাঁসাই নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক বন্যা হলে ক্ষুদিরাম ব্যাপক ত্রানকার্যে অংশগ্রহন করে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যান। এমনকি প্রচণ্ড জ্বরে তার মৃত্যশঙকা দেখা দেয়। বিধাতার কৃপা আর প্রচণ্ড মানসিক জোরে ক্ষুদিরাম সুস্থ হয়ে ওঠেন। এবার শুরু হয় তার একনিষ্ট ভাবে বিপ্লবী জীবনে অভিষেক। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং রাজনারায়ণ বসু এ দুজন ছিলেন তার মহান বিপ্লবী জীবনের গুরু।
বৃটিশবিরোধী গোপন আখড়াগুলোর প্রতিটি কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয় হতে থাকেন এবং একদিন প্রকাশ্যে "সোনার বাংলা" শীর্ষক বিপ্লবাত্মক ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। জেল থেকে পালিয়ে দুঃসাহসী ক্ষুদিরাম বিপ্লবী রাজনৈতিক দল যুগান্তরে যোগ দেন এবং একের পর এক গোপন বোমা হামলা চালাতে থাকেন এবং পুনরায় গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ১৯০৮ সালের ৩০ শে এপ্রিল বিহারে ইউরোপিয়ান ক্লাবে সর্বেশষ বোমা হামলা চালান এবং তিনজন বৃটিশ অফিসারকে হত্যা করেন।
এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে বিপ্লবী এক ভারতীয় ক্ষুদিরাম যখন ফাঁসির মন্চে। তখন আরো দুজন ভারতীয় লাথুনিপ্রসাদ ও জানকিপ্রসাদ জাজ হয়ে তখন বিচারকের চেয়ারে। এই দুই বিচারক বৃটিশ জাজ কর্নডফের সাথে ক্ষুদিরামের ফাঁসির আদেশ জারী করেন।
ফাঁসির আদেশ শুনে ক্ষুদিরাম হাসে শুধুই হাসে।
ক্ষুদিরামের হাসিতে বিভ্রান্ত হয়ে মিঃ কর্নডফ ভারতীয় বিচারক লাথুনিপ্রসাদকে বলেন- ও মনে হয় ওর যে ফাঁসির রায় হয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি।
১৮ বছরের ক্ষুদিরাম জাজের কথা শুনে বলে- বুঝতে পেরেছি বলেই হাসছি । মৃত্যুতো সবার হবে । কিন্তু এরকম বিপ্লবী মৃত্যু কয়জনেরই হবে।
বিচারক জানকিপ্রসাদ বলেন- মৃত্যুর পূর্বে তোমার কোনো অন্তিম ইচ্ছা আছে কিনা।
জ্বি আছে। কিন্তু সেটাতো পূর্ণ হবেনা। আমি চাই- আমার মৃত্যুর পূর্বে সব ভারতীয়কে বোমা বানানো শিখিয়ে যেতে।
এক মুঠো খুদের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া ক্ষুদিরাম আঠোরো বছরের বিপ্লবী জীবন নিয়ে ফাঁসির মন্চে হাসতে হাসতে মারা যান।
আজ এই মহান বিপ্লবীর ১৩০ তম জন্মদিন। নিজের দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে জীবন দেয়া এই বিপ্লবীকে যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যেতো তবে বিপ্লবী চে'র সাথে সাথে ক্ষুদিরামের ছবিটিও হয়তোবা আমাদের টিশার্টের বুকে-পীটে আজ শোভা পেতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:১০