আমার গলায় Nikon3100 ঝুলানো, সারা দিন হাটতে হাটতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে এখন রমনা পার্কের একটা ছাউনিতে বসে আছি ৷ কাকরাইল মসজিদ এর পাশে যে গেট টা আছে সেই গেট দিয়ে রমনা পার্কে ঢোকার সময় আধ লিটার একটা পানির বোতল কিনেছি ৷ আমি সাধারণত ঠাণ্ডা পানি খাই ৷ কিন্তু ঠান্ডা পানি ধারে কাছে পাওয়া সম্ভাবনা না থাকায় এই ব্যবস্থা ৷ আধ লিটার পানি কেনার সময় ভেবেছিলাম খেতে পারব না ৷ কারন নরমাল পানি বিচ্ছিরি লাগে ৷
কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছাউনির নিচে যেতে যেতে পানি শেষ ৷ সম্ভবত তেষ্টা বেশি পেয়েছিল ৷ এখন ভর দুপুর ৷ রমনা পার্কে তেমন মানুষের চলা ফেরা নাই ৷ আমি যে ছাউনি টা তে বসে আছে সেটা বেশ বড় ৷ বেশ আরাম করে বসেছি ৷ বেশিই আরাম হয়ে গেছে মনে হল, একটু ঝিমুনি আসছে ৷
সারা দিনে কি কি করলাম ভাবছি ৷ অনেক ছবি তুললাম ৷ সেই সেগুন বাগিচা থেকে হাটতে হাটতে পুরাণ ঢাকা চলে গিয়েছিলাম ৷ হাটতে হাটতে শেষে যেয়ে থামলাম একটা নদীর পারে নদীটার উপর দিয়ে একটা বড় ব্রিজ চলে গেছে ৷ এলাকার নাম টা জানা হল না ৷ আবার হাটতে হাটতে গেলাম গেলাম শান্তি নগর, সেখান থেকে আবার কত দিকে…
আমি জানি না এখন কি করব, কোথায় যাব ৷ ভীষণ হতাশ লাগছে ৷ তবে কেন হতাশ আমি জানি না ৷ কখনো কখনো এমন হয় ভীষণ হতাশ লাগে ৷ এর কারণ কি ?
মানুষ তার অজান্তেই নিজের মাঝে হারিয়ে যেতে পারে ৷ প্রত্যেকটি মানুষের মাঝে সাগর পরিমাণ, সাগর বললে মনে হয় কম হবে তার চেয়ে বলি মহাকাশ পরিমাণ উপাদান আছে যার মাঝে সে হারিয়ে যেতে পারে ৷ এই যেমন আমি এখন ভাবছি মানুষ সব চেয়ে বড় কিছুর উদাহরণ হাঁটলে সাগর কে টেনে আনে ৷ জীবনে প্রথম যেদিন সাগর দেখেছিলাম নিজে খুব ছোটো মনে হয়েছে ৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে আপনি যখন অনেক বড় একটা বিশাল একটা বস্তু দেখবেন প্রথম দেখায় তা অনেক বড় মনে হবে, আস্তে আস্তে তা আপনার কাছে অত বড় মনে না ও হতে পারে ৷ যথা সম্ভব আস্তে আস্তে তা আপনার চোখে সয়ে যাবে ৷ আপনি আরও বড় কিছু চাইবেন ৷ কিন্তু মজার বিষয় হল আপনি যখন সমুদ্রের সামনে যাবেন, অজশ্র বার আপনার তা মনে হবে না ৷ এর কারণ কি ?
এতক্ষণ কেন এই সব ভাবলাম তা জানি না, মাঝে মধ্যেই আমার মনের মাঝে এমন প্রশ্ন জাগে আবার চলে ও যায় ৷ আমি বসে আসি ছাউনির নিচে মাঝে মধ্যে একজন দু জন আসছে যাচ্ছে ৷ আমার সামনে এসে একজন মাঝ বয়সী মানুষ বসল ৷ দেখতে মাঝ বয়সী হলেও চার চুল কিছু সাদা হয়ে গেছে ৷ উনি সম্ভবত বেশি টেনশন করেন ৷ আমি মাঝে মধ্যে তার দিকে তাকাচ্ছি ৷ কারো দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে থাকলে ব্যাপার টা কেন যেন দেখায় ৷ এই কেমন দেখানো টা আমি ব্যাখ্যা করতে পারলাম না ৷
লোকটার পাশে একটা ব্যাগ রাখা ৷ আমার যেহেতু খেয়ে কাজ নেই সময় ব্যয় করার চেষ্টা করছি আমি ভাবলাম কি থাকতে পারে উনার ব্যাগ এ ? ব্যাগটা অফিস ব্যাগ, সম্ভবত অফিসিয়াল কাজের কাগজ পত্র আছে ৷ কিন্তু এখন ভর দুপুর অফিস রেখে এখানে কেন ?
পরে ভাবলাম থাকতেই পারে যা খুশি হোক আমার কি ? আবার ভাবলাম নাহ কাজ নেই ভাবি কি আছে ৷ লোকটার ব্যাগ টা যে বেশ ফুরে আছে তা না, আবার ব্যাগ যে একদম খালি তা না ৷ বলা যেতে পারে স্বাস্থ্যবান ব্যাগ ৷ লোকটা মোবাইল টেপা টেপি করছে আমাকে খেয়াল করছে বলে মনে না হলেও আমি বুঝতে পারলাম উনি আমাকে ভাল ভাবেই খেয়াল করছেন ৷
আমি আবার ব্যাগ এর দিকে নজর দিলাম ৷ ব্যাগ এ বই তাকতে পারে, কাপড় চোপড় থাকতে পারে , কাগজ পত্র থাকাই সব চেয়ে যুক্তি যুক্ত ৷ দমকা বাতাস বইছে ৷ রমনা পার্কে আমার বেশ একটা শীত শীত ভাব লাগল নিশ্চয়ই শীত চলে আসছে ৷ উঠে যাব কিনা ভাবছি তখন দেখলাম ব্যাগটা দুলছে ৷ না না ভীষণ ভাবে দুলছে তা না ৷ দমকা বাতাসে অল্প একটু দুই পাশে দুলছে অনেকটা …. কি ভাবে বুঝানো যায় ?? ডিম!!! ধরেন একটা ডিম কে আপনি যদি টেবিলে রেখে একটা টোকা দেন তাহলে যেমন অল্প অল্প দুলবে ওরকম ৷
হাহ… ব্যাগের ভেতর তাহলে ডিম !!! মনে মনে হাসলাম কি সব ভাবছি ৷ পাগল হয়ে গেছি নিশ্চয়ই ৷ আমি ভাবলাম এবার উঠা যাক ৷ অনেক ফালতু চিন্তা হয়েছে ৷ উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কেন যেন উঠতে পারছি না ৷ আমার ক্লান্ত পা দুটো নড়তে চাচ্ছে না ৷ আচ্ছা উনার ব্যাগ এ কি কোনও গোলাকার বোমা আছে ? হঠাৎ বুক টা ধড়ফড় করতে শুরু করল ৷ ধুর ছাই কি ভাবছি মেজাজ টা গরম হচ্ছে ৷
লোকটা চলে যাচ্ছে ৷ মনটা যেন কেন আরও খারাপ হয়ে গেল ৷ আবার ভয় লাগছে ৷ আমি কিছু সন্দেহ করেছি বুঝে ফেলল নাকি ? মনটা ভাল ছিল তা না ৷ কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল আরও, মনে হয় আমি সামাজিক জীব ৷ হাজার হলেও একটা মানুষ ছিল আমার সামনে ৷ ভাল লাগছিল একটু ? চলে যাওয়াতে আরও খারাপ লাগছে আগের চেয়ে ? কি সব ভাবছি আমি একবার বলছি এই লোকের ব্যাগে বোমা আবার...ধুর মাথায় সমস্যা হল নাকি … এবার উঠেই পড়লাম ৷ হাঁটছি রমনা পার্কের সুন্দর রাস্তা দিয়ে ৷ ভাল লাগছে ৷ এদিক ওদিক ঘুরছি দু একটা ছবি তুলছি ভাল লাগছে ৷ ক্যামেরা এর ফোকাস ঠিক করছিলাম হঠাৎ দেখলাম সেই ব্যাগ ৷ আরে সেই লোক না ? উনি গেট দিয়ে বের হচ্ছেন ৷ মৎস্য ভবন টার সামনের যে গেট সেদিক দিয়ে ৷
আমি খুব মজা পেলাম , এখন আর ভয় লাগছে না ৷ মনে মনে ভাবছি ধুর কি সব ভেবে লোকটাকে খারাপ ভেবেছি ৷ উনি গিয়েছিলেন এক দিকে আমি তার উল্টো দিকে ৷ এবার নির্ঘাত উনাকে যেয়ে বলব আঙ্কল আপনার একটা ছবি তুলব ৷ আপনি দাঁড়ান ৷ আমি পা চালালাম ৷ উনি মৎস্য ভবনের দিকে যাচ্ছেন ঐ দিকে এগোল শিল্প কলা ৷ আমি জানি না আমার মনে আবার ভয় লাগছে ৷ শিল্পকলায় আজ অনেক বড় একটা অনুষ্ঠান ৷ হায় হায় নির্ঘাত … আমার রাস্তা পার হতে একটু দেরি হয়ে গেল ৷ ততক্ষণে উনি শিল্প করার সামনে ৷ আমি জানি না আমি এখন রীতি মত দৌড়চ্ছি উনাকে আমার ধরতে হবেই ৷ আঙ্কল … আঙ্কল.. বলে লোকটাকে থামালাম.. উনি বেশ ভয় পেলেন ৷ আমাকে মেরে ফেলবে নাকি এখন ? মানে উনি ভাবতে পারেন আমি উনাকে ফলো করছি কেন ? উনি নিশ্চয় আমাকে দেখেছিলেন রমনা পার্কে ৷ আমি উনাকে ডাকার আগে এই সব এত কিছু চিন্তা করি নাই ৷
রীতি মত বোকার মত কয়েক সেকেন্ড গেল , ছবি… ছছছ বি তোলা যাবে একটা ? লোকটা খুব অবাক হল ! তার পর একটা অমায়িক হাসি বলল একটু দাড়াও তার পর দেখলাম একজন মহিলা তার সাথে একটা ৬-৭ বছরের মেয়ে দৌরে আসছে আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লাম আমি ভাবলাম এদের সহ আমাকে উড়িয়ে দিবে ? আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে কি করব আমি , আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে , আমাদের পেছনে অনেক মানুষ আমরা কিছুটা দূরে এখানে বোমা ফাটরে আমি মরব নির্ঘাত লোকটা মরবে মেয়েটা, আর মহিলা.. এসব যখন ভাবছি তখন দেখলাম মেয়েটা লোকটা কোলে লাফিয়ে পড়ল… হাহ… বাবা ? বাবা নিশ্চয় মেয়ে উড়িয়ে দিবে না… নিজের পশ্চাদ পদে লাথি মারতে ইচ্ছে হচ্ছে.. ধুর… লোকটা বলল কি হল তোলও ছবি… আমি দেখলাম মেয়েটার হাতে একটা পুতুল ব্যাগ টা এখন আর ডিম ডিম লাগছে না ৷ নিশ্চয় পুতুল এর বক্স টা ব্যাগ এ ছিল ৷ বক্স টা একটু গোলাকার টাইপ এর ই … আমার হাত কাঁপছে.. সম্ভবত বুক ধড়ফড় করছিল… এখন টেনশন নেমে গেছে… খুব একটা শান্তি আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখে দিলাম ক্যামেরা টা …. ক্যামেরাটা যখন ক্লিক করলাম তখন বিকট একটা শব্দ হল, অনুষ্ঠান হচ্ছিল সেখানের স্টেজের কাছা কাছি কোনো যায়গা থেকে… বাবার কোলে থাকা মেয়েটার মুখে দেখতে পেলাম কৌতূহল আর বাবা মা এর চোখ মুখে ভীষণ এক আতঙ্ক… আর স্টেজের আশে পাশের মানুষ গুলোর চোখে মুখে আর্তনাদ ৷ আমার মনটা ভীষণ খারাপ, চারি দিকে মানুষ ছুটছে… বাতাস ভারি ভারি লাগছে… আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে উঠছে চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে...