যৌন অপরিহার্যতা বিষয়ে একটি জিনিস বলা উচিত... আধুনিক বিশ্বে যৌনতা জীববিদ্যা নয়, এটি জীববিজ্ঞান যা হাজার হাজার বছরের পিতৃতন্ত্র দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সংজ্ঞাটি সত্য নয়, তবে এটি আমাদের মনে প্রোথিত। এটা আমাদের সর্বসাধারণের সামাজিক-স্থানগুলোর এবং আমাদের মানসিক-কারাগারগুলোর স্থাপত্যে লেখা। পিতৃতন্ত্র দূর হয়নি, যৌনতা ভিত্তিক নিপীড়নও যায়নি, শেষ হয়নি এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে লড়াই করার প্রয়োজন।
'লিঙ্গসমালোচক' এমন একটি শব্দ যা লিঙ্গান্ধরা নিজেদের বর্ণনা করতে ব্যবহার করে। যদি আমি এটি ব্যবহার করি তবে আমি তা করছি কারণ এটি সেই অর্থে বর্ণনামূলক। এটি তাদের মতাদর্শ বর্ণনা করে না কারণ তারা লিঙ্গ সমালোচনামূলক নয়। বরং তারা লিঙ্গ অপরিহার্যতা আর যৌন অপরিহার্যতাবাদী। ভুল হওয়া সত্ত্বেও 'লিঙ্গসমালোচক' কিছু উপায়ে 'লিঙ্গবিদ্বেষী'র তুলনায় ভাল একটি শব্দ কারণ তাদের মধ্যে অনেকেই উগ্র নারীবাদী নয়।
লিঙ্গসমালোচক বা অধিকার বিরোধী গোষ্ঠীর অর্থায়ন এবং অতি ডানপন্থীদের আইনী পদক্ষেপ সিআইএ-এর অনেক অনেক উপায়ে প্রগতিশীল ভাষা অথবা উন্নয়নশীল দেশকে সহযোগিতা করার চেষ্টা নামক প্রতারণা থেকে ভিন্নতর। কারণ এইসব মতাদর্শ এবং আন্দোলনের মিশ্রণ শুধুমাত্র অর্থায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বেশিভাগই যারা নিজেদের লিঙ্গঅধিকারবিদ্বেষী হিসাবে চিহ্নিত করে তারা আসলে সমকামী বিরোধী, তারা বর্ণবাদী বিশ্বাসের সাথে সমর্থন প্রকাশ করে যা লিঙ্গান্তরিত লোকেদের (এবং সাধারণভাবে যেকোন মানুষের) উপর তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সমান্তরালে যায় এবং সেটাকে আরো নোংরামিতে বিস্তার করে। কিন্তু অর্থায়নের কেন্দ্র অনুসরণ করা একাধিক বিপর্যস্ত জায়গায় নিয়ে যাবে। একজনকে নারীর অধিকারের ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী হিসাবে দেখা কঠিন যখন তাদের কর্মকান্ডগুলি গর্ভপাত বিরোধী গোষ্ঠীগুলির সাথে সারিবদ্ধ হয়, অথবা তাদেরকে যারা পিতামাতাদেরকে সন্তান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরও ক্ষমতা দেয়ার পক্ষপাতী, বা যারা লিঙ্গরূপান্তর বিরোধী মানসিক চিকিৎসা বা ধর্মীয়ভাবে হেদায়েত করাকে সমর্থন করে।
অবশ্যই সবাই যারা নিজেদেরকে 'লিঙ্গসমালোচক' হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে তারা এই মতাদর্শের সব খারাপ অংশকেই যে সমর্থন করে, এমন কিন্তু না। তাদের সকলেই তাদের গোষ্ঠী এবং "দাতব্য সংস্থাগুলি" কীভাবে অর্থায়ন এবং পরিচালিত হয় সে সম্পর্কে সচেতন নয়৷ এবং কিছু যারা এবিষযটা খুঁজে পায় তারা এটাকে আদতে নিন্দাই করে। কিন্তু এটা আসলে জোটবদ্ধতার দোষে দুষ্ট নয়। এটি এক অন্তর্নিহিত মতাদর্শ। যদি একটি দলের শারীরিক স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাখ্যান করা হয় তবে এটি অন্যদেরকেও একই পথে পরিচালিত করে। যদি কিছু লোকের চারপাশে জৈবিক অপরিহার্যতা গ্রহণ করা হয় তবে অন্যান্য ধরণের জৈবিক অপরিহার্যতা গ্রহণ করতে তেমন আর একটা দীর্ঘ পথ বা পদক্ষেপ বাকি থাকে না। যদি একটি গোষ্ঠীকে বিকৃত বা ধর্ষক হিসাবে চিহ্নিত করা হয় তবে একই ধারণা অন্য গোষ্ঠীতেও প্রয়োগ করতে বেশি সময় লাগে না।
আসল ব্যাপারটা হল, তৃতীয়লিঙ্গের মানুষগুলো বিভিন্ন পদবী ও পন্থায় ও স্তরে থেকে নিজেদের পরিচয় ধারণ করে। তাদের কেউ কেউ (খুবই কম সংখ্যক) আবার এমনকি নিজেরাই 'লিঙ্গসমালোচক' বা 'লিঙ্গবিদ্বেষীনারীবাদী', ঠিক যেমন বেশিরভাগ নিপীড়িত গোষ্ঠীতেই কিছু কিছু লোক থাকে যারা তাদের নিজেদের নিপীড়নের পক্ষে যুক্তি দেখায়। অন্যদের সঠিকভাবে পুরোপুরি অর্থেই লিঙ্গসমালোচনাকারী বা লিঙ্গ/যৌন বিতর্কবিলোপকারী বলা যেতে পারে। অনেকে, এবং তর্কযোগ্যভাবে বেশিরভাগই, আরও প্রয়োজনীয় ধারণা বা বাঁধাধরা চিন্তাগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে যা কোন কোন সাম্প্রতিক অতীতের তৃতীয়লিঙ্গ অধিকার আন্দোলনের যুক্তিতর্কের সাথে যুক্ত ছিল। এবং যারা লিঙ্গ বিষয়ক গদবাঁধা ধারণাগুলি পূরণ করে, অনেক লোকের মতো যাদের 'জৈবিক নারী' এবং 'জৈবিক-পুরুষ' বলা হয়, তারাও আসলে বাইনারি যৌন ও লিঙ্গের দ্বিমূল পিতৃতান্ত্রিক প্রত্যাশার কারণেই তা করে। যদি রাস্তায় কাউকে 'যথেষ্ট-পুরুষ' বা 'যথেষ্ট-মহিলা'র মত না দেখতে হওয়ার জন্য অথবা কে কার সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপণ করলো, এ কারণে মারধর করা হয়, তবে এই জিনিসগুলি কেবল দার্শনিক বিতর্কই নয়, এগুলি ব্যবহারিক এবং বেঁচে থাকার বিষয়ে অপরিহার্য্য অংশ হয়ে ওঠে।
লিঙ্গবিদ্বেষীদের স্তরভিত্তিক অবস্থানগত বৈচিত্র্য অনেক কম। তাদের প্রেক্ষাপট বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আসতে পারে, এটা নিশ্চিত। তবে তারা এইসব অবস্থান ও প্রেক্ষাপট একসাথে একটি চুঙ্গির মত সংগ্রহ করে। আমি সেই ফানেলে মানুষের ধারণাসমূহকে সংগ্রহ করাটা দেখেছি। আমি দেখেছি মানুষকে এটা দিয়ে নিচে তলিয়ে যেতে। এই চু্ঙ্গিগত মনোভাব অন্যান্য আরো প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানগুলি ধারণ/তৈরি করে।
যখন কেউ বলে যে তারা তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য লড়াই করছে কিন্তু একই সাথে অন্যের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের সমস্ত সময় ব্যয় করছে তখন তারা আসলে আর মুক্তিযোদ্ধা থাকে না। অবশ্যই তারা তর্কাতীতভাবে শাসন করার জন্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। যদি একজন শ্রমিক শ্রেণীর ব্যক্তি উদ্বাস্তু বা অভিবাসীদেরকে তাদের নিপীড়নের জন্য দায়ী করে, অথবা একজন পুরুষ নারীদের আক্রমণ করে কারণ তারা পুঁজিবাদের অধীনে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে এটি ভুলভাবে এইসব আক্রমণ হয়েছে, আমরা দেখতে পাব যে এগুলোও নিপীড়ন। এই সামাজিক ক্ষমতার কাঠামো ধ্বংস করা দরকার, নিজেকে শক্তিশালী বোধ করার খাতিরে তা সমর্থন বা জোরদার না করে। যারা বলে যে তারা নারী মুক্তি বা অধিকারের জন্য লড়াই করছে তাদের জন্য তৃতীয়লিঙ্গের মানুষকে আক্রমণ করাটা সময় ব্যয় করা ছাড়া অন্য কোন মানেই রাখে না। এই দু'পক্ষের সবাই-ই কিন্তু মানুষগুলো একই পদ্ধতি বা সমাজব্যবস্থা দ্বারা নিপীড়িত হচ্ছে। এটি সেইসব নারী এবং পুরুষদের মতো যারা নিজেদের মানবাধিকার কর্মী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন কিন্তু যারা পুরুষতন্ত্রের পরিবর্তে নারীবাদীদের প্রতি ক্ষুব্ধ। এবং প্রায়ই এরাই সেইসব মহিলা এবং পুরুষ যারা লিঙ্গবিদ্বেষী হয়। এবং এইসবগুলো দলই একই গোত্রের দ্বারা অর্থায়ন পেয়ে থাকে।
আমি এখানে যা বলছি তার কোনোটির অর্থই এই না যে লিঙ্গবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকারী সকল ব্যক্তিকেই হিসাব থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে হবে। তারা সমাজের মধ্যে গেঁথে থাকা অনেক অনুষঙ্গের মতোই। আমি বলতে চাচ্ছি যে, বাদ দেয়া যাবে না, যদি না আপনি আপনার চেনাজানা প্রতিটা যৌনবাদী ও বর্ণবাদী ও সমকামবিরোধী ও পুঁজিবাদী, সবাইকেই হিসাবের বাইরে রাখতে পারেন। কিন্তু এই বিষয় বা জিনিসেরও বিভিন্ন মাত্রা আছে। কিছু লোক আছে যারা নিজেদেরকে এবং নিজেদের ঘৃণাকে হিংসাত্মকভাবে প্রকাশ করে, আর কিছু লোক যারা এইবিষয়ক ভাবনা প্রকাশ করে চিন্তাশীল ও বিনীতভাবে । কিছু নির্যাতিত মানুষ প্রকাশ্যঘৃণাকারীকে পছন্দ করে কারণ অন্তত সেক্ষেত্রে নিজস্ব অবস্থানটা কোথায় তা জানা আছে এবং কিছু সামাজিক সমর্থন নিয়ে এইসব প্রকাশ্য-ঘৃণাকারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও যায়। অন্যদিকে সূক্ষ্ম গোঁপন ঘৃণাকারী-সংস্করণগুলিকে কিছুটা সমস্যাযুক্ত, যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন কারণ এদের ছদ্মের সাথে সাথে আরও রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা। কিছু মানুষ আছে যারা অন্যদের কাছে পৌঁছাতে পারে, পারে তাদের মতামত পরিবর্তন করতে। কেউই স্থির বা অবিচল নয়। আমরা সবাই বছরের সাথে সাথে বিষষ সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে বিকশিত ও পরিবর্তিত করি। এবং অবশ্যই বেশিরভাগ লোকেরা যারা অপরিহার্যতার সাথে দহরমমহরম করে তাদের জীবনে সেটা ছাড়াও আরো অনেক কিছুই আছে। তাদের আছে একাধিক কারণ। কিছু হয়ত তাদের মানসিক আঘাতের সাথে জড়িত, আর কিছু হয়তো সেই সাথে নির্ভরশীল তারা যে ক্ষমতায় অবস্থিত সেটার উপর। কিন্তু মানবজাতি সম্পর্কে এ কথাটাও সত্য যে, আমরা দ্বিমত হতে পারি এবং তারপরও একে অপরকে ভালবাসতে পারি যদি না একজনের মতবিরোধ অন্যের নিপীড়ন এবং মানবতা ও অস্তিত্বের অধিকারকে অস্বীকার করার মূল কারণ হয়ে থাকে।
যারা তাদের বিশ্বাসকে ব্যবহার করে, হাতিয়ার বানিয়ে বলে যে লিঙ্গান্তরিত নারীরা নারী নয়, তৃতীয়লিঙ্গের মানুষের অধিকার এবং মুক্তির জন্য তারা এক বিরাট সমস্যা। এমনকি তারাও হয়তো বুঝতে পারছে যে যৌন/জীববিদ্যা বাইনারি/দ্বিমূলক বিষয় নয়। তারাও বুঝতে পারছে যে যৌনতা সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াটা সামাজিকভাবেও নির্মিত হয়। সুতরাং তারা বুঝতে পারে যে আমাদের সত্যিই যৌনতা এবং লিঙ্গকে আলাদা জিনিস হিসাবে দেখা উচিত না। এদুটোর উভয়ই এপ্রকার সামাজিক নির্মাণ এবং দুটোর উভয়ই হ্রাসকারী এবং অপরিহার্যতাবাদী। এদুটো বিষয় বিজড়িত হয়। আমি মনে করি, উভয় (শব্দ)পদই অগণ্য সংখ্যক জিনিস বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
আমি মনে করি আলোচনা সমালোচনা করাটা মহান কাজ। কিন্তু আমি অসম্মতিতে সম্মত হওয়ার সীমা সম্পর্কে আমার পূর্বোক্ত উদ্ধৃতিটিতে ফেরত যেতে চাই। আমি এটাও পরামর্শ দিচ্ছি যে লিঙ্গবিদ্বেষী লোকেদের মতামতের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। যা প্রায়ই প্রজনন সংক্রান্ত ক্ষমতা ও অধিকারেই সীমিত। এটা জীববিজ্ঞান দ্বারা নারীকে সংজ্ঞায়িত করার ভুল-প্রচেষ্টা। এটা লিঙ্গকে অনুমান করে নিয়ে "পুরুষদের" সংজ্ঞায়িত করার অপপ্রচেষ্টা। এটা কখনও কখনও যুক্তি দেয় যে কোন মানুষকে শুধুমাত্র 'ব্যক্তি' বলা আপত্তিকর। এটা জনসাধারণের পয়:নিষ্কাষণ এবং গার্হস্থ্য সহিংসতায় আশ্রয়ের মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলির ক্ষেত্রকে সীমিত করে তোলে।
কিন্তু এটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, আমার কবিতা ও মতবাদের সাথে মানুষের যে সমস্যাটি রয়েছে তা হল আমার প্রস্তাবে উভয় পক্ষই সমান উপাদানে তৈরী যা আসলে সেখানে নেই। এটা অনেকটা ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন উভয়কেই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলার মতো। অথবা বর্ণবাদী এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অধিকারের জন্য লড়াকু, উভয়কেই মুক্তিযোদ্ধা বলার সামিল; অথবা যে (আবার তথাকথিত সামাজিক শর্তাবলী ব্যবহার করছি) পুরুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা জৈবিক পুরুষ এবং নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করা জৈবিক নারী উভয়ই সমান। আমি বলতে চাচ্ছি যে এই সমস্ত উদাহরণে উভয় পক্ষই মনে করে যে তারা মুক্তির পক্ষের যোদ্ধা। কিন্তু বাস্তবে একপক্ষ ক্ষমতার অধিকারী এবং অপরপক্ষ সেই শক্তি দ্বারা নিগৃহীত। এটি অবশ্যই এই বিস্তৃত তুলির আঁচড়ের চেয়ে আরও জড়িত এবং জটিল। কিন্তু ক্ষমতা এখানে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, এবং প্রভাব হয়ে যায় অভিপ্রায়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।
এটা বলতে অপেক্ষা রাখেনা যে, বর্ণবাদী এবং যারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা সবাই একই-প্রকার-মুক্তিকামী নয়। কেবল এটাই বলা যায় যে, যারা বিশ্বাস করে 'লিঙ্গাতরিত নারীরা নারী নয়' তারা আসলে মৌলিকভাবে লিঙ্গবিদ্বেষী, এবং তাই একটি শ্রেণী হিসাবে, তারা লিঙ্গ অধিকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
যৌনপরিচয় এবং লিঙ্গপরিচয়, উভয় ধারণাই সামাজিকভাবে নির্মিত, তবে তারা একই জিনিস নয়। তারা উভয়ই দ্বান্দ্বিকভাবে সম্পর্কিত, বিপরীতের ঐক্য। যৌনতা - এবং সাধারণভাবে আমাদের দেহ - সামাজিকভাবে নির্মিত এক ধারণাসমষ্টি, তবে এটাও ঠিক যে আমাদের শারীরিক উপস্থিতি রয়েছে। লিঙ্গ হল কিভাবে পিতৃতন্ত্র আমাদের যৌনজৈবিক দেহকে সংজ্ঞায়িত, নিয়ন্ত্রিত এবং শোষিত করার চেষ্টা করে, সেই কাহিনীর সর্বমোট।
নারীবাদের মৌলবাদী অবস্থান অনুযায়ী, যেমনটা আমি বুঝি, লিঙ্গ হল একটি সামাজিক নির্মাণ যা আমাদের উপর পুরুষতান্ত্রিক এবং শ্রেণীবাদী সমাজ দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি লিঙ্গে অবিশ্বাস করি। মানে আমি মনে করি লিঙ্গ নিজেই প্রধান সমস্যা। এবং আমরা যদি 'মেয়েলি' এবং 'পুরুষালি'কে কেবলমা্ত্র বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করি, তাহলেও কিন্তু আমরা পিতৃতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণকারী অজানা অদৃশ্য শক্তির জন্য নিজেদেরকে ভাগ করে নিচ্ছি।
আমি মনে করি অনেক মৌলিক নারীবাদী, আমি নিজেও এর অন্তর্ভুক্ত, এই ভেবে আতঙ্কিত যে তৃতীয়লিঙ্গের অধিকার আন্দোলনের বেশিরভাগ অংশই লিঙ্গের ধারণাকে মনে করছে যে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য কোন ধরণের আচরণ গ্রহণযোগ্য সে সম্পর্কে লিঙ্গবাদী, বর্ণবাদী ও শ্রেণীবাদী নিয়ম ছাড়াও অন্য কিছু বাস্তবতা রয়েছে। আসলে এগুলো ছাড়া আর কোনই বাস্তব প্রতিবদ্ধকতা নেই। এবং নারী মুক্তির পুরো জোর এই নিয়মগুলিকে প্রত্যাখ্যান করার উপর কেন্দ্রীভূত করা উচিত, এবং আমাদের উচিত জীববিজ্ঞান নির্বিশেষে যে কোনও ধরণের যৌন অভিব্যক্তি বা লিঙ্গ ভূমিকা বেছে নেওয়ার অধিকারের জন্য লড়াই করা।
লিঙ্গস্বাধিকার আন্দোলন যৌনতা এবং লিঙ্গের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশাল সব প্রশ্ন উত্থাপন করছে, এবং আমাদের আরও গভীরভাবে চিন্তা করার জন্য দাবি জানাচ্ছে। আমাদের চিন্তার সীমানাকে প্রসারিত করেছে নারীমুক্তি এবং সমকামী মুক্তির সীমাবদ্ধতাগুলোরও বাইরে। আমি মনে করি 'ইহা' একটি খুব ভাল জিনিস। আমি মনে করি আমাদের এই ধারণাগুলি সম্পর্কে নিবিড়ভাবে আলোচনা/তর্ক করা উচিত, তবে কোন ধারণাকে 'লিঙ্গবিদ্বেষী' হিসাবে আক্ষ্যায়িত করার বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক হওয়া উচিত। আমি বলতে চাচ্ছি, যখন তা তা-ই হয়, তবে তাই বলুন, কিন্তু কোন উপাধি খুব তাড়াতাড়ি না দেওয়াই শ্রেয়। ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ভাবনার পূর্ণ, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরাপদ আলোচনা দরকার।
আমি কি ব্যক্তিগতভাবে লিঙ্গ অধিকার দ্বারা প্রভাবিত? না। তবে কি আমি ব্যক্তিগতভাবে যদি কোন কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকি, তাহলে কি কোন মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে আমার লেখাটা উচিত নয়? আমার বিশ্বাস এর ঠিক বিপরীত। বিশেষাধিকার একটি বাধ্যবাধকতা। প্রথমত, চুপ করা এবং শোনা। কিন্তু শুরুতেই অথবা পরে, কোন এক সময়, কোন একটা পক্ষ বেছে নিতেই হবে এবং এর জন্য লড়াই করতে হবে। এটি কখনই নির্যাতিত গোষ্ঠীর নেতৃত্ব অনুসরণ করার মতো সোজাসাপ্টা বিষয় নয়, কারণ মুক্তি সংগ্রামগুলি সর্বদাই বিভিন্ন ধরণের নিপীড়ন এবং শ্রেণী স্বার্থ দ্বারা বিভক্তিত হয়ে থাকে।
একমাত্র না হলেও অন্তত প্রধানতম প্রশ্ন যেটা একজনকে লিঙ্গবিদ্বেষী হিসাবে বিবেচনা করা হবে কি হবেনা এই বিভাজক দাগটা টানে, তা হলো: 'আপনি কি স্বীকার করেন যে লিঙ্গান্তরিত-মহিলারা মহিলা?' কেউ যদি তা স্বীকার না করেন তবে 'সে' একজন লিঙ্গবিদ্বেষী এবং কমরেডসম আলাপের অযোগ্য।
যদি এই কথোপকথনটি লিঙ্গের পরিবর্তে বর্ণ বা জাতি সম্পর্কে হয়, লিঙ্গান্তরিত মহিলারা আসলেই মহিলা কিনা তা জিজ্ঞাসা করার পরিবর্তে যদি বিতর্কটি হয় কালো মানুষ আসলেই মানুষ কিনা, তাহলে কি এটাকে একটি বৈধ বিতর্ক বিবেচনা করা যায়?
এটি কোন বৈধ তুলনা নয়। কালো মানুষ সত্যিই মানুষ কিনা এই প্রশ্ন করার সমতুল্য হতে পারে: লিঙ্গান্তরিত-মানুষ সত্যিই মানুষ কিনা, এই প্রশ্নটা করা।
আর লিঙ্গান্তরিত-নারী নারী নন বলা 'মানে' এই না যে তারা মানুষ নয়। লিঙ্গান্তরিত মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করার কারণ এই নয় যে তারা প্রকৃত নারী (এবং প্রকৃত পুরুষ); এটার কারণ তারা মানুষ এবং তাদের মানবাধিকার রয়েছে – এবং তার চেয়েও বেশি: তৃতীয়লিঙ্গের এই মানুষগুলো একটি গোষ্ঠী হিসাবে নিপীড়িত, তাই এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অধিকারের প্রশ্ন নয়। আমাদের সকলেরই তাই উচিত তৃতীয়লিঙ্গের পক্ষে, লিঙ্গহীনতার পক্ষে, লড়াই করা।
আমার মতে মহিলারা তাদের দৈহিক-জীববিজ্ঞানের সমষ্টি নয় এবং আমার মতে মহিলা (অথবা পুরুষ) শুধুমাত্র একটা লিঙ্গ পরিচয় না। আমি "একজন প্রকৃত নারী"-ধারণার সাথে একমত নই। আমি মনে করি এটি হাজার হাজার বছর ধরে নারীদের নিপীড়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এমন একট্ হাতিয়ার।
আমি মনে করি নারী মুক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন অংশ এবং সমকামী মুক্তির বিভিন্ন দল এবং ক্রমবর্ধমান লিঙ্গস্বাধিকার আন্দোলনের গোত্রগুলোর নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা সকলেরই প্রাকৃতিক-মিত্র হওয়ার কথা, তবে যেহেতু তাদের আছে ভিন্ন ইতিহাস এবং বস্তুগত অবস্থান, তাই তাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে বাধ্য। এর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জনগণের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেমন হয় তেমনটা হওয়া উচিত, পরস্পর শত্রুদের মধ্যে যেমন তেমনটা না হওয়াই ভালো।
প্রকৃত শত্রু, ফ্যাসিবাদী সংবাদমাধ্যম এবং নব্য উদারনৈতিক পুরুষতন্ত্র উভয়ের মাধ্যমে. লাফিয়ে আগুনে আরো ঘি ঢালে, ঝাঁপিয়ে পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। কিন্তু তাদের সেই সুযোগ দেয়া ঠিক না যখন তারা বন্ধুদের শত্রু হিসাবে ভেবে আক্রমণ-আচরণ করার জন্য প্রলোভিত-চোষণ শুরু করে । এবং হ্যাঁ, এখানে সীমানার উভয় পাশের অনেক লোকজনই রয়েছে, যাদের অনেকেরই আছে বিশ্বের প্রতিটি অংশে সমস্ত রঙের মহিলাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার কয়েক দশক দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু তারা আসলে 'লিঙ্গবিদ্বেষী সীমানার/বেড়ার' কোন পাশে আছে? "লিঙ্গান্তরিত মহিলারা কি নারী?" এই প্রশ্নটাই হওয়া উচিত একটি বিভাজক সীমানা যা নির্ধারণ করে যে কেউ আসলে লিঙ্গবিদ্বেষী কিনা।
"লিঙ্গান্তরিত নারীরা নারী" এর চেয়ে ভালো স্লোগান আর কি হতে পারে? আদর্শভাবে এমন কিছু যা সমস্ত তৃতীয়লিঙ্গের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং জীববিদ্যা সম্পর্কে অর্থহীন দর্শন এড়িয়ে যায় এবং এড়িয়ে যায় 'লিঙ্গ কী' এবং 'সত্যিকারের তৃতীয়লিঙ্গ কী' এবং 'একজন মহিলা বা পুরুষ আসলে কী'… এইসব আজেবাজে প্রশ্ন। প্রকৃতঅর্থে তা এমন কিছু যা আসল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে, যাহলো ঐতিহাসিকভাবে লিঙ্গান্তরিত মানুষের কলঙ্ক এবং বৈষম্য থেকে মুক্ত করা, সেইসব বৈষম্য যা এখনো তাদেরকে আমাদের সমাজের সমসদস্য হওয়া থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে।
"লিঙ্গান্তরিত নারীরা নারী" এর চেয়েও ভালো স্লোগান হতে পারে 'লিঙ্গের মুক্তি এখন'।
আমি বুঝতে পারি যে এটা কেবল মুক্তির রাস্তাটাকে আরো দীর্ঘ বানায়, এটা আসলে একধরনের টালবাহানার আশ্রয়। এটা প্রশ্ন তোলে, তৃতীয়লিঙ্গের জনগণ বিভিন্ন বিষয়ে যে বৈষম্যের মুখোমুখি হয়, তাতে আপনার অবস্থান কোথায় ? কিন্তু হয়তো এই প্রশ্নগুলো একটু কম বিষাক্ত পরিবেশে তর্ক করা যেতে পারে, যেখানে মতানৈক্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে একে অন্যকে শত্রু শিবিরে নিয়ে না যায়।
এর আগে আসা নারীমুক্তি এবং সমকামী মুক্তির মতোই, লিঙ্গস্বাধিকার হল একটি মুক্তিমূলক মনন-প্রসারণকারী আন্দোলন, এবং আমি মনে করি যে এর অনেক কিছুই সঠিকভাবে আসবে যদি 'লিঙ্গান্তরিত মহিলারা নারী নয়' এবং 'লিঙ্গান্তরিত পুরুষরা পুরুষ নয়' এটা ভাবা শুরু হয়: তারা নতুন কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে। হতেই পারে লিঙ্গহীন মানুষ চিরকাল থেকেই সমাজের একটি অংশ ছিল-আছে-থাকবে, কিন্তু এখন তারা একটি আন্দোলন, যা সম্ভাবনার রংধনু হয়ে অন্য কিছু হিসাবে লিঙ্গ পরিচয়ের পুরো ধারণাটিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৩:৫০