'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার ন্যায় পৃথিবীর সকল ভাষা যেন পায় শ্রদ্ধা ও সম্মান' - এই স্লোগানকে সামনে রেখেই ফেব্রুয়ারী ২০০১ এ প্রকাশিত হয়েছিল এক বসন্তের ভালোবাসা। একটি দ্বি-মাত্রিক (বাংলা-মনিপুরি) কাব্যগ্রন্থ। মুতুম অপু সম্পাদিত দ্বিমাত্রিক কবিতার গ্রন্থ এক বসন্তের ভালোবাসা কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত কিছু কবিতা এখানে দেয়া হলো। কবিতাগুলো মনিপুরি ভাষা অর্থাত্ মীতৈ লোন বা মৈতৈ লোন থেকে বাংলায় অনূদিত। আর এ অনুবাদের কঠিনতম কাজটি করেছেন কবিরা নিজে, তবে কবি হামোম প্রমোদ এর কবিতাটি শেরাম নিরঞ্জন কর্তৃক অনূদিত। - মাইবম সাধন
এ. কে. শেরাম
এক এক করে ভেঙ্গে পড়ে সবকিছু
আমার বাড়ীর কাছেই
সেই কোন প্রাচীন কালের একটা সেতু ছিলো।
একদিন রাত্রির পৌঢ় প্রহরে
সকলের অজ্ঞাতসারে ভেঙ্গে পড়লো সেই সেতু।
আমাদের বাড়ীর বাম পাশেই
আমাদের কোন প্রপিতামহের বানানো
পরিত্যক্ত একটি প্রাচীন ইমারতও ছিলো,
শৈশবের লুকোচুরি খেলার স্থান
পুরনো সেই ইমারতের ক্ষয়িত শরীর থেকে
এখন কেবলি লাবন্য খসে পড়ে,
এখানে ওখানে উত্কন্ঠ ভেসে ওঠে
শ্যাওলা ধরা তার নীল নীল শিরা উপশিরা ;
জরাজীর্ণ সেই ঘর এখন পোকা মাকড়ের বসত বাড়ী
কুকুর বেড়ালও সেখানে যায়না সহজে।
একদিন সকলের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে
সশব্দ হুংকারে ভেঙ্গে পড়লো সেই জীর্ণ ইমারত।
আমাদের গ্রামের পাশে বহমান
রাত্রির মতো রহস্যময়ী যে নদী
ভরা পেটেই হয়তোবা সে ক্ষুধার্ত হয় বেশী,
তাইতো সে বর্ষার ভরা প্লাবনেই
ক্ষুধার বিশাল ব্যদিত মুখে
গ্রাস করে দুপারের খন্ড খন্ড মাটি।
ভাঙ্গনের এই ভয়াল শব্দে
সচকিত হয়ে চমকে চমকে ওঠে
রাত্রির বুকে বিশ্রামরত নির্বিরোধ গ্রাম।
কেনো জানিনা
এক এক করে সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে
ভেঙ্গে পড়ে প্রকৃতি, চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি
টুকরো টুকরো হয়ে যায় পৃথিবী, আকাশ, জল ও বায়ু
বৃদ্ধ-যুবা, নারী-পুরুষ, সাদা-কালো
কেউ বাদ যায়না ভাঙ্গনের এই সর্বভুক ক্ষুধার গ্রাস থেকে।
এক এক করে ভেঙ্গে পড়ে সবকিছু
মানুষের হৃদয়ের সেতু
বিশ্বাসের ঘর
জীবনের নদী
কিন্ত তারপরও
গোপনে গোপনে একাকী পালিয়ে
হয়তোবা এখনও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে ভালোবাসা,
হয়তোবা ভাঙ্গনের এই করাল গ্রাসে
এখনও পড়েনি ভালোবাসার ঘর।
এক এক করে ভেঙ্গে পড়ার এই সর্বগ্রাসী সময়ে
এটুকুইতো আমার প্রাণদ ভরসা
আমি বাচিয়ে রাখতে চাইও শুধু এটুকুই
আমার বেঁচে থাকার ভিত্তিভূমি হিসেবে।
হামোম প্রমোদ
বিপ্রতীপ
'বলেছিলে ভুলবোনা এ জীবনে আমরা আমাদের
প্রতিজ্ঞা করেছিলে ভালোবাসার সুতোয় বাঁধব দুজন'
শুয়ে শুয়ে ভাবি আমি সেই অচল শপথের কথা
হৃদয়ের গভীর খচখচে করে ওঠে এক অচেনা ব্যথা
একদিন আমি বলেছিলাম লক্ষী-সরস্বতী
চন্ডী-বেহুলার ধারা তুমি-তুমিও বলেছিলে
রাধা-কৃষ্ণ, খম্বা-থোইবীর অমর কাহিনী
কিন্ত আজ রাধা-কৃষ্ণে, খম্বা-থোইবীতে দুরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে ক্রমশঃ
চেতনার চারিদিকে এক রহস্যময়ী পাপেটের ওড়াওড়ি
সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুরন্ত এক মহিষ
হিংস্র কুকুরের গর্জন ভেসে আসে ইথারে ইথারে
পলায়নপর মা কালীর ভুলের মাশুল দিচ্ছে রক্তাক্ত জিহ্বা
অর্থাত্ কোথা থেকে যেনো পালিয়ে এলো সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে
সীতা, দ্রোপদী, মাইনু, পেমচা, এই উন্মুক্ত ময়দানে
আর অন্ধ গহ্বরে আত্মধিক্কারে হাতড়াতে থাকে
দেবরাজ ইন্দ্র, জিউস, পাখংবা, মহাদেব
রাবন, দূর্যোধন আর নোংবানের দু'চোখ অশ্রুসিক্ত আজ
ক্লীওপেট্রা, মোনালিসা, শন্দ্রেম্বীর হাসিতে প্রশান্তি খুঁজতে গিয়ে দেখি
ছোপ ছোপ রক্তের রঞ্জিত হয়ে আছে স্তনাগ্র থেকে নাভিমূল
কে তুমি বসে আছো পুষ্পরথে ?
হৃদয়ের স্পন্দনে তুমি কি বিচলিত নও ?
একবার তাকিয়ে দেখো চেতনার শার্সিতে
বলে যাও একবার কে ?
আমি ভঙ্গি পরিবর্তন করে শুয়ে থাকি পুনরায়।
শেরাম নিরঞ্জন
অদাহ্য হৃদয় পোড়ে
দু'হাতে স্বপ্ন সরাতে সরাতে এগিয়ে যায় সে
তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে জ্যোত্স্নার অন্ধকার
লাবন্য উপচে পড়ে জ্যোত্স্নার দীপ্তিতে
সরলরেখা হয়ে যায় জীবনের জটিল কম্পোজিশন
সে,
সন্ধ্যামালতীর মালা গাঁথে
তার চোখের পল্লবে নাচে নীল তারার বুটিদার আকাশ
এবং হঠাত্
পূর্ণ চাঁদ ভেঙ্গে ভেঙ্গে
দ্বি-খন্ড
ত্রি-খন্ড
চর্তুখন্ড
অতঃপর চৈত্রের পাতা ঝরার শব্দ
তার চোখে ভাসে গান্ধারীর শত স্নানের মৃত্যুশোক
স্মৃতিদীর্ণ ট্রয় তার কাঁধে রাখে হাত
অদাহ্য হৃদয় পোড়ে-পোড়েনা ভালোবাসা তবু..
এন. যোগেশ্বর অপু
জল পর্দার চোখ
হিম কুয়াশার চাদর জড়ালে প্রকৃতি
তোমার উষ্ণ উপস্থিতির জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে যাই
আদিগন্ত আলোয় উদ্ভাসিত হলে বিশ্বলোক
শিশিরের মতো ঝরে যায় জীবনের দিনগুলো
কালের গর্ভ হতে পূনর্জন্মের অস্থির প্রহরে
আমি একা, শুধু একা। নিঃসঙ্গ।
কেমন আছো অনিতা, আনন্দের সত্সঙ্গ হারা এদিনে
সময় এখন এ ঘরে স্থির, তবু শুনি
ঘড়ির কাঁটার মতো পথিকের পদধ্বনি
আসা-যাওয়ার ক্লান্তিহীন সময়ের সঙ্গীতে
কে যেনো জেগে ওঠে হৃদয়ে।
পর্দা ওড়ানো বসন্ত বাতাস চুপি চুপি
বলে যায় পথিক জীবনের গল্প।
অনিতা, কোলাহল এ সময়ে ভালো আছো ?
ঘুমহীন রাত্রির পোড়া চোখে
বন্দি সময়ের শয্যার এপাশ ওপাশ
খুলে বসি হৃদয়ের জানালা একা, নিশ্চুপ।
কল্পনার রঙের মতো দেয়ালের ছবিগুলো
ঝাপসা হয়ে আসে চোখে জল পর্দায়
এ জীবন যাত্রায়-
তোমার সেই জল পর্দার চোখের মতো।
নামব্রম শংকর
কুয়াশাচ্ছন্ন ভালোবাসার গল্প
কুয়াশার চাদর জড়িয়ে
আবছা অন্ধকারেই রয়ে গেলে তুমি।
তোমাকে কি নামে ডাকি ?
আফ্রোদিতি, নুমিতলৈ নাকি সুস্মিতা।
ভেবে পাইনা কি করে জাগাই তোমাকে
সুখ স্বপ্নের অতল থেকে।
জানিনা কি করে বুঝাই তোমাকে
তৃষিতের এক চুমুক জল তুমি,
হৃদয়ের প্রান্তরে বুনো হাওয়া
রুগ্ন আকাশে একাদশীর চাঁদ।
ভালোবাসার অনুর্বর ক্ষেত্রে উদ্যমী চাষী আমি
শুষে নিতে চাই ভালোবাসার মাংশ-হৃতপিন্ড।
আমি সেই ক্ষণের অপেক্ষায়
একদিন সূর্যের প্রখর আলোয় কুয়াশা কেটে যাবে
আবছা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে তুমি।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:৪১